X
মঙ্গলবার, ৩০ এপ্রিল ২০২৪
১৬ বৈশাখ ১৪৩১

‘ডাইলপুরির মইদ্যে ডাইল নাইকা, হুদা আলু’

আমীন আল রশীদ
৩১ ডিসেম্বর ২০২৩, ২১:৩২আপডেট : ৩১ ডিসেম্বর ২০২৩, ২১:৩২

আব্দুল করিম দ্বিতীয় পুরিটা খায়, খেতে খেতে সে পুনরায় বলে, ‘এই হালারা আলু দিয়া ডাইলপুরি বানায়, ডাইলের দাম বাইড়া যাইতাছে, আপনের লাইগা আমি ডাইল লয়া আমুনে।’

শহীদুল জহিরের ‘কোথায় পাব তারে’ গল্পের আব্দুল করিম ডালপুরির মধ্যে ডালের বদলে আলু থাকা নিয়ে বেশ চিন্তিত। কারণ, তখন ডালের দাম বেড়ে যাচ্ছিল। আর আলু ছিল খুবই সস্তা। এই গল্পটি তিনি লিখেছিলেন ১৯৯৯ সালে। মুশকিল হলো, এখন সেই আলুর দামই ‘বাইড়া যাইতাছে’। ফলে এই সময়ে শহীদুল জহির গল্পটা লিখলে হয়তো সংলাপটা এরকম হতো: ‘আলুপুরির মইদ্যে আলু নাইকা, হুদা ডাইল। আপনের লাইগা আমি আলু লয়া আমুনে।’

সারা পৃথিবীতে সবচেয়ে বেশি প্রয়োজনীয় এবং জনপ্রিয় খাদ্যশস্য আলু। আলুকে বলা হয় ভাত ও রুটির বিকল্প। আলুই একমাত্র খাদ্যপণ্য, যাকে সবচেয়ে বেশি পদ্ধতিতে খাওয়া যায়। যেকোনও মাছ ও মাংসের সঙ্গে তো বটেই, আলাদা করে আলু ভর্তা, আলু ভাজিসহ আলুর বিবিধ রেসিপি আছে।

স্মরণ করা যেতে পারে, বিগত তত্ত্বাবধায়ক সরকারের আমলে চালের সংকট দেখা দিলে তখন ভাতের বিকল্প হিসেবে সরকার আলু খেতে উৎসাহিত করতে নানা কর্মসূচি হাতে নিয়েছিল। এর মধ্যে রাজধানীর আগারগাঁওয়ে বঙ্গবন্ধু আন্তর্জাতিক সম্মেলন কেন্দ্রে আয়োজিত একটি অনুষ্ঠানে আলু দিয়ে প্রায় ৪০ পদের খাবার তৈরির রেসিপি দেখানো হয়েছিল। তখন একটি স্লোগান বেশ জনপ্রিয় হয়েছিল: ‘বেশি করে আলু খান, ভাতের ওপর চাপ কমান।’ অর্থাৎ ভাতে অভ্যস্ত বাঙালির পাতে ভাতের টান পড়লেও অন্তত শর্করার ঘাটতি যাতে না হয় এবং যাতে পেট খালি না থাকে, সেজন্য সবচেয়ে সস্তা খাদ্যপণ্য হিসেবে আলু খাওয়ার পরামর্শ দেওয়া হচ্ছিল।

কৃষিনির্ভর বাংলাদেশের মানুষের কাছে ভাতের পরেই আলুর কদর সবচেয়ে বেশি। এর কারণও একাধিক। যেমন আলু সারা বছরই পাওয়া যায়; আলু সবচেয়ে কম দামি খাদ্যপণ্যের একটি; আলুতে প্রচুর শর্করা থাকে—ফলে যারা কায়িক পরিশ্রম করেন, তারা ভাতের সঙ্গে আলু কিংবা ভাত একটু কম খেলেও আলু দিয়ে সেটি পুষিয়ে নিতে পারেন। আলু যেকোনও সময় যেকোনও পরিস্থিতিতে যেকোনও উপায়ে খাওয়া যায়। শুধু সিদ্ধ করে একটু লবণ দিয়েও খেয়ে ফেলা যায় এবং তাতে বেশ ভালো করেই ক্ষুধা নিবারণ হয়। সম্ভবত পৃথিবীর আর কোনও খাদ্যপণ্য এত দ্রুত মানুষের ক্ষুধা নিবারণ এবং শর্করার চাহিদা মেটাতে পারে না। ফলে নানা কারণেই আলুর প্রতি মানুষের কদর বেশ প্রাচীন। তবে বাংলাদেশের মানুষের কাছে আলুর কদরের প্রধান কারণ এর দাম। কিন্তু সেই আলুর দামই এখন সংবাদ শিরোনাম। শুধু তাই নয়, গণমাধ্যমের খবর বলছে, এক বছরের ব্যবধানে আলুর দাম বেড়েছে ২২৯ শতাংশ। এ মুহূর্তে খুচরা বাজারে আলু বিক্রি হচ্ছে ৮০ টাকার কমবেশি। অথচ গত বছর এই সময়ে আলুর কেজি ছিল মানভেদে ১৬ থেকে ২২ টাকা।

সাধারণত ডিসেম্বর মাসের মাঝামাঝি সময়ে বাজারে নতুন আলু আসে। এরপর এর দাম কমতে শুরু করে। কিন্তু এবার তা হয়নি। উপরন্তু নতুন আলু বাজারে আসায় আগের বছরের পুরোনো আলুর দাম যেভাবে কমার কথা ছিল, তাও কমেনি। বাজারে মাছ-মাংস এবং শীতকালীন সবজির দামও এবার গত বছরের চেয়ে বেশি। ভরা মৌসুমেও রাজধানীর বাজারে প্রতি পিস ফুলকপি চল্লিশ টাকার কমে পাওয়া যায় না। অথচ এই সময়ে প্রতি পিস ফুলকপির দাম ২০ টাকার বেশি হওয়ার কথা নয়। আর বাজারে যখন মাছ মাংস এবং অন্যান্য সবজির দামে বেড়ে যায়, তখন মানুষ ভাতের সঙ্গে অন্তত আলু খেয়ে বাঁচতে চায়। কিন্তু এবার সেই আলুও চলে যাচ্ছে গরিব মানুষের নাগালের বাইরে।

গণমাধ্যমের খবর বলছে, দেশে এবার রেকর্ড পরিমাণ আলুর উৎপাদন হয়েছে। হিমাগারেও আছে ভরপুর মজুত। অথচ বাজারে এর কোনও ছাপ নেই। কারণ কী সিন্ডিকেট? ব্যবসায়ীরা মিলে এক মৌসুমেই শত কোটি টাকার অতিরিক্ত মুনাফা করতে চান?  

বাজার অর্থনীতির সহজ সূত্র হলো, কোনও পণ্যের উৎপাদন ও মজুত পর্যাপ্ত থাকলে সেটির দাম কমবে। কিন্তু অর্থনীতির এই সূত্র মার খায় যদি ব্যবসায়ীরা কারসাজি করে পণ্য বাজারে না ছাড়েন অথবা সিন্ডিকেট করে একটা নির্দিষ্ট জায়গায় দাম আটকে রাখেন। আলুর ক্ষেত্রে সম্ভবত তা-ই হচ্ছে। কেননা বাজারে সবচেয়ে বেশি চাহিদা যে পণ্যের, সেটির দাম বাড়লেও মানুষ সেটি কিনতে চাইবেই। আর ব্যবসায়ীরা মূলত ক্রেতাদের এই দুর্বলতার সুযোগটিই নিয়ে থাকেন।

মুশকিল হলো, আলু কৃষকের কাছ থেকে সরাসরি বাজারে আসে না। মাঠ থেকে তোলার পর সিংহভাগ চলে যায় হিমাগার ও মজুতদারের কাছে। তাদের হাত ধরে তা বাজারে আসে। মাঝখানে বড় একটা সময় থাকে হিমাগারে। প্রায় বছরজুড়ে সংরক্ষণের সময়টাতে ব্যবসায়ীরাই মূলত বাজার নিয়ন্ত্রণ করেন। অনেক হিমাগার মালিকও আবার আলুর ব্যবসার সঙ্গে জড়িত। তারাই হিমাগারে আলু রেখে বাজারে সংকট সৃষ্টি ও সিন্ডিকেট করে দাম বাড়ান।

কৃষক পর্যায় থেকে খুচরা বাজারে ক্রেতার হাতে পৌঁছানোর মাঝখানে প্রতিটি পণ্যের দাম যেভাবে বেড়ে যায় সেটিও বরাবরই একটা বড় তর্কের বিষয়। যেমন চট্টগ্রাম নগরের বাজারগুলোতে খুচরা পর্যায়ে নতুন আলু প্রতি কেজি গড়ে ৭৫ টাকা দরে বিক্রি হচ্ছে। অথচ একই আলু পাইকারি আড়তে বিক্রি হচ্ছে ৪৫ থেকে ৪৭ টাকায় (প্রথম আলো, ২৯ ডিসেম্বর ২০২৩)। কৃষি মন্ত্রণালয়ের হিসাবে প্রতি কেজি আলুর উৎপাদন খরচ সাড়ে ১০ টাকা। অতএব যে পণ্যের উৎপাদন খরচ ১১ টাকার কম, সেই পণ্য খুচরা বাজারে গিয়ে কোন যুক্তিতে ৭০ টাকা কেজিতে বিক্রি হবে? বাজার মনিটরিং বলে কোনও বস্তু কি কার্যকর আছে?

কৃষি মন্ত্রণালয়ের তথ্য বলছে, বছরে আলুর চাহিদা রয়েছে প্রায় ৯০ লাখ টন। আর এ মৌসুমে ফলন আগের বছরের চেয়ে বেশি হয়েছে। ২০২১-২২ অর্থবছরে উৎপাদন হয়েছে ১ কোটি ২ লাখ টন। পরের ২০২২-২৩ অর্থবছরে ১০ লাখ টন বেড়ে উৎপাদন দাঁড়ায় প্রায় ১ কোটি ১২ লাখ টনে। সেই হিসাবে চাহিদার বিপরীতে প্রায় ২২ লাখ টন বেশি উৎপাদন হয়েছে। কিন্তু তারপরও বাজারে এখন আলুর কেজি কোন যুক্তিতে ৭০-৮০ টাকা হবে?

প্রসঙ্গত, আলু উৎপাদনে বাংলাদেশ বিশ্বে সপ্তম আর এশিয়ায় তৃতীয়। অথচ সেই দেশে এখন ভরা মৌসুমে আলুর কেজি ৮০ টাকা বা তার কিছু কমবেশি। ভরা মৌসুমেও আলুর দাম চড়ার কারণ হিসেবে ব্যবসায়ীরা বলছেন, ভারতীয় আলু আমদানি বন্ধ এবং দেশীয় আলুর সরবরাহ কম থাকায় দাম বেড়েছে। প্রশ্ন হলো, বাংলাদেশকে কেন আলু আমদানি করতে হবে? যে পণ্য উৎপাদনে বাংলাদেশের অবস্থান এশিয়ায় তৃতীয় এবং বিশ্বে সপ্তম, সেটিও কেন আমদানি করতে হবে?

বাঙালির প্রধান খাদ্য ভাত। সেই ভাতের কাঁচামাল চালের দাম নিয়েও মানুষের মধ্যে অসন্তোষ দারুণ। বাজারে এখন গরিবের চাল বলে খ্যাত মোটা চালের কেজিও ৫০ টাকা। সুতরাং ‘বেশি করে আলু খান, ভাতের ওপর চাপ কমান’ বলে একসময় যে স্লোগান ছিল সেটিকে এখন উল্টিয়ে ‘বেশি করে ভাত খান আলুর ওপর চাপ কমান’ বলারও সুযোগ নেই। কারণ ভাতের দামও অনেক। তাহলে স্বল্প আয়ের মানুষ কী খেয়ে বাঁচবে?

বলা হয় মানুষের মাথাপিছু আয় বেড়েছে। ক্রয়ক্ষমতা বেড়েছে। এ কথায় ভুল নেই। কিন্তু এটি হচ্ছে মুদ্রার একপিঠ। অন্যপিঠ হলো, যে হারে মাথাপিছু আয় বেড়েছে, নিত্যপণ্যের দাম এবং জীবনযাপনের অন্যান্য খরচ বেড়েছে তার চেয়ে অনেক বেশি। এখন মাসে ৫০ হাজার টাকা আয় করা ব্যক্তিটিও নিম্ন-মধ্যবিত্ত।

সরকারি হিসাব মতে, এখন মাথাপিছু আয় যদি ২ হাজার ৮২৪ ডলারও মেনে নেওয়া হয়, তাহলে বছরে বাংলাদেশের সবচেয়ে কম উপার্জনকারী একজন মানুষের আয় হওয়ার কথা ২ লাখ ৮২ হাজার ৪০০ টাকা। অর্থাৎ মাসে ২৩ হাজার ৫৩৩ টাকা। বাস্তবতা এর চেয়ে ভিন্ন তাতে সন্দেহ নেই। কারণ, যেসব সূচক মাথায় রেখে মাথাপিছু আয় নির্ধারণ করা হয়, সেটি বরাবরই বিতর্কিত এবং সরকারের তরফে যে তথ্য দেওয়া হয়, সেটি কখনোই পুরোপুরি বিশ্বাসযোগ্য নয়। সেই অবিশ্বাস আড়ালে রেখেও যদি এটি মেনে নেওয়া হয় যে এ মুহূর্তে বাংলাদেশের সবচেয়ে কম উপার্জনকারী ব্যক্তিরও মাসিক আয় সাড়ে ২৩ হাজার টাকা, তারপরও তিনি কি এই এই টাকা দিয়ে সংসার চালাতে পারছেন? অন্তত যাদের শহরে বাসা ভাড়া করে থাকতে হয়? যাদের বাসা ভাড়ার বাইরেও পরিবারের ৪-৫ জন সদস্যের খাওয়া, পোশাক, চিকিৎসা/ওষুধ, সন্তানের পড়ালেখা করাতে হয়, তাদের পক্ষে ২৩ হাজার টাকায়ও কি এখন সংসার চালানো সম্ভব? বাস্তবতা হলো, লাখ লাখ মানুষের আয় ১০ হাজার টাকারও নিচে। তাদের সংসারগুলো কীভাবে চলে? তারা কীভাবে চাল-ডাল-আলু-তেল-নুন কেনার পরে পোশাক, চিকিৎসা ও সন্তানের পড়ালেখার খরচ জোগান?

বলা হয়, রাষ্ট্র এসব গরিব মানুষের জন্য ভর্তুকি মূল্যে খাদ্যপণ্য দিচ্ছে। এটিও ঠিক। প্রতিদিন টিসিবির ট্রাকের পেছনে মানুষের যে লম্বা লাইন দেখা যায়, তা দিয়ে দেশের অর্থনীতি সম্পর্কে কিছুটা ধারণা করা যায়। কিন্তু প্রশ্ন হলো, স্বল্পমূল্যে এই খাদ্যপণ্য কত শতাংশ মানুষের কাছে পৌঁছাচ্ছে? আর যে দামে দেওয়া হচ্ছে, সেটিও কি গরিব মানুষের জন্য স্বস্তি বয়ে আনছে? উপরন্তু প্রতিদিন যে পরিমাণ খাদ্যপণ্যের চাহিদা, সেই তুলনায় সরবরাহ কি যথেষ্ট আছে? আছে কী নেই সেই তর্কের সুরাহা হোক বা না হোক, সন্ধ্যা ঘনালে ৬৪ নম্বর বাড়ির আব্দুল আজিজ ব্যাপারির সঙ্গে আব্দুল করিমের পুনরায় দেখা হয় এবং আব্দুল আজিজ ব্যাপারি পুনরায় তাকে ডালপুরি খাওয়ার দাওয়াত দেয়। তখন আব্দুল করিম বলে, ‘আপনে এত ডাইলপুরি খান ক্যালা?’ আব্দুল আজিজ ব্যাপারি বলে, ‘আর কি খামু? বাপ-দাদায় খায়া গেছে, আমিও খাই!’ তখন আব্দুল করিম বলে, ‘ডাইলপুরির মইদ্যে ডাইল নাইকা, হুদা আলু, আপনেরে কইলাম ডাইল আইনা দেই।’

লেখক: কারেন্ট অ্যাফেয়ার্স এডিটর, নেক্সাস টেলিভিশন।

/এসএএস/এমওএফ/

*** প্রকাশিত মতামত লেখকের একান্তই নিজস্ব।

বাংলা ট্রিবিউনের সর্বশেষ
বুয়েটকে হিজবুত তাহরীর-মুক্ত করতে ৬ শিক্ষার্থীর স্মারকলিপি
বুয়েটকে হিজবুত তাহরীর-মুক্ত করতে ৬ শিক্ষার্থীর স্মারকলিপি
বরুণের স্পিনের পর সল্ট ঝড়ে দিল্লিকে হারালো কলকাতা
বরুণের স্পিনের পর সল্ট ঝড়ে দিল্লিকে হারালো কলকাতা
বেতন বৈষম্যে উচ্চশিক্ষার মান হারাচ্ছে বেসরকারি কলেজগুলো
বেতন বৈষম্যে উচ্চশিক্ষার মান হারাচ্ছে বেসরকারি কলেজগুলো
খিলগাঁও তালতলা মার্কেটে ক্যাশলেস লেনদেন চালু
খিলগাঁও তালতলা মার্কেটে ক্যাশলেস লেনদেন চালু
সর্বশেষসর্বাধিক

লাইভ