X
শুক্রবার, ০৩ মে ২০২৪
১৯ বৈশাখ ১৪৩১

‘ঠগ বাছতে গা উজাড়’

প্রভাষ আমিন
২০ আগস্ট ২০২৩, ১৬:৪৫আপডেট : ২০ আগস্ট ২০২৩, ১৬:৪৫

জামায়াতে ইসলামীর আদর্শিক গুরু বিতর্কিত মাওলানা আবুল আলা মওদুদী। আর বাংলাদেশে তাদের আইকন যুদ্ধাপরাধী গোলাম আযম। তবে বাংলাদেশে জামায়াতে ইসলামীর সবচেয়ে বড় ব্র্যান্ড যুদ্ধাপরাধী দেলাওয়ার হোসাইন সাঈদী। জামায়াতের শীর্ষ নেতাদের প্রায় সবাই একাত্তরে মানবতাবিরোধী অপরাধের দায়ে দণ্ডিত।

অনেকের ফাঁসি কার্যকর হয়েছে। তবে তাদের আইকন ও ব্র্যান্ডের মৃত্যু হয়েছে কারাগারে। দুজনই আমৃত্যু কারাদণ্ডে দণ্ডিত ছিল।

সাঈদী একাত্তর সালে হত্যা, হত্যায় সহায়তা, লুটতরাজ, অগ্নিসংযোগ, ধর্মান্তরের মতো মানবতাবিরোধী অপরাধে জড়িত থাকলেও সে তখন জামায়াতে ইসলামী বা অন্য কোনও সংগঠনের সঙ্গে জড়িত ছিল না। সুললিত কণ্ঠে আতর, তসবি বিক্রি করার কৌশলকে কাজে লাগিয়ে আশির দশকে ওয়াজ করে দারুণ জনপ্রিয়তা পায় সাঈদী। নারী বিদ্বেষ আর অশ্লীলতা ছিল সাঈদীর জনপ্রিয়তার মূল চাবিকাঠি। আর ধর্মকে পুঁজি করে সাঈদীর এই জনপ্রিয়তাকে কাজে লাগাতে তাকে কাছে টেনে নেয় জামায়াতে ইসলামী।

বাংলাদেশের রাজনীতিতে স্বাধীনতাবিরোধী জামায়াতের পুনরুত্থানের দায় অনেকটাই সাঈদীর। তাই এই সাঈদীকেই তারা ব্র্যান্ড হিসেবে সামনে এনেছে। আর তার ব্রান্ড ভ্যালু বাড়াতে এবং সর্বোচ্চ ব্যবহার নিশ্চিত করতে মরিয়া জামায়াত। আর এ জন্য তাদের প্রধান অস্ত্র গুজব। বারবার সাঈদীকে নিয়ে নানান গুজব ছড়িয়েছে জামায়াতে ইসলামী। ২০১৩ সালে ২৮ ফেব্রুয়ারি একাত্তরের মানবতাবিরোধী অপরাধ মামলায় সাঈদীকে মৃত্যুদণ্ড দেওয়া হয়। এরপর চাঁদের ছবির সঙ্গে সাঈদীর ছবি মিলিয়ে সুপার এডিট করে ‘বাঁশের কেল্লা’ ফেসবুক পেজে আপলোড করা হয়। শুরু হয় সহিংসতা। তিন দিনের সহিংসতায় বিপুল সম্পদ ধ্বংস তো হয়ই, প্রাণ যায় ৪৬ জনের। ৮৩ বছর বয়সে হৃদরোগে আক্রান্ত হয়ে দেশের সেরা হাসপাতালে সাঈদীর মৃত্যুর পর আবার গুজব নিয়ে মাঠে নামে জামায়াত। প্রথমেই তারা অভিযোগ করে সাঈদীকে চিকিৎসা না দিয়ে হত্যা করা হয়েছে। সরকার যদি সাঈদীকে হত্যাই করতে চাইতো, তাহলে আরও আগেই করতে পারতো। অন্য অনেকের ক্ষেত্রে বাংলাদেশে মানবাধিকার লঙ্ঘিত হয়েছে, বিচার বহির্ভূত হত্যাকাণ্ডের ঘটনা ঘটেছে। কিন্তু যুদ্ধাপরাধীরা আইনের সর্বোচ্চ সুরক্ষা পেয়েছে। ট্রাইব্যুনালের রায়ের  বিরুদ্ধে আপিল, রিভিউ, এমনকি রাষ্ট্রপতির ক্ষমা পর্যন্ত তারা যেতে পেরেছেন। তাই এটা নিঃসন্দেহে বলা যায়, অন্যদের ক্ষেত্রে ব্যতিক্রম থাকলেও যুদ্ধাপরাধীদের ক্ষেত্রে আইনের শাসনের ব্যত্যয় ঘটেনি। কাশিমপুর কারাগারে হৃদরোগে আক্রান্ত হলে সাঈদীকে প্রথম গাজীপুর হাসপাতালে নেওয়া হয়। সেখান থেকে দ্রুত আনা হয় দেশের সেরা হাসপাতাল বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিব মেডিকেল বিশ্ববিদ্যালয় হাসপাতালে। সেখানে তাৎক্ষণিকভাবে তার সর্বোচ্চ চিকিৎসার ব্যবস্থা করা হয়। ডাক্তাররা চেষ্টা করতে পারেন। কিন্তু চাইলেই তারা সবাইকে বাঁচিয়ে রাখতে পারেন না। বাংলাদেশে মানুষের গড় আয়ু ৭৩ বছর। সেখানে ৮৩ বছর বয়সী একজন মানুষ হৃদরোগে আক্রান্ত হলে ডাক্তারদের সর্বোচ্চ চেষ্টার পরও মারা যেতেই পারেন। এ ব্যাপারে বিএসএমএমইউ কর্তৃপক্ষ ব্যাখ্যা দিয়েছে। ব্যক্তিগত আগ্রহে আমি খোঁজ নিয়ে দেখেছি, সাঈদীর চিকিৎসায় কোনও গাফিলতি হয়নি। কিন্তু গুজবের কারখানা জামায়াত বলতে লাগলো, এটি মৃত্যু নয়, হত্যাকাণ্ড। বিনা চিকিৎসায় তাকে হত্যা করা হয়েছে। যথারীতি তাণ্ডবে নামে গুজব বাহিনী।

১৪ আগস্ট রাতে এবং ১৫ আগস্ট সকালে তারা শাহবাগ এলাকায় ব্যাপক সহিংসতা চালায়। যে ডাক্তার সাঈদীকে চিকিৎসা দিয়েছেন, তাকে হত্যার হুমকি দেওয়া হয়।

তবে সহিংসতা আর হুমকিতেই থেমে থাকেনি গুজব বাহিনী। সাঈদীকে নিয়ে নানান গালগল্প ছড়ায় তারা সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে। ‘বিশ্বের পাঁচ জনের একজন হিসেবে অনুমতি ছাড়াই কাবা শরিফে ঢুকতে পারেন সাঈদী’, কিংবা ‘তৃতীয় ব্যক্তি হিসেবে কাবায় সাঈদীর গায়েবানা জানাজা অনুষ্ঠিত হয়েছে’- এ ধরনের গুজবে এখন সয়লাব সামাজিক যোগাযোগমাধ্যম। কিন্তু নানাভাবে ফ্যাক্টচেকাররা দেখিয়েছেন, এসবই মিথ্যা। সাঈদীর মৃত্যুর ৯৮ মিনিট পর বাংলাদেশে ভূমিকম্প হয়েছে। এটা নিছকই একটা কাকতালীয় ঘটনা। কিন্তু সাঈদীর অনুসারীদের দাবি, সাঈদীর মৃত্যুতেই কেঁপে উঠেছে বাংলাদেশ। সেই সাঈদীকে চাঁদে দেখা যাওয়ার মতো গল্প।

সমস্যা হলো, বাংলাদেশের কিছু অসচেতন মানুষ এসব বিশ্বাস করে এবং ছড়ায়। এভাবেই সাঈদীকে নিয়ে একটা মিথ তৈরির চেষ্টা করছে জামায়াতের গুজব শাখা। আমার খালি একটা প্রশ্ন, যারা কথায় কথায় ধর্মের কথা বলে, তারা এমন মিথ্যা কথা বারবার ছড়ায় কীভাবে? মিথ্যা বলা তো মহাপাপ। পাপের ভয়, পরকালের ভয় কী তাদের নেই। মৃত্যুর পরও আল্লাহর বিচার আছে, সেটা কি তারা জানে না। আখেরাতে এই মিথ্যার জন্য সাঈদী কি তাদের বাঁচাতে পারবে?

আগেই বলেছি, আশির দশকে নারী বিদ্বেষ আর অশ্লীলতাকে পুঁজি করে সাঈদী ব্যাপক জনপ্রিয়তা পায়। সাঈদীর মৃত্যুর পর সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে তার ভক্তকুলের আহাজারি চোখে পড়েছে। যে যে দলেরই হোক, যে মতেরই হোক; মৃত্যুর পর তার ব্যাপারে একটা সহানুভূতি তৈরি হয়। এটা মানবতার সাধারণ রীতি। কিন্তু সাঈদী আর সবার মতো সাধারণ মানুষ নয়। সে সুনির্দিষ্ট যুদ্ধাপরাধের দায়ে দণ্ডিত। তার বিরুদ্ধে ২০টি অভিযোগ আনা হলেও ট্রাইব্যুনালে ৮টি অভিযোগ প্রমাণিত হয়েছিল। ট্রাইব্যুনাল তাকে মৃত্যুদণ্ড দিলেও পরে উচ্চ আদালত তাকে আমৃত্যু কারাদণ্ড দেয়। একজন দণ্ডিত যুদ্ধাপরাধী মৃত্যুর পরও অপরাধী। তাই আর সবার মতো মৃত্যুর পর তার সহানুভূতি প্রাপ্য নয়। কিন্তু সাঈদীর মৃত্যুর পর তার সমর্থকরা তো বটেই, এমনকি প্রগতিশীলতার ভেকধারী অনেকেই শোক প্রকাশ করেন। সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে এমন অনেক কবি-সাহিত্যিক-সাংবাদিকের মুখোশ উন্মোচিত হয়েছে। ফেসবুকে অনেকেই ঘোষণা দিয়ে সাঈদীর জন্য শোকাহতদের আনফ্রেন্ড বা ব্লক করেছেন। আমি অবশ্য কখনোই ভিন্নমতের কাউকে আনফ্রেন্ড বা ব্লক করিনি। ভিন্নমতের প্রতি আমার পূর্ণ শ্রদ্ধা রয়েছে। আমি সবসময় সবার কথা জানতে চাই, শুনতে চাই। তবে এবার কয়েকজনকে ব্লক করেছি। তবে সেটা ভিন্নমতের কারণে নয়, অশ্লীলতার কারণে। আমার পাবলিক স্ট্যাটাসে এসে যারা অশ্লীল ভাষায় গালাগাল করেছেন বা হুমকি দিয়েছেন; তাদের কয়েকজনকে ব্লক করতেই হয়েছে নিজের টাইমলাইন অশ্লীলতামুক্ত ও পরিচ্ছন্ন রাখার স্বার্থে।

তবে এরচেয়ে ভয়ংকর হলো, সরকারি দলের সমর্থক, বিশেষ করে ছাত্রলীগের কারও কারও আহাজারি। দেশের বিভিন্ন স্থানে ছাত্রলীগের নেতাদের কেউ কেউ সাঈদীর মৃত্যুতে শোক প্রকাশ করেছেন, তার জন্য জান্নাত কামনা করেছেন, সাঈদীকে ‘কোরআনের পাখি’ হিসেবে অভিহিত করেছেন। ছাত্রলীগ অবশ্য এদের ব্যাপারে কঠোর অবস্থানে গিয়েছে। সাঈদীর মৃত্যুতে শোক প্রকাশ করার ঘটনায় দেশের বিভিন্ন স্থানে এখন পর্যন্ত ৬৫ জনকে বহিষ্কার করেছে ছাত্রলীগ। তাদের বিরুদ্ধে সংগঠনের নীতি ও আদর্শবিরোধী কাজ করার অভিযোগ আনা হয়েছে।

টানা তিন মেয়াদ ক্ষমতায় থাকায় বিভিন্ন সংগঠনের লোকজন ক্ষমতার লোভে সরকারি দলের বিভিন্ন সংগঠনে যোগ দিয়েছে। কেউ এসেছে মামলা থেকে বাঁচতে, কেউ এসেছে আখের গোছাতে। অনেক আগেই ছাত্রলীগে শিবিরের অনুপ্রবেশের কথা বলেছিলেন আওয়ামী লীগের সাবেক সাধারণ সম্পাদক সৈয়দ আশরাফুল ইসলাম। বললেও সে অনুপ্রবেশ বন্ধ হয়নি। বরং আরও বেশি করে হয়েছে। হয়েছে যে সেটা এখন বহিষ্কার করে প্রমাণ করতে হচ্ছে। বিএনপি-জামায়াত-শিবিরের লোকজনকে আওয়ামী লীগে অনুপ্রবেশের সুযোগ করে দেওয়ার দায় অবশ্যই আওয়ামী লীগের। তারচেয়ে বড় কথা হলো, ক্ষমতার লোভে, ক্ষমতায় টিকে থাকার জন্য আওয়ামী লীগ গত ১৪ বছরে হেফাজতের সঙ্গে আপস করেছে, পাঠ্যপুস্তকে পরিবর্তন এনেছে। নিজেদের আরও ধার্মিক প্রমাণ করার জন্য উঠেপড়ে লেগেছে। এই সুযোগে আলগা হয়ে গেছে আওয়ামী লীগ ও ছাত্রলীগের আদর্শিক দৃঢ়তা। এখন ফেসবুক স্ট্যাটাস দেখে দেখে বহিষ্কার করে লাভ হবে না। স্ট্যাটাস না দেওয়া আরও কত শিবির লুকিয়ে আছে, সেটা কে জানে।

ঠগ বাছতে গেলে গা উজাড় হয়ে যাবে। তাই আওয়ামী লীগ-ছাত্রলীগকে অসাম্প্রদায়িক চেতনায় দৃঢ় থাকতে হবে। নিজেদের আদর্শিক লড়াইটা আরও শক্তিশালী করতে হবে। জামায়াত-শিবির নিজেদের চামড়া বাঁচাতে আওয়ামী লীগে আসবে, কিন্তু কখনও আওয়ামী লীগ হবে না। সুযোগ পেলেই তারা সংগঠন বেচে পালাবে। ফলে সাবধান হতে হবে এখনই।

লেখক: হেড অব নিউজ, এটিএন নিউজ

 

/এসএএস/এমওএফ/

*** প্রকাশিত মতামত লেখকের একান্তই নিজস্ব।

বাংলা ট্রিবিউনের সর্বশেষ
অপহৃত ১০ বাংলাদেশিকে ফেরত দিয়েছে আরাকান আর্মি
অপহৃত ১০ বাংলাদেশিকে ফেরত দিয়েছে আরাকান আর্মি
ধানমন্ডিতে ছাদ থেকে পড়ে গৃহকর্মী আহত 
ধানমন্ডিতে ছাদ থেকে পড়ে গৃহকর্মী আহত 
ম্যানচেস্টার ইউনাইটেডে সকার স্কুলের বাছাইয়ে ৩ বাংলাদেশি কিশোর
ম্যানচেস্টার ইউনাইটেডে সকার স্কুলের বাছাইয়ে ৩ বাংলাদেশি কিশোর
দীর্ঘ অপেক্ষার পর ঢাকায় স্বস্তির বৃষ্টি, কমলো তাপমাত্রা
দীর্ঘ অপেক্ষার পর ঢাকায় স্বস্তির বৃষ্টি, কমলো তাপমাত্রা
সর্বশেষসর্বাধিক

লাইভ