X
সোমবার, ২০ মে ২০২৪
৬ জ্যৈষ্ঠ ১৪৩১

শিশুসাহিত্যকে গুছিয়ে তোলা খুব জরুরি

ফাতেমা তুজ জোহরা
১৫ জুন ২০২৩, ১৭:৩৫আপডেট : ১৫ জুন ২০২৩, ১৭:৩৫

আমাদের শিশুসাহিত্যে আর কতদিন মোটা শারীরিক গঠনের চরিত্র হয়ে থাকবে সবচেয়ে ‘বোকা’। ‘খারাপ মনে’র মানুষটির চেহারা হবে খুব খারাপ। আর কালো মোটা মেয়েটি, যার মুখভর্তি বসন্তের দাগ নিঃসন্দেহে সে হবে চরম কুটিল, বাজে, লোভী আর নিষ্ঠুর এক চরিত্র।

বাস্তবে টুকটুকে লাল রাজপুত্ররা সবচেয়ে কুৎসিৎ মনের নিষ্ঠুর মানুষটি হলেও গল্পে সে খারাপ মানুষ হতেই পারে না। কালো, খাটো মুখভর্তি কালো দাগের মেয়েটি রাজকন্যা হয়ে উঠতে পারবে কি কখনও? পিঠে কুঁজ আর গাভর্তি বসন্তের দাগ নিয়ে কিংবা কুচকুচে কালো বরণ নিয়ে হওয়া যাবে রাজপুত্র?

এসব প্রশ্নের উত্তর ‘না’। কেননা, শিশুসাহিত্য যুগ যুগ ধরে মানুষের ভালো ও মন্দকে শিশুর সামনে তুলে ধরার মাধ্যম হিসেবে বেছে নিয়েছে মানুষের শারীরিক গড়ন, রঙ, নানাবিধ শারীরিক বৈশিষ্ট্যকে। জীবনের সাদা ও কালো পথ চেনাতে গিয়ে আক্ষরিক অর্থেই গায়ের চামড়ার সাদা ও কালোকে রূপক করে তুলেছি আমরা।

তাই শিশুসাহিত্যে আমরা দেখি তোতলা কিংবা মোটা মানুষ মানেই বোকা, খারাপ মানুষ মানেই কালো আর খাটো, যার মুখভর্তি বসন্তের দাগ। কুটিল মানুষটির পিঠে কুঁজ কিংবা উঁচু দাঁত অনিবার্য। কিন্তু এ অবস্থা আর কতদিন চলবে? তাই এ প্রশ্ন আমাদের ভাবায়। সেই ভাবনাকে কাজে রূপান্তর করে শিশুসাহিত্যকে গুছিয়ে তোলা আজ খুব জরুরি।

শিশুদের জন্য সাহিত্য, শিশুদের নিয়ে সাহিত্য নাকি শিশুর উপযোগী সাহিত্য? কোনটা লিখছি আমরা কিংবা কোনটা দেবো শিশুদের? বাংলা সাহিত্যের দীর্ঘ পথ পার হয়ে এসে শিশুসাহিত্যে আজও রয়ে গেছে অনেক শূন্যতা। বাংলা ভাষার শিশুসাহিত্য কেমন যেন সোজা হয়ে দাঁড়াতে পারেনি, তার মেরুদণ্ড সদ্যজাত শিশুর মতো নরম আর ভঙ্গুর রয়ে গেছে।

শিশুদের বয়সের যে ১৮ বছরের বিশাল সীমা, তাতে প্রাক-প্রাথমিক শিশুসাহিত্য, প্রাথমিকে পড়া শিশুদের সাহিত্য, কিশোরসাহিত্য আর প্রাক-যৌবনে প্রবেশ করবে যে শিশু তাদের সাহিত্যের হিসেবে গোলমাল অনেক। অভিভাবক, শিক্ষক সবাই বিষয়টা নিয়ে দ্বিধায় ভোগেন, কোন ক্লাসে কোন বই পড়বে শিশুরা। শিশু নিজেও ভাবে কোনটা লুকিয়ে পড়বে আর কোনটা প্রকাশ্যে। তবে তা পাঠ্যবই, পরীক্ষার আর কোচিংয়ের মাধ্যমে যে অমোঘ জ্ঞানলাভ ঘটে তারপর যদি কোনও সময় বাঁচে কেবল তবেই।

শিশুসাহিত্যে বিশাল অংশ রূপকথা বা লোকজ সাহিত্য, সেটি শিশুমনে কল্পনার রাজ্য উন্মোচন করে দেয়। কিন্তু সেই শিশুমন ঠিক কতটা পরিপক্ব হলে শুধু সাহিত্য হিসেবে গ্রহণ করতে পারবে রূপকথা রাজ্যের রাজার সাত বিয়ে করা, রানিকে কিংবা প্রজাকে যেমন খুশি বীভৎস সাজা দেওয়া, বনবাসে পাঠানো, কুরুচিপূর্ণ উপায়ে নারীকে হেনস্তা করা, বর্ণবৈষম্যকে উৎসাহিত করা– এই বিষয়গুলোকে? এছাড়াও অনেকের মতে গোপাল ভাঁড় বা মোল্লা নাসিরুদ্দিন নিজের স্ত্রীর সঙ্গে যে আচরণ করেন তা শিশুর জন্য রীতিমতো অশ্লীলতার পর্যায়ে পড়ে।

এই সাহিত্যে আর একটি বড় অংশ দখল করে আছে সমস্যার অলৌকিক সমাধান। কোনও রাজপুত্র কিংবা কোনও পরি অথবা কোনও উপকারী চরিত্র অলৌকিকভাবে আপনার সব মুশকিল আহসান করে ফেলে। কিন্তু আমরা কি শিশুদের জানাবার প্রয়োজন বোধকরি যে  জীবনে কোনও কিছুই এমনি এমনি হয় না। লাগে কঠোর পরিশ্রম, কেউ কারও কাজ করে দেয় না, আসতে পারে অনেক বিপদ। রানি হতে চাইলে লাগে যোগ্যতা, পরিশ্রম আর কঠিন অধ্যবসায়। মাথায় মুকুট পরে সেজেগুজে বেরানোতে নয়; বরং সারা জীবনকে সেবায় বিলিয়ে দিলেই কেবল সত্যিকারের রানি হওয়া যায়।

শিশুসাহিত্যের ভাষাগত দিকটির দিকে যদি কিছুটা আলোকপাত করি তবে দেখবো তাদের যেটি পাঠ করে শোনানো হয় সেটি আসলে বয়সের সর্বোচ্চ সীমা সাধারণত ৬-৭ বছরের মধ্যে। অভিভাবকরাই বইটি পড়ে শোনাবেন– বাংলাদেশে এরকম বই অনেক পাওয়া যায় এবং এসব বইয়ের মান ভালো ঠিকই কিন্তু শিশু নিজেই পড়তে পারবে সেরকম বই প্রকাশের জায়গায় আমরা অসম্ভব রকম পিছিয়ে আছি।

তাই শিশুর বয়স এবং পঠন দক্ষতা বিবেচনায় নিয়ে মানসম্মত শিশুপাঠ্য বইয়ের ইংরেজিতে যাকে ‘আর্লি রিডার’ বলা হয় সেরকম বই প্রকাশে আমাদের ঘাটতি সবচেয়ে বেশি। পঠন দক্ষতা অনুযায়ী যে বয়সোপযোগী শিশুসাহিত্য দরকার, বিশেষ করে প্রাক-প্রাথমিক এবং প্রাথমিকে তা নিয়ে বিপুল উদ্যোগ ও কার্যক্রম অত্যাবশ্যক। এসব বইয়ের বিষয়বস্তু নির্বাচনে খুব সতর্ক হওয়া উচিত। বিষয়বস্তু যেমন হবে সহজ, তেমনি আকর্ষণীয় এবং বর্ণবৈষম্য, লিঙ্গবৈষম্য, অশুভ  ইঙ্গিত ইত্যাদি কোনও কিছু যেন বিষয়কে কলুষিত করতে না পারে, তার প্রতি কঠোর নজর দেওয়া এবং সাহিত্যটি পাঠের মাধ্যমে পঠন দক্ষতার বিকাশ ঘটানোও জরুরি।

আমরা দেখেছি অনেক প্রথিতযশা ব্যক্তি শিশুদের জন্য লিখছেন কিন্তু পঠন দক্ষতা বিচারে তার বেশিরভাগই কিশোরসাহিত্য। তাই ৩-৫ বছর বয়সী শিশুদের জন্য সার্থক সাহিত্য খুঁজে পাওয়া দুষ্কর। কিন্তু ইংরেজি, রুশ, জাপানিজ ভাষায় আর্লি রিডার নামে পরিচিত এ ধরনের খুব ভালো মানের সাহিত্যের সংগ্রহ অত্যন্ত সমৃদ্ধ।

আমাদের বাংলা ভাষার ইতিহাস বহু পুরনো হওয়া সত্ত্বেও ২-৪ কিংবা ৩-৬ বছর বয়সীদের জন্য খুব মানসম্মত সাহিত্য সৃষ্টি হয়নি বললেই চলে। ০-৬ বছর বয়সীদের জন্য যেসব কাজ হচ্ছে সেগুলো কতটা গবেষণানির্ভর ও সুচিন্তিত সম্পাদনার মধ্য দিয়ে প্রকাশিত তা নিয়ে রয়েছে সংশয়। রয়েছে নানামাত্রার ঘাটতি।

এ ঘাটতি পূরণে শিশুসাহিত্য রচনায় শুধু ছন্দ মেলাবার জন্য যথেচ্ছ শব্দের ব্যবহার, শিশুর বুঝতে অসুবিধা হয় এমন শব্দ ও বিষয়বস্তু পরিহার করা জরুরি। শিশুর জন্য সাহিত্য বলে তাতে রহস্য, চমক, দুঃখবোধ থাকবে না তা নয়। তবে দায়সারাভাবে কাহিনিকে সরল করে তোলার চেষ্টা কিংবা কাহিনিকে অতিরিক্ত জটিল করে তোলা– কোনোটাই গল্পকে শক্তিশালী করে তুলতে পারে না।

যেহেতু তারা শিশু, তাই তাদের জন্য একটা কিছু লিখলেই হলো– এ মনোভাব কাম্য নয়। কারণ, মনে রাখা ভালো একজন বয়স্ক মানুষের তুলনায় শিশুদের মনে একটা ভালো গল্প বা কবিতা অনেক বেশি প্রভাব বিস্তার করে থাকে।

শিশুকে কি থাকতে দেওয়া উচিত শুধু কল্পনা জগতে নাকি তাকে পরিচয় করাতে হবে কঠোর বাস্তবতার সঙ্গে– এ প্রশ্নের উত্তর মেলা কঠিন। কিন্তু এই ভাবনাগুলো বই প্রকাশে বিবেচনায় রাখতেই হবে। থাকতে হবে শক্তিশালী সম্পাদনা পরিষদ। লেখকের প্রতি সর্বোচ্চ সম্মান বজায় রেখেই শিশুসাহিত্যকে শিশুর সুস্থ সার্বিক বিকাশে শ্রম দিতে হবে দায়িত্বশীল ব্যক্তি এবং প্রতিষ্ঠানকে।

লেখক: শিক্ষা বিশেষজ্ঞ, ইগনাইট পাবলিকেশন্স

/এসএএস/এমওএফ/

*** প্রকাশিত মতামত লেখকের একান্তই নিজস্ব।

বাংলা ট্রিবিউনের সর্বশেষ
পোশাক থেকে সুগন্ধির দাগ কীভাবে তুলবেন
পোশাক থেকে সুগন্ধির দাগ কীভাবে তুলবেন
সংযোগ নেই তবু দিনমজুরের নামে বকেয়া বিদ্যুৎবিল পরিশোধের নোটিশ!
সংযোগ নেই তবু দিনমজুরের নামে বকেয়া বিদ্যুৎবিল পরিশোধের নোটিশ!
মাতৃহারা হলেন অভিনেতা জামিল
মাতৃহারা হলেন অভিনেতা জামিল
অস্ট্রেলিয়ার বিপক্ষে ম্যাচের আগে বাংলাদেশ দলে দুঃসংবাদ
অস্ট্রেলিয়ার বিপক্ষে ম্যাচের আগে বাংলাদেশ দলে দুঃসংবাদ
সর্বশেষসর্বাধিক