X
শনিবার, ২৭ এপ্রিল ২০২৪
১৪ বৈশাখ ১৪৩১

স্বাস্থ্য খাতের উদ্ভাবন ও এসডিজি অর্জনের ২০৩০ সাল, কত দেরি?

রেজা সেলিম  
১৪ নভেম্বর ২০২৩, ১৮:৩৫আপডেট : ১৪ নভেম্বর ২০২৩, ২০:৩২

২০১৯ সালে বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থা স্বাস্থ্য, উন্নয়ন এবং মানবিক কাজে নিয়োজিত ১৩টি বহুপাক্ষিক সংস্থাকে একত্রিত করে বিশ্বব্যাপী টেকসই উন্নয়ন লক্ষ্যমাত্রা বা এসডিজি বাস্তবায়নে গ্লোবাল অ্যাকশন প্ল্যান তৈরি করে, যা ‘এসডিজি-৩ গ্লোবাল অ্যাকশন প্ল্যান’ নামে পরিচিত। এর লক্ষ্য হলো দেশগুলোকে স্বাস্থ্য-সম্পর্কিত টেকসই উন্নয়ন লক্ষ্যমাত্রা অর্জন ও অগ্রগতি ত্বরান্বিত করতে সাহায্য করা, যাতে সবাই মিলে সুসমন্বিত পদক্ষেপ নেওয়া যায় ও দেশে দেশে নেওয়া জাতীয় পরিকল্পনাগুলোতে আরও সমন্বিত ও সারিবদ্ধ সমর্থন প্রদানের জন্য সংস্থাগুলোর মধ্যে সহযোগিতা জোরদার করার প্রতিশ্রুতি নিশ্চিত থাকে। ধারণা করা হয়েছে, এতে যদি কোনও দেশের অদক্ষতা থেকে থাকে তাদের নিয়ে একসঙ্গে কাজ করার উপায়ও বের করে আনা যাবে। উন্নত স্বাস্থ্যসেবা কৌশল অর্জনে বাংলাদেশের মতো আরও অনেক দেশের সুযোগ রয়েছে সেগুলো যেন যথাযথ সম্মান ও স্বীকৃতি পায় তাও নিশ্চিত রাখা, যা এই অ্যাকশন প্ল্যানের অন্যতম উদ্দেশ্য।

আমরা জানি, ইতোমধ্যে জাতিসংঘের একটি রেজুলেশনে বাংলাদেশের প্রধানমন্ত্রীর কর্তৃক স্বাস্থ্য খাতের অন্যতম উদ্ভাবন ‘কমিউনিটি ক্লিনিক’ একটি বিশেষ উদ্যোগ হিসেবে স্বীকৃতি পেয়েছে, যা আন্তর্জাতিক পর্যায়ে একটি সফল কার্যক্রমের সম্মানজনক দৃষ্টান্ত হয়েছে।

কোভিড-১৯ মহামারির আগেও, ২০৩০ সালের মধ্যে কোনও দেশই টেকসই উন্নয়ন লক্ষ্যমাত্রা (এসডিজি) অর্জনের পথে ছিল না। একাধিক চলমান সংকটের কারণে এই মহামারিটি এখন স্থবির হয়ে পড়েছে এবং এমনকি বৈশ্বিক লক্ষ্যের দিকে দেশগুলোর অগ্রগতিও বিপরীতমুখী হয়েছে। ২০১৯ সালে প্রতিষ্ঠিত এই গ্লোবাল অ্যাকশন প্ল্যান ফর হেলদি লাইভস অ্যান্ড ওয়েল-বিয়িং ফর অল (SDG3 GAP)-এর মাধ্যমে যে ১৩টি বহুপাক্ষিক সংস্থা তাদের সহযোগিতা জোরদার করার জন্য প্রতিশ্রুতি রেখেছে সেগুলো প্রধানত আন্ত-সহযোগিতার একটি প্ল্যাটফর্ম, যা সব দেশের জন্য স্বাস্থ্য-সম্পর্কিত এসডিজি লক্ষ্যমাত্রা অর্জনের মাধ্যমে একটি ন্যায়সঙ্গত এবং স্থিতিস্থাপক স্বাস্থ্য ব্যবস্থা গড়ে তুলতে সহায়ক। সহযোগিতার নতুন উপায়গুলোকে বের করে আনাও এই প্ল্যানের অন্যতম লক্ষ্য, যাতে দেশগুলো গভীর কৌশলের সঙ্গে তাদের সহায়তার সমন্বয়ে নিজেদের দক্ষতা উন্নত করতে পারে।

দেশগুলোর এসব প্রচেষ্টার মধ্যে রয়েছে সর্বজনীন স্বাস্থ্য কভারেজ অর্জনের জন্য টেকসই অর্থায়নকৃত প্রাথমিক স্বাস্থ্যসেবা সিস্টেমকে শক্তিশালী করা, মা ও শিশু স্বাস্থ্যের উন্নয়ন করা, অসংক্রামক রোগ প্রতিরোধ করা এবং রোগের প্রাদুর্ভাব এড়াতে দেশগুলোর সক্ষমতা শক্তিশালী করা। কোভিড-১৯ মহামারি প্রমাণ করেছে যে শক্তিশালী অংশীদারিত্বের মাধ্যমে অনেক কিছু অর্জন করা যেতে পারে, যার মধ্যে টেকসই উন্নয়নের জন্য ২০৩০ সালের যেসব এজেন্ডা রয়েছে, যা কাউকে পিছনে না রাখার সংকল্প নিশ্চিত করে। শক্তিশালী বহুপাক্ষিক সহযোগিতা স্বাস্থ্য-সম্পর্কিত এসডিজি অর্জনের দিকে দেশগুলোর অগ্রগতি সমর্থন করার একটি উপায়ও বটে।

স্বাস্থ্য খাতে বাংলাদেশের এসডিজি অর্জনের অগ্রগতির ব্যাখ্যাগুলো একটি ধোঁয়াশার মধ্যে আবর্তিত হচ্ছে। সাম্প্রতিক ডেঙ্গু জ্বরে দেশের মানুষের আক্রান্ত ও মৃত্যু হারের সূচক জনস্বাস্থ্য উন্নয়ন সুবিধা সম্প্রসারণ তথ্যের পাশাপাশি মোটেও সুখকর নয়। কারণ, আক্রান্ত ও নিরাময় হার ও সে হারের তুলনায় মৃত্যুর হার স্বাস্থ্য পরিসংখ্যানের জগতে ব্যাপক প্রশ্ন তৈরি করেছে যেসবের উত্তর দেওয়া আমাদের দেশের বিশেষজ্ঞদের জন্য হয় বিব্রতকর বা তাদের কোনও আগ্রহ নেই প্রমাণ করে। বৈশ্বিক সহযোগিতার দুর্বল যোগসূত্র আমাদের এই পরিস্থিতিতে ফেলেছে। নতুবা প্রতিদিন দেশের ১০-১২ জন নিরপরাধ নাগরিক একটি পরিচিত রোগে মারা যাচ্ছে অথচ দেশের স্বাস্থ্য ব্যবস্থায় তার জন্যে কোনও উৎকণ্ঠা নেই! দৈনিক আক্রান্ত-নিরাময় ও মৃত্যুর হারে ডেঙ্গু জ্বরের পরিসংখ্যান কোভিড-১৯ মহামারির চেয়েও উদ্বেগজনক এ কথা আমরা কেন বুঝতে পারছি না?

একটি ন্যায়সঙ্গত স্বাস্থ্য ব্যবস্থা নির্মাণে আমরা যে সমতার কথা বলি সেখানে ডেঙ্গু আক্রান্তের বিষয়টিকে জনস্বাস্থ্য ব্যবস্থাপনায় অবহেলার চোখে দেখা হচ্ছে, নিশ্চয়ই তা আমাদের অস্বীকার করা উচিত হবে না।

২০১৫ সালে যখন জাতিসংঘের সাধারণ পরিষদ তার ২০৩০ এজেন্ডা নির্ধারণ করেছিল, তখন কেউ কল্পনাও করতে পারেনি যে বাংলাদেশ সময়ের আগেই স্বাস্থ্যের জন্য ‘কয়েকটি’ মাইলফলক লক্ষ্য অতিক্রম করবে। সুস্বাস্থ্যের জন্য বিশ্বব্যাপী এই টেকসই উন্নয়ন লক্ষ্য ৩-এ পাঁচ বছরের কম বয়সী মৃত্যুর হার এবং নবজাতক মৃত্যুর হারের শিশু-সম্পর্কিত সূচকগুলো, সেইসঙ্গে মাতৃমৃত্যুর অনুপাত এবং সড়ক দুর্ঘটনায় মৃত্যুর জন্য নারী-সম্পর্কিত লক্ষ্যগুলোও অন্তর্ভুক্ত রয়েছে।

 
বাংলাদেশ ১৪ হাজারেরও বেশি কমিউনিটি ক্লিনিকের একটি বিস্তৃত নেটওয়ার্ক স্থাপন করে তার কার্যকারিতা অর্জন করতে সক্ষম হয়েছে, যা উল্লেখযোগ্য সংখ্যক মানুষের জন্য প্রাথমিক স্বাস্থ্যসেবা দিতে পারছে। আমরা জানি ও বিশ্বাস করি যে প্রাথমিক পরিচর্যার মাধ্যমে প্রতিরোধমূলক ব্যবস্থা (সচেতনতা, জীবন-কৌশল ও ওষুধ) সব লক্ষ্যমাত্রা অর্জনের চাবিকাঠি।

নির্দিষ্ট সময়ের মধ্যে এসডিজি লক্ষ্যগুলো অর্জনে আমাদের এখন দরকার বাড়ি পর্যায়ে সেবা নিশ্চিত করা। কারণ, মানুষ অসুস্থ হয় বাড়িতেই (হাসপাতালে এসে কেউ অসুস্থ হয় না); আর এই সেবা নিশ্চিত করতে গ্রাম-পাড়া-মহল্লা পর্যায়ে সর্বজনীন স্বাস্থ্যসেবা কৌশলের উদ্ভাবনী উদ্যোগের সুযোগ রয়েছে। দ্বিতীয়ত, কমিউনিটি ক্লিনিক ও উপজেলা স্বাস্থ্যকেন্দ্রগুলোর মধ্যে তথ্য-প্রযুক্তির সেবা সমন্বয়ে জরুরি যত্ন পরিষেবাগুলো বিকাশ করা ও নিশ্চিত রাখা প্রয়োজন, যেখানে সেপসিস, রক্তপাত, স্ট্রোক এবং হার্ট অ্যাটাকের মতো সময়-গুরুতর ক্ষেত্রে প্রয়োজনীয় চিকিৎসাসেবা যথাযথভাবে সরবরাহ করা সম্ভব। ২০১৯ সালে জেনেভায় ৭২তম বিশ্ব স্বাস্থ্য সমাবেশে এই বিষয়টি স্বীকৃত হয়েছিল, যখন রেজুলেশন ৭২.১৬ গৃহীত হয়েছিল এই মর্মে যে সার্বজনীন স্বাস্থ্য কভারেজের জন্য জরুরি যত্ন ব্যবস্থা অপরিহার্য।

এক বছরের মাথায় কোভিড মহামারিকালে এই ৭২.১৬ সিদ্ধান্ত কতটা সঠিক ছিল তা প্রমাণিত হয়েছে।

এসডিজি ৩-এর লক্ষ্যমাত্রা অর্জনের জন্য দেশে প্রাথমিক পরিচর্যা পরিষেবাগুলোকে শক্তিশালী করার জন্য অবশিষ্ট ছয় বছর যথেষ্ট সময় নাও হতে পারে, তবে আগামী পাঁচ বছরের মধ্যে সারা দেশে স্বাস্থ্যকর্মী ও চিকিৎসকদের জন্য কমিউনিটি ক্লিনিকভিত্তিক জরুরি যত্ন প্রশিক্ষণ ও সংযোগ কর্মসূচি অনাকাঙ্ক্ষিত মৃত্যু কমাতে অবদান রাখবে। স্বাস্থ্য সমস্যার চলমান হারের অনুপাত বোঝাতে স্বাস্থ্যসেবায় নিয়োজিত সবার জন্যে শিক্ষা কর্মসূচি থাকা দরকার। কোভিড-১৯ মহামারি ইতোমধ্যে প্রমাণ করেছে যে বাংলাদেশের স্বাস্থ্য খাত চ্যালেঞ্জ নিতে প্রস্তুত, তা যত বড়ই হোক না কেন; আমাদের এখন যা দরকার তা হলো উপযুক্ত নির্দেশনা।

সরকারের উপরি মহলে এই নির্দেশনা গ্রহণ ও বাস্তবায়নের সমন্বয়ে ঘাটতি রয়েছে। মাননীয় প্রধানমন্ত্রী যা বোঝেন সেটা যে স্বাস্থ্য বিভাগের কর্মী বাহিনীও একইভাবে অনুভব করেন– সেটার কোনও প্রমাণ আমরা সচরাচর দেখতে পাই না। যেমন, স্বাস্থ্য খাতের গবেষণা, কোনও উদ্যোগ নেই। প্রধানমন্ত্রী স্বাস্থ্য গবেষণার গুরুত্ব কী তা বিস্তারিত বলে দেবার পরে টাকা বরাদ্দ হয়েছে ঠিকই, কিন্তু নীতিমালার ঘেরাটোপে সেসব টাকা আর খরচ হয় না। স্বাস্থ্যসেবায় বেসরকারি খাতের অংশগ্রহণে সরকারের সুস্পষ্ট অঙ্গীকার ও নীতিমালা রয়েছে, কিন্তু তাতে যে পরিমাণ মহীসোপান পাড়ি দিতে হয় তাতে উদ্ভাবনী উদ্যোগের পুনঃনিমজ্জন ছাড়া আর কোনও উপায় থাকে না।

জনস্বাস্থ্য গবেষণায় এই দেশে সামাজিক খাতের প্রচুর উপাদান রয়েছে, যেগুলো গুরুত্ব দেওয়া অতি জরুরি, কিন্তু রাজনৈতিক কর্মীদের দুর্বল অনুধাবনের সুযোগে অপর একটি নির্বাহী পক্ষ দীর্ঘসূত্রতার সুযোগ নিতে পারছে। অথচ রাজনৈতিক অঙ্গই সমাজের উন্নয়ন প্রভাবে অনেক বেশি বিস্তৃত ভূমিকা রাখতে সমর্থ। ফলে দেশে ও বিদেশে আমাদের অর্জন কাগুজে হয়ে থাকে কিনা তা ভেবে দেখা দরকার। এসডিজি অর্জন আমাদের হাতে আছে, কিন্তু আর মাত্র ছয় বছর ২০৩০ নিয়ে আমরা যেভাবে কথা বলি তাতে মনে হয় সেটা ছয় হাজার বছর পরে আসবে। এখানে রাজনৈতিক অঙ্গের ভূমিকাই যে অধিকতর বেশি, রাষ্ট্র পরিচালনা কৌশলে এর সুস্পষ্ট ধারণা প্রতিষ্ঠিত থাকা দরকার।

লেখক: পরিচালক, আমাদের গ্রাম

ই-মেইলঃ [email protected]

/এসএএস/এমওএফ/

*** প্রকাশিত মতামত লেখকের একান্তই নিজস্ব।

বাংলা ট্রিবিউনের সর্বশেষ
পশ্চিম তীরে ইসরায়েলি অভিযানে গ্রেফতার ২০
পশ্চিম তীরে ইসরায়েলি অভিযানে গ্রেফতার ২০
রিভ চ্যাট ভার্সন ৪.০ উন্মোচন
রিভ চ্যাট ভার্সন ৪.০ উন্মোচন
উচ্চশিক্ষার সাম্প্রতিক প্রবণতা
উচ্চশিক্ষার সাম্প্রতিক প্রবণতা
জাপানে ৬.৫ মাত্রার ভূমিকম্প অনুভূত
জাপানে ৬.৫ মাত্রার ভূমিকম্প অনুভূত
সর্বশেষসর্বাধিক

লাইভ