X
সোমবার, ২০ মে ২০২৪
৬ জ্যৈষ্ঠ ১৪৩১

শক্তিশালী বিরোধী দল কেন টিকিয়ে রাখতে হয়?

এম আর ইসলাম
১৮ ডিসেম্বর ২০২৩, ১৮:২১আপডেট : ১৮ ডিসেম্বর ২০২৩, ১৮:২১

শক্তিশালী বিরোধী দল ছাড়া যে গণতন্ত্র টিকে থাকে না বা সরকার ব্যবস্থার কোনও নৈতিক বৈধতা থাকে না, স্বাধীনতা উত্তরকালে এই বোধ আজ সবচেয়ে বেশি অনুভূত। রাজতন্ত্র আর ঔপনিবেশিক সাম্রাজ্যবাদের হাত থেকে মুক্ত হয়ে যে রাজনৈতিক পরিকাঠামো বাংলাদেশে পেয়েছে, তা কখনোই খুব মজবুত বা জুতসই কিছু ছিল না। এ দেশে কোনোদিনই কোনও দল বা সরকার শক্তিশালী গণতন্ত্র চায়নি। তার কারণে গণতন্ত্রের পথ রুদ্ধ করা হয়েছে বিভিন্নভাবে। কখনও সরাসরি সামরিক ফরমান জারি করে, কখনও বা সংবিধানের ব্যাপক পরিবর্তন ঘটিয়ে, গণতন্ত্রকে বরাবরই স্তিমিত করা হয়েছে। মাঝে মাঝে তাই মনে হয়েছে, এ দেশে রাজনীতি না বুঝেই বেশিরভাগ লোক রাজনীতিক হয়ে গেছেন। তাই রাজনৈতিক জ্ঞানে আর প্রজ্ঞায় রাজনীতিকরা কখনোই সামগ্রিকভাবে স্বাস্থ্যবান হতে পারেননি।

রাজনীতি বা রাষ্ট্র পরিচালনা কোনও একপক্ষীয় বন্দোবস্ত নয়। রাষ্ট্র তৈরির যেসব রাজনৈতিক দর্শন আছে, তার মধ্যে ব্যাপক চর্চিত আর সমৃদ্ধ তত্ত্ব হচ্ছে, ‘সোশ্যাল কন্ট্রাক্ট থিওরি’। এই তত্ত্ব অনুযায়ী, রাষ্ট্রের বুৎপত্তি হয় রাষ্ট্র আর জনগণের মধ্যকার এক চুক্তির মাধ্যমে। সময়ের পরিক্রমায়, রাষ্ট্র হয়ে ওঠে সরকারের পরিকাঠামো, আর জনগণের এজেন্ট বা মুখপাত্র হয়ে যায় বিরোধী দল। অর্থাৎ সৃষ্টির শুরু থেকেই রাষ্ট্রের মধ্যে চলে পক্ষ-বিপক্ষের খেলা। এই খেলার ময়দান যে দেশে যত মসৃণ আর অবাধ, সেখানে গণতন্ত্র তত সমৃদ্ধ। রাষ্ট্র আর জনগণের হিসাব-নিকাশ শক্তিশালী পার্টি সিস্টেম ছাড়া, রাষ্ট্র দিক হারাতে ব্যর্থ।  

অথচ বিরোধী দল দমনে বা নির্মূলে স্বাধীন বাংলাদেশের স্বাধীন সরকারগুলো যেন পরাধীনকালের ভিনদেশি সরকারগুলোর চেয়ে বেশি নির্দয়। সম্ভবত, হয় তারা রাজনীতি বোঝেন না, অথবা রাষ্ট্রের গণতান্ত্রিক ব্যবস্থার প্রতি তাদের অঙ্গীকার আর বিশ্বাসের ঘাটতি আছে। আওয়ামী লীগের মতো এত বড় আর প্রাচীন দলের আজ কোনও প্রকৃত অর্থের বিরোধী দল ছাড়া সংসদ চালাতে হয়, চালাতে হয় রাষ্ট্র, আর আয়োজন করতে হয় নির্বাচনের। নির্বাচন করতে হচ্ছে নিজের দলের প্রার্থীদের মধ্যে। গোঁড়া আওয়ামী সমর্থকের জন্যও এটা এক অনাকাঙ্ক্ষিত রাজনৈতিক উপাখ্যান। এমন গণতন্ত্র কে চেয়েছিল কোনকালে? এমন নাজুক অবস্থা কোনও রাজনৈতিক দলের জন্যই কল্যাণকর নয়; স্বাস্থ্যকর নয় রাষ্ট্রের জন্যও।

যদিও এ দেশের প্রায় সব ক্ষমতাসীন দল বিরোধী দলগুলোর প্রতি প্রায় সমানভাবেই অসহিষ্ণু ছিল। এরা ফাঁকা ময়দানে গোল দিতে চায় বরাবরই। রাজনৈতিকভাবে প্রতিপক্ষকে মোকাবিলার সাহস দেখাতে ভয় পায়। কোনও ধরনের বিরোধিতা সহ্য করতে পারে না। তাই তো সাংবিধানিকভাবে স্বীকৃত সভা-সমিতির অধিকার, মত প্রকাশের অধিকারগুলোকে সংকুচিত করে তোলে। এই রাজনৈতিক অধিকারগুলোকে বাহারি আইনের শৃঙ্খলায় বেঁধে ফেলে। রাষ্ট্রের আইনশৃঙ্খলা বাহিনীদের বিরোধী দল দমনের কাজে ব্যবহার করা হয়। এমন দমনমূলক আচরণের জন্য হামলা-মামলা হয়ে ওঠে অন্যতম হাতিয়ার। সরকার রূপান্তরিত হয় এক কর্তৃত্ববাদী যন্ত্রে।

অথচ সংসদীয় গণতন্ত্রে, রাজনৈতিক দলগুলোর ভূমিকা সর্বজনীন। এ ব্যবস্থায়  সাংবিধানিকভাবে সরকারের ক্ষমতা চর্চা থাকবে নিয়ন্ত্রিত। এই নিয়ন্ত্রণ তাত্ত্বিকভাবে জনগণের কাছে থাকলেও মূলত তার প্রয়োগ ঘটায় রাজনৈতিক দলগুলো। উন্নত গণতন্ত্রে, কার্যকর বিরোধী দলগুলো ক্ষমতাসীন দলগুলোর চেয়ে কার্যত বেশি ভূমিকা রাখে। সরকারের জবাবদিহি নিশ্চিতের সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ স্থান হয় সংসদ। সরকারের সাওয়াল-জবাবের জন্য বিরোধী দলের সংসদ সদস্যরা মূলত দুঁদে উকিলের ভূমিকায় অবতীর্ণ হয়। সরকার বা ক্ষমতাসীন দলকে প্রশ্নবাণে জর্জরিত করাই এদের মূল কাজ। জনগণের যাবতীয় চাহিদা অনুযায়ী যে নীতিমালা সরকারি দলগুলো নিয়ে থাকে, সেগুলোর ত্রুটি ধরিয়ে দিয়ে সরকারকে মূলত পরোক্ষভাবে সাহায্য করে যায় বিরোধী দলগুলো। সরকারের রাষ্ট্র পরিচালনার যাবতীয় পরিকল্পনাকে পরিশুদ্ধ করে বিরোধী দলের গঠনমূলক সমালোচনা। বাংলাদেশের ক্ষেত্রে এ ভূমিকার কোনও বিকল্প ছিল না। এর কারণ হচ্ছে সংবিধানের ৭০ অনুচ্ছেদ, যার মাধ্যমে এক ধরনের দলীয় দাসত্ব নিশ্চিত করা হয়েছে। নিজ দলের সিদ্ধান্তের বিরোধিতা করা বা তার বিপক্ষে ভোট দেবার ক্ষমতা যখন একজন এমপির থাকে না, তখন নিজ দলের কারও কাছ থেকে সমালোচনা বা গঠনমূলক বিরোধিতা আশা করা সম্ভবপর হয়ে ওঠে না। এ ক্ষেত্রে বিরোধী দলেরাই তাদের প্রাণবন্ত তর্কবিতর্কের মাধ্যমে সংসদীয় কার্যক্রমগুলোকে বেগবান করে ও দলীয় একচেটিয়াকরণ থেকে মুক্ত রাখে।

সরকারকে মূলত জনগণের কাছে জবাবদিহি করে রাখে এই বিরোধী দলগুলো। সরকারের বেপরোয়া গতির বিপরীতে বিরোধী দল মূলত সেফটি ভ্যাল্ভ হিসেবে কাজ করে। জনমত সৃষ্টি করার মাধ্যমে বিরোধী দলগুলো সরকারকে জনগণের দৃষ্টিভঙ্গি বা জনদাবির সঙ্গে পরিচিত করে তোলে।

রাজনৈতিক প্রতিদ্বন্দ্বিতা থাকলে, দলগুলো তাদের নেতৃত্বের সক্ষমতা আর দুর্বলতাও বুঝতে সক্ষম হয়। এই অনুশীলন সর্বোত্তমভাবে করা সম্ভব হয় নির্বাচনকালে। রাজনৈতিক নেতৃত্ব বেরিয়ে আনার এই মাহেন্দ্রক্ষণ নষ্ট হয় যদি বিরোধী দলগুলোর জন্য সমতাভিত্তিক পরিবেশ তৈরি করে না দেওয়া হয়। সুষ্ঠু নির্বাচন আর শক্ত প্রতিপক্ষের অভাবে ক্ষমতাসীন রাজনৈতিক দলগুলোও সক্ষম নেতৃত্ব হারাতে থাকে অথবা যোগ্য নেতৃত্ব তৈরি করতে ব্যর্থ হয়। যেকোনও বৃহৎ রাজনৈতিক দলকে তার নিজের স্বার্থেই সমপর্যায়ের রাজনৈতিক দলগুলোকে পরিচর্যা করতে হয় বা টিকিয়ে রাখতে হয়। তা না হলে, ক্ষমতাসীন দল হয় গতি হারায় অথবা বেপরোয়া হয়, যার কোনোটাই গণতন্ত্রের স্বাস্থ্যের জন্য মঙ্গলজনক নয়। শক্তিশালী পার্টি পলিটিক্সের অভাবে অরাজনৈতিক শক্তিরও উত্থান ঘটে। মোটা দাগে, ক্ষমতাসীন দল ও শক্তিশালী বিরোধী দল উভয়েই গণতন্ত্র বিনির্মাণে ভূমিকা রাখে। তাই বিরোধী দল নির্মূল করতে চাওয়া অথবা বিরোধী দলকে ক্ষমতাহীন করা, অথবা দুর্বল দলকে পোষ্য বিরোধী দলে পরিণত করা, যেকোনও শাসক দলের জন্য আত্মহত্যার শামিল।    

লেখক: অধ্যাপক, জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়

/এসএএস/এমওএফ/

*** প্রকাশিত মতামত লেখকের একান্তই নিজস্ব।

বাংলা ট্রিবিউনের সর্বশেষ
‘বাংলাদেশ দলে খেলতে না পারলে আমি মরে যাবো না‘
‘বাংলাদেশ দলে খেলতে না পারলে আমি মরে যাবো না‘
ডাটাবেজ প্রজেক্টের নামে অনিয়ম-দুর্নীতির অভিযোগ নিষ্পত্তির নির্দেশ
ডাটাবেজ প্রজেক্টের নামে অনিয়ম-দুর্নীতির অভিযোগ নিষ্পত্তির নির্দেশ
১৪ দলের বৈঠক ডেকেছেন শেখ হাসিনা, কী থাকবে এজেন্ডায়?
১৪ দলের বৈঠক ডেকেছেন শেখ হাসিনা, কী থাকবে এজেন্ডায়?
রংপুর মেডিক্যাল ও নরসিংদীর পাঁচদোনা ভূমি অফিসে দুদকের অভিযান
রংপুর মেডিক্যাল ও নরসিংদীর পাঁচদোনা ভূমি অফিসে দুদকের অভিযান
সর্বশেষসর্বাধিক