X
সোমবার, ০৭ জুলাই ২০২৫
২৩ আষাঢ় ১৪৩২

রোজিনার বিরুদ্ধে মামলাটি কি বৈধ?

আমীন আল রশীদ
২০ মে ২০২১, ১৬:০৭আপডেট : ২০ মে ২০২১, ১৬:০৭

আমীন আল রশীদ জনপ্রিয় ও প্রভাবশালী সংবাদপত্র প্রথম আলোর সিনিয়র রিপোর্টার রোজিনা ইসলামের বিরুদ্ধে অফিসিয়াল সিক্রেটস অ্যাক্টে যে মামলা হয়েছে, সেই মামলা কতদিন চলবে, গোয়েন্দা পুলিশ কবে মামলার রিপোর্ট দেবে, মামলার পরিণতি কী হবে, রোজিনা ইসলামকে দোষী সাব্যস্ত করা হবে নাকি তিনি নির্দোষ প্রমাণিত হবেন, সচিবালয়ে আটকে রাখার সময় তার সঙ্গে কর্মকর্তা-কর্মচারীদের যেসব কথাবার্তার ভিডিও এরইমধ্যে প্রচার শুরু হয়ে গেছে, এমনকি কিছু ফোনকল রেকর্ডও যেভাবে ফাঁস করা হচ্ছে—তাতে পুরো ঘটনাটি কোথায় গিয়ে দাঁড়াবে, তা এখনই বলা মুশকিল। কিন্তু তার বিরুদ্ধে স্বাস্থ্য মন্ত্রণালয় যে মামলাটি করেছে, সেটির বৈধতা নিয়েই প্রশ্ন রয়েছে।

পাঠকরা এরইমধ্যে জেনেছেন যে ১৭ মে দুপুরে রোজিনা ইসলামকে স্বাস্থ্য সচিবের একান্ত সচিবের কক্ষে পাঁচ ঘণ্টারও বেশি সময় ধরে আটকে রাখা হয় এবং এই সময়ে তাকে শারীরিকভাবে লাঞ্ছিত করা হয়েছে বলেও অভিযোগ উঠেছে। অবশেষে মধ্যরাতে তাকে শাহবাগ থানায় নেওয়া হয় এবং অফিসিয়াল সিক্রেটস অ্যাক্টে মামলা দিয়ে পরদিন সকালে আদালতে পাঠানো হয়। পুলিশ জিজ্ঞাসাবাদের জন্য পাঁচদিন রিমান্ডের আবেদন করলেও আদালত তা নাকচ করে দিয়ে রোজিনাকে কারাগারে পাঠানোর আদেশ দেন।

ব্রিটিশ আমলে তৈরি অফিসিয়াল সিক্রেটস অ্যাক্ট নিয়ে বিতর্ক বহুদিনের। এটিকে ‘কালা কানুন’ বলেও অভিহিত করা হয়। কারণ, এই আইনের দোহাই দিয়ে জনস্বার্থ সংশ্লিষ্ট তথ্যও সরকারি কর্মচারীরা গোপন করে রাখেন। ধারণা করা হয়েছিল, ২০০৯ সালে তথ্য অধিকার আইন পাস হওয়ার ফলে এই বিতর্কিত আইনটি বোধ হয় অকার্যকর হয়ে যাবে। কারণ, আধুনিক বিশ্ব তথ্য গোপন নয়, বরং তথ্য প্রকাশের।

এই আইনে বলা হয়েছে, যদি কোনও ব্যক্তি রাষ্ট্রের নিরাপত্তা এবং স্বার্থের পরিপন্থী কোনও উদ্দেশ্য নিয়ে গুপ্তচরবৃত্তি করেন তাহলে তার শাস্তি হবে। সরকার কর্তৃক নিষিদ্ধ কোনও এলাকায় গমন করেন, পরিদর্শন করেন বা ভেতরে প্রবেশ করেন, তাহলে শাস্তি হবে। কিন্তু সচিবালয় কোনও নিষিদ্ধ জায়গা নয়। সেখানে সাংবাদিকদের প্রবেশাধিকারের জন্য সরকার পরিচয়পত্র দিয়েছে এবং সরকার জানে যে সেখানে সাংবাদিকরা তথ্য সংগ্রহের জন্য যাবেন। আর সাংবাদিকরা যেভাবে, যে প্রক্রিয়ায় তথ্য সংগ্রহ করেন, সেটিকে কোনোভাবেই গুপ্তরচরবৃত্তি বলার সুযোগ নেই। এই আইনটি করা হয়েছে মূলত সরকারি কর্মচারীদের জন্য, যাতে তারা প্রশাসনের কোনও গোপন নথি বা তথ্য পাচার বা প্রকাশ করতে না পারেন। এটি সাংবাদিকদের জন্য প্রযোজ্য হতে পারে না।

জনগণের করের পয়সায় রাষ্ট্র কীভাবে চলছে; তাদের পয়সা কোথায় কীভাবে খরচ হচ্ছে; গণকর্মচারীরা কী করছেন—তা জানা প্রত্যেকটি নাগরিকের অধিকার। সুতরাং অফিসিয়াল সিক্রেটস অ্যাক্টের দোহাই দিয়ে যাতে তথ্য গোপন করা না হয়, সেজন্যই তথ্য অধিকার আইন পাস করা হয়। এই আইনের আলোকে সুনির্দিষ্টভাবে রাষ্ট্রীয় নিরাপত্তার স্বার্থে কিছু তথ্যের বাইরে সব তথ্যই জনগণ ও গণমাধ্যমকে জানাতে সরকারি কর্মচারীরা বাধ্য। কিন্তু বিস্ময়করভাবে দেখা গেলো যে সেই বিতর্কিত অফিসিয়াল সিক্রেটস অ্যাক্টেই একজন স্বনামধন্য অনুসন্ধানী সাংবাদিককে গ্রেফতার করা হলো যখন দেশের মানুষ স্বাধীনতার সুবর্ণজয়ন্তী উদযাপন করছে; যখন দেশের মানুষ জাতির জনকের জন্মশতবর্ষ উদযাপন করছেন; যখন মুক্তিযুদ্ধে নেতৃত্বদানকারী দল আওয়ামী লীগ রাষ্ট্র ক্ষমতায় এবং জাতির জনকের কন্যা যখন সরকারপ্রধান—এর চেয়ে লজ্জার কিছু হতে পারে না।

অনুসন্ধানী সাংবাদিকতা তথা রাষ্ট্রীয় বড় কোনও অন্যায়ের খবর জনগণকে জানানো গণমাধ্যমের দায়িত্ব। একজন সাংবাদিক যদি সরকারি কোনও নথির ফটোকপি নেন বা ছবি তোলেন, সেটি কোনোভাবেই চুরি বা অপরাধের পর্যায়ে পড়ে না। সুতরাং এটি জোর দিয়েই বলা উচিত যে রোজিনা ইসলামের বিরুদ্ধে যে অভিযোগে মামলা দিয়ে তাকে জেলখানায় পাঠানো হয়েছে, সচিবালয়ের আটকে রেখে তাকে যেভাবে হেনস্তা করা হয়েছে, সেটি সুস্পষ্টভাবে স্বাধীন ও অনুসন্ধানী সাংবাদিকতার ওপরে চরম আঘাত। এ ধরনের ঘটনার মধ্য দিয়ে রাষ্ট্রের অসৎ, দুর্নীতিবাজ ও গণবিরোধী সরকারি কর্মচারীরা এমন একটি ভয়ের পরিবেশ সৃষ্টি করতে চায়, যাতে সাংবাদিকরা কোনও ধরনের অনিয়ম ও দুর্নীতির খবর প্রকাশে সাহস না পান। তারা সচিবালয়সহ রাষ্ট্রের গুরুত্বপূর্ণ স্থাপনাসমূহে সাংবাদিকদের প্রবেশ সীমিত বা সম্ভব হলে পুরোপুরি নিষিদ্ধ করতে চায়, যাতে তারা নির্বিঘ্নে জনগণের টাকা লুটপাট করতে পারে। কিন্তু এরকম একজন দুজন বা আরও বেশি সাংবাদিকের কণ্ঠরোধ করে অনুসন্ধানী সাংবাদিকতার দরজা বন্ধ করা কঠিন।

রোজিনা ইসলাম দীর্ঘদিন ধরে সচিবালয়কেন্দ্রিক সরকারি কর্মচারীদের অনিয়ম-দুর্নীতি ও লুটপাটের সংবাদ বস্তুনিষ্ঠ, নিরপেক্ষতা ও সাহসিকতার সঙ্গে প্রকাশ করে আসছেন। যে কারণে তিনি ওইসব অসৎ ও দুর্নীতিবাজ কর্মকর্তা-কর্মচারীর টার্গেটে ছিলেন।

রোজিনার বিরুদ্ধে মামলার বাদী স্বাস্থ্য মন্ত্রণালয়ের উপ-সচিব শিব্বির আহমেদ ওসমানী। এজাহারের যে ছবি গণমাধ্যমে প্রকাশিত হয়েছে, তাতে তার যে স্বাক্ষর দেখা যাচ্ছে, সেটি তার আসল স্বাক্ষর নয়। স্বাস্থ্য মন্ত্রণালয়ের পরিপত্রে তার যে স্বাক্ষর, তার সঙ্গে মামলার এজাহারে দেওয়া স্বাক্ষরের ফারাক আকাশ-পাতাল। মানুষের স্বাক্ষর নানা কারণে একটু এদিক-সেদিক হয়। সেটা ব্যক্তির মুড, কাগজ বা কলমের কারণে। অনেক সময় দ্রুত স্বাক্ষর দিতে গেলেও কিছুটা হেরফের হয়। কিন্তু এজাহারে শিব্বির আহমেদের যে স্বাক্ষর, তার সঙ্গে তার আসল স্বাক্ষরের কোনও মিল নেই। তার মানে এটা পরিষ্কার যে শিব্বির আহমেদ স্বাক্ষর করেননি। কেন করেননি? সচিব বা ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তাদের নির্দেশেই যদি মামলার বাদী হন, তাহলে তিনি কেন স্বাক্ষর করলেন না? তিনি কি বাদী হতে চাননি? আবার যেদিন এই মামলা হয়েছে, তার পরদিনই শিব্বির আহমেদসহ দুই কর্মকর্তার দফতর বদলের আদেশ হয়। আবার সেই আদেশ প্রত্যাহারও করা হয়। কেন এই নাটকীয়তা—তা নিয়েও অনুসন্ধান জরুরি।

মামলায় রোজিনা ইসলামের মতো একজন ডাকসাইটে সাংবাদিকের পরিচয় যেভাবে লেখা হয়েছে, সেটিও অত্যন্ত অবমাননাকর। তাকে রিমান্ডে নিয়ে আদালতে পুলিশ যে আবেদন জানিয়েছে, তার ভাষা আরও অবমাননাকর। সেখানে লেখা হয়েছে, ‘আসামি কর্তৃক চোরাইকৃত নথিপত্র রাষ্ট্রীয় সরকারি গুরুত্বপূর্ণ গোপনীয় দলিল, যা জনসমক্ষে প্রচার করা হইলে সংশ্লিষ্ট দেশসমূহের সাথে বাংলাদেশের সম্পর্ক নষ্ট হয়ে যাওয়ার আশঙ্কা রয়েছে।’ রিমান্ড আবেদনে আরও লেখা হয়েছে, ‘আসামিকে জামিনে মুক্তি দিলে চিরতরে পলাতক হওয়ার সমূহ সম্ভাবনা রয়েছে। তাই তাকে ব্যাপক ও নিবিড় জিজ্ঞাসাবাদের জন্য পাঁচ দিনের রিমান্ডে পাওয়া একান্ত প্রয়োজন।’ পুলিশ এখানে ‘ব্যাপক’ ও ‘নিবিড়’ জিজ্ঞাসাবাদ বলতে কী বুঝিয়েছে—তা সাধারণ মানুষও বোঝে। রিমান্ডে নিয়ে পুলিশ কী করে, সেটা সবাই জানে। রাষ্ট্রের সম্মানিত ও গুরুত্বপূর্ণ ব্যক্তিদেরও রিমান্ডে পুলিশ যে নির্মম নির্যাতন করে, সেটি গোপন কোনও বিষয় নয়।

রিমান্ড আবেদনে একজন সাংবাদিককে ‘ধৃত আসামি’ বলে উল্লেখ করা হয়েছে। স্বাধীনতার সুবর্ণজয়ন্তীতে এসেও রাষ্ট্রের সবচেয়ে বড় আইনশৃঙ্খলা বাহিনী পুলিশ কেন নাগরিকদের সম্মান করতে শিখলো না, তাদের মধ্যে যে ন্যূনতম ভদ্রতা ও শালীনতা তৈরি হলো না, সেটিও বিরাট প্রশ্ন।

মামলার এজাহার ও রিমান্ড আবেদনে বলা হয়েছে, ‘নথিপত্র রাষ্ট্রীয় সরকারি গুরুত্বপূর্ণ গোপনীয় দলিল।’ প্রশ্ন হলো, তথ্য যদি এতই গোপন হয়, তাহলে সেটি কী করে স্বাস্থ্য সচিবের একান্ত সচিবের কক্ষে এমনভাবে থাকলো যে একজন সাংবাদিক ভেতরে ঢুকেই সঙ্গে সঙ্গে মোবাইল ফোনে ছবি তুলতে পারলেন বা সেই কাগজ নিজের ব্যাগে ভরে ফেললেন? বরং যদি ওই নথি বা ডকুমেন্ট এতটাই গোপনীয় হয়ে থাকে যে, এই তথ্য প্রকাশিত হলে রাষ্ট্রের ভাবমূর্তি নষ্ট হবে বা কোনও রাষ্ট্রের সঙ্গে বাংলাদেশের সম্পর্ক খারাপ হবে, তাহলে সেই তথ্য বা নথির সুরক্ষা দিতে ব্যর্থতার দায়ে তো সংশ্লিষ্ট কর্মকর্তা-কর্মচারীদের বিরুদ্ধেই অফিসিয়াল সিক্রেটস অ্যাক্টে মামলা হওয়া উচিত। কারণ, তারা অফিসের সিক্রেসি বজায় রাখতে ব্যর্থ হয়েছেন।

মনে রাখা দরকার, সাংবাদিকদের মূল শক্তিই হচ্ছে সোর্স। যার সোর্স যত বেশি এবং যত শক্তিশালী, তিনি তত বড় সাংবাদিক। বলাই হয়, প্রথমে সংবাদের কাছে সাংবাদিককে যেতে হয়, কিন্তু একসময় সংবাদই সাংবাদিকের কাছে আসে। প্রথম আলোর মতো সংবাদপত্রের রিপোর্টারদের হাতে প্রতিনিয়তই এমন অসংখ্য রিপোর্ট বা রিপোর্টের ক্লু আসে, যার অনেক কিছুই প্রথম আলো বা এরকম প্রভাবশালী সংবাদপত্রগুলো প্রকাশ করে না—যতক্ষণ না পর্যাপ্ত তথ্যপ্রমাণ এবং সংশ্লিষ্ট সব পক্ষের বক্তব্য পাওয়া যায়।

রোজিনা ইসলাম শুধু নন, সচিবালয়সহ রাষ্ট্রের গুরুত্বপূর্ণ অন্যান্য প্রতিষ্ঠানে কর্মরত তার মতো আরও অনেক সাংবাদিকেরই অসংখ্য সোর্স আছেন। সেই সোর্স কখনও সচিব, কখনও উপ-সচিব, কখনও আরও নিচু স্তরের কর্মকর্তা এমনকি অফিসের পিয়ন ও নৈশপ্রহরীরাও বড় বড় খবরের সন্ধান দেন। মানে তারাও সোর্স। সুতরাং কোন তথ্যটি একজন সাংবাদিক কোন কৌশলে বা কোন প্রক্রিয়ায় বের করে নিয়ে আসবেন অথবা কোন সোর্স কোন প্রক্রিয়ায় তথ্যটি সাংবাদিককে দেবেন, সেটি ব্যক্তিভেদে নির্ভর করে।

এসব নথি সাধারণত অফিসের কোনও না কোনও স্তরের কর্মচারীরাই সাংবাদিকদের সরবরাহ করেন। কখনও সেটি ফটোকপি করে, কখনও মোবাইল ফোনে ছবি তুলতে দিয়ে, কখনও বা সাংবাদিককে মেইল বা হোয়াটসঅ্যাপে দিয়ে। এসব তথ্য পাওয়ার ক্ষেত্রে সাংবাদিকরা সোর্স গোপন রাখেন। সাংবাদিকতায় সোর্স এতটাই গুরুত্বপূর্ণ এবং সোর্সের গোপনীয়তা রক্ষা করা এতটাই সিরিয়াস বিষয় যে, সাংবাদিক কোনও অবস্থাতেই তার সোর্সের নাম বলবেন না যদি সেটি অতি গোপনীয় হয় এবং সোর্স যদি তাকে অফ দ্য রেকর্ডে তথ্যগুলো দেন।

সোর্সরা সাংবাদিকদের এসব তথ্য দেন নানা কারণে। কেউ দেন সাংবাদিকের সঙ্গে সুসম্পর্কের খাতিরে; কেউ দেন তার প্রতিদ্বন্দ্বী কর্মীদের দুর্নীতির খবর জানাতে এবং সৎ ও দেশপ্রেমিক কর্মীরা সাংবাদিকদের তথ্য দেন দেশের স্বার্থে—যাতে দেশের মানুষ আসল ঘটনা জানতে পারেন। যাতে দেশের বড় ধরনের ক্ষতি না হয়। কিন্তু অফিসিয়াল সিক্রেটস অ্যাক্টের দোহাই দিয়ে যদি সরকারি অফিসের লোকজন সাংবাদিকদের তথ্য দেওয়া বন্ধ করে দেন, তাহলে দেশে অনুসন্ধানী সাংবাদিকতা বলে আর কিছু থাকবে না। তখন প্রেস রিলিজ ও ব্রিফিংয়ের বাইরে কোনও সংবাদ হবে না। সরকারি কর্মকর্তা-কর্মচারীদের একটা বড় অংশই চান এভাবে অনুসন্ধানী সাংবাদিকতার মৃত্যু হোক। কারণ, অনুসন্ধানী সাংবাদিকতা না থাকলে তাদের অনিয়ম, চুরি ও লুটপাটের খবর সাংবাদিকরা জানবে না।

সংবিধানের ৭(১) অনুচ্ছেদে স্পষ্ট বলা আছে, প্রজাতন্ত্রের সকল ক্ষমতার মালিক জনগণ। সুতরাং সেই জনগণের স্বার্থসংশ্লিষ্ট কোনও তথ্যের ছবি যদি একজন সাংবাদিক ফটোকপি করে বা মোবাইল ফোনে ধারণ করে নিয়ে আসেন, সেটি কী করে চুরি হয়? কী করে সেই সাংবাদিকের বিরুদ্ধে অফিসিয়াল সিক্রেটস অ্যাক্টে মামলা হয়, যদি না সেই তথ্যটি প্রকাশের ফলে রাষ্ট্রের গোপনীয়তা ক্ষুণ্ন হয় বা বিদেশি কোনও রাষ্ট্রের সঙ্গে সম্পর্কের অবনতি হয়।

২০১১ সালের জনস্বার্থ সংশ্লিষ্ট তথ্য প্রকাশ (সুরক্ষা প্রদান) আইনে পরিষ্কার বলা আছে যে, ‘কোনও তথ্য প্রকাশকারী উপযুক্ত কর্তৃপক্ষের নিকট, যুক্তিযুক্ত বিবেচনায়, জনস্বার্থ সংশ্লিষ্ট সঠিক তথ্য প্রকাশ করিতে পারিবেন। আইনে এও বলা আছে যে, তথ্যের সত্যতা সম্পর্কে বিশ্বাস করিবার যুক্তিসঙ্গত কারণ না থাকিলেও তিনি যদি এরূপ বিশ্বাস করেন যে, তথ্যটি সত্য হইতে পারে এবং তথ্যের গুরুত্ব বিবেচনা করিয়া উহার সত্যতা যাচাই করা সমীচীন, তারপরও তিনি এই তথ্য প্রকাশ করতে পারবেন।’ তার মানে জনস্বার্থ সংশ্লিষ্ট তথ্য প্রকাশে সাংবাদিকের কোনও আইনি বাধা নেই। যদি জনস্বার্থ সংশ্লিষ্ট তথ্য প্রকাশ অপরাধ হয়ে থাকে, তাহলে বড় বড় দুর্নীতির খবর প্রকাশিত হবে না। মুক্তিযোদ্ধা সম্মাননা ক্রেস্টে ভেজাল সোনা, ভুয়া মুক্তিযোদ্ধার সার্টিফিকেট দিয়ে বছরের পর বছর চাকরি করা, মোটা অংকের ঘুষ নিয়ে চাকরি দেওয়ার মতো খবরগুলো আড়ালেই থেকে যাবে। সুতরাং দেশ ও মানুষের স্বার্থসংশ্লিষ্ট সব তথ্যই একজন সাংবাদিক যেভাবেই হোক, যেকোনও কৌশলেই হোক সংগ্রহ করার অধিকার রাখেন। তার এই কৌশলকে অপরাধ বা চুরি বলে বিবেচনা করে মামলা দেওয়ার এখতিয়ার কোনও সরকারি কর্মকর্তার নেই।

প্রশ্ন হলো, রোজিনা ইসলাম যে তথ্য বা নথিগুলো সংগ্রহ করেছিলেন বা ছবি তুলেছিলেন বলে বলা হচ্ছে, সেই তথ্যগুলো আসলে কী? সেগুলো আসলেই কতটা গোপনীয়? তারও চেয়ে বড় কথা, তথ্যগুলো তো প্রকাশিতই হয়নি। তিনি যদি তথ্যগুলো পত্রিকায় প্রকাশ করতেন এবং তখন যদি সত্যিই দেখা যেতো যে এগুলো রাষ্ট্রের গোপনীয়তা ক্ষুণ্ন করেছে, তখন মামলার প্রসঙ্গ আসতো।

বরং যে লোকগুলো পাঁচ ঘণ্টারও বেশি সময় রোজিনাকে সচিবালয়ের একটি কক্ষে আটকে রেখে তার ওপর শারীরিক নির্যাতন চালিয়েছে, লাঞ্ছিত করেছে, তাদের বিরুদ্ধেই ২০১৩ সালের নিরাপত্তা হেফাজতে নির্যাতন ও মৃত্যু নিবারণ আইনে মামলা দায়ের করা উচিত। সেই সঙ্গে জাতীয় সম্প্রচার ও গণমাধ্যমকর্মী আইন দ্রুত পাস করে সাংবাদিকদের পেশাগত সুরক্ষা নিশ্চিত করার দাবিটিও জোরালো করা উচিত। অফিসিয়াল সিক্রেটস অ্যাক্ট, ডিজিটাল নিরাপত্তা আইন এবং পেনাল কোডের যেসব ধারা স্বাধীন ও অনুসন্ধানী সাংবাদিকতার পথ সংকুচিত করে, সাংবাদিকদের ভয়ের মধ্যে রাখে, সেসব আইন ও ধারা বাতিলের দাবিও জোরালো করা দরকার।

রোজিনা ইসলামের বিরুদ্ধে এই মামলায় একটি বিষয় খুব স্পষ্ট হয়েছে যে রাজনৈতিকভাবে সাংবাদিকদের সংগঠনগুলোর দ্বিধাবিভক্ত হলেও রোজিনার মুক্তি এবং তার ওপর নির্যাতনকারী স্বাস্থ্য মন্ত্রণালয়ের কর্মকর্তা-কর্মচারীদের শাস্তির দাবিতে সব দল, ফোরাম ও ইউনিটের সাংবাদিকরা ঐক্যবদ্ধ হয়েছেন। এই ঐক্য অটুট থাকলে ভবিষ্যতে কেউ আর সাংবাদিকদের গায়ে হাত দেওয়ার সাহস পাবে না। বরং একটা সময় পর্যন্ত সাংবাদিকদের যে সামাজিক ও রাষ্ট্রীয় মর্যাদা ছিল, যেটি সাম্প্রতিক বছরগুলোয় নানা কারণেই ক্ষুণ্ন হয়েছে, সেই হৃত গৌরব আবার ফিরে আসবে।

লেখক: সাংবাদিক

/এসএএস/এমওএফ/

*** প্রকাশিত মতামত লেখকের একান্তই নিজস্ব।

বাংলা ট্রিবিউনের সর্বশেষ
টিভিতে আজকের খেলা (৭ জুলাই, ২০২৫)
টিভিতে আজকের খেলা (৭ জুলাই, ২০২৫)
মধ্যরাতে সংবর্ধনায় বিশ্বকাপ স্বপ্নের কথা বললেন ঋতুপর্ণা ও আফঈদারা 
মধ্যরাতে সংবর্ধনায় বিশ্বকাপ স্বপ্নের কথা বললেন ঋতুপর্ণা ও আফঈদারা 
গণভবন জয় করেছি, এবার জাতীয় সংসদ জয় করবো: নাহিদ ইসলাম
গণভবন জয় করেছি, এবার জাতীয় সংসদ জয় করবো: নাহিদ ইসলাম
একটি দলের কারণে ঐকমত্য কমিশনে মৌলিক সংস্কারের প্রস্তাবনা আটকে যাচ্ছে: আখতার
একটি দলের কারণে ঐকমত্য কমিশনে মৌলিক সংস্কারের প্রস্তাবনা আটকে যাচ্ছে: আখতার
সর্বশেষসর্বাধিক