X
শুক্রবার, ০৩ মে ২০২৪
১৯ বৈশাখ ১৪৩১

রেজা-নুর: কে যে কার ‘দালাল’?

প্রভাষ আমিন
২২ জুন ২০২৩, ২১:৩৪আপডেট : ২২ জুন ২০২৩, ২১:৩৪

নির্বাচনকে সামনে রেখে সরকারি পক্ষ, বিরোধী পক্ষ; সবাই যার যার ঘর গুছিয়ে নেওয়ার চেষ্টা করবে; এটাই স্বাভাবিক। শুধু নিজেদের ঘর গোছানো নয়, নিজেদের পক্ষের লোকজনকে নিয়ে একাট্টা হয়ে থাকাটাও এই সময়ে জরুরি। নির্বাচনকে সামনে রেখে তাই রাজনীতিতে নানান মেরুকরণ চলছে, চলছে ভাঙাগড়ার খেলা। সরকারি দলের চেয়ে বিরোধী দলের একাট্টা হয়ে থাকাটা বেশি জরুরি। টানা তিন মেয়াদে ক্ষমতায় থাকা আওয়ামী লীগকে উৎখাতে মরিয়া এখন বিরোধী দলগুলো। কিন্তু আওয়ামী লীগকে উৎখাত করতে যে ইস্পাতদৃঢ় ঐক্য দরকার, বিরোধী দলগুলোর মধ্যে সেটা নেই বললেই চলে। বরং নির্বাচন যত এগোচ্ছে, বিরোধী দল ও জোটে ভাঙন প্রবণতা ততই বাড়ছে।

অনেক দিন নিষ্ক্রিয় থাকার পর বিএনপির দীর্ঘদিনের জোট ‘২০ দলীয় জোট’ আনুষ্ঠানিকভাবে বিলুপ্ত হয়ে গেছে সম্প্রতি। আর ২০১৮ সালে বিএনপি যে ‘জাতীয় ঐক্যফ্রন্ট’-এর অধীনে নির্বাচনে অংশ নিয়েছিল, সেটা অনানুষ্ঠানিকভাবে বিলুপ্ত হয়ে গেছে নির্বাচনের পরপরই। বিএনপি এখন বিভিন্ন দল এবং জোটের সঙ্গে যুগপৎ আন্দোলনের ফর্মুলায় এগোচ্ছে। যুগপৎ আন্দোলনে অংশ নিতে ১১ দলের সমন্বয়ে গঠিত হয়েছিল গণতন্ত্র মঞ্চ। এই মঞ্চের মূল দল ছিল গণঅধিকার পরিষদ। কিন্তু গণতন্ত্র মঞ্চে যথাযথ মর্যাদা না পাওয়ার অভিযোগ এনে সেটি ছেড়ে এসেছে গণঅধিকার পরিষদ। এবার ভাঙন এসেছে গণঅধিকার পরিষদের ঘরে। আহ্বায়ক আর সদস্য সচিবের অভিযোগ-পাল্টা অভিযোগ, বহিষ্কার-পাল্টা বহিষ্কারে গণঅধিকার পরিষদ এখন অণু-পরমাণুতে বিভক্ত হতে চলেছে।

গত দেড় দশকে বাংলাদেশের রাজনীতিতে সবচেয়ে বড় চমকের নাম অবশ্যই নুরুল হক নুর। কোটা সংস্কার আন্দোলনে নেতৃত্ব দিয়ে বিভিন্ন বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার্থীদের কাছে দারুণ জনপ্রিয়তা পেয়েছিলেন নুর। ছাত্রলীগ বারবার হামলা করে, পিটিয়ে নুরুল হক নুরকে ডাকসুর ভিপি বানিয়ে দেয়। কোটা আন্দোলনে পাওয়া জনপ্রিয়তা আর ডাকসুর সূত্রে পাওয়া স্বীকৃতি দুয়ে মিলে নুরুল হক নুরের আকাঙ্ক্ষা বড় হয়। শিক্ষাঙ্গন থেকে নিজেদের টেনে আনেন জাতীয় রাজনীতিতে। ছাত্র অধিকার পরিষদ থেকে গঠিত হয় গণঅধিকার পরিষদ। সরকারের বিরুদ্ধে কঠোর বক্তব্য দিয়ে কোটা আন্দোলনের মতো জাতীয় রাজনীতিতেও দারুণ চাঞ্চল্য সৃষ্টি করেন নুর।

তবে মুখে গণতন্ত্রের কথা বললেও গণঅধিকার পরিষদও শেষ পর্যন্ত বাংলাদেশের অন্য সব দলের মতোই ব্যক্তিকেন্দ্রিক। ছাত্র অধিকার পরিষদ বলেন আর গণঅধিকার পরিষদ; পদ যাই হোক; নুরুল হক নুরই সর্বেসর্বা। দলে সাম্প্রতিক ভাঙনের প্রতিক্রিয়ায় ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষক ড. আসিফ নজরুল যে লিখেছেন, ‘এটা নুরদের দল, রেজা কিবরিয়ার নয়’ আমি তার সঙ্গে একমত। ড. রেজা কিবরিয়া গণঅধিকার পরিষদের আহ্বায়ক হলেও সংগঠনটি তার নয়। তিনি আসলে উড়ে এসে জুড়ে বসা নেতা। নুরুল হক নুরই সংগঠন করার সময় একটা ভালো সাইনবোর্ড খুঁজছিলেন। আমরা জেনেছি, নুর অনেকের কাছেই গিয়েছিলেন নেতৃত্বের প্রস্তাব নিয়ে। শেষ পর্যন্ত ‘রাজনৈতিক এতিম’ ড. রেজা কিবরিয়াকেই পটাতে পেরেছিলেন। অবশ্য না পটে উপায়ও ছিল রেজা কিবরিয়ার। আওয়ামী লীগের সাবেক অর্থমন্ত্রী শাহ এ এম এস কিবরিয়ার ছেলে ড. রেজা কিবরিয়ার রাজনীতির শুরুটা অবশ্য আওয়ামী বিরোধিতা দিয়ে। ড. রেজা কিবরিয়ার মতো উচ্চশিক্ষিত, মার্জিত, ভদ্র মানুষদের রাজনীতিতে আসা অবশ্যই আমাদের জন্য আনন্দের সংবাদ। বিদেশে উচ্চ বেতনের চাকরি এবং ঝলমলে ক্যারিয়ার ফেলে বাংলাদেশে এসে রাজনীতিতে সক্রিয় হওয়ায় সবার ধন্যবাদ পাচ্ছিলেন রেজা কিবরিয়া। গণফোরামে যোগ দিয়ে দ্রুতই উন্নতি হয় তার। অল্প সময়ে দলের সাধারণ সম্পাদক বনে যান তিনি। কিন্তু যত দ্রুত উন্নতি, তত দ্রুতই দল ভেঙে বেরিয়ে আসেন তিনি। তখন নুরুল হক নুরের একজন সাইনবোর্ড দরকার ছিল। আর রেজা কিবরিয়ার দরকার ছিল আশ্রয়। দুয়ে মিলে গড়ে ওঠে গণঅধিকার পরিষদ। তবে তেলে-জলে যে মিশবে  না, এটা সবাই জানতো। রেজা কিবরিয়া আর নুরুল হক নুর এক টেবিলে বসে রাজনীতি নিয়ে আলোচনা করছেন; এটাই যথেষ্ট ইন্টারেস্টিং। দুজন আসলে দুই মেরুর লোক। রেজা কিবরিয়া শিক্ষাদীক্ষা, আভিজাত্যে নুরের বিপরীত শ্রেণির মানুষ। নুর তৃণমূল থেকে উঠে আসা, এমনকি ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়েরও প্রান্তিক শিক্ষার্থী তিনি। দুজনের রাজনীতির ভাষাই দুজনের বোঝার কথা নয়। তাই ‘আজ দুজনার দুটি পথ, ওগো দুটি দিকে গেছে বেঁকে’ গাইছেন দুজনই।

তবে তাদের মিলনটা যতটা আনন্দের ছিল, বিচ্ছেদটা ততই তিক্ত। বিশেষ করে ড. রেজা কিবরিয়ার জন্য মায়াই লাগছে। বাংলাদেশের রাজনীতিতে বেমানান এই ভদ্রলোকটি নুর বাহিনীর হাতে যে হেনস্তার শিকার হলেন, তা সহজে ভুলতে পারবেন বলে মনে হয় না।

কোটা আন্দোলনে হঠাৎ পেয়ে যাওয়া জনপ্রিয়তাকে খুব নিপুণভাবে পুঁজি হিসেবে ব্যবহার করেছেন নুর। কোটা সংস্কারের দাবিতে আন্দোলন করলেও নুর বা তার সংগঠনের শীর্ষ নেতাদের কেউই সরকারি চাকরি বা অন্য কোনও চাকরিতে যাননি। রাজনীতিকেই তারা পেশা হিসেবে বেছে নেন। অনেকেই নুরুল হক নুরকে ‘বিকাশ নুর’ নামে ডাকে। বিকাশে শুভাকাঙ্ক্ষীদের কাছ থেকে পাওয়া চাঁদার টাকাতেই নাকি তাদের সংসার ও সংগঠন চলে। তাও না হয় চলছিল। কিন্তু নুরুল হক নুর যখন জাতীয় থেকে আন্তর্জাতিক পর্যায়ে চলে গেলেন, গোল বাধলো তখনই। সম্প্রতি নুর মধ্যপ্রাচ্য সফর করেন। সেখানে প্রবাসীদের সঙ্গে বৈঠক করেন। অভিযোগ রয়েছে, সেখানে তিনি ইসরায়েলের গোয়েন্দা সংস্থা মোসাদের এক প্রতিনিধির সঙ্গে বৈঠক করেছেন। বাংলাদেশের কোনও রাজনীতিকের ইসরাইলের কারও সঙ্গে বৈঠক করাটাই অপরাধ, সেখানে তিনি বৈঠক থেকে ফেরার সময় নাকি কালো একটি ব্যাগ নিয়ে এসেছেন। গণঅধিকার পরিষদের আহ্বায়ক রেজা কিবরিয়া সদস্য সচিব নুরুল হক নুরের কাছে সংগঠনের আয়-ব্যয়ের হিসাব চেয়েছিলেন, স্বচ্ছতা চেয়েছিলেন। তাতেই নুরের লোকজন রেজা কিবরিয়ার বাসার ছাদেই তাকে মারতে যায়। অপমানিত রেজা কিবরিয়া বৈঠক থেকে বেরিয়ে চলে আসেন। নুরের লোকজন এখন বলছেন, রেজা কিবরিয়া ইনসাফ কায়েম কমিটির কাছ থেকে মাসে তিন লাখ টাকা পান।

গণঅধিকার পরিষদের এক নেতা বলেছেন, আমাদের একজন মোসাদের এজেন্ট, একজন সিআইএ‘র। আমরা তাহলে কার রাজনীতি করবো। নুরের ভাবমূর্তি উজ্জ্বল করতে আসা ড. রেজা কিবরিয়ার এখন নিজের ভাবমূর্তি যায় যায় দশা। দুই বছরেরও কম বয়সের একটা রাজনৈতিক দলের সঙ্গে জনগণের সম্পর্ক গড়ে ওঠেনি ঠিকমতো। এখনই গোয়েন্দাদের সঙ্গে বৈঠক, বিভিন্ন এজেন্সির দালালি, চাঁদাবাজির অভিযোগের শেষ নেই।  

রেজা কিবরিয়ার লোকজন বলছেন, নুর আসলে সরকারের লোক। একসময় ছাত্রলীগ করা নুর ‘শেখ হাসিনার চেহারায় মায়ের মুখ দেখে’। আর এ কারণেই এত  বিপ্লবী কথাবার্তা বললেও নুরের কখনও কিছু হয় না। আর নুরের লোকজনের অভিযোগ, রেজা কিবরিয়া আসলে আওয়ামী পরিবারের সদস্য। বিএনপি ভেঙে নির্বাচনে যেতে চান বলেই বিএনপি থেকে বহিষ্কৃত শওকত মাহমুদের সঙ্গে তার ওঠাবসা।

দুইপক্ষের কথা শুনে আমি বিভ্রান্ত হয়ে যাই। কে যে কার দালাল? কে মোসাদ, সিআইএ, র’-এর এজেন্ট। কে যে সরকারের দালাল বোঝা আসলেই মুশকিল।

লেখক: হেড অব নিউজ, এটিএন নিউজ
 
/এসএএস/এমওএফ/

*** প্রকাশিত মতামত লেখকের একান্তই নিজস্ব।

বাংলা ট্রিবিউনের সর্বশেষ
অপহৃত ১০ বাংলাদেশিকে ফেরত দিয়েছে আরাকান আর্মি
অপহৃত ১০ বাংলাদেশিকে ফেরত দিয়েছে আরাকান আর্মি
ধানমন্ডিতে ছাদ থেকে পড়ে গৃহকর্মী আহত 
ধানমন্ডিতে ছাদ থেকে পড়ে গৃহকর্মী আহত 
ম্যানচেস্টার ইউনাইটেডে সকার স্কুলের বাছাইয়ে ৩ বাংলাদেশি কিশোর
ম্যানচেস্টার ইউনাইটেডে সকার স্কুলের বাছাইয়ে ৩ বাংলাদেশি কিশোর
দীর্ঘ অপেক্ষার পর ঢাকায় স্বস্তির বৃষ্টি, কমলো তাপমাত্রা
দীর্ঘ অপেক্ষার পর ঢাকায় স্বস্তির বৃষ্টি, কমলো তাপমাত্রা
সর্বশেষসর্বাধিক

লাইভ