X
সোমবার, ২৯ এপ্রিল ২০২৪
১৬ বৈশাখ ১৪৩১

মনোনয়ন পেলে ‘দামি’ প্রার্থী, না পেলে ‘ডামি’!

এরশাদুল আলম প্রিন্স
০৫ ডিসেম্বর ২০২৩, ২০:২৬আপডেট : ০৫ ডিসেম্বর ২০২৩, ২০:২৬

তফসিল ঘোষণার পর আওয়ামী লীগ এখন নির্বাচনমুখী। প্রার্থীরা দলীয় মনোনয়ন ফরম কিনেছেন। সরকার সমর্থক দলগুলো সরকারের সঙ্গে আসন নিয়ে দেনদরবার করে যাচ্ছে। জাতীয় পার্টির দৌড়ঝাঁপ বঙ্গভবন পর্যন্ত গড়িয়েছে। তৃণমূল বিএনপি সব আসনে মনোনয়ন দেওয়ার দাবি করেছিল। যদিও মাঠে তাদের হাঁকডাক নেই। এদিকে চমক দেখিয়েছেন কল্যাণ পার্টির চেয়ারম্যান। গোলাগুলি করে সরকারের সঙ্গে পারা যাবে না, তাই তিনি গলাগলির পথ ধরেছেন। বিদ্রোহী রণক্লান্ত, অতএব রণেভঙ্গ! এদিকে সরকারের জোটসঙ্গী বাম দলগুলো হতাশ। ইনু-মেননদের কথা ভুলে গিয়ে আওয়ামী লীগ ২৯৮টি আসনে প্রার্থী দিয়েছে। এতদিন যারা সরকারের পরীক্ষিত বন্ধু ছিল আজ তারা অবহেলার পাত্র! নির্বাচনে চীনকে পাশে পেতে তারাই দৌড়ঝাঁপ করেছে অথচ ভোটের মাঠে তারা অচিন পাখি। মেনন বলেছেন, সরকার নির্বাচন করতে পারলেও বিদেশি চাপ সামলাতে তাদের ঠিকই লাগবে। ভাবটা এমন যে বিদেশি চাপ সামলাতে তারাই সরকারি ঢাল হিসেবে কাজ করবে।

মনোনয়ন বিকিকিনির হাটে প্রার্থীদের আনন্দ-আয়োজনে আওয়ামী লীগ হয়তো জোটের কথা ভুলেই গিয়েছিল। লক্ষণ তা-ই বলছে। তা না হলে জোটের প্রার্থীদের বাদ দিয়ে সব আসনে প্রার্থী কেন?

একই আসনে আওয়ামী লীগের একাধিক প্রার্থীও রয়েছে। বড় দল, একাধিক প্রার্থী থাকাটাই স্বাভাবিক। এর আগে ৬ আগস্ট গণভবনে বর্ধিত সভায় প্রধানমন্ত্রী বলেছিলেন, ‘নৌকা মার্কায় যাকেই মনোনয়ন দেই, ভালো-মন্দ যা-ই হোক, প্রতিজ্ঞা করতে হবে যে তাকে ভোট দিয়ে জয়যুক্ত করতে হবে।’  এখন দেখা যাচ্ছে প্রতীক না পেলেও স্বতন্ত্র প্রার্থী হয়ে নির্বাচন করা যাবে। তারা আওয়ামী লীগেরই প্রার্থী। যারা নৌকা পেয়েছেন তারা ‘দামি’ প্রার্থী, আর যারা পাননি তারা ‘ডামি’।

২০১৮ সালের নির্বাচনেও সরকার এই মডেল অনুসরণ করেছিল। প্রতীক যেহেতু একাধিকজনকে দেওয়া যায় না, তাই একজনকে নৌকা দেওয়া হয়েছে। আরেকজনকে দেওয়া হয়েছে দোয়া। আগে প্রতীক ছাড়া দলীয় প্রার্থী নির্বাচন করলে তাকে বলা হতো বিদ্রোহী প্রার্থী। এখন বিদ্রোহী প্রার্থীরাই হলো ডামি প্রার্থী- মানে তারাও প্রার্থী।

এতে দল হিসেবে আওয়ামী লীগ লাভবানই হবে। কারণ, আওয়ামী লীগের ভোট আওয়ামী লীগেই থাকবে। ভোট পড়বে হয় নৌকায় না হয় তাদেরই স্বতন্ত্র প্রার্থীর প্রতীকে। অন্য কোনও প্রতীকে নয়। আমার মনে হয় আগামী নির্বাচনগুলোতে বড় দলগুলো এ কাজই করবে। তাতে নিজ দলের প্রার্থী বিদ্রোহী প্রার্থী হবে না, আবার আওয়ামী লীগের ভোট ধানের শীষেও পড়বে না। যে প্রার্থীই জয়ী হোন- দামি অথবা ডামি- আওয়ামী লীগেরই জয়। স্থানীয়ভাবে দলের ভাঙন ঠেকাতে ডামি কৌশল ভালো কাজ করবে।

এ ‘ডামি’ কৌশল শুধু জাতীয় নির্বাচনই নয়, স্থানীয় নির্বাচনে আমরা এর চেয়ে আরও অ্যাডভান্সড মডেল দেখেছি। মেয়র প্রার্থী জাহাঙ্গীরকে নৌকা দেওয়া হয়নি। নৌকা দেওয়া হয়েছে আজমত উল্লাহ খানকে। জাহাঙ্গীর তার মাকে নিয়ে নির্বাচন করিয়েছেন। জয়ী হওয়ার পর মুজিব কোট পরে জাহাঙ্গীর তার মাকে নিয়ে বিশাল মোটর শোভাযাত্রা নিয়ে বঙ্গভবনে হাজির হয়েছেন। আজমত উল্লাহকে প্রতীক দিয়ে তাকেও হাতে রাখা হলো, আবার রাজনীতির মাঠে হারিয়ে যাওয়া ছেলেকে ফিরে পাওয়াও হলো।

এতে বিজয়ী মেয়রের পদটি শেষমেশ আওয়ামী লীগেরই থাকলো। আসন্ন জাতীয় নির্বাচনের ক্ষেত্রেও একই ফর্মুলা, একই সমীকরণ- তাই ফলাফলও একই হবে। যে-ই জয়ী হোক-দামি অথবা ডামি, দুজনই আওয়ামী লীগের।

বিএনপি ছাড়া এমন একটি নির্বাচনে আওয়ামী লীগের প্রার্থীরা প্রতীক পাক বা না পাক (দামি অথবা ডামি) জিতে আসবে। কিন্তু ইনু-মেননের মতো জোটসঙ্গীরা সেরকম একটি নির্বাচনে জিতে আসতে পারবে কি? আওয়ামী লীগের একাধিক প্রার্থীর হাড্ডাহাড্ডি লড়াইয়ের মধ্যে তারা ‘কাবাবের হাড্ডি’ ছাড়া আর কিছু নয়। ইতোপূর্বে কোনও নির্বাচনে নিজ দল ও প্রতীক নিয়ে নির্বাচন করে এককভাবে জয়ী হওয়ার রেকর্ড তাদের নেই। এটা জেনে বুঝে ইনু-মেননরা সে ঝুঁকি কেন নেবেন? তাই নৌকামুক্ত আসনে তারা জোটের প্রার্থিতা না পেয়ে আপাতত গোস্বা।

তাদের গোস্বা টের পেয়ে ওবায়দুল কাদের বলেছেন– ১৪ দলের সঙ্গে জোটবদ্ধভাবেই নির্বাচন হবে, আসন সমন্বয় করা হবে। ইতোমধ্যে ২৯৮ আসনে আওয়ামী লীগের দলীয় মনোনয়ন দেওয়া হয়েছে। এদিকে জোটের প্রার্থীরা আওয়ামী লীগের দিকে তাকিয়ে আছেন। তাহলে আসন সমন্বয় কীভাবে সম্ভব? সুযোগ আছে। জোটসঙ্গীরা শুধু নির্বাচন করুক। জিতিয়ে আনার দায়িত্ব তো সরকারের।

সরকারের উদ্দেশ্য জাতিকে একটি অংশগ্রহণমূলক, অন্তর্ভুক্তিমূলক ও প্রতিদ্বন্দ্বিতামূলক নির্বাচন উপহার দেওয়া, বিএনপি আসুক বা না আসুক, নিবন্ধিত দল ও বেশি বেশি প্রার্থীরা নির্বাচন করুক সরকার সেটি চায়। এমন একটি নির্বাচনকে আওয়ামী লীগ গ্রহণযোগ্য নির্বাচন হিসেবে প্রচার করবে। সে কারণেই সরকার চায় তৃণমূল বিএনপি, কল্যাণ পার্টি বা তার জোটসঙ্গীরা নিজেদের মতোই নির্বাচন করুক। নির্বাচনে বেশি দল মানে বেশি প্রার্থী। বেশি প্রার্থী মানে বেশি ভোটার। মানে একটি অংশগ্রহণমূলক, অন্তর্ভুক্তিমূলক ও প্রতিদ্বন্দ্বিতামূলক নির্বাচন।

কিন্তু দেশের কার্যত বিরোধী দল (Defacto Opposition) হলো বিএনপি। সরকারের কাছে অবশ্য জাতীয় পার্টিই বিরোধী দল। অর্থাৎ জাতীয় পার্টি হলো ‘সরকারি বিরোধী দল’। এখন প্রশ্ন হলো, এই কার্যত বিরোধী দল বাদ দিয়ে সরকারি বিরোধী দল বা তৃণমূল বিএনপি বা এরকম আরও কিংস পার্টির মাধ্যমে একটি অংশগ্রহণমূলক, অন্তর্ভুক্তিমূলক ও কিছুটা প্রতিদ্বন্দ্বিতামূলক নির্বাচন করা গেলেও তাকে কি গ্রহণযোগ্য (Credible) নির্বাচন বলা যাবে?

একটি নির্বাচনের কতটি রাজনৈতিক দল অংশগ্রহণ করলো সেটি গুরুত্বপূর্ণ সন্দেহ নেই। কিন্তু মূল রাজনৈতিক দলগুলো নির্বাচনে অংশগ্রহণ করলো কিনা সেটিই বড় কথা। গ্রহণযোগ্য নির্বাচনের গুরুত্বপূর্ণ বিষয় হলো সরকার ও বিরোধী দলের অংশগ্রহণ। ১৫ ফেব্রুয়ারির নির্বাচনটি প্রশ্নবিদ্ধ, কারণ সেখানে প্রধান বিরোধীদল আওয়ামী অংশগ্রহণ করেনি। ঠিক একই যুক্তিতে আজও যদি বিএনপি নির্বাচনে না আসে তবে এ নির্বাচনটিও প্রশ্নবিদ্ধই থেকে যাবে। কাজেই, প্রধান দুই দলের বাইরে গিয়ে বেশি দল, বেশি প্রার্থী ও বেশি ভোটার দিয়ে নির্বাচন করলেই কি তা গ্রহণযোগ্য নির্বাচন হবে? দুটি দলের ক্ষেত্রেই এটি সত্য। তৃণমূল জাতীয় বিএনপি বা কল্যাণ পার্টি জাতীয় যুক্তফ্রন্টকে মাঠে নামিয়ে নির্বাচনি বৈতরণী পার হতে পারলেও গ্রহণযোগ্য নির্বাচনের তকমা গায়ে লাগানো সহজ কিছু নয়। সেটি সম্ভব হলে ২০১৪, ২০১৮ বা ১৫ ফেব্রুয়ারি নিয়ে কথা হতো না।

গ্রহণযোগ্য নির্বাচন কী তা মানবাধিকারের আন্তর্জাতিক সনদই বলে দিয়েছে। অনুচ্ছেদ ২১ বলছে, ‘জনগণের ইচ্ছা‌ই হবে সরকারের শাসন ক্ষমতার ভিত্তি; এ‌ই ইচ্ছা প্রকৃত নির্বাচনের মাধ্যমে ব্যক্ত হতে হবে। এ নির্বাচন হতে হবে প্রত্যক্ষভাবে বা অবাধে।’ এছাড়া জাতিসংঘ কর্তৃক গৃহীত Declaration of Principles for International Election Observation বলছে, একটি গ্রহণযোগ্য নির্বাচন হতে হলে এতে নির্বাচনে অংশগ্রহণযোগ্য সব দলেরই অংশগ্রহণ জরুরি। কে ক্ষমতায় এলো গেলো সেটি ভিন্ন কথা। জাতিসংঘের ওই সনদ ও ঘোষণাপত্র অনুযায়ী এই দ্বাদশ সংসদ নির্বাচন যে পথে এগোচ্ছে তা কি গ্রহণযোগ্যতার সনদ পাবে?

গ্রহণযোগ্য নির্বাচনের জন্য ২০০৬ সালের ৩০ অক্টোবর তৎকালীন বিরোধীদলীয় নেত্রী শেখ হাসিনা বঙ্গভবনে রাষ্ট্রপতির সঙ্গে দেখা করে ১১টি বিষয়ে ২০ দফা দাবিনামা দিয়েছিলেন। একটি সুষ্ঠু ও গ্রহণযোগ্য নির্বাচনের জন্য তার প্রতিটি দফাই অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ। তার দাবির মূল বিষয় ছিল নির্বাচনের আগে ও পরে আওয়ামী লীগের জন্য একটি আস্থাজনক পরিবেশ সৃষ্টি করা। আজকের প্রেক্ষাপটেও সে দাবিগুলো অত্যন্ত প্রাসঙ্গিক। ডামি প্রার্থী দিয়ে প্রার্থী ও ভোটারদের অংশগ্রহণ কিছুটা বাড়ানো গেলেও নির্বাচন সংশ্লিষ্ট আন্তর্জাতিক আইন, সনদ ও মানদণ্ড অনুযায়ী তা গ্রহণযোগ্য হওয়া কঠিন। ডামি প্রার্থী দিয়ে দামি নয়, ডামি নির্বাচনই হয়।

লেখক: আইনজীবী, প্রাবন্ধিক

/এসএএস/এমওএফ/

*** প্রকাশিত মতামত লেখকের একান্তই নিজস্ব।

বাংলা ট্রিবিউনের সর্বশেষ
সিটি ক্লাবের সঙ্গে অবনমন হলো গাজী টায়ার্সের
সিটি ক্লাবের সঙ্গে অবনমন হলো গাজী টায়ার্সের
দুই বিভাগের সব, তিন বিভাগের আংশিক শিক্ষা প্রতিষ্ঠান বন্ধ থাকবে
দুই বিভাগের সব, তিন বিভাগের আংশিক শিক্ষা প্রতিষ্ঠান বন্ধ থাকবে
খুলনায় এযাবৎকালের সর্বোচ্চ তাপমাত্রার নতুন রেকর্ড
খুলনায় এযাবৎকালের সর্বোচ্চ তাপমাত্রার নতুন রেকর্ড
মানবাধিকার রেকর্ড নিয়ে জাতিসংঘে সমালোচনার মুখে তালেবান
মানবাধিকার রেকর্ড নিয়ে জাতিসংঘে সমালোচনার মুখে তালেবান
সর্বশেষসর্বাধিক

লাইভ