আজ ৩ নভেম্বর। জেল হত্যা দিবস। শুধু বাংলাদেশের ইতিহাসেই নয়, মানব সভ্যতার ইতিহাসে বেদনাবিধুর কলঙ্কিত দিন। গণপ্রজাতন্ত্রী বাংলাদেশের যে ক’টি দিন চিরকাল কালো দিন হিসেবে চিহ্নিত হয়ে থাকবে, তার একটি ৩ নভেম্বর। ১৯৭৫ সালের এই দিনে বাঙালি জাতিকে নেতৃত্বশূন্য করতে ঢাকা কেন্দ্রীয় কারাগারে অন্তরীণ জাতির চার মেধাবী আলোর দিশারী মহান মুক্তিযুদ্ধের অন্যতম পরিচালক, মুক্তিযুদ্ধের নেতৃত্বদানকারী ও জাতির জনক বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের একনিষ্ঠ-ঘনিষ্ঠ সহচর বাংলাদেশের প্রথম অস্থায়ী রাষ্ট্রপতি সৈয়দ নজরুল ইসলাম, প্রধানমন্ত্রী তাজউদ্দীন আহমদ, মন্ত্রিসভার সদস্য ক্যাপ্টেন এম মনসুর আলী এবং এএইচএম কামরুজ্জামানকে নির্মম ও নৃশংসভাবে হত্যা করা হয়।
হাজার বছরের শ্রেষ্ঠ বাঙালি বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের আজীবন সহযাত্রী ক্যাপ্টেন এম. মনসুর আলী বৃহত্তর পাবনার এক গ্রামীণ সমাজ থেকে উঠে আসা মুসলিম মধ্যবিত্ত পরিবারের সন্তান। এই দুই নেতার মধ্যে পারস্পরিক সম্পর্ক ছিল খুবই হৃদ্যতাপূর্ণ। দীর্ঘদিনের রাজনীতি ও কর্মতৎপরতা তারই ইঙ্গিত বহন করে। চিন্তাভাবনাও ছিল সাদৃশ্যপূর্ণ। দুজনের লক্ষ্য ছিল বাঙালির জাতীয় মুক্তিসংগ্রাম। সোনার বাংলার স্বপ্নের বাস্তবায়ন। বাঙালি জাতি রাষ্ট্রের বিকাশধারার প্রতিটি পদক্ষেপে মনসুর আলীর পদচারণা বা উপস্থিতি লক্ষ করা যায়। বাঙালির স্বাধিকার থেকে স্বাধীনতা প্রাপ্তির উষাকাল পর্যন্ত ঘটনা প্রবাহের একজন কেন্দ্রীয় নেতা, রাষ্ট্র চিন্তক এবং বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের সহযাত্রী। আওয়ামী লীগের ইতিহাস প্রমাণ করে দুজনের চিন্তা ও কর্ম সমান্তরালভাবেই ছিল গণমানুষ কেন্দ্রিক। তরুণ বয়স থেকে রাজনীতিতে সক্রিয় এম মনসুর আলী বহু রাজনীতির বহু চড়াই উৎরাই পেরিয়ে গণমানুষের নেতা বা জাতীয় নেতা হিসেবে আবির্ভূত হয়েছিলেন।
এম মনসুর আলী ছিলেন নিঃসন্দেহে বাংলাদেশের রাজনৈতিক ইতিহাসে এক অনন্য প্রতিভার অধিকারী । স্বাধীন সার্বভৌম বাংলাদেশ গঠনের ক্ষেত্রে অসামান্য অবদান এবং অসাম্প্রদায়িক প্রগতিশীল রাজনীতিতে বিশ্বাসী বাঙালি জাতীয়তাবাদী আন্দোলনে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করেন। তাঁর রাজনীতির মূল উদ্দেশ্য ছিল জনকল্যাণমূলক রাজনৈতিক চেতনার বাস্তবায়ন। চৌ এন লাই যে অর্থে তাঁর Outline of a Talk on Leadership and Review of Work বা নেতৃত্ব বিষয়ে যা বোঝাতে চেয়েছেন– যারা সমাজের সত্যিকার কিছু চান, যারা সমাজকে এগিয়ে নিতে চান, সমাজে এক বৈপ্লবিক পরিবর্তন চান, ঠিক সেইরূপ একজন সংগঠক ও তাত্ত্বিক ছিলেন এম. মনসুর আলী।
বিদ্যায়তনিক শিক্ষায় এম. মনসুর আলী ছিলেন অত্যন্ত মেধাবী ও সুশিক্ষিত। শিক্ষা জীবনে কৃতিত্বের অধিকারী এম. মনসুর আলী বরাবরই বৃত্তিপ্রাপ্ত হয়েছেন। বিদ্যালয়ের শিক্ষাতেও যেমন প্রথম বিভাগ প্রাপ্ত হতেন, ঠিক তেমনি ওই সময়ে ভারতের বিখ্যাত আলীগড় মুসলিম বিশ্ববিদ্যালয় থেকে অর্থনীতিতে প্রথম শ্রেণিতে এমএ ও এলএলবি ডিগ্রি অর্জন করেছেন। বলা বাহুল্য, ব্রিটিশ রাজত্বের সময় ভারতের সেরা শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানগুলোর একটি হলো আলীগড় মুসলিম বিশ্ববিদ্যালয়। এখানকার ছাত্র হওয়ায় তিনি সে সময় অনুভব করেছিলেন শিক্ষিত নাগরিক ব্যতিত পরাধীন স্বদেশের মুক্তি নেই। তাঁর ব্যক্তি জীবনের বিকাশ এখানেই ঘটেছিল। আলীগড় মুসলিম বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্র থাকাকালীন ১৯৪৩ সালের আগস্ট মাসে তাঁর এক আত্মীয়কে চিঠি লেখেন। চিঠির পরিভাষায় ওই সময়ের আলীগড় মুসলিম বিশ্ববিদ্যালয়ের সমকালীন প্রতিচ্ছবি ফুটে উঠেছে। আলীগড় মুসলিম বিশ্ববিদ্যালয়ের ১৭, এম. এম. হোস্টেল থেকে লেখা চিঠিতে তিনি উল্লেখ করেছেন:
“যাক, মর্জ্জি খোদা এখানে সময় মতই পৌঁছিয়াছিলাম ...একটু আগে না আসিলে ভর্তি হওয়া খুবই কঠিন হইত। কেননা এখানে এবার ছাত্রের ভয়ানক ভীড়। ভারতের বিভিন্ন প্রদেশ ছাড়া বাহির হইতেও অনেক ছেলে এখানে পড়িতে আসে। বিভিন্ন দেশের ছেলে বিভিন্ন ভাষায় কথা বলে। তবে উর্দ্দু জানিলে সকলের সঙ্গেই প্রায় কথোপকথন করা যায়। কিন্তু উর্দ্দু না জানার দরুণ আমাদের বাঙালি ছেলের খুবই অসুবিধা হয়; সব সময়ই ইংরাজীতে কথা বলিতে হয়। প্রথম প্রথম বেশ একটু অসুবিধা হইত। এখন মর্জ্জি খোদা সেরকম কোন অসুবিধা নাই। আমাদের বাংলার আরও কয়েকজন ছেলে আছে। আমরা সকলেই বেশ মিলে মিশে আছি।… সব সময় পাজামা এবং সার্ট পরিয়া থাকিতে হয়। কখনও খালি গায়ে থাকার উপায় নাই। দুই বেলাই গোস্ত এবং রুটী খাইতে হয়। কিন্তু এখানকার পানি এত ভাল যে খাওয়ার এক ঘন্টা পর পরই ভয়ানক ক্ষুধা লাগে।” ( মির্জা সাখাওয়াৎ হোসেন, ইতিহাসের ধারায় এম. মনসুর আলী ও রক্তাক্ত নভেম্বর’ ৭৫, পৃ. ২২-২৩)
একথা বলা খুব একটা অত্যুক্তি হবে না যে, ব্রিটিশ শাসিত বাংলার এক প্রত্যন্ত অঞ্চলের মধ্যবিত্ত পরিবারে জন্মগ্রহণ করেও আধুনিক শিক্ষা গ্রহণ থেকে নিজে বিরত হননি। তাঁর লেখা চিঠি থেকে প্রমাণিত হয় তিনি শুধু পুঁথিগত বিদ্যার দিকে ব্যাপৃত ছিলেন না। শিক্ষার বাইরে গিয়ে সবার সাথে মিশেছেন। তাঁর উপদেশবাণীর অন্যতম ছিল, “সব সময় এই কথা মনে রাখিও যে, নিজে উপযুক্ত না হইলে দুনিয়ায় কেহই ভালবাসে না এবং জীবনে উন্নতি করার একমাত্র পথ খোদাকে স্মরণ পথে রাখিয়া মনোযোগ দিয়া লেখাপড়া করা।” ( মির্জা সাখাওয়াৎ হোসেন, পৃ. ২৩)
কাজে, কর্তব্যে ক্যাপ্টেন এম মনসুর আলী যেমন কৃতিত্বের স্বাক্ষর রেখেছেন, রাজনীতিতেও তাই। খুবই ভালো সংগঠক ছিলেন। একারণেই ১৯৭৫ সালে বঙ্গবন্ধু বাকশাল গঠন করলে এম. মনসুর আলী ছিলেন বাকশালের সেক্রেটারি জেনারেল। মনসুর আলীর রাজনৈতিক সংগঠক হয়ে ওঠা একদিনে সম্ভব হয়নি। মির্জা সাখাওয়াৎ হোসেন লিখেছেন:
“ শেখ মুজিব যখন আওয়ামী লীগের সমস্ত দায়িত্ব নিজের হাতে গ্রহণ করেন, তখন শেখ মুজিবের প্রিয় বন্ধু ও সহচর হিসেবে মনসুর আলী কেন্দ্রীয় কমিটিতে সহ সভাপতি নির্বাচিত হন। ষাটের দশকের শেষ দিকে শেখ মুজিবের ছয় দফা আন্দোলন যে ক্রমাগত জনপ্রিয়তা লাভ করতে থাকে, তার পশ্চাতে মনসুর আলীর অবদান ছিল অসাধারণ। সে কারণেই শেখ মুজিবের কারাবাসজাত অনুপস্থিতিতে যাঁরা আওয়ামী লীগের নেতৃত্ব দিয়েছিলেন তাঁদের মধ্যে মনসুর আলীর নাম বিশেষভাবে উল্লেখযোগ্য। উনসত্তরের গণ- আন্দোলনে সারা উত্তর বাংলায় গণ- আন্দোলনকে দুর্বার করার জন্য মনসুর আলী নিরলসভাবে কাজ করেছিলেন। মনসুর আলী যথার্থ অর্থেই ছিলেন একজন গণনেতা। তাই তিনি জনগণের সঙ্গে গভীর যোগাযোগ স্থাপন করে সকল আন্দোলনেই জনগণকে সম্পৃক্ত করবার চেষ্টা করেছেন ।” ( মির্জা সাখাওয়াৎ হোসেন, পৃ. ৩৪-৩৫)
সঠিক নেতৃত্বের এই ধারা সম্পর্কে স্ট্যালিনের মতামতের সাথেও তার প্রতিফলন দেখতে পাই। স্ট্যালিন যেমন বলেছিলেন, নেতৃত্বকে অবশ্যই জনগণের সাথে গভীর সম্পর্ক রাখতে হবে। এবং নেতৃত্ব এবং জনগণ যে অভিজ্ঞতা লাভ করেছেন তার মধ্যে সংশ্লেষ ঘটাতে হবে। শুধুমাত্র এভাবেই সঠিক নেতৃত্ব সৃষ্টি হতে পারে। মনসুর আলীর মানবীয় গুণাবলি, দেশ ও জাতির প্রতি দায়বদ্ধতাবোধ, ব্যক্তিত্ব, প্রচণ্ড স্বাতন্ত্র্যবোধ, স্পষ্টবাদীতা বিস্ময় উদ্রেক করে। তাঁর সম্পর্কে এইচ. টি. ইমাম যথার্থই বলেছেন, “ মুক্তিযুদ্ধ শুরু হওয়ার পর এম. মনসুর আলী অস্থায়ী বিপ্লবী সরকারের অর্থমন্ত্রী নিযুক্ত হন। তাঁর প্রশাসনিক অভিজ্ঞতা, নেতৃত্বের দৃঢ়তা এবং সামরিক ও বেসামরিক ক্ষেত্রে তাঁর দক্ষতার ছাপ ছিল স্পষ্ট। বঙ্গবন্ধুর ঘনিষ্ঠ সহযোগী হিসেবে তিনি সর্বদা নীতির প্রশ্নে ছিলেন আপোষহীন।” ( এইচ. টি. ইমাম, বাংলাদেশ সরকার ১৯৭১, ঢাকা: বাংলা একাডেমী, পৃ. ৬২)
১৯৭২ সালের জানুয়ারি মাসে বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান স্বদেশ প্রত্যাবর্তন করে মন্ত্রী পরিষদ পুনর্গঠন করেন। তখন ক্যাপ্টেন এম মনসুর আলী দায়িত্ব নেন প্রথমে যোগাযোগ ও পরে স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী হিসেবে। যোগাযোগ মন্ত্রী হিসেবে তিনি হার্ডিঞ্জ ব্রিজ মেরামতে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রাখেন।
১৯৭৫ সালের ২৬ জানুয়ারি দেশের শাসন ব্যবস্থার পরিবর্তন ঘটে। রাষ্ট্রপতি শাসিত শাসন ব্যবস্থায় বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান রাষ্ট্রপতি হন এবং তিনি প্রধানমন্ত্রীর দায়িত্ব দেন ক্যাপ্টেন এম মনসুর আলীকে। ১৯৭৫ সালের ২৬ জানুয়ারি প্রধানমন্ত্রী ক্যাপ্টেন মনসুর আলীর নেতৃত্বে ১৭ জন মন্ত্রী এবং ৯ জন প্রতিমন্ত্রী শপথ গ্রহণ করেন।
কাপ্টেন এম. মনসুর আলী প্রধানমন্ত্রী নিযুক্ত হওয়ায় জাতীয় সংসদের সদস্যগণ এবং সমগ্র দেশবাসী তাঁকে অভিনন্দন জানান। প্রধানমন্ত্রী হিসেবে ক্যাপ্টেন এম মনসুর আলী নতুন উৎসাহও উদ্দীপনা নিয়ে দেশবাসীকে জাতির জনক বঙ্গবন্ধুর নেতৃকে দেশ পুনর্গঠনের কাজে আত্মনিয়োগের আহবান জানান।
ক্যাপ্টেন এম. মনসুর আলীর স্মৃতিচারণে তার পুত্র প্রাক্তন মন্ত্রী মরহুম মোহাম্মদ নাসিম লিখেছিলেন, ‘সন্তান হিসেবে আমি গর্বিত এজন্য যে শহীদ এম মনসুর আলী আমার বাবা। তিনি বাংলাদেশের স্বাধীনতা সংগ্রামের অনতম মহানায়ক। জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের নেতৃত্বে যে চারজন জাতীয় নেতা বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধের নেতৃত্ব দিয়েছিলেন, তাদের মধ্যে শহীদ এম মনসুর আলী অনতম। তিনি আমার আদর্শিক নেতা। যখনই আমি কোনো কাজ করি, চিন্তা করি, আমার চিন্তা চেতনায় সবসময় আমার বাবার জন্য আবেগ অনুভব করি। তিনি যেমন জীবনে বঙ্গবন্ধুর সঙ্গে ছিলেন, মরণেও বঙ্গবন্ধুর সঙ্গেই আছেন।’ (মোহাম্মদ নাসিম, যে শোকগাথা আজ শক্তির উৎস, প্রথম আলো, ৩ নভেম্বর ২০১৭)
মানবতা ও গণতন্ত্রের ইতিহাসে ৩ নভেম্বর একটি কলঙ্কিত দিন। স্বাধীনতা সংগ্রামের সংগঠক জাতীয় চার নেতাকে ঘাতকচক্র হত্যা করে। কারগারের নিরাপদ আশ্রয়ে এ ধরনের বর্বর হত্যাকাণ্ড পৃথিবীর ইতিহাসে নজিরবিহীন। গভীর শ্রদ্ধার সাথে আমরা জেল হত্যা দিবসে শহীদ জাতীয় চার নেতাকে গভীর শ্রদ্ধার সঙ্গে স্মরণ করছি।
লেখক: অধ্যাপক, ইতিহাস বিভাগ, চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়