X
শনিবার, ০৪ মে ২০২৪
২১ বৈশাখ ১৪৩১

জাতির বীর সন্তানদের শ্রদ্ধায় স্মরণের দিন

ড. মো. সাজ্জাদ হোসেন
১৪ ডিসেম্বর ২০২৩, ০০:০৬আপডেট : ১৪ ডিসেম্বর ২০২৩, ০০:০৬

১৯৭১ সালের রক্তক্ষয়ী মুক্তিযুদ্ধ। জীবন-সম্ভ্রম ও ত্যাগের বিনিময়ে রচিত আমাদের স্বাধীনতা। ডিসেম্বর মাস। মুক্তিযোদ্ধারা তীব্র গতিতে এগিয়ে যাচ্ছে শত্রুর বিপক্ষে। তাদের একটাই টার্গেট, যেকোনও মূল্যে বিজয় নিশ্চিত করা। বিজয়ের একেবারে দ্বারপ্রান্তে পূর্ব বাংলা। চারদিকে থেকে খবর আসছে বিভিন্ন অঞ্চল স্বাধীন হওয়ার। মুক্তিযোদ্ধারা বাদবাকি পরাধীন অঞ্চলগুলো দ্রুত স্বাধীন করে চলেছে। দেশের কোনও কোনও অঞ্চলে পত পত করে উড়ছে আমাদের লাল সবুজের পতাকা। এমন মুহূর্তে বাঙালি জাতির বীর সন্তান বুদ্ধিজীবীদের হত্যার পরিকল্পনা আঁকতে থাকে পাকিস্তানি হানাদাররা। ইয়াহিয়া খানের দখলদার বাহিনী নিজেদের নিশ্চিত পরাজয় বুঝতে পেরে তাদের এদেশীয় রাজাকার, দোসর, আলবদর ও আলশামসের মাধ্যমে চূড়ান্ত আঘাত হানে। বাঙালি জাতিকে মেধাশূন্য করার লক্ষ্যে ১৯৭১ সালের ১৪ ডিসেম্বর বিজয় দিবসের মাত্র দুদিন আগে জাতির সবচেয়ে মেধাবী লেখক, সাংবাদিক, শিল্পী ও বুদ্ধিজীবীদের হত্যা করা হয়। সারা দেশে ৯৯১ জন শিক্ষাবিদ, ১৩ জন সাংবাদিক, ৪২ জন আইনজীবী, ৪৯ জন চিকিৎসক, ৯ জন শিল্পী ও সাহিত্যিক এবং ৫ জন প্রকৌশলী দেশমাতৃকার জন্য নিজেকে উৎসর্গ করেন।

বুদ্ধিজীবীদের সংগ্রাম
দেশের সব শ্রেণি-পেশার মানুষদের সঙ্গে নিয়ে বাংলার শিক্ষিত জনগোষ্ঠী অতীত থেকে তাদের বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের নেতৃত্বে সংগ্রাম চালিয়ে আসছিল। বিশেষ করে ‘৪৭-এর দেশভাগ ও তার পরবর্তী আন্দোলন-সংগ্রামে পূর্ব বাংলায় নেতৃত্ব দিয়েছে শিক্ষিত সমাজ। তাদের সঙ্গে দেশের সর্বস্তরের জনগণ অংশ নিয়েছে। পরে দীর্ঘমেয়াদে যা মুক্তি সংগ্রামে রূপ নিয়েছিল। পাকিস্তানি শাসকগোষ্ঠীর যেকোনও অন্যায়ের বিরুদ্ধে প্রথম প্রতিবাদটা পূর্ব বাংলার শিক্ষিত সমাজ তথা বুদ্ধিজীবীদের পক্ষ থেকেই এসেছিল। ফলে শাসকগোষ্ঠী এই বুদ্ধিজীবী সমাজের প্রভাব বুঝতে সক্ষম হয়। একাত্তরের ২৫ মার্চের গণহত্যার মাধ্যমে শুরু হয়ে দীর্ঘ নয় মাসই দেশের বুদ্ধিজীবীদের বেছে বেছে হত্যা করা হয়েছে। কারণ, ইতোপূর্বে অন্যায়ের বিরুদ্ধে কলম ধরে, সৃষ্টিশীল কর্মের পাশাপাশি রাস্তায় নেমে প্রতিবাদ জানিয়ে শাসকদের চক্ষুশূল হয়েছিলেন বুদ্ধিজীবীরা। ফলে মুক্তিযুদ্ধের শুরু থেকে শেষ দিন পর্যন্ত চলে বুদ্ধিজীবী হত্যাকাণ্ড।

শহীদ বুদ্ধিজীবীগণ
১৯৭১ সালের ১৪ ডিসেম্বর। সেদিন অসংখ্য বুদ্ধিজীবী প্রাণ দিয়েছেন দেশের জন্য। শহীদ বুদ্ধিজীবীদের মধ্যে উল্লেখযোগ্য কয়েকজন হলেন, গোবিন্দ্র চন্দ্র দেব (জি সি দেব), ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ইংরেজি বিভাগের অধ্যাপক; জ্যোতির্ময় গুহঠাকুরতা, ঢাকা  বিশ্ববিদ্যালয়ের ইংরেজি বিভাগের অধ্যাপক; মোফাজ্জল হায়দার চৌধুরী, গবেষক, বুদ্ধিজীবী ও ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের বাংলা বিভাগের অধ্যাপক; সিরাজুদ্দীন হোসেন, বিখ্যাত সাংবাদিক ও দৈনিক ‘ইত্তেফাক’-এর তৎকালীন নির্বাহী সম্পাদক; সেলিনা পারভিন, সাংবাদিক ও সাহিত্যিক; ডা. আব্দুল আলিম চৌধুরী, চক্ষু বিশেষজ্ঞ; আলতাফ মাহমুদ, সংগীতজ্ঞ, ‘আমার ভাইয়ের রক্তে রাঙানো’ গানের সুরকার; মুনীর চৌধুরী, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের বাংলা বিভাগের অধ্যাপক এবং নাট্যকার; শহীদুল্লা কায়সার, প্রখ্যাত সাংবাদিক ও ঔপন্যাসিক এবং জহির রায়হান, প্রখ্যাত সাহিত্যিক ও চলচ্চিত্র পরিচালক। মুক্তিযুদ্ধের ডিসেম্বর মাস ছিল খুব কঠিনতর সময়, ৪ ডিসেম্বরে ঢাকায় নতুন করে কারফিউ জারি করা হয়। ১ ডিসেম্বর থেকে বুদ্ধিজীবী হত্যাকাণ্ডের প্রস্তুতি গ্রহণ শুরু করে হানাদার বাহিনী এবং ১৪ ডিসেম্বর এই ঘৃণ্য পরিকল্পনা বাস্তবায়িত হয়। অধ্যাপক, চিকিৎসক, সাংবাদিক, শিল্পী, প্রকৌশলী, লেখক ও দার্শনিকসহ প্রখ্যাত বুদ্ধিজীবীদের পাকিস্তান সেনাবাহিনী এবং তাদের দোসর রাজাকাররা অপহরণ করে নিয়ে যায়। অনেককে তাদের নিজ বাড়ি থেকে তুলে নেওয়া হয়। চোখে কাপড় বেঁধে মিরপুর, মোহাম্মদপুর, নাখালপাড়া, রাজারবাগসহ বিভিন্ন স্থানে আটকে রেখে অকথ্য নির্যাতন শেষে নৃশংসভাবে তাদের হত্যা করে লাশ রায়ের বাজার এবং মিরপুরের বধ্যভূমিতে ফেলে রাখা হয়।

করুণ বিষাদের দিন
বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের নেতৃত্বে মুক্তিযোদ্ধারা স্বাধীন করে দেশ। দেশের মানুষ পায় এক স্বাধীন ভূখণ্ড। তবে এ অর্জন খুব সহজ ছিল না। বাঙালিরা এক স্বাধীন ভূখণ্ড পেলেও গভীর ক্ষত থেকে যায় জাতির হৃদয়ে। ১৪ ডিসেম্বর বাঙালির করুণ বিষাদের দিন। তাঁদের আদর্শে এই দেশকে গড়ে তুলতে পারলে বুদ্ধিজীবীদের ঋণ কিছুটা হলেও পরিশোধ করা সম্ভব। ১৬ ডিসেম্বর আমাদের অহংকারের দিন। তবে এ কথাও ভুলে গেলে চলবে না, এই দিনটিকে অর্জন করতে বাঙালিকে প্রত্যক্ষ করতে হয়েছে ৩০ লাখ প্রাণের বিসর্জন, ধর্ষিত বোনের আহাজারি, বাড়িঘর থেকে উচ্ছেদ ও অগ্নিসংযোগের মতো ঘটনা। ১৪ ডিসেম্বরের শহীদ বুদ্ধিজীবীরা বেঁচে থাকলে বাংলাদেশ অর্থনৈতিক, রাজনৈতিক, সামাজিক, শিক্ষা, সংস্কৃতি, শিল্প-সাহিত্যে অধিকতর অগ্রগতি অর্জন করতে পারতো তা বলা বাহুল্য। মূলত বাঙালির আত্মপরিচয় ও প্রকৃত আদর্শ ধারণের কারণেই এই বুদ্ধিজীবীদের হত্যা করা হয়। বুদ্ধিজীবীদের একটি রাষ্ট্রের বিবেক হিসেবে আখ্যায়িত করা হয়। বিশেষ করে একটি নবগঠিত রাষ্ট্রের জন্য বুদ্ধিজীবীদের ভূমিকা অপরিসীম। কারণ, রাষ্ট্র মানে শুধু একটি ভূখণ্ড নয়। দেশের চিরায়ত সংস্কৃতি, ভাষা, ঐতিহ্য, অর্থনীতি, সমাজের মেলবন্ধনে একটি রাষ্ট্র রূপ পায়। কিন্তু ১৪ ডিসেম্বরের হত্যাকাণ্ড দেশে এক শূন্যতা তৈরি করে, যা স্বাধীনতা উত্তর বাংলাদেশের অর্থনৈতিক, সামাজিক ও রাজনৈতিক উন্নয়নে তথা জাতি গঠনে প্রতিবন্ধকতা সৃষ্টি করে। মুক্তিযুদ্ধের ঘটনাপ্রবাহ দেখলেই স্পষ্ট হয়, বুদ্ধিজীবী হত্যাকাণ্ড কোনও সাময়িক ফলাফলের জন্য সংঘটিত হয়নি। পরাজয় এড়ানোর কোনও পথই যখন অবশিষ্ট ছিল না, তখন এই হত্যাকাণ্ডের ছক কষে পাকিস্তানিরা। পূর্ব পাকিস্তান নামক ভূখণ্ড হাতছাড়া হওয়ার পর এই রাষ্ট্র যেন মাথা তুলে দাঁড়াতে না পারে সে পরিকল্পনার বহিঃপ্রকাশ ছিল ১৪ ডিসেম্বরের এই হত্যাকাণ্ড। এদিন সহস্রাধিক বুদ্ধিজীবীর জীবন কেড়ে নেওয়া হয়। এটি ছিল আসন্ন বাংলাদেশকে মেধাশূন্য ও দুর্বল রাষ্ট্রে পরিণত করার চূড়ান্ত ষড়যন্ত্র।

ষড়যন্ত্র আজও থেমে নেই
জাতির বিবেক বুদ্ধিজীবীদের পরিকল্পিত হত্যা না করা হলে, বাংলাদেশ অনেক আগেই বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের নেতৃত্বে উন্নত দেশ হিসেবে বিশ্বের দরবারে প্রতিষ্ঠা পেতো। পরবর্তীতে দেশরত্ন শেখ হাসিনা দেশকে বিশ্বমহলে সুপ্রতিষ্ঠিত করেছেন। বঙ্গবন্ধুকন্যা বাবার অসমাপ্ত কাজ করে চলেছেন নিষ্ঠার সঙ্গে। স্বাধীনতার পরে দেশের বিরুদ্ধে দোসররা নীলনকশা চালিয়ে গেছে। দেশকে পিছিয়ে দেওয়ার জন্য বঙ্গবন্ধুকে পরিকল্পিতভাবে হত্যা করে। এ হত্যাকাণ্ডের পর স্বাধীনতাবিরোধীরা দীর্ঘদিন দেশের ক্ষমতায় ছিল। তবে বিলম্বে হলেও মুক্তিযুদ্ধের পক্ষের শক্তি রাষ্ট্রীয় ক্ষমতায় এসেছে। রাষ্ট্র পরিচালনার নীতি ও কৌশলে মুক্তিযুদ্ধের চেতনার সম্মিলন ঘটেছে। বঙ্গবন্ধুকন্যা শেখ হাসিনার নেতৃত্বে মুক্তিযুদ্ধের চেতনায় এগিয়ে চলেছে বাংলাদেশ। তবে ডিসেম্বর মাস এলে এখনও একাত্তরের পরাজিত শক্তি মাথাচাড়া দিয়ে উঠতে চায়। সাম্প্রতিককালে দ্বাদশ সংসদ নির্বাচন ঘিয়ে আবারও ষড়যন্ত্র শুরু করেছে জামায়াত-বিএনপি। সারা দেশে আগুনসন্ত্রাস শুরু করেছে তারা। নির্বাচন বানচালের ষড়যন্ত্র করছে তারা। তবে, সব ষড়যন্ত্র শক্তহাতে মোকাবিলা করতে সদা প্রস্তুত আছে মুক্তিযুদ্ধের সপক্ষের শক্তি।  

বাঙালির মহান নেতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের সব নির্দেশনা এ দেশের মানুষ অক্ষরে অক্ষরে পালন করেছিল। তাঁর ৭ মার্চের ভাষণ শুনে জাতি মুক্তিযুদ্ধের প্রস্তুতি নিয়েছিলেন। আর স্বাধীনতার ঘোষণা শুনে মুক্তিযুদ্ধে ঝাঁপিয়ে পড়েছিলেন। বাঙালিরা যখন জয়ের দ্বারপ্রান্তে তখন পরিকল্পিতভাবে বুদ্ধিজীবীদের হত্যা করে পাকিস্তানি হানাদার বাহিনী। যাতে স্বাধীন দেশ বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান ভালোভাবে পরিচালনা করতে না পারেন। এখন মুক্তিযুদ্ধের পরাজিত শক্তি বঙ্গবন্ধুকন্যা দেশরত্ন শেখ হাসিনাকে পরাজিত করতে চাচ্ছে। ১৪ ডিসেম্বর যেমন বুদ্ধিজীবীদের পিছন দরজা দিয়ে আক্রমণ চালিয়ে হত্যা করেছে, ঠিক ২০২৩ সালে ডিসেম্বর মাসে এসেও স্বাধীনতাবিরোধীরা মানুষ পুড়িয়ে হত্যাকাণ্ড চালাচ্ছে। শহীদ বুদ্ধিজীবী দিবসে উপলক্ষে সবার প্রতি আহ্বান জাতির বীর সন্তানদের স্মরণ ও শ্রদ্ধার পাশাপাশি আগুনসন্ত্রাসীদের বয়কট করা হোক।

লেখক: অধ্যাপক; বিজ্ঞান ও তথ্যপ্রযুক্তিবিদ; সদস্য, বাংলাদেশ বিশ্ববিদ্যালয় মঞ্জুরি কমিশন (ইউজিসি); পরিচালক, বাংলাদেশ স্যাটেলাইট কোম্পানি লিমিটেড (বিএসসিএল); সভাপতি, এডুকেশন, রিসার্চ অ্যান্ড ডেভেলপমেন্ট ফোরাম অব বাংলাদেশ (ইআরডিএফবি); প্রতিষ্ঠাতা সহ-সভাপতি, আমরাই ডিজিটাল বাংলাদেশ ফাউন্ডেশন।

/এসএএস/এমওএফ/

*** প্রকাশিত মতামত লেখকের একান্তই নিজস্ব।

বাংলা ট্রিবিউনের সর্বশেষ
পদ্মশ্রী পাওয়া শিল্পী এখন দিনমজুর!
পদ্মশ্রী পাওয়া শিল্পী এখন দিনমজুর!
সিলেটে এয়ার অ্যাস্ট্রার বিজনেস পার্টনার মিট
সিলেটে এয়ার অ্যাস্ট্রার বিজনেস পার্টনার মিট
ডি মারিয়ার সঙ্গে চুক্তির গুঞ্জনে যা বললেন মায়ামি কোচ
ডি মারিয়ার সঙ্গে চুক্তির গুঞ্জনে যা বললেন মায়ামি কোচ
রাজশাহীতে হাসান আজিজুল হক সাহিত্য উৎসব, পদক পাচ্ছেন ৬ জন
রাজশাহীতে হাসান আজিজুল হক সাহিত্য উৎসব, পদক পাচ্ছেন ৬ জন
সর্বশেষসর্বাধিক

লাইভ