X
সোমবার, ০৭ জুলাই ২০২৫
২৩ আষাঢ় ১৪৩২

করোনাকালে কেমন আছে মধ্যবিত্ত?

রুমিন ফারহানা
২৯ মে ২০২১, ১৭:২২আপডেট : ২৯ মে ২০২১, ১৭:২২

রুমিন ফারহানা কিছুদিন আগে খাবার অর্ডার করেছিলাম একটা অনলাইন ফুড ডেলিভারি সার্ভিস প্রভাইডারের কাছ থেকে। ৫ টায় খাবার পৌঁছানোর কথা, কিন্তু সেই খাবার আসলো রাত সাড়ে ৮ টায়। আমরা ক্ষুধার্ত, বিস্মিত, এবং কিছুটা ক্ষুব্ধ তো বটেই। এর মধ্যেই ডেলিভারি ম্যান সাড়ে ৭ টার দিকে ফোন করে জানালো কিছুক্ষণের মধ্যেই পৌঁছে যাবে খাবার। মেজাজ ঠিক রাখতে না পেরে কিছুটা কড়াভাবেই কথা বলেছিলাম তার সঙ্গে।

এক সময় খাবারের ডেলিভারি আমার দরজায় এসে পৌঁছে। দরজা খুলি একই রকম মানসিকতা নিয়ে। দরজা খুলে যাকে দেখলাম তিনি বয়সের দিক থেকে আমার দেখা সব ডেলিভারিম্যান থেকে আলাদা। মুখে মাস্ক ছিল বলে বয়স স্পষ্টভাবে বোঝা না গেলেও ভদ্রলোকের কাঁচাপাকা চুল আর মুখের উন্মুক্ত অংশ দেখে অনুমান করি বয়স ৫০ এর বেশি। এরপর খাবার নেওয়া এবং মূল্য চোকানোর সময় তার সাথে যতটা কথা হয়েছে তাতে দেখলাম ভদ্রলোক খুব সুন্দর বাংলায় অমায়িকভাবে কথা বলছেন।

ভদ্রলোকের এপিয়ারেন্স, ভাষার ব্যবহার, বাচনভঙ্গি সবকিছু মিলিয়ে অল্প সময়ে আমার মধ্যে যে কৌতূহল তিনি জাগিয়ে গিয়েছিলেন তার জেরে সেই রাতেই তাকে আবার ফোন করেছিলাম আমি। তিনি যা বললেন তা খুব অপ্রত্যাশিত না হলেও দুঃখজনক ছিল নিশ্চয়ই। ভদ্রলোক মাঝারি মানের একজন ব্যবসায়ী ছিলেন। ঢাকায় নিজের অফিস আর গাড়ি প্রমাণ করে তার অর্থনৈতিক স্বাচ্ছন্দ্য। স্ত্রী, তিন পুত্রকন্যা নিয়ে সুখের সংসার। দেড় বছরের করোনার ধাক্কায় বন্ধ হয়ে গেছে অফিস। বিক্রি করে দিতে হয়েছে তার গাড়িটি। গাড়ি বিক্রির টাকার বড় অংশ পরিবারের ব্যয় নির্বাহে ব্যয় করেছেন আর কিছু টাকা দিয়ে একটা মটরসাইকেল কিনে তিনি ডেলিভারিম্যানের কাজ করছেন। তার বর্তমান পেশার কথা জানে না তার পরিবার।

এই ধরনের খবর করোনার পর প্রতিনিয়তই পত্রিকায় এসেছে। কখনও আমরা দেখেছি টিসিবির লাইনে দাঁড়িয়েছে এক সময়ে মোটামুটি ভালো মানের চাকরি করা কিন্তু বর্তমানে বেকার মানুষ। দেখেছি কিন্ডারগার্টেন স্কুলের মালিক দিয়েছেন চায়ের দোকান। কিন্ডারগার্টেন এবং নন-এমপিও স্কুলের শিক্ষক এবং অনেক চাকরিজীবী নানা জিনিস ফেরি করছেন। করোনা মানুষকে কেবল আপনজন হারাই করেনি, বহু মানুষকে ছুঁড়ে ফেলে দিয়েছে তার চিরচেনা অভ্যস্ত অবস্থান থেকে।

কয়েকদিন আগেই এই ধরনের আর একটি ঘটনা গণমাধ্যমে ব্যাপকভাবে আলোচিত হয়েছিল। করোনায় সংকটে পড়া যেসব মানুষ সংকোচের কারণে মানুষের কাছে সাহায্য চাইতে পারেন না তাদের জন্য চালু করা হেল্পলাইন ৩৩৩ নম্বরে ফোন করে মহাবিপদে পড়েছিলেন নারায়ণগঞ্জের ফরিদ আহমেদ। তিনি চারতলা বাড়ি এবং একটি হোসিয়ারি কারখানার মালিক, এমন তথ্যের ভিত্তিতে ইউএনও আরিফা জহুরা ৩৩৩–এ কল করে অযথা হয়রানি ও সময় নষ্ট করার দায়ে ফরিদ আহমেদকে শাস্তি হিসেবে ১০০ গরিব লোকের মধ্যে খাদ্য সহায়তা বিতরণের নির্দেশ দেন। এটা না করতে পারলে জেলে যেতে হবে এই ভয়ে তিনি স্ত্রীর অলংকার বন্ধক রেখে এবং আত্মীয়দের কাছ থেকে ঋণ করে ৬৫ হাজার টাকা ব্যয় করে খাদ্য সহায়তা করতে বাধ্য হন।  

এই ঘটনায় একজন ইউএনও কোনও সুনির্দিষ্ট আইন ছাড়াই তাকে শাস্তি দেওয়া এবং অতি ক্ষমতাশালী আমলাতন্ত্র এখন কতটা বেপরোয়া হয়ে ওঠে যাচ্ছে-তাই করার মতো গুরুত্বপূর্ণ আলোচনা সরিয়ে রেখে এখানে এই লেখার সঙ্গে প্রাসঙ্গিক করোনার গল্পটা নিয়েই কথা বলা যাক। সত্যিই জনাব ফরিদের একটি ছোট হোসিয়ারি কারখানা ছিল। পৈত্রিক চারতলা বাড়িটি ছয় ভাই ও এক বোনের মধ্যে ভাগ হওয়ার পর তার ভাগে পড়েছে মাত্র তিনটি কক্ষ। এর মধ্যেই তিনি তার পরিবার নিয়ে চলছিলেন। কিন্তু করোনার সময়ে তিনি তার হোসিয়ারি কারখানাটি আর চালিয়ে যেতে পারেননি। পরে একটি হোসিয়ারি কারখানায় ১২ হাজার টাকা বেতনে কাটিং ও দেখাশোনার কাজ করতে শুরু করেন তিনি। স্ত্রী, কন্যা আর এক বুদ্ধি প্রতিবন্ধী পুত্রকে নিয়ে তার দিন আর চলছিল না। করোনা তাকে খাদ্যের কষ্টের মুখোমুখি করেছে।

এ রকম আরও অসংখ্য ঘটনার উদাহরণ চাইলে দেওয়াই যায় কিন্তু সেটি এই লেখার পরিসর কেবল বাড়িয়েই তুলবে। এই ঘটনাগুলোর কোনোটিই বিচ্ছিন্ন ঘটনা নয়। অর্থনীতি বিষয়ক গবেষণা সংস্থা সানেমের রিপোর্ট বলছে ২০২০ সালের নভেম্বর-ডিসেম্বরে (যখন পুরোদমে অর্থনৈতিক কর্মকাণ্ড চলছিল) তখন দেশের দারিদ্র্যসীমার নিচে অবস্থানকারী মানুষের সংখ্যা ৪২ শতাংশ। করোনা একেবারে শুরু হওয়ার আগে এই হার ছিল ঠিক অর্ধেক। এদিকে এপ্রিল থেকে আবার কখনও কঠোর/সর্বাত্মক লকডাউন, আবার কখনও বিধিনিষেধের নামে অর্থনৈতিক কর্মকাণ্ডের ওপরে চাপ চলছেই তাই এটা নিশ্চিতভাবেই বলা যায় বর্তমানে দারিদ্র্যসীমার নিচে থাকা মানুষের সংখ্যা ৪২ শতাংশের অনেক বেশি হবে। অর্থাৎ ১৭ কোটি মানুষের দেশে অন্তত ৬ কোটির বেশি মানুষ দারিদ্র্যসীমার নিচে নেমে গেছে। সানেম ছাড়াও পিপিআরসি ও বিআইজিডির জুন মাসের এক যৌথ গবেষণা বলছে দেশে দারিদ্র বেড়ে ৪৩ শতাংশ হয়েছে। আর সিপিডির দাবি এই হার ৩৫ শতাংশে উন্নিত হয়েছে।

বাংলাদেশ পরিসংখ্যান ব্যুরোর (বিবিএস)এক জরিপে দেখা গেছে, পরিবারভিত্তিক মাসিক আয় প্রায় ৪ হাজার টাকা কমে সাড়ে ১৫ হাজার টাকা হয়েছে, বেকারত্ব বেড়েছে ১০ গুণ। আর অর্থনীতিবিদেরা বলছেন সরকারি উন্নয়ন কৌশলে গলদ থাকায় করোনার মতো আঘাত অর্থনীতি সহ্য করতে পারেনি। আন্তর্জাতিক শ্রম সংস্থা আইএলও বলছে ২০১৯ সালে বিশ্বে যত মানুষ চাকরি হারিয়েছেন তার চেয়ে ৩৩ মিলিয়ন বেশি কর্মী ২০২০ সালে চাকরি হারিয়েছেন। অনেক ব্যবসায়ী, উদ্যোক্তা ও নিয়োগদাতা বিলীন হয়ে যাওয়ার মুখে।   

সম্প্রতি অর্থনীতিবিদ অধ্যাপক ড. আবুল বারাকাত তার এক লেখায় দেখিয়েছেন, ১৭ কোটি মানুষের দেশে ২০২০ সালে কোভিডের কারণে ঘোষিত লকডাউনের আগে শ্রেণি কাঠামো ছিল এমন যেখানে দরিদ্র মানুষ ছিল ২০ শতাংশ, মধ্যবিত্ত ৭০ শতাংশ, ধনী ১০ শতাংশ যা লকডাউনের পর সম্পূর্ণ পাল্টে হয়েছে দরিদ্র ৪০ শতাংশ, মধ্যবিত্ত ৫০ শতাংশ আর ধনী ১০ শতাংশ। অর্থাৎ কেবল মাত্র ধনী শ্রেণি বাদ দিয়ে আর সকলেই করোনার অভিঘাতে বিপর্যস্ত হয়েছে। করোনা এবং লকডাউন দেশে আয় বৈষম্য বাড়িয়েছে বিপদজনক মাত্রায়। 

বাস্তবতা হলো করোনায় প্রতিদিনই কাজ হারাচ্ছে মানুষ। পথে বসেছে বহু ক্ষুদ্র ও মাঝারি উদ্যোক্তা। সরকার প্রণোদনা ঘোষণা করেছে ঠিকই কিন্তু সেই প্রণোদনার অর্থ বৃহৎ শিল্প যতটা পেয়েছে ক্ষুদ্র ও মাঝারি শিল্প ততটা নয়। অর্থ বরাদ্দ এবং ছাড় দুই ক্ষেত্রেই বৃহৎ এবং ক্ষুদ্র ও মাঝারি শিল্পের মধ্যে বৈষম্য প্রকটভাবে দৃশ্যমান। সরকারের কাছে কোনও সঠিক পরিসংখ্যান বা ডাটা নেই কারা কাজ, চাকরি বা ব্যবসা হারিয়েছে এই করোনাকালে। কারাইবা নতুনভাবে যুক্ত হয়েছে দরিদ্র মানুষের তালিকায়। ইউরোপ, আমেরিকার মতো দেশগুলো করোনার এই সময়ে তাদের নাগরিকদের অ্যাকাউন্টে প্রতি মাসে নির্দিষ্ট অংকের টাকা জমা দিয়েছে। বাংলাদেশে ২০২০ সালে করোনার প্রথম ঢেউ আসার পর ৩৫ লাখ মানুষের অ্যাকাউন্টে আড়াই হাজার টাকা দেওয়া হয়েছে আর কিছু দিন আগে দ্বিতীয় ঢেউয়ের পর ৩৫ লাখ মানুষের জন্য আবারও আড়াই হাজার টাকা বরাদ্দ হয়েছে। আজকের বাজারে এই টাকা ৪ সদস্যের একটা পরিবারের জন্য কতটুকু ভরসা কিংবা আদৌ ন্যূনতম কোনও ভরসা কিনা সেটা সহজেই অনুমেয়।

করোনার অভিঘাতে এই দেশের দরিদ্র প্রান্তিক মানুষরা যখন ভয়ংকর অবস্থায় পড়েছে তখন মধ্যবিত্তদের নিয়ে কথা বলাটাকে অমানবিক মনে হতে পারে। কারো মনে হতেই পারে এটা আমার ক্লাস-বায়াস। নিজের শ্রেণির প্রতি কিছুটা বেশি সহমর্মিতা থাকা মানব চরিত্রের একটি দিক। কিন্তু অন্তত আমার এই লেখায় আমার উদ্দেশ্য সেটা ছিল না। একটা দেশের মধ্যবিত্তরা কত দ্রুত নিম্নবিত্ত হয়ে যাচ্ছে এবং যারা এখনও মধ্যবিত্ত আছে তাদের কত কঠোর সংগ্রাম করে টিকে থাকতে হচ্ছে সেই চিত্র আমাদের সমাজের দরিদ্র এবং প্রান্তিক মানুষের অবস্থান সম্পর্কে খুব ভালো ধারণা দেয়।

দীর্ঘদিন থেকেই বর্তমান সরকার উন্নয়নের বড়াই করে। একটা দেশে যদি সত্যিকার উন্নয়ন হয়ে থাকে তাহলে সেখানেই টেকসই মধ্যবিত্ত শ্রেণি তৈরি হয়। অথচ মাত্র কয়েক মাসের অর্থনৈতিক কর্মকাণ্ডের ধীরগতি এই দেশের লক্ষ লক্ষ মধ্যবিত্তকে দারিদ্র্যসীমার নিচে পাঠিয়ে দেয়। তথাকথিত উন্নয়ন সাম্প্রতিক কালের সবচেয়ে বড় মিথ্যাচার।

লেখক: আইনজীবী, সুপ্রিম কোর্ট। সংরক্ষিত আসনে সংসদ সদস্য ও বিএনপি দলীয় হুইপ

 

/এসএএস/

*** প্রকাশিত মতামত লেখকের একান্তই নিজস্ব।

বাংলা ট্রিবিউনের সর্বশেষ
টিভিতে আজকের খেলা (৭ জুলাই, ২০২৫)
টিভিতে আজকের খেলা (৭ জুলাই, ২০২৫)
মধ্যরাতে সংবর্ধনায় বিশ্বকাপ স্বপ্নের কথা বললেন ঋতুপর্ণা ও আফঈদারা 
মধ্যরাতে সংবর্ধনায় বিশ্বকাপ স্বপ্নের কথা বললেন ঋতুপর্ণা ও আফঈদারা 
গণভবন জয় করেছি, এবার জাতীয় সংসদ জয় করবো: নাহিদ ইসলাম
গণভবন জয় করেছি, এবার জাতীয় সংসদ জয় করবো: নাহিদ ইসলাম
একটি দলের কারণে ঐকমত্য কমিশনে মৌলিক সংস্কারের প্রস্তাবনা আটকে যাচ্ছে: আখতার
একটি দলের কারণে ঐকমত্য কমিশনে মৌলিক সংস্কারের প্রস্তাবনা আটকে যাচ্ছে: আখতার
সর্বশেষসর্বাধিক