X
শুক্রবার, ২৯ মার্চ ২০২৪
১৫ চৈত্র ১৪৩০

অভিভাবকের আয় আনুপাতিক শিক্ষাব্যয় নির্ধারণ কি সম্ভব?

উমর ফারুক
৩০ এপ্রিল ২০২১, ১৫:৩০আপডেট : ৩০ এপ্রিল ২০২১, ১৫:৩০

উমর ফারুক ১৯৯৭ সালের কথা। সদ্য মাধ্যমিক পাস করেছি। বাবা একটি ইটভাটায় হিসাব রাখতেন। সাত ভাই-বোনের সংসার। বড় ভাই একটি স্বায়ত্তশাসিত প্রতিষ্ঠানে ছোট চাকুরে। বেতন কম। সর্বসাকুল্যে হাজার দুয়েক। আমাদের সংসারের অভাবটা বড়। তারচেয়ে বড় অগ্রজের স্বপ্ন। এই অভাবের সংসারে, তিনি স্বপ্ন দেখলেন আমাকে ঢাকা সিটি কলেজে পড়াবেন। চান্সও পেয়ে গেলাম। কিন্তু সে তো অনেক টাকার ব্যাপার! ভর্তি, ফরম পূরণের কথা যদি বাদও দেই, তৎকালীন সময়ে শুধু মাসিক বেতনই ৪০০ টাকা। ঢাকা সিটি কলেজ তখন সারাদেশে সেরাদের সেরা। তখনই ওই কলেজে আধুনিক শিক্ষা যাত্রা শুরু করে। জানি না, অগ্রজ কোথা থেকে এই সাহস পেলেন! অবশেষে আমাকে ঢাকা সিটি কলেজে ভর্তি করা হলো। সেশন ফি, মাসিক বেতন, নাস্তা, যাতায়াত সব মিলিয়ে প্রতিমাসে অনেক টাকার ব্যাপার। প্রতিদিন অফিস থেকে ফিরে, সন্ধ্যাবেলা ভাই টিউশন করতে বেরুতেন। বলতেন, আমার কাজ করতে ভালো লাগে। টিউশনির উদ্দেশ্যে একটু বেরুনো যায়! কথাগুলো ওখানেই শেষ হতে পারতো। কিন্তু হলো না। উচ্চ মাধ্যমিকে ফরম পূরণের সময় জানলাম, আমার হিসাবে মোটা অংকের বকেয়া জমেছে। সব মিলিয়ে ৭/৮ হাজার টাকারও বেশি, যা আমার অভিভাবকের মাসিক আয়ের প্রায় চারগুণ।

পরিসংখ্যান বিভাগের আরেফিন স্যার দয়ালু মানুষ। একখানা দরখাস্ত নিলেন। টাকার পরিমাণ খানিকটা কমলো। সে যাত্রায় বেঁচেও গেলাম। কিন্তু আজও খুব মনে পড়ে, সবার কপালে তো আর আমার মতো এমন সুপ্রসন্ন হয় না। অথচ কী হাস্যকর সমাজ দেখুন, ওই প্রতিষ্ঠানে অনেকেই পেট্রোল পুড়িয়ে আসতো। টিফিনে কি সব নামিদামি খাবার খেতো! আমি ওগুলোর নামও জানতাম না। অথচ দুজনের শিক্ষাব্যয় সমান!

সময়টা আজও বদলায়নি। ওরকমই আছে। আজও পত্রিকার পাতায় দেখতে হয় মেডিক্যালে ভর্তির সুযোগ পেয়েও ভর্তির টাকা জোগাড় করতে পারছে না মেধাবী শিক্ষার্থী। চোখ দুটো ছলছল করে। কিছু দিন আগে এক বৃত্তির ভাইভা বোর্ডে থাকার সুযোগ হয়েছিল। আবেদনকারীদের অত্যন্ত ভয়াবহ অবস্থা দেখে ভেতরে ভেতরে কেঁদেছি। পড়ার ফাঁকে কেউ দিনমজুর দিচ্ছে, কেউ তেলের পাম্পে কাজ করছে, কেউ ইট ভাঙছে। কেউবা মাঝে মাঝেই না খেয়ে কাটাচ্ছে। আমার একজন পরিচিত আছে। হঠাৎ হঠাৎ কোথায় যেন হারিয়ে যায়। একবার জিজ্ঞেস করলাম, কই হারাও বারবার? কিছুটা ইতস্তত হয়ে ছেলেটা জানালো, ‘স্যার একটু সুযোগ হলেই রাজমিস্ত্রির কাজে সাহায্য করতে যাই। ওতেই চলে আমার লেখাপড়া। বাবা-মাকেও অল্পস্বল্প দেই।

আমার ছাত্রজীবনের অভিজ্ঞতা, ভিক্ষা করে সন্তানকে বিশ্ববিদ্যালয়ে পড়িয়েছিলেন একজন। সন্তান রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার্থী আর বাবা সেই বিশ্ববিদ্যালয়েই ভিক্ষা করতেন। সপ্তাহের একটি নির্দিষ্ট দিনে বিশ্ববিদ্যালয়ের পাশের রেললাইনে সন্তানের হাতে পড়ালেখার খরচ তুলে দিতেন। বয়স হয়েছিল, চোখে ভালো দেখতে পেতেন না। শরীরে রোগও বাসা বেঁধেছিল। তবু হাল ছাড়েননি তিনি। কাঁধে ঝোলা, হাতে ছড়ি, আর ভেজা চোখে সন্তানকে বড় করার স্বপ্ন দেখতেন। ভাবতেন এইতো আর মাত্র ক’টা দিন। আমার এক সহপাঠীর বাবা উপজেলা সদরে নাইটগার্ড ছিলেন। মাসে বেতনের দু’হাজার টাকার পুরোটাই সন্তানকে পাঠাতেন। শিক্ষাব্যয়ের সঙ্গে তাল মেলাতে বন্ধুটি খাদ্য তালিকা থেকে এক বেলা মুছে ফেলেছিল। এভাবেই তার শিক্ষাজীবন শেষ হয়েছিল। অথচ রাষ্ট্রীয় কোষাগারে এই ভিক্ষুকের সন্তান, নাইটগার্ডের সন্তানকেও সমপরিমাণ শিক্ষাব্যয়ের টাকা জমা দিতে হয়েছে।

অত্যন্ত দুর্ভাগ্যের বিষয় হলো, আমাদের শিক্ষাব্যয় সবার জন্য সমান। যে শিক্ষার্থী শীততাপ নিয়ন্ত্রিত গাড়ির, পেট্রোল পুড়িয়ে শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে আসছে এবং যে শিক্ষার্থী একবেলা কম খেয়ে পায়ে হেঁটে আসছে, দু’জনের শিক্ষাব্যয় সমান। কী হাস্যকর! কী লজ্জাজনক! শিক্ষাব্যয় নির্ধারণে আমরা কতটা উদাসীন!

প্রতিনিয়ত আমাদের শিক্ষাব্যয় বৃদ্ধি পাচ্ছে। উচ্চশিক্ষায় এই ব্যয় বৃদ্ধির হার আরও বেশি। বিশ্ববিদ্যালয়গুলোতে মাঝে মাঝে এর প্রতিবাদ হয়। কিন্তু খুব একটা উপকারে আসে না। প্রতিদিন শিক্ষাব্যয়ের সঙ্গে তাল মিলিয়ে বাড়ছে জীবনযাত্রার ব্যয়ও। এখন প্রশ্ন হলো, আমাদের শিক্ষাব্যয় কেন সবার জন্য সমান? কেন আমরা শিক্ষাব্যয়ে ভার যৌক্তিকভাবে আরোপ করতে পারিনি? কেন অভিভাবকের আয় আনুপাতিক শিক্ষাব্যয় নির্ধারণ করতে পারিনি? আর এ জন্যই প্রাথমিকভাবে আমাদের কাছে প্রতীয়মান হচ্ছে, শিক্ষাব্যয় সবার জন্য সমান হারে নির্ধারণ করেই বরং আমরা উচ্চবিত্ত ও সাধারণ মানুষের মাঝে এক বিশাল দেয়াল তুলে দিয়েছি। ফলে গরিব মেধাবীরা সব সময় অদম্য মেধাবী হয়ে উঠতে পারছে না, হারিয়ে যাচ্ছে। আর বিনিময়ে ব্যাপকভাবে ক্ষতিগ্রস্ত হচ্ছে আমাদের মেধা খাত।

আজকের সময়ে এসে, ‘শিক্ষা অধিকার না পণ্য’ এই বিষয়ে বিস্তর বিতর্ক করা যেতে পারে। শিক্ষার কতটুকু অধিকার আর কতটুকু পণ্য সেই বিতর্কও হয়তো উঠতে পারে। শিক্ষাব্যয়ের কতটুকু সরকার আর কতটুকু ব্যক্তিকে বহন করতে হবে সে বিতর্কও উঠতে পারে। কিন্তু সামর্থ্য বিবেচনা না করে শিক্ষাব্যয় নির্ধারণ সম্পূর্ণরূপে অবিবেচনাপ্রসূত। অতিরিক্ত ব্যয় (সবার জন্য সমান, অর্থাৎ গরিবের জন্য অতিরিক্ত) বহন করতে গিয়ে কারও শিক্ষাজীবন ব্যাহত করা প্রকৃত শিক্ষাব্যবস্থার লক্ষ্য হতে পারে না। অভিভাবকের আয় ও পারিপার্শ্বিকতা বিবেচনা না করে, তার আর্থসামাজিক অবস্থা বিবেচনা না করে, সবার জন্য সমান শিক্ষাব্যয় নির্ধারণ কোনও বিচক্ষণ ও প্রজ্ঞাবান সিদ্ধান্ত হতে পারে না। যদি আমরা শিক্ষিত জাতি গঠনের মাধ্যমে দারিদ্র্যরেখা ভেঙে ফেলতে চাই, শ্রেণিবৈষম্য ভেঙে ফেলতে চাই, তাহলে সমাজের নিম্নশ্রেণির মানুষের জন্য হ্রাসকৃত মূল্যে বিশেষ শিক্ষাব্যয় নির্ধারণ করতে হবে। খেয়াল রাখতে হবে, কোনও অবস্থাতেই সবার মাঝে সমতার ভিত্তিতে যেন শিক্ষাব্যয় বণ্টিত না হয়, বরং ন্যায্যতার ভিত্তিতে বণ্টিত হতে হবে। ব্যক্তি পর্যায়ের সক্ষমতা বিবেচনা করে শিক্ষাব্যয় নির্ধারণ করতে হবে। পারিবারিক সামর্থ্য ও আঞ্চলিক অর্থনৈতিক চিত্র বিবেচনা করে শিক্ষাব্যয় নির্ধারণ করতে হবে।

বিদেশের কোনও গল্প নয়, বরং দেশের অভ্যন্তরের একটি কলেজের শিক্ষাব্যয়ের উদাহরণ টানা যেতে পারে। বাংলাদেশে ক্যাডেট কলেজগুলোতে শিক্ষাব্যয় নির্ধারিত হয় অভিভাবকের আয় দ্বারা। যে অভিভাবকের আয় যত বেশি তার সন্তানের শিক্ষাব্যয় তত বেশি। উল্টো করে বললে, যে অভিভাবকের আয় যত কম তার সন্তানের শিক্ষা ব্যয় তত কম। একই মানের শিক্ষা গ্রহণ করতে একজন মুদির দোকানিকে যখন নয়শত টাকা ব্যয় করতে হচ্ছে, তখন একজন সচ্ছল ব্যক্তির শিক্ষা ব্যয় কয়েক হাজার টাকা। কিন্তু উভয়ই একই মানের শিক্ষা গ্রহণ করছে। একই পরিবেশে থাকছে, খাচ্ছে। সমগ্র দেশ থেকে কিছু মেধাবীকে তুলে এনে তাদের অভিভাবকের সামর্থ্য অনুযায়ী শিক্ষামূল্য সংগ্রহ করে সমমানের শিক্ষা সবার মাঝে বিলিয়ে দেওয়া হচ্ছে। ক্যাডেট কলেজে শিক্ষার মান নিঃসন্দেহে মানসম্পন্ন। ফলে নির্মমভাবে বললে এর আর্থিক মূল্য কম হওয়ারও কোনও সুযোগ নেই। কিন্তু একবার ভাবুন তো, সবার জন্য যদি সমান শিক্ষাব্যয় নির্ধারণ করা হতো তাহলে কি একজন গরিব মেধাবী ক্যাডেট কলেজে পড়ার সুযোগ পেত?

আমাদের রাষ্ট্রযন্ত্র একজন ভিক্ষুকের সন্তানের কাছ থেকে শিক্ষাব্যয়ের নামে অর্থ হাতিয়ে নিচ্ছে। অবিবেচকের মতো সবার কাছ থেকে সমান শিক্ষাব্যয় নির্ধারণ করছে। ইতোমধ্যে প্রাথমিক শিক্ষাকে বাধ্যতামূলক ও সর্বজনীন করা হয়েছে, যার সুফল আমরা পেতেও শুরু করেছি। কিন্তু উচ্চশিক্ষা ব্যয় সবার জন্য বহনযোগ্য, সহনশীল করতে না পারলে কিংবা গরিব মেধাবী শিক্ষার্থীদের শিক্ষাজীবন নির্বিঘ্ন করতে না পারলে শিক্ষা প্রকৃত আলো ছড়াতে ব্যর্থ হবে। আমাদের শিক্ষা পদ্ধতির সবচেয়ে দুর্বল দিক হলো, সবাইকে সমান অর্থ ব্যয় করে ডিগ্রি অর্জন করতে হয় (বিশেষ দু-একটি ক্ষেত্র ছাড়া)। শিক্ষা ব্যয় নির্ধারণে যৌক্তিকতা আবশ্যক। অভিভাবকের সামর্থ্য বিবেচনায় শিক্ষাব্যয় নির্ধারণ করা আজ সময়ের দাবি। শিক্ষাব্যয় নির্ধারণে সমাজশ্রেণি বিবেচনায় ন্যায্য ব্যয় নির্ধারণ করা আজ সময়ের দাবি। ধনী-গরিব-মেধাবী বিবেচনায় যৌক্তিক ব্যয় নির্ধারণ শিক্ষায় সহায়ক ভূমিকা রাখতে পারে। অভিভাবকের আয় আনুপাতিক শিক্ষাব্যয় সমাজে প্রকৃত শিক্ষার আলো ছড়াতে পারে, আর তা না হলে আর মুখ থুবড়ে পড়বে আমাদের আর্থিকভাবে পিছিয়ে পড়া মেধাবীরা। রাষ্ট্র যেভাবে সবার প্রাথমিক শিক্ষার দায়িত্ব নিয়েছে, সেভাবে গরিব মেধাবীদের উচ্চশিক্ষা অথবা বিশেষায়িত শিক্ষা অথবা টেকনিক্যাল শিক্ষার দায়িত্বও নিক। অভিভাবকের আয় আনুপাতিক শিক্ষাব্যয় নির্ধারণ করা ছাড়া আমাদের প্রকৃত মুক্তি সম্ভব নয়।

 লেখক: শিক্ষক, অ্যাকাউন্টিং অ্যান্ড ইনফরমেশন সিস্টেমস বিভাগ, বেগম রোকেয়া বিশ্ববিদ্যালয়, রংপুর।

ই-মেইল: [email protected]

/এসএএস/এমওএফ/

*** প্রকাশিত মতামত লেখকের একান্তই নিজস্ব।

বাংলা ট্রিবিউনের সর্বশেষ
ফিরেই ফর্টিসকে বিধ্বস্ত করলো মোহামেডান
ফিরেই ফর্টিসকে বিধ্বস্ত করলো মোহামেডান
লঞ্চঘাটের পন্টুন থেকে পদ্মা নদীতে পড়ে যুবকের মৃত্যু
লঞ্চঘাটের পন্টুন থেকে পদ্মা নদীতে পড়ে যুবকের মৃত্যু
রাশিয়ায় বন্ধ হলো জাতিসংঘের নজরদারি সংস্থার কার্যক্রম
রাশিয়ায় বন্ধ হলো জাতিসংঘের নজরদারি সংস্থার কার্যক্রম
ওজন কমিয়ে সাকিব পুরো ফিট, সন্তুষ্ট সহকারী কোচ
ওজন কমিয়ে সাকিব পুরো ফিট, সন্তুষ্ট সহকারী কোচ
সর্বশেষসর্বাধিক

লাইভ