X
শুক্রবার, ২৬ এপ্রিল ২০২৪
১৩ বৈশাখ ১৪৩১

করোনার যুগেও জনসমুদ্র!

রেজানুর রহমান
২২ ফেব্রুয়ারি ২০২১, ১৭:১৩আপডেট : ২২ ফেব্রুয়ারি ২০২১, ২০:০৮

রেজানুর রহমান ‘কতদিন আর ঘরে বসে থাকা যায়? আর তো পারি না। ছেলেমেয়েরা সারাক্ষণ অস্থির থাকে। ঘরের বাইরে বের হতে চায়। স্কুল-কলেজ, বিশ্ববিদ্যালয় বন্ধ। বলতে গেলে পুরো একটা বছর তারা ঘরবন্দি সময় কাটাচ্ছে। এমন তো নয় যে অন্যরাও ঘরবন্দি জীবন কাটাচ্ছে। জীবন-জীবিকার প্রয়োজনে শুধু শিক্ষার্থীরা ছাড়া আর সবাই তো স্বাভাবিক নিয়মেই ঘরের বাইরে বের হচ্ছে। বাজারে ভিড়, অবকাশ কেন্দ্রে ভিড়, নির্বাচনি জনসভায় ভিড়। করোনার সতর্কতায় কেউ তো আর নিয়ম-কানুন মানছে না। আর তাই ছেলেমেয়েদের কোনোভাবেই বোঝানো যাচ্ছে না। তাদের একটাই কথা। সবকিছুই তো খোলা। তাহলে আমাদের শিক্ষা প্রতিষ্ঠান খুলতে সিদ্ধান্ত আসছে না কেন? ছেলেমেয়েদের কথার জবাব খুঁজে পাই না রে ভাই। ওরা তো অযৌক্তিক কথা বলছে না। তবু জবাব খুঁজে পাচ্ছি না। কী যে করি...।’

এটি একজন অভিভাবকের উক্তি। তার তিন ছেলেমেয়ের মধ্যে বড়টা ছেলে। কলেজে পড়ে। মেজটা মেয়ে, নবম শ্রেণির ছাত্রী। সবার ছোট ছেলে। ষষ্ঠ শ্রেণিতে পড়ে। করোনার কারণে প্রায় এক বছর ঘরবন্দি জীবন কাটাচ্ছে। তাদের বাবা-মা কোনোভাবেই এখন আর ঘরবন্দি রাখতে পারছে না। কিছু বললেই দু’কথা শুনিয়ে দেয়। কে ঘরে বসে আছে বল? বাজার ঘাটে তো আগের মতোই ভিড় হচ্ছে। করোনার টিকার জন্য লাইনে দাঁড়াচ্ছে অনেকে। কিন্তু স্বাস্থ্যবিধি মানছে ক’জন?

কথা যে একেবারে অযৌক্তিক তা কিন্তু নয়। দেশের শিক্ষা প্রতিষ্ঠান ছাড়া আর সবই তো খোলা। জাতীয় প্রেসক্লাবের উদ্যোগে ২১ ফেব্রুয়ারি কেন্দ্রীয় শহীদ মিনারে ফুলের শ্রদ্ধার্ঘ্য দিতে গিয়েছিলাম। শ্রদ্ধার্ঘ্য অর্পণ শেষে বেরিয়ে যাচ্ছিলাম শহীদ মিনার প্রাঙ্গণ থেকে। তখনই কয়েকজন কিশোর-তরুণ আমাকে ঘিরে ধরলো। তারা আমার সঙ্গে কথা বলতে চায়। জিজ্ঞেস করলাম তোমরা আমাকে চেনো? ওদের মধ্যে লম্বা মতো ছেলেটি জবাব দিলো– হ্যাঁ, আপনাকে চিনি। টিভিতে আপনাকে দেখি। বাংলা ট্রিবিউনে আপনার লেখা পড়ি। আপনার সঙ্গে একটা কথা বলার ছিল?

ওরা সংখ্যায় পাঁচ জন। কারও মুখে মাস্ক নাই। দু’জনের হাতে মাস্ক ঝুলছে। অন্য তিন জন মাস্ক পকেটে রেখেছে। জিজ্ঞেস করলাম, মাস্ক পরনি কেন? দু’জনের মধ্যে ছেটোখাটো ছেলেটি বলল, এটা বলতে পারেন আমাদের এক ধরনের প্রতিবাদ! চমকে উঠলাম ছেলেটির কথা শুনে। মাস্ক না পরার মাধ্যমে সে কীসের প্রতিবাদ জানাতে চাচ্ছে! তাছাড়া তাদের প্রতিবাদের গুরুত্ব কে-ই বা দিবে?

জিজ্ঞেস করলাম– তোমরা কীসের প্রতিবাদ জানাচ্ছ? ছেলেটি সাথে সাথেই বলল, কর্তৃপক্ষের ঘোষণা বাস্তবায়ন না করার প্রতিবাদ।

অবাক হয়ে আবার জিজ্ঞেস করলাম– কর্তৃপক্ষ কোন ঘোষণা বাস্তবায়ন করেনি?

ওদের মধ্যে চশমা পরা ছেলেটি বলল, ‘স্যার আপনারা বড়রা যা বলেন তার অনেক কিছুই কার্যক্ষেত্রে মানেন না! বলার জন্য বলেন!’

আমার কৌতূহল বেড়ে গেছে। ছেলেটিকে বললাম– আসল ঘটনা বুঝিয়ে বলো!

ছেলেটি এবার প্রতিবাদের সুরে বলল, ‘বলা হয়েছিল করোনার কারণে এবার একসাথে পাঁচ জনের বেশি কোনও গ্রুপ শহীদ মিনারে ঢুকতে পারবে না। মাস্ক পরতে হবে। নিরাপদ দূরত্বে থাকতে হবে। আপনিই বলেন তো কোন নিয়মটা মানা হচ্ছে? কোথায় পাঁচ জনের গ্রুপ? কোথায় মাস্ক পরা মানুষ? নিরাপদ দূরত্ব কি একেই বলে? যে নিয়ম রাখতে পারবেন না সেটা বলেন কেন?

এতক্ষণ বিষয়টা খেয়াল করিনি। ছেলেটির কথা শুনে নতুন করে শহীদ মিনারের চারপাশটা একবার দেখে নিলাম। যে দিকে তাকাই শুধুই মানুষ আর মানুষ। অনেকেরই মুখে মাস্ক আছে। তবে কেউ কেউ থুতনির নিচে মাস্ক ঝুলিয়ে রেখেছে। নিরাপদ দূরত্বের ব্যাপারে কেউই গুরুত্ব দিচ্ছে না। পারে তো একজন অন্যজনের ঘাড়ের ওপর দাঁড়িয়ে যায়।

ছেলেগুলোর মুখের দিকে তাকানোর সাহস পাচ্ছিলাম না। ওরা তো যৌক্তিক কথা বলেছে। আমরা বড়রা যা বলি অনেক ক্ষেত্রে তা মানি না। অথবা বলার জন্য বলি। পাঁচ জনের বেশি কোনও গ্রুপ শহীদ মিনারে ঢুকতে পারবে না। এই যে ঘোষণাটা দেওয়া হলো তার যুক্তি কী? কেউ কি এই ঘোষণা মানবে? ছেলেরা তো সঠিক প্রতিবাদ করেছে। ওদের বললাম– বাবারা স্যরি। একটা ভুল হয়ে গেছে। বড়দের পক্ষ থেকে আমি তোমাদের কাছে ক্ষমা চাইছি। তোমরা আমার একটা কথা শোনো, সবার হাতে তো দেখি মাস্ক রয়েছে। মুখে মাস্ক লাগাও।

সাথে সাথে ওরা মাস্ক পরলো। খুশি মনে বললাম– ধন্যবাদ। চলে আসবো ভাবছি। ওরা আবার ঘিরে ধরলো আমাকে। একজন বললো, ‘স্যার আমাদের আসল কথা তো আপনাকে বলা হয়নি!’

আসল কথা? সেটা কী বলো তো?

ওরা পাঁচ জনই সমস্বরে বলল, আমাদের স্কুল কলেজ কবে খুলবেন বলেন?

অবাক হয়ে বললাম– এই প্রশ্নের উত্তর আমার পক্ষে দেওয়া কী সম্ভব? আমি তো অথরিটির কেউ নই।

বেঁটে মতো ছেলেটি এবার বেশ ক্ষুব্ধ ভঙ্গিতে তার মোবাইল ফোন বের করে একটা ভিডিও দেখাল আমাকে। কক্সবাজারের সমুদ্রসৈকতে তিল ধারণের ঠাঁই নেই। যে দিকে চোখ যায় শুধুই মানুষ আর মানুষ।

ছেলেটি প্রশ্ন করলো– স্যার কী বুঝলেন?

সত্যি বলতে কী, আমি কিছুই বুঝতে পারছিলাম না। ছেলেটি হঠাৎ কক্সবাজারের ভিডিও দেখালো কেন? ছেলেটিই বিষয়টা পরিষ্কার করলো– স্যার আপনারা তো স্বাস্থ্যবিধি মেনে চলার কথা বলছেন। দূরত্ব মেনে চলার পরামর্শ দিচ্ছেন! এটা কি তার নমুনা? কক্সবাজারে এই দৃশ্য দেখে কি বোঝার উপায় আছে দেশে করোনা বলতে কিছু আছে? আমার এক বন্ধু ওর বাবা-মায়ের সাথে কক্সবাজারে ঘুরতে গেছে। সে-ই ভিডিওটা পাঠিয়েছে। কক্সবাজারে নাকি কোনও হোটেলেই সিট খালি নেই। বেড়াতে গিয়ে অনেকে নাকি রাতে খোলা আকাশের নিচে সময় কাটাচ্ছে। স্যার এবার আপনিই বলেন, সবকিছু খুলে দিয়েছেন। মানুষ যে যার মতো ঘুরে বেড়াচ্ছে। ব্যবসা বাণিজ্য করছে। অফিস আদালতে কাজ হচ্ছে। তাহলে শিক্ষা প্রতিষ্ঠান খুলতে বাধা কোথায়? স্যার আমাদের এই কথাগুলো সংশ্লিষ্ট কর্তৃপক্ষের কাছে বলবেন, একটু লিখবেন।

ওদের কথাগুলো শুনে আবারও নিজেকে অপরাধী মনে হলো! না বুঝে, না শুনে আমরা অনেক কিছুই তাদের ওপর চাপিয়ে দেই! একদিকে বলছি সামাজিক দূরত্ব অর্থাৎ ভিড় এড়িয়ে চলুন। অন্যদিকে ভিড়ের মধ্যেই ডুবে যাচ্ছি। কক্সবাজার সমুদ্রসৈকতে জনসমুদ্রের কথাই ভাবুন তো একবার। করোনা অত্যন্ত ছোঁয়াচে রোগ। ওই জনসমুদ্রে একজনেরও যদি করোনার উপসর্গ থেকে থাকে তাহলে সেটাই হবে আশঙ্কার বিষয়। শুধু কক্সবাজারের কথাই বা বলছি কেন। ঢাকায় কেন্দ্রীয় শহীদ মিনারসহ সারাদেশে শহীদ দিবস পালনের যে কর্মসূচি পালিত হয়েছে সেখানেও ছিল না করোনা সতর্কতার কোনও উদ্যোগ, উৎকণ্ঠা। তার মানে পরিবেশ-পরিস্থিতি বলছে দেশ করোনামুক্ত হয়েছে। তাহলে শিক্ষা প্রতিষ্ঠান খুলে দিতে সমস্যা কোথায়?

যদিও বিষয়টি পুরোপুরি সরকারের সিদ্ধান্তের ওপর নির্ভর করছে। তবে শিক্ষা প্রতিষ্ঠান খুলে দেওয়ার দাবি দিনে দিনে বেশ জোরালে হচ্ছে। বিশ্ববিদ্যালয় পর্যায়ে হল খুলে দেওয়ার দাবি উঠেছে। প্রচার মাধ্যমসমূহের খবর– ইতোমধ্যে তালা ভেঙে হলে উঠেছেন জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়ের একদল শিক্ষার্থী। রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়েও হল খোলার দাবি উঠেছে। মঞ্জুরি কমিশনের পক্ষ থেকে বলা হয়েছে, শিক্ষার্থীদের টিকা দেওয়ার পর বিশ্ববিদ্যালয়সমূহ খুলে দেওয়া হবে। কিন্তু সেটা কতদিনে সম্ভব তার কোনও ধারণা দেওয়া হয়নি। ফলে দিনে দিনে মানসিকভাবে অস্থির হয়ে যাচ্ছে শিক্ষার্থীরা। এক্ষেত্রে বড়দের চেয়ে ছোটদের অবস্থা ভয়াবহ। বড়রা নানা কাজের কথা বলে মন চাইলেই ঘর থেকে বের হচ্ছে। কিন্তু ছোটরা সে সুযোগ পাচ্ছে না। বন্ধুদের সাথে লাফালাফি, ঝাঁপাঝাঁপি করে যাদের সময় কাটতো তারা এখন ঘরবন্দি। ফলে অনেকের ক্ষেত্রে মোবাইল ফোনের প্রতি আসক্তি বাড়ছে। সারাক্ষণ মোবাইল ফোন নিয়েই থাকে। একজন অভিভাবক বললেন, ছেলেমেয়েদের ঘরে বসিয়ে রাখা বেশ কঠিন হয়ে যাচ্ছে। দিনে দিনে তাদের মেজাজ খিটখিটে হচ্ছে। কথা বলে বিরক্ত ভঙ্গিতে। আমার বড় ছেলে ৭ম শ্রেণির ছাত্র। ঢাকায় কেন্দ্রীয় শহীদ মিনার ও কক্সবাজারের সমুদ্রসৈকতে জনস্রোত দেখে সে আমার প্রতি মহাবিরক্ত। ‘ঢাকার শহীদ মিনার ও কক্সবাজারে মানুষের ভিড় দেখে তো মনেই হচ্ছে না এই দেশে করোনা আছে। তোমরা শুধু শুধু আমাদের স্কুল বন্ধ রেখেছো। স্কুল খুলে দেওয়ার ব্যবস্থা করো’।

সময়ের বাস্তবতায় শিক্ষা প্রতিষ্ঠান এখনই খুলবে কী খুলবে না সে সিদ্ধান্ত নেবে সরকার। তবে শিক্ষার্থীদের শিক্ষাজীবন ও পাশাপাশি তাদের মানসিক সংকটের দিকটাকেও গুরুত্ব দেওয়া জরুরি। কথা ও কাজের মধ্যে একটা সমন্বয় প্রয়োজন। একদিকে বলছি সামাজিক দূরত্ব মেনে চলুন। ভিড়ের মাঝে যাবেন না। অথচ এই কথা কার্যক্ষেত্রে গুরুত্ব পাচ্ছে না। ফলে শিক্ষার্থীরা দিনে দিনে অস্থির হয়ে উঠছে। অনেকের অভিন্ন বক্তব্য– দলবেঁধে যদি বেড়াতে যাওয়া যায়, জনসমুদ্রে মিশে সমুদ্র স্নান করা যায়, ভোটযুদ্ধের জন্য মিছিল, সমাবেশ করা যায়, তাহলে শিক্ষা প্রতিষ্ঠান খুলতে এত দ্বিধা কেন?

লেখক: কথাসাহিত্যিক, নাট্যকার, সম্পাদক: আনন্দ আলো

/এসএএস/এমওএফ/

*** প্রকাশিত মতামত লেখকের একান্তই নিজস্ব।

বাংলা ট্রিবিউনের সর্বশেষ
যাত্রা শুরু করলো ইউএস-বাংলার ‘এয়ারবাস’
যাত্রা শুরু করলো ইউএস-বাংলার ‘এয়ারবাস’
ব্রাইটনকে উড়িয়ে দেওয়ার পর সতর্ক ম্যানসিটি
ব্রাইটনকে উড়িয়ে দেওয়ার পর সতর্ক ম্যানসিটি
পরিবারের অভাব দূর করতে সিঙ্গাপুরে গিয়ে লাশ হয়ে ফিরলেন রাকিব
পরিবারের অভাব দূর করতে সিঙ্গাপুরে গিয়ে লাশ হয়ে ফিরলেন রাকিব
কেমন চলছে ভারতের লোকসভার দ্বিতীয় দফার ভোট?
কেমন চলছে ভারতের লোকসভার দ্বিতীয় দফার ভোট?
সর্বশেষসর্বাধিক

লাইভ