X
শুক্রবার, ০৩ মে ২০২৪
২০ বৈশাখ ১৪৩১

আধুনিক গণমাধ্যমের নেপথ্য কারিগরের বিদায়

প্রভাষ আমিন
৩০ আগস্ট ২০২৩, ২২:৩৩আপডেট : ৩০ আগস্ট ২০২৩, ২২:৩৩

এই প্রজন্মের লোকজন তাকে চেনে না, চেনার কথাও নয়। কারণ, অনেক দিন তিনি লোকচক্ষুর আড়ালেই ছিলেন। গত ২৮ আগস্ট সন্ধ্যায় চলে গেলেন একেবারেই আড়ালে। ২৮ আগস্ট ছিল আমার জন্মদিন। এমনিতে জন্মদিন উদযাপন নিয়ে আমার কোনও আদিখ্যেতা নেই। জন্মদিন এলে আমি কিছুটা লজ্জিত থাকি। এত সময় পেরিয়ে গেলো কিছুই তো করা হলো না। দিনটিতে আমি একটু আড়ালেই থাকি। পরিবারের সাথে সময় কাটাই। আড়ালে ছিলাম বলে কাজী শাহেদ আহমেদের প্রয়াণের খবরটা পেলাম কিছুটা বিলম্বে। জন্মদিনের উচ্ছ্বাসটা ম্লান হয়ে গেলো।

উচ্ছ্বাসের জায়গা নিলো বেদনা, সন্ধ্যাটা গ্রাস করে নিলো নস্টালজিয়া। স্মৃতির পুকুরে উথাল-পাতাল ঢেউ। আমার বন্ধুদের অনেকেই কাজী শাহেদ আহমেদের সাথে তাদের ব্যক্তিগত স্মৃতিচারণে ভরিয়ে তুলেছিলেন ফেসবুকের পাতা। কিন্তু আমার সাথে কাজী শাহেদের কোনও ব্যক্তিগত স্মৃতি নেই। কাজী শাহেদ আহমেদের প্রয়াণে আমি আসলে সময় পরিভ্রমণ করছিলাম। স্বৈরাচার এরশাদবিরোধী আন্দোলনের উত্তাল সময়, স্বৈরাচার পতনের পর গণতন্ত্রের সাথে মুক্ত গণমাধ্যমের বিকাশ, একই সময়ে গণমাধ্যমকর্মী হিসেবে আমার বেড়ে ওঠা– এই সময়টার নেপথ্য নায়ক ছিলেন কাজী শাহেদ আহমেদ। এক কথায় বলতে গেলে– আজকের বাংলাদেশের আধুনিক গণমাধ্যমের ধারাটি দাঁড়িয়ে আছে কাজী শাহেদ আহমেদের সাহসের ওপর ভর করে।

সেনাবাহিনীর চাকরি শেষে ব্যবসায় মনোযোগী ছিলেন কাজী শাহেদ। দেশে তখন সামরিক স্বৈরাচার এরশাদের বিরুদ্ধে তুমুল আন্দোলন। সে আন্দোলনে রাজনীতিবিদরা তো ছিলেনই; ছিলেন সংস্কৃতিকর্মী, কবি, শিল্পী, সাহিত্যিক এবং গণমাধ্যমকর্মীরাও। তখন যায়যায়দিন, বিচিন্তা, সাপ্তাহিক খবরের কাগজকে ঘিরে বিকশিত হচ্ছিল স্বৈরাচারবিরোধী আন্দোলনের শামিল গণমাধ্যমকর্মীরা। কিন্তু যতই সাহস থাকুক, কমিটমেন্ট থাকুক, প্রতিভা থাকুক; গণমাধ্যমকে এগিয়ে নিতে চাই বিনিয়োগ। খবরের কাগজ জনপ্রিয়তা পেলেও বিনিয়োগের অভাবে যখন ধুঁকছিল, তখন এগিয়ে আসেন কাজী শাহেদ আহমেদ। সাপ্তাহিক খবরের কাগজে প্রথম জুটি বাঁধেন কাজী শাহেদ আহমেদ আর নাঈমুল ইসলাম খান; আধুনিক সাংবাদিকতার দুই পথিকৃত। নিজে সেনাবাহিনীর লোক হলেও কাজী শাহেদের মালিকানার পত্রিকা খবরের কাগজ ছিল সামরিক স্বৈরাচারের বিরুদ্ধে সোচ্চার কণ্ঠ। জনপ্রিয়তার শীর্ষে ওঠা খবরের কাগজ হয়ে উঠেছিল স্বৈরাচারবিরোধী আন্দোলনের মুখপত্র। দুই বাংলার জনপ্রিয় লেখকদের ভিন্ন স্বাদের কলামে পাঠকদের মুগ্ধ করে রাখতো খবরের কাগজ। স্বৈরাচারের পতনের পর খবরের কাগজকে ঘিরে বেড়ে ওঠা সংবাদকর্মীদের স্বপ্নও বড় হয়। খবরের কাগজের ভ্রুণ থেকে জন্ম নেয় দৈনিক আজকের কাগজ।

বাংলাদেশের গণমাধ্যম নিয়ে যারা গবেষণা করেন তারা নিশ্চয়ই মানবেন, আজকের কাগজের প্রকাশনা বাংলাদেশের গণমাধ্যমের একটি যুগান্তকারী ঘটনা। নাঈমুল ইসলাম খানের নেতৃত্বে একদল সাহসী ও মেধাবী তরুণ বদলে দিয়েছিলেন বাংলাদেশের গণমাধ্যমের খোলনলচে। সাপ্তাহিক পত্রিকার মেজাজ ভর করেছিল দৈনিকে। ছোট ছোট বাক্যের স্মার্ট, আধুনিক গদ্য, জাম্প ছাড়া রিপোর্ট, আধুনিক ক্রীড়া সাংবাদিকতা, শিল্প-সাহিত্য সবকিছু দেখার এক নতুন চোখ নিয়ে এসেছিল আজকের কাগজ। এই কাজটা নাঈমুল ইসলাম খানের নেতৃত্বে তরুণ সংবাদকর্মীরাই করেছেন। কিন্তু তাদের পেছনে ছিলেন কাজী শাহেদ আহমেদের মতো একজন সাহসী স্বপ্নবান মানুষ।

স্বৈরাচারবিরোধী আন্দোলনের সময় কাজী শাহেদের মালিকানাধীন খবরের কাগজ ছিল এস্টাবলিশমেন্টের বিরুদ্ধে। আবার স্বৈরাচার পতনের পর প্রকাশিত আজকের কাগজও ছিল এস্টাবলিশমেন্টের বিরুদ্ধে। এই দুটি পত্রিকার জনপ্রিয়তার রহস্যও তাই। তবে শুধু যে পত্রিকার জনপ্রিয়তা বা বাণিজ্যিক কারণে আজকের কাগজ এস্টাবলিশমেন্টের বিরুদ্ধে ছিল তা নয়। এখানে পত্রিকার একটি আদর্শিক অবস্থানও ছিল। জামায়াত সমর্থিত বিএনপি ক্ষমতায় থাকার সময়ও আজকের কাগজ সাহসের সাথে মুক্তিযুদ্ধের সঠিক ইতিহাস তুলে ধরেছে, যুদ্ধাপরাধীদের বিচারের দাবিকে সামনে এনেছে, জয়বাংলার কথা বলেছে, বঙ্গবন্ধুর কথা বলেছে। আজকের গণমাধ্যমের বাস্তবতা বিবেচনায় তখন আজকের কাগজের অবস্থান ছিল অনেক সাহসী। কাজটা সাংবাদিকরাই করেছেন। কিন্তু সাহসের উৎস ছিলেন কাজী শাহেদ। একটা পত্রিকা ততটাই সাহসী, যতটা তার মালিক। আজকের কাগজের সম্পাদক বা সাংবাদিকরা যতই সাহসী আর মেধাবী হোন; কাজী শাহেদ না চাইলে তাদের পক্ষে স্বাধীনভাবে কাজ করা সম্ভব ছিল না। তাই আজকের কাগজ শুধু একটি বাঁকবদল করা বাণিজ্যকভাবে সফল পত্রিকা নয়; বাংলাদেশকে মুক্তিযুদ্ধের চেতনায় পরিচালনার ক্ষেত্র তৈরিতেও রেখেছে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা। কাজী শাহেদ তখন সংবাদপত্রের মালিকদের সংগঠনেরও নেতৃত্ব দিয়েছেন।

শুধু আজকের কাগজের মালিক হিসেবেই তিনি পরিচিতি পেতে পারতেন। কিন্তু কাজী শাহেদ ছিলেন একজন বহুমুখী উদ্যোক্তা। ক্রীড়া সংগঠক কাজী শাহেদ আবাহনী লিমিটেডের নবজাগরণের নেতা। আবাহনী ক্রীড়া চক্র আবাহনী লিমিটেড হওয়া পর তিনি ছিলেন ডিরেক্টর ইনচার্জ। জেমকন গ্রুপের প্রতিষ্ঠাতা কাজী শাহেদ একজন সফল ব্যবসায়ী উদ্যোক্তাও। অর্গানিক খাবার জনপ্রিয় করার ক্ষেত্রে তার দারুণ ভূমিকা রয়েছে। তিনি দেশে প্রথম অর্গানিক চায়ের বাগান করেছিলেন। সমতল ভূমিতেও যে চায়ের চাষ সম্ভব সেটি প্রমাণ করেছেন দূরদর্শী কাজী শাহেদ। অবহেলিত পঞ্চগড়কে বদলে দিয়েছেন একেবারে। তার প্রতিষ্ঠিত ইউনিভার্সিটি অব লিবারেল আর্টস বাংলাদেশ-ইউল্যাব দেশের অন্যতম সেরা বিশ্ববিদ্যালয়।

কাজী শাহেদ আহমেদের স্ত্রী আমিনা আহমেদ একজন সংগীতশিল্পী। সেই সূত্রে সংগীত এবং শিল্পকলার নানা শাখায় ছিল কাজী শাহেদ পরিবারের পদচারণা। এমন একটি পরিবার গণমাধ্যমে যুক্ত ছিলেন বলে বাংলাদেশের গণমাধ্যমেও লেগেছে রুচির ছোঁয়া। শুধু ব্যবসা-বাণিজ্য বা গণমাধ্যম উদ্যোক্তা নয়, শত ব্যস্ততায়ও লেখালেখিতে সময় দিয়েছেন কাজী শাহেদ আহমেদ। তার বেশ কিছু বই প্রকাশিত হয়েছে। তিনি তার তিন ছেলেকে বড় করেছেন নিজের চিন্তাচেতনা ও আদর্শে। বলা ভালো, নিজের বহুমাত্রিক প্রতিভা ছড়িয়ে দিয়েছেন তিন ছেলের মাঝে। বড় ছেলে কাজী নাবিল আহমেদ রাজনীতি করছেন, জাতীয় সংসদের সদস্যও তিনি। পাশাপাশি পিতার ফুটবল প্রেম ধরে রেখেছেন ফুটবল ফেডারেশনের সহ-সভাপতি কাজী নাবিল আহমেদ। মেজো ছেলে কাজী আনিস আহমেদ পিতার গণমাধ্যমের প্রতি ভালোবাসার উত্তরাধিকার বহন করছেন। বাংলা ট্রিবিউন ও ঢাকা ট্রিবিউনের প্রকাশক কাজী আনিস আহমেদ লেখালেখির সাথেও জড়িত। আন্তর্জাতিক সাহিত্যের সাথে বাংলাদেশের সাহিত্যের সেতুবন্ধন গড়তে গত কয়েক বছর ধরেই ঢাকা লিট ফেস্ট আয়োজনের অন্যতম পরিচালক কাজী আনিস আহমেদ। আর ছোট ছেলে কাজী ইনাম আহমেদ বাংলাদেশ ক্রিকেট বোর্ডের অন্যতম পরিচালক।

৮৩ বছর বয়সে মৃত্যু পরিণত মৃত্যুই। তবে এক জীবনে কাজী শাহেদ আহমেদ যা করেছেন, অনেকে মিলেও তা করতে পারেন না। পরিণত বয়সে মৃত্যু হলেও বাংলাদেশের গণমাধ্যম, ক্রীড়াজগৎ, ব্যবসায়ী মহল তাকে মনে রাখবে বহুদিন।

লেখক: হেড অব নিউজ, এটিএন নিউজ

/এসএএস/এমওএফ/

*** প্রকাশিত মতামত লেখকের একান্তই নিজস্ব।

বাংলা ট্রিবিউনের সর্বশেষ
এবার ফিলিস্তিনপন্থি বিক্ষোভে সরব কানাডার বিশ্ববিদ্যালয়গুলো
এবার ফিলিস্তিনপন্থি বিক্ষোভে সরব কানাডার বিশ্ববিদ্যালয়গুলো
প্রত্যেক বস্তা থেকে সরানো হয় চাল, ডিলারের বিরুদ্ধে থানায় মামলা
প্রত্যেক বস্তা থেকে সরানো হয় চাল, ডিলারের বিরুদ্ধে থানায় মামলা
পবিত্র কোরআনে বৃষ্টির নানা রূপ বর্ণনা
পবিত্র কোরআনে বৃষ্টির নানা রূপ বর্ণনা
নদীতে ধরা পড়ছে না ইলিশ, কারণ জানালেন মৎস্য কর্মকর্তা
নদীতে ধরা পড়ছে না ইলিশ, কারণ জানালেন মৎস্য কর্মকর্তা
সর্বশেষসর্বাধিক

লাইভ