X
শুক্রবার, ২৬ এপ্রিল ২০২৪
১৩ বৈশাখ ১৪৩১

দিচ্ছে না কেউ জবাব তার!

রেজানুর রহমান
১৪ জুলাই ২০২০, ১৬:৪৭আপডেট : ১৪ জুলাই ২০২০, ১৬:৪৯

রেজানুর রহমান কথায় আছে একটুখানি ভুলের তরে অনেক কিছু ঘটে, ভুল করেছে যারা সবে ভুক্তভোগী বটে।—আমার ধারণা কোথাও যেন মস্তবড় একটা ভুল হয়ে যাচ্ছে। এখনই যদি আমরা সচেতন না হই, তাহলে ভুলটা হয়তো সংশোধন করা মুশকিল হয়ে পড়বে। ভুলটা কী, সেটা কমবেশি সবাই অনুধাবন করতে পারছি। এই নিয়ে কানাঘুষা, ফিসফাস করছি। আকারে, ইঙ্গিতে অনেক কথা বলার চেষ্টা করছি। ‘বোবার শত্রু  নাই’ এই ভেবে অনেকেই চুপ থাকার ভূমিকা পালন করছি। ফলে ভুলের গর্তটা দিনে দিনে অনেক বড় হয়ে যাচ্ছে। এখনই গর্তটা ভরাট করতে না পারলে ভবিষ্যতে হয়তো এই গর্তটাই অনেক সমস্যা, সংকটের কারণ হয়ে দাঁড়াবে।
এখন প্রশ্ন হলো ভুলটা কী? আসুন দেখি সাধারণ মানুষ কী বলে। ঢাকা শহরের একটি রাস্তার মোড়। চায়ের দোকানের সামনে বেঞ্চি দখল করে বসে আছে কয়েকজন নানা পেশার মানুষ। কেউ চা খেতে খেতে, কেউবা বিরস মুখে দোকানের সামনে রাখা বেঞ্চির ওপর বসে অলস আড্ডা দিচ্ছে। তাদেরই একজন বক্তার ভূমিকা নিয়েছে। টেলিভিশনের টকশো স্টাইলে কথা বলছে। অন্যরা মনোযোগী শ্রোতার মতো চুপচাপ তার কথা শুনছে। ‘ভাই আমার কথাটা কিন্তু ক্লিয়ার। আপনি মুখে বলবেন এক কথা, আর করবেন অন্যটা, তাহলে তো হবে না। একটা মানুষ প্রকাশ্যে অপরাধ করলো। তার অপরাধের কারণে শুধু দেশে নয় বিদেশেও আমাদের ভাবমূর্তি ক্ষুণ্ন হচ্ছে। অথচ তাকে গ্রেফতার করা হচ্ছে না। কেন গ্রেফতার করা হচ্ছে না? সমস্যাটা কোথায়? এই যে আমরা একটা ভুল করছি, একদিন হয়তো তার কড়া মাশুল দিতে হবে।

লোকটির কথা শেষ হতে না হতেই উপস্থিত অন্যরা কে আগে কথা বলবে, তার প্রতিযোগিতায় মেতে উঠলো। একজন বয়স্ক লোক সবাইকে থামিয়ে দিয়ে বললো, আপনারা থামেন...আমার একটা কথা আছে। এই দেশে ছোট চোরের বিচার হয়। আর বড় চোরেরা পার পেয়ে যায়। তাকে থামিয়ে দিয়ে অন্য একজন বললো, চোর বলবেন না। বলেন ডাকাইত। ছোট ডাকাইতের বিচার হয়। কিন্তু বড় ডাকাইতের কেউ ‘পশম’ও ছিঁড়তে পারে না। দেশটা বড় বড় ডাকাইতে ভরে গেছে। এবার তাকে থামিয়ে দিয়ে আরেকজন বললো, বিচার হবে কেমন করে? ডাকাইতে ডাকাইতে কিন্তু অনেক মিল। এক ডাকাইত অন্য ডাকাইতকে সমর্থন করে। ফলে অপরাধ অর্থাৎ ভুলের মাত্রাটা বেড়ে যায়। এক সময় ভুলের পাহাড় সৃষ্টি হয়। তখন আর ভুল সংশোধনের সুযোগ থাকে না। এবার তাকে থামিয়ে দিয়ে তরুণ বয়সী একজন উত্তেজিত ভঙ্গিতে বললো, ভাই আমাকে একটা প্রশ্নের জবাব দেন তো...এই যে সাহেদ নামের তথাকথিত একজন ভিআইপি প্রকাশ্যে এতবড় অপরাধ করলো, এখন পর্যন্ত তার বিরুদ্ধে কোনও ধরনের অ্যাকশন না হওয়ার কারণ কী? কারণ হইলো, এই লোক একা কিন্তু অপরাধ করে নাই! দেশের অনেক রথি মহারথিকে সঙ্গে নিয়া জঘন্য অপরাধ করেছে। কাজেই তার বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নেওয়া সহজ হবে না। কারণ ব্যবস্থা নিলে যদি ‘থলের বিড়াল’ বাইর হয়া যায়...

সঙ্গে সঙ্গে চায়ের দোকানের সামনে উপস্থিত সকলেই হই হই করে উঠলো। বললো, কথা ঠিক কথা ঠিক...সাহেদের সঙ্গে দেশের প্রভাবশালী যত মানুষের ছবি প্রকাশ হয়েছে তাতে মনে হয় না সাহেদের বিরুদ্ধে সহজেই কোনও ব্যবস্থা নেওয়া হবে! আর যদি তাই হয় তাহলে আমরা একটা মস্তবড় ভুল করে ফেলবো। গোটা জাতিকে কিন্তু এই ভুলের খেসারত দিতে হবে...

কথাগুলো অতি সাধারণ মানুষের। তারা সহজেই ভুলটা ধরে ফেলেছে। অথচ অসাধারণ মানুষেরা নিশ্চুপ। ভাবটা এমন, কিছুই ঘটেনি। অথবা ‘বোবার শত্রু নাই’ এই মানসিকতায় নিশ্চুপ ভূমিকা পালন করছেন অসাধারণ মানুষেরা। সেই সিঁদ কাটা চোরের গল্পের মতো...গভীর রাতে এক চোর গেরস্তের ঘরের সিঁদ কেটে ঘরে ঢুকেছে। গেরস্তের সামনেই সে ঘরের সিন্দুক ভেঙে সোনা দানা, টাকা পয়সা নিয়ে চম্পট দেয়। চোরের হাতে ধারালো অস্ত্র দেখে গেরস্ত প্রাণভয়ে কিছুই বলে না। পরের দিন পুলিশ গেরস্তকে জিজ্ঞেস করে, আপনার চোখের সামনেই ঘটনাটা ঘটলো অথচ আপনি কিছুই বললেন না? তখন গেরস্তের উক্তি ছিল, আরে ভাই আমি তো বললাম... চোর ব্যাটা শেষ পর্যন্ত কী করে সেটাই তো আমি দেখছিলাম। এখানে আমার ভুলটা কোথায় দেখলেন? বলেন...

সত্যি তো গেরস্তের ভুলটা কোথায়? তিনি তো দেখছিলেন। এই দেখতে গিয়ে তিনি যে নিজের সংসারের সর্বস্ব খুইয়ে বসে আছেন, সেকথা একবারও ভাবেননি। আমাদের সামাজিক ও রাষ্ট্রীয় জীবনেও একই ঘটনা ঘটে চলেছে। অপরাধী অপরাধ করছে। আমরা দেখেও না দেখার ভান করছি। ফলে অপরাধপ্রবণতা বাড়ছে। সাহেদ নামের তথাকথিত ভিআইপির কথাই যদি বলি। চিকিৎসাসেবার নামে মারাত্মক অনিয়ম ও দুর্নীতির নেতৃত্ব দিয়েছেন তিনি। কোভিড-১৯ এর হাজার হাজার ভুয়া সার্টিফিকেট দিয়ে বিদেশে দেশের ভাবমূর্তি ক্ষুণ্ন করেছেন। কোভিড-১৯ এর নেগেটিভ সার্টিফিকেট নিয়ে ইতালিতে যাওয়ার পথে ইতালির বিমানবন্দরেই ‘ধরা’ খান বাংলাদেশের কিছু মানুষ। তাদের পুশব্যাক করা হয়। অর্থাৎ ইতালিতে ঢুকতে না দিয়ে বাংলাদেশে ফিরিয়ে দেওয়া হয়। এই ন্যক্কারজনক ঘটনার পর শুধু ইতালি নয়, অন্যান্য দেশেও বাংলাদেশের মানুষের যাওয়ার পথ বন্ধ হয়ে গেছে। একজন তথাকথিত ভিআইপি সাহেদের অন্যায় কর্মকাণ্ডের বলি হচ্ছে একটা দেশ। অথচ তার বিরুদ্ধে এখন পর্যন্ত দৃশ্যত কোনও ব্যবস্থাই নেওয়া হয়নি। এটা যে কত বড় ভুল হচ্ছে দেশের জন্য তা হয়তো আমরা এখন বুঝতে পারবো না। তবে একদিন এই ভুলের অনেক বড় মাশুল গুনতে হবে। তুষের আগুন সাধারণত দেখা যায় না, বোঝাও যায় না। কিন্তু তলে তলে তুষের আগুন ভয়ংকর হয়ে ওঠে। আমরা কি সেই ভয়ংকরের দিকে পা বাড়াচ্ছি।

একথা সকলেই স্বীকার করবেন, বর্তমানে পৃথিবীব্যাপী স্বাস্থ্যব্যবস্থা নিয়েই মানুষের দুশ্চিন্তা বেশি। সে কারণে দেশে দেশে স্বাস্থ্যব্যবস্থার সততা নিশ্চিত করা হয়েছে। শুধু বাংলাদেশের ব্যতিক্রম। বাংলাদেশে এই মুহূর্তে চরম অনিয়ম ও অস্থিরতার ক্ষেত্র হয়ে উঠেছে স্বাস্থ্যব্যবস্থা। কোনও জবাবদিহি নেই। স্বাস্থ্য মন্ত্রণালয়ের দায়িত্বপ্রাপ্ত মাননীয় মন্ত্রী, সচিব ও স্বাস্থ্য অধিদফতরের ডিজির মধ্যে চলছে ঠান্ডা লড়াই। অথচ করোনার এই সংকটে স্বাস্থ্য মন্ত্রণালয় ও স্বাস্থ্য অধিদফতরের স্বচ্ছতা ও সততা আশা করেছিল দেশের মানুষ। কিন্তু ওই যে ‘চোরে না শুনে ধর্মের কাহিনি’। অবস্থাদৃষ্টে মনে হচ্ছে দেশের স্বাস্থ্যখাত অন্যায়, অনিয়ম ও দুর্নীতির স্বর্গরাজ্যে পরিণত হয়েছে। সে কারণে স্বাস্থ্যখাতে প্রতিনিয়ত অনিয়ম-অনাচারের পাহাড় জমছে। দুর্নীতির পাহাড়কে আড়াল করারও চেষ্টা চলছে পুরোদমে। কিন্তু ‘সাহেদ কাণ্ডের’ ফলে দুর্নীতির পাহাড়টাকে আর আড়াল করা যাচ্ছে না। পাহাড়টা প্রকাশ্যে দেখা যাচ্ছে। কিন্তু দুর্ভাগ্য আমাদের। দুর্নীতির এই পাহাড় কেটে ফেলার কোনোই ইঙ্গিত পাওয়া যাচ্ছে না! অনেকে একে ভুলের পাহাড়ও বলছেন। অবাক না, ভুলেও পাহাড় হয়?

মাটির পাহাড় কেটে ফেলা যায়। কিন্তু ভুলের পাহাড় সহজেই কাটা যায় না। অথচ আমরা আমাদের সমাজ ও রাষ্ট্রীয় জীবনে ভুলের পাহাড়ই বড় করছি। অথচ মাননীয় প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার দূরদর্শী নেতৃত্বে দেশটা উন্নয়ন-অগ্রযাত্রায় অহংকারের সঙ্গেই এগিয়ে যাচ্ছিল। করোনা সংকটে না পড়লে এতদিনে দেশের অবকাঠামোগত অনেক উন্নয়ন আরও দৃশ্যমান হয়ে উঠতো। করোনায় যে মুহূর্তে আমাদের উচিত ন্যায়-নিষ্ঠার পরিবেশ বজায় রেখে একটি কাঙ্ক্ষিত ভোরের অপেক্ষা করা সেখানে আমরা অনেকে প্রকাশ্যে অন্যায়-অনাচার ও দুর্নীতিতে মত্ত হয়ে উঠেছি। সামাজিক অবক্ষয়ের চিত্রটা দিনে দিনে বড় হচ্ছে। দেখি না কী হয়, এই মানসিকতায় অনেকেই অন্যায়, অনিয়ম দেখেও পাশ কাটিয়ে চলছেন। একটাই ভয় সত্য কথা বলতে গিয়ে যদি বিপদে পড়ে যাই! বর্তমান সময়ে দেশ থেকে ‘সত্য’ যেন উধাও হয়ে গেছে। বরং মিথ্যাকে সত্যে পরিণত করার নানান ষড়যন্ত্র শুরু হয়েছে। রিজেন্ট হাসপাতাল ও সাহেদ কাণ্ডের সঙ্গে জড়িত রয়েছে জেকেজি নামে একটি ভুঁইফোঁড় প্রতিষ্ঠান। রিজেন্ট হাসপাতালের সহায়তায় জেকেজিই করোনার মনগড়া রিপোর্ট দিয়ে কোটি কোটি টাকা হাতিয়ে নিয়েছে। জেকেজির চেয়ারম্যান হলেন ডা. সাবরিনা। অথচ গ্রেফতার হওয়ার আগেও তিনি বিভিন্ন প্রচার মাধ্যমে জেকেজির চেয়ারম্যান নন বলে দাবি করেছেন। এ নিয়ে বিভিন্ন প্রচার মাধ্যমের কর্মীদের সঙ্গে দুর্ব্যবহারও করেছেন। একজন অপরাধীর এই ধরনের বেপরোয়া আচরণ ও ঔদ্ধত্য প্রকাশ অনেক প্রশ্নের জন্ম দিয়েছে। কিন্তু এর কোনও জবাব নেই। স্বাস্থ্যখাতে সীমাহীন দুর্নীতি ও মারাত্মক অপরাধ করেও সাহেদ কেন গ্রেফতার হচ্ছেন না এর কোনও জবাব নেই। এমপি পাপুল কী করে এত বড় অপরাধী হয়ে উঠলেন এরও কোনও জবাব নেই! স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয় বলছে ঈদ উপলক্ষে ঢাকা শহরে কোনও পশুর হাট বসবে না। তবুও পশুর হাট বসানোর তোড়জোড় চলছে। কারা এই সাহস দেখাচ্ছেন, এরও কোনও জবাব নেই। করোনার এই দুর্যোগে সামাজিক দূরত্ব মেনে চলার কথা জোর দিয়ে বলা হলেও হাটে বাজারে, রাস্তায় কেউই তা মানছেন না। কেন মানছেন তারাও কোনও জবাব নেই। বাজারে দ্রব্যমূল্যের দাম বাড়ছে। কেন বাড়ছে তারও কোনও জবাব নেই। শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান বন্ধ থাকার পরও কেন সম্পূর্ণ টিউশন ফি দাবি করা হচ্ছে, এই প্রশ্নের জবাবও কেউ দিতে পারছেন না। বারবার সতর্ক করে দেওয়া সত্ত্বেও খাবারে ভেজাল ও ফলমূলে ফরমালিন মিশিয়ে যাচ্ছেন অসাধু ব্যবসায়ীরা। কেন এই ঘৃণ্য কাজ তারা করছেন তারও কোনও জবাব নেই। ফলে সামাজিক জীবনে অজানা এক ভয়ের সৃষ্টি হচ্ছে। এই ভয় করোনার থেকেও শক্তিশালী। এই ভয় থেকে মুক্তির পথ কী? আওয়াজ দিন! জাগো বাহে কোনঠে সবাই!

লেখক: কথাসাহিত্যিক, নাট্যকার, সম্পাদক আনন্দ আলো

 

 

/এসএএস/এমএমজে/

*** প্রকাশিত মতামত লেখকের একান্তই নিজস্ব।

বাংলা ট্রিবিউনের সর্বশেষ
ডুবন্ত শিশুকে বাঁচাতে গিয়ে প্রাণ গেলো আরেক শিশুরও
ডুবন্ত শিশুকে বাঁচাতে গিয়ে প্রাণ গেলো আরেক শিশুরও
‘ডে আফটার টুমরো’ নয়, টুডে
‘ডে আফটার টুমরো’ নয়, টুডে
জিম্মি মুক্তির বিষয়ে আন্তরিক হলেও গাজায় আগে যুদ্ধবিরতি চায় হামাস
জিম্মি মুক্তির বিষয়ে আন্তরিক হলেও গাজায় আগে যুদ্ধবিরতি চায় হামাস
হাসিনা-তাভিসিন আন্তরিক বৈঠক, থাইল্যান্ডের সঙ্গে ৫ দলিল স্বাক্ষর
হাসিনা-তাভিসিন আন্তরিক বৈঠক, থাইল্যান্ডের সঙ্গে ৫ দলিল স্বাক্ষর
সর্বশেষসর্বাধিক

লাইভ