X
শনিবার, ২৭ এপ্রিল ২০২৪
১৩ বৈশাখ ১৪৩১

করোনার মধ্যে ভিক্ষার প্রতিযোগিতা

আনিস আলমগীর
১৩ এপ্রিল ২০২১, ১৬:৪৬আপডেট : ১৩ এপ্রিল ২০২১, ১৬:৪৬

আনিস আলমগীর সরকার ১৪ এপ্রিল থেকে সারাদেশে ৭ দিনের জন্য সর্বাত্মক লকডাউন বা তালাবন্দি কর্মসূচিতে যাচ্ছে। তবে জরুরি সেবা এবং গার্মেন্টসসহ উৎপাদনমুখী শিল্প খোলা থাকছে। লকডাউন অতি জরুরি হয়ে পড়লেও একশ্রেণির লোক এর বিরুদ্ধে জনমত গড়ার চেষ্টা চালাচ্ছে, সে কারণে বলা যায় না এবারের লকডাউন কতটা সফল হবে। লকডাউন কড়া হচ্ছে না কেন সেই সমালোচনার মধ্যে পড়েছে সরকার। কারণ, প্রতিদিন করোনায় মৃত এবং আক্রান্তের সংখ্যা পূর্ব রেকর্ড ভাঙছে। অন্যদিকে লকডাউনে সবকিছু বন্ধ থাকলে স্বল্প আয়ের মানুষ কীভাবে চলবে প্রশ্ন তুলেছেন অনেকে। কেউ কেউ মনে করছেন লকডাউন না দিয়ে সেনাবাহিনী নামিয়ে মাস্ক পরা, স্বাস্থ্যবিধি মানা বাধ্যতামূলক করা সম্ভব হলে করোনার বিস্তার কমে যাবে।

লকডাউনের খবর আসতেই গার্মেন্টস মালিকদের সংগঠন ১০ হাজার কোটি টাকা প্রণোদনা চেয়ে বসে আছে। গত বছরও এমন পরিস্থিতিতে ২৫ মার্চ জাতির উদ্দেশে দেওয়া ভাষণে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা রফতানিমুখী শিল্প, বিশেষ করে তৈরি পোশাক খাতের জন্য পাঁচ হাজার কোটি টাকার প্রণোদনা প্যাকেজ ঘোষণা করেছিলেন। সেটি বাড়তে বাড়তে সাড়ে ১০ হাজার কোটি টাকা হয়েছিল। এবারও তারা সে পরিমাণ প্রণোদনা দেওয়ার ‘আবদার’ করেছেন।

বাংলাদেশে গার্মেন্টস শিল্পের বয়স এখন প্রায় চল্লিশ বছর। গত চার দশকের মধ্যে গার্মেন্টস সেক্টর একটা শক্তিশালী ভিত্তি প্রতিষ্ঠা করতে পেরেছে। শ্রমিকরা বেঁচে থাকার আশ্রয় পেয়েছে, মালিকরাও সামাজিকভাবে প্রতিষ্ঠিত হয়েছে। বর্তমানে মন্ত্রিসভায় অনেক মন্ত্রী আছেন, সংসদে অনেক এমপি আছেন গার্মেন্টস ব্যবসার সঙ্গে জড়িত। স্বয়ং বাণিজ্যমন্ত্রী টিপু মুন্সি তৈরি পোশাক মালিকদের সংগঠন ফোরাম ও সম্মিলিত পরিষদের যৌথ কমিটির প্রেসিডেনশিয়াল সভাপতি। প্রধানমন্ত্রীর বেসরকারি শিল্প ও বিনিয়োগ উপদেষ্টা সালমান এফ রহমানও এই শিল্পের সঙ্গে আছেন।

বোঝাই যাচ্ছে সংসদ এবং সরকারের মধ্যে বিজিএমইএ সদস্যদের কতটা প্রভাব রয়েছে। সরকারের মধ্যে তাদের প্রভাব আছে সে কারণেই মনে হচ্ছে বিজেএমইএ এখন সরকারের মধ্যে নিজেদের সুপার পাওয়ার কল্পনা করছে। দীর্ঘদিন গার্মেন্টস শিল্পে কোনও অশুভ কার্যকলাপ নেই, শ্রমিক আন্দোলন নেই, অন্তত প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার সরকারের গত ১২ বছর শান্তিপূর্ণভাবে তারা ব্যবসা করছেন। এমন পরিবেশে কারখানা যদি চালু রাখার অনুমতি দিয়ে সরকার তালাবন্দি ঘোষণা করলে নতুন প্রণোদনা লাগবে কেন?

এর আগে প্রণোদনার নামে গার্মেন্টস মালিকদের সরকার দুই শতাংশ হারের সুদে ঋণ দিয়েছে। ছয় মাস পর থেকে একটা নির্ধারিত সময়ের মধ্যে এই টাকা শোধ করার কথা ছিল। সে ঋণ কতটা আদায় হয়েছে সে পরিসংখ্যান কোথাও পেলাম না। যদি খুব অসুবিধা হয় বিজিএমইএ আগের প্রণোদনা থেকে নেওয়া ঋণের টাকা পরিশোধের সময় বাড়ানোর দাবি করতে পারে। নতুন করে ১০ হাজার টাকার প্রণোদনা চাওয়া অন্যায় আবদার, যেহেতু গার্মেন্টস খাতকে লকডাউনের আওতার বাইরে রাখা হয়েছে।

এদিকে, করোনার মধ্যে বইমেলা আয়োজনের ‘শখ’ মেটানোর পর বই প্রকাশকরা তাদের শিল্পকে রক্ষার জন্য সরকারের কাছে ১০০ কোটি টাকার বই ক্রয়ের অনুরোধ জানিয়েছে। প্রকাশকদের পক্ষে প্রধানমন্ত্রীর কাছে খোলা চিঠি লিখেছেন আগামী প্রকাশনীর মালিক ওসমান গনি। বই বিক্রির কোনও হিসাব বাংলা একাডেমি না জানালেও প্রকাশকরা দাবি করছেন ৯০ কোটি টাকা লগ্নি করে তারা এই মেলায় ৩ কোটি ১২ লাখ টাকার বই বিক্রি করেছেন। সারা বিশ্বে বই বেচাকেনার ধরন পাল্টে গেলেও আমাদের প্রকাশকরা মেলাকেন্দ্রিক বই বেচাকেনার মধ্যে সীমাবদ্ধ আছে। নতুন কোনও চিন্তা নেই তাদের। এবার মেলায় নতুন বই প্রকাশ হয়েছে ২৬৪০টি। গতবার নতুন বই প্রকাশের সংখ্যা ছিল ৪৯১৯টি।

তবে ওসমান গণির আবেদন নিয়ে প্রশ্ন তুলেছেন অনেকে। তারমধ্যে দীর্ঘদিন বই প্রকাশনা ব্যবসায়ের সঙ্গে যুক্ত বদিউদ্দিন নাজির কয়েকটি গুরুত্বপূর্ণ প্রশ্ন তুলেছেন। তিনি জানতে চেয়েছেন, কেন বেছে বেছে একটি ব্যবসায়ী মহলকে মদত দিতে সরকারি তহবিল ব্যয় করতে হবে, যেখানে দেশের সব ধরনের ব্যবসা করোনা-কবলিত ও দুর্দশাগ্রস্ত।

দ্বিতীয়ত, ‘সরকার প্রাথমিক বিদ্যালয়ে বঙ্গবন্ধু কর্নার প্রতিষ্ঠার জন্য ১৫০ কোটি টাকার বই কিনেছে। তাই প্রকাশকেরা ইতোমধ্যে ইনসেনটিভ পেয়েছেন। এখন এই বই যাদের জন্য কেনা হয়েছে তাদের পাঠোপযুক্ত হয়েছে কিনা, ওই প্রকল্প থেকে শিশুরা কতখানি লাভবান হয়েছে, সেই টাকা থেকে কয়টি প্রকাশক ও লেখক উপকৃত হয়ে প্রকাশনা শিল্পকে আগুয়ান করেছে, আগে তার একটি নিরপেক্ষ অডিট হওয়া প্রয়োজন ও তার রিপোর্ট জনসমক্ষে প্রকাশ হওয়া প্রয়োজন। এই পুরো প্রক্রিয়ার কতটা স্বচ্ছতার সঙ্গে প্রতিপালিত হয়েছে তারও উল্লেখ প্রয়োজন। আরও প্রয়োজন এই কারণে যে, প্রকল্পটি দেশের একজন মহান নেতার নামে তাঁর জন্মশতবার্ষিকী উপলক্ষে সরকার গ্রহণ করেছিল। এ থেকে প্রাপ্ত অভিজ্ঞতাকে পাশ কাটিয়ে আবারও ১০০ কোটি টাকার বই কেনা অবিবেচনাপ্রসূত হবে।’

বদিউদ্দিন নাজির মনে করেন, সরকার জনগণের ট্যাক্সের টাকায় ১০০ কোটি টাকার বই কিনে নদীতে ফেলে দিতে পারে না। আমাদের National Book Capacity কত সেই তথ্য সরকারের হাতে থাকতে হবে।

অন্যদিকে লকডাউনের মধ্যে সাহায্যের নামে রাস্তায় চাঁদাবাজিতে নেমেছে বিভিন্ন প্রতিষ্ঠান। গরিবদের সাহায্যের নামে আমার বাসার সামনে প্রতি সপ্তাহে মাইক দিয়ে চাঁদা ভিক্ষা করতে আসে ‘খুকুমণি ফাউন্ডেশন’ নামের একটি সংগঠন। এরা ভিক্ষা চাওয়ার আগে চিৎকার দিয়ে বলে- ‘সরকার অনুমোদিত’ ‘সরকার অনুমোদিত’। ফাউন্ডেশন অনুমতি দেওয়া হয়েছে কি মানুষের বাড়ি বাড়ি গিয়ে উচ্চস্বরে মাইক দিয়ে চাঁদা তোলার জন্য? এটা কি সরকারের ফাউন্ডেশন অনুমোদনের নীতিমালার মধ্যে পড়ে? আমি তো জানি পড়ে না। মানুষের অনুভূতিকে কাজে লাগিয়ে এ ধরনের ব্যবসা আর কত চলবে!

বাসার সামনে এক শব্দ প্রতিবন্ধী অর্থহীন বিকট চিৎকার দিয়ে প্রতি সপ্তাহে ভিক্ষা চাইতে আসে রাত ১০টা, সাড়ে ১০টার দিকে। সাপ্তাহিক রুটিন করে প্রতিদিন একক ফকির, দলবদ্ধ ফকির, ফাউন্ডেশন ফকির চিৎকার দিয়ে ভিক্ষা করতে আসে নগরীর বাসায় বাসায়। আবাসিক-অনাবাসিক এলাকার কোনও পার্থক্য নেই এই শহরে। রাস্তায়, গলিতে গলিতে, বাসার সামনে ব্যানে সবজি, মাথায় মাছ, হাতে মুরগি নিয়ে চিৎকার করে ফেরিওয়ালারা। এত ফেরিওয়ালা, এত চান্দা পার্টি আর ফকিরের অসহ্য চিৎকারের অত্যাচারে এই শহর থেকে পালাতে ইচ্ছে করে। দেশে এত ফকির বিরাজমান থাকলে সরকারের আর্থ-সামাজিক উন্নয়ন কর্মসূচির টাকা, করোনায় গরিবদের জন্য বরাদ্দকৃত সাহায্য কাদের পেটে যাচ্ছে?

সরকারের উচিত সরকারি-বেসরকারি ত্রাণের সমন্বয় করা। যারা সাহায্য পাচ্ছে তারা পাচ্ছেই, আর চিৎকার করতে পারছে না বলে অনেকে কষ্টে আছে। মধ্যবিত্তকে নিয়ে কোনও চিন্তাই নেই সরকারের। অনেক লোক এই সময়ে মানবতার সেবায় মানুষের পাশে দাঁড়াতে চায়। কিন্তু তারা কেন ভুঁইফোড় চাঁদাবাজ সংগঠনকে অর্থ দিবে! ধনীদের থেকে, আগ্রহী দান খয়রাতকারীদের থেকে সাহায্য সংগ্রহের সুব্যবস্থা করা দরকার। যেখানে লোকজন চাইলে সাহায্য জমা দিয়ে আসবে বা তারা সাহায্যকারী থেকে সংগ্রহ করবে। দেশ মধ্যম আয়ের দিকে যাচ্ছে, আর গার্মেন্টস মালিক, বই ব্যবসায়ী, এনজিও ব্যবসায়ী, রাস্তার ফকির- সবার ভিক্ষার প্রতিযোগিতায় নামলে দেশ কীভাবে চলবে!

লেখক: সাংবাদিক ও কলামিস্ট, ইরাক ও আফগান যুদ্ধ-সংবাদ সংগ্রহের জন্য খ্যাত।

[email protected]

/এসএএস/এমওএফ/

*** প্রকাশিত মতামত লেখকের একান্তই নিজস্ব।

বাংলা ট্রিবিউনের সর্বশেষ
প্রতিবন্ধী শিল্পীদের আয়োজনে মঞ্চস্থ হলো ‘সার্কাস সার্কাস’ নাটক
প্রতিবন্ধী শিল্পীদের আয়োজনে মঞ্চস্থ হলো ‘সার্কাস সার্কাস’ নাটক
‘শো মাস্ট গো অন’
চিকিৎসা সুরক্ষা আইন জরুরি‘শো মাস্ট গো অন’
ছাদে আম পাড়তে গিয়ে নিচে পড়ে শিশুর মৃত্যু
ছাদে আম পাড়তে গিয়ে নিচে পড়ে শিশুর মৃত্যু
বেয়ারস্টো-শশাঙ্কে হেসেখেলে ২৬২ রান করে জিতলো পাঞ্জাব
বেয়ারস্টো-শশাঙ্কে হেসেখেলে ২৬২ রান করে জিতলো পাঞ্জাব
সর্বশেষসর্বাধিক

লাইভ