X
সোমবার, ০৭ জুলাই ২০২৫
২৩ আষাঢ় ১৪৩২

সামাজিক নিরাপত্তা বাজেটে দরিদ্র‌ কোথায়?

ডা. জাহেদ উর রহমান
০৭ জুন ২০২১, ১৭:০০আপডেট : ০৭ জুন ২০২১, ১৭:০০
ডা. জাহেদ উর রহমান সামাজিক নিরাপত্তার নামে এক অবিশ্বাস্য প্রতারণা করছে সরকার। প্রতি বছরের মতো এবারও অনেক বড় একটা অঙ্ক দেখানো হয়েছে। আগামী অর্থবছরের প্রস্তাবিত বাজেটে কাগজে-কলমে এক লাখ ৭ হাজার কোটি টাকার বেশি বাজেট বরাদ্দ দেখানো হচ্ছে এই খাতে। অথচ এতেই আছে সরকারি কর্মকর্তা-কর্মচারীদের অবসর ভাতা-গ্র্যাচুইটি, মুক্তিযোদ্ধা ভাতা, সঞ্চয়পত্রের সুদ, উপবৃত্তির টাকা, এমনকি প্রণোদনার জন্য দেওয়া ঋণের সুদে ভর্তুকি সমন্বয়ের অর্থ। এসব ক্ষেত্রেও কিছু দরিদ্র প্রান্তিক মানুষ সাহায্য পেয়ে থাকতে পারে। কিন্তু গুরুত্বপূর্ণ প্রশ্ন হচ্ছে, গরিব মানুষকে টার্গেট করে কত টাকা বরাদ্দ হচ্ছে এই খাতে?

উন্নত কল্যাণ রাষ্ট্রগুলো নানা শ্রেণি-গোষ্ঠীর মানুষের জন্য নানা ধরনের সামাজিক নিরাপত্তা কর্মসূচি চালু রাখে। আমাদের মতো সীমিত সামর্থ্যের দেশে এই কর্মসূচির প্রধান হওয়া উচিত দরিদ্র, প্রান্তিক জনগণ,‌ তারপর অন্যান্য শ্রেণি-পেশার মানুষ। পরবর্তী আলোচনার জন্য জেনে নেওয়া যাক এই মুহূর্তে বাংলাদেশের দরিদ্র মানুষের সংখ্যা কত।

এই দেশের সরকারের বিরুদ্ধে ডাটা ম্যানিপুলেশনের খুবই শক্ত অভিযোগ আছে। তবু আমরা এই কলামের আলোচনার স্বার্থে সরকারের ডাটা মেনে নিচ্ছি। সরকারি হিসাবেই করোনার আগে এই দেশের ২১ শতাংশ মানুষ দারিদ্র্যসীমার নিচে বসবাস করতো। অর্থাৎ সংখ্যায় এটি ছিল সাড়ে তিন কোটির বেশি। কিন্তু করোনার কারণে নানাভাবে অর্থনৈতিক কর্মকাণ্ড স্থবির হয়ে পড়ায় দারিদ্র্যসীমার নিচে বসবাসকারী মানুষের সংখ্যা নিশ্চিতভাবেই বেড়েছে অনেক।

বেসরকারি সংস্থা পাওয়ার অ্যান্ড পার্টিসিপেশন রিসার্চ সেন্টার (পিপিআরসি) এবং ব্র্যাক ইনস্টিটিউট অব গভর্ন্যান্স অ্যান্ড ডেভেলপমেন্টের (আইজিডি) যৌথ গবেষণা জরিপে দেখা গেছে, করোনার অভিঘাতে এই বছরের মার্চে দেশে নতুন করে দরিদ্র হয়েছে ২ কোটি ৪৫ লাখ মানুষ। জরিপে যারা সাধারণত দারিদ্র্যসীমার উপরেই বসবাস করেন। করোনার আগে সরকারি হিসাবে সাড়ে ৩ কোটির সঙ্গে এই সংখ্যা যোগ করলে বর্তমানে দরিদ্র মানুষের সংখ্যা হয় ৬ কোটি।

আরেকটি গবেষণায় অর্থনীতির গবেষণা সংস্থা সানেম জানায়, গত বছরের নভেম্বর ডিসেম্বরে দেশের দারিদ্র্যসীমার নিচে বসবাসকারী জনসংখ্যার অনুপাত ছিল ৪২ শতাংশ, অর্থাৎ সাত কোটির বেশি। তাদের হিসাবে নতুন হাওয়া দরিদ্রের সংখ্যা তখনই ছিল সাড়ে ৩ কোটির বেশি।
এরপর গত এপ্রিল মাস থেকে কখনও লকডাউন, কখনও কঠোর/সর্বাত্মক লকডাউন, কিংবা কখনও বিধিনিষেধের নামে দুই মাসের বেশি সময় অর্থনৈতিক কর্মকাণ্ডে স্থবিরতা ছিল। এই সময়ের প্রভাবেও দরিদ্রের সংখ্যা আরও বৃদ্ধি পেয়েছে এটা নিশ্চিত। এটা নিশ্চিতভাবেই বলা যায়, বর্তমান বাংলাদেশে অর্ধেকের বেশি মানুষ, অর্থাৎ প্রায় সাড়ে ৮ কোটি মানুষ দারিদ্র্যসীমার নিচে অবস্থান করছে। করোনার অভিঘাতে যাওয়া মানুষের সংখ্যা বর্তমানে প্রায় পাঁচ কোটি হতে পারে।
এই নতুন দরিদ্রদের জন্য বাজেটে ন্যূনতম কোনও কথা নেই। তাদের নিয়ে একটি বাক্য না থাকা মানে এত বড় একটা সামাজিক সংকট নিয়ে সরকারের ন্যূনতম কোনও মাথাব্যথা নেই। তাহলে সমাজের প্রান্তিকদের জন্য প্রস্তাবিত বাজেটে কী আছে? কত টাকাই‌ বা বরাদ্দ করা হয়েছে সেজন্য?

বয়স্ক ভাতা, বিধবা ভাতা,‌‌ প্রতিবন্ধী ভাতা এরকম নানা শ্রেণিতে সমাজের প্রান্তিক মানুষকে ভাতা দেওয়া হয়। বর্তমান অর্থবছরে এমন মানুষদের মধ্যে সামাজিক নিরাপত্তা ভাতা পেয়েছে ৯৮ লক্ষ জন। আগামী অর্থবছরে কিছু কিছু কর্মসূচির আওতা বাড়ানো হচ্ছে। তাতে উপকারভোগী যুক্ত হবে ১৪ লক্ষ জন। অর্থাৎ উপকারভোগীর সংখ্যা সর্বমোট হবে ১ কোটি ১২ লক্ষ। এদের বেশিরভাগ ক্ষেত্রে মাসিক ভাতার পরিমাণ ৫০০ টাকা, আর অল্প কিছু ক্ষেত্রে ৭৫০ টাকা। প্রতিমাসে ৫০০ টাকা করে হিসাব করলে ৬৭২০ কোটি টাকা বরাদ্দ প্রয়োজন। আর কিছু ক্ষেত্রে মাসিক ৭৫০ টাকা বিবেচনা করলে এই সর্বমোট বরাদ্দ সর্বোচ্চ ৭০০০ কোটি টাকা হতে পারে। আর কিছু ক্ষেত্রে ভর্তুকি মূল্যে খাদ্য সাহায্য যোগ করলে আর মাত্র কয়েকশ’ কোটি টাকায় যোগ হতে পারে এর সঙ্গে। একেবারে প্রান্তিকে দরিদ্র জনগোষ্ঠীর জন্য সামাজিক সুরক্ষায় বরাদ্দের পরিমাণ কোনোভাবেই ৮ হাজার কোটি টাকার বেশি হবে না। অর্থাৎ জিডিপির মাত্র ০.২৩ শতাংশ। সত্যিকারের প্রান্তিক দরিদ্র অসহায় মানুষের জন্য বরাদ্দ এটুকুই।

কিন্তু এই কাগজে-কলমে সামাজিক সুরক্ষা ভাতা পাওয়া মানুষগুলোর মধ্যে কতজন আসলেই সত্যিকারের প্রান্তিক মানুষ? পরিকল্পনা কমিশনের সাধারণ অর্থনীতি বিভাগের সদস্য (জ্যেষ্ঠ সচিব) ড. শামসুল আলম কিছু দিন আগে জানিয়েছেন, গবেষণায় দেখা গেছে সামাজিক সুরক্ষা নানা কর্মসূচিতে যেসব নাম তালিকাভুক্ত হয় তার মধ্যে কমপক্ষে ৪৬ শতাংশ ‌ ভাতা পাবার যোগ্য নন। কারণ, তারা সামর্থ্যবান। আমরা দীর্ঘদিন থেকেই এরকম অভিযোগ দেখেছি সরকার এবং সরকারি দলের সঙ্গে জড়িত লোকজন দেশের দরিদ্রদের জন্য বরাদ্দকৃত ভাতা নিজেদের এবং তাদের আত্মীয়-স্বজনের নামে করে তুলে নিয়ে নেন। ড. শামসুল আলমের তথ্য দিয়ে আমরা যদি সামাজিক সুরক্ষার উপকারভোগীর সংখ্যা বিবেচনা করি তাহলে সত্যিকারের উপকারভোগীর সংখ্যা দাঁড়ায় মাত্র ৬০ লাখ।

এ প্রসঙ্গে আরেকটি গুরুত্বপূর্ণ আলোচনা আছে– ভাতার অতি কম পরিমাণ। প্রান্তিক জনগোষ্ঠীর জন্য বরাদ্দ দেশের প্রায় সব ভাতার ক্ষেত্রে ৫০০ টাকা করে দেওয়া হচ্ছে। ভারতে এই ভাতার পরিমাণ বাংলাদেশি টাকায় ১২০০ টাকা। বেশ কিছু দিন থেকে সরকার মাথাপিছু আয় ভারতকে ছাড়িয়ে যাওয়ার গর্ব করছে খুব। এখন আমরা যদি মাথাপিছু আয়ে ভারতের চেয়ে এগিয়ে থাকি, তাহলে আমরা অন্তত তাদের সমান ভাতা দিই না কেন?

স্বাস্থ্য, শিক্ষার মতো বাংলাদেশ কল্যাণ অর্থনীতির এই ক্ষেত্রেও যাচ্ছেতাই অবস্থানে আছে। কিছু দিন আগে এশীয় উন্নয়ন ব্যাংকের (এডিবি) এক প্রতিবেদনে দেখা গেছে, সামাজিক সুরক্ষা খাতে খরচের দিক থেকে বাংলাদেশ এশিয়ার নিচের দিককার পাঁচটি দেশের একটি। বাংলাদেশের পেছনে আছে শুধু মিয়ানমার, কম্বোডিয়া, ভুটান ও লাওস। এ ক্ষেত্রে বাংলাদেশের অবস্থান ২১তম। শুরুতে যেভাবে বলেছিলাম যে সব অঙ্ক আমাদের সামাজিক নিরাপত্তার ক্ষেত্রে ঢুকিয়ে দেওয়া হয়, সেগুলো ঠিকমতো হিসাব করলে আমাদের অবস্থান সর্বশেষেই হতো।

আমরা দেখছি করোনার মতো বিপর্যয়ের সময়েও এই রাষ্ট্র সবচেয়ে দরিদ্র, প্রান্তিক মানুষের জন্য অতি তুচ্ছ পরিমাণ বরাদ্দ দিচ্ছে। সরকার সত্যিকার অর্থে জনগণের পাশে থাকলে সামাজিক নিরাপত্তায় দরিদ্র জনগোষ্ঠীর সংখ্যা যেমন কয়েক গুণ বাড়াতো, তেমনি বরাদ্দের পরিমাণ বাড়াতো অনেকটা। কারণ, যে মানুষগুলো ন্যূনতম ভাতা পাচ্ছিলেন এতদিন, করোনায় তাদেরও অন্য কোনও উৎস থেকে উপার্জন কমে গেছে।

একটা দেশের যতটুকু অর্থনৈতিক সামর্থ্য তৈরি হয় সেটার সুষম বণ্টনের ওপরেই নির্ভর করে সেই রাষ্ট্রের আপামর মানুষ কেমন থাকবে। রাষ্ট্রকেই সেই দায়িত্ব নিতে হয়। স্বাধীনতার সুবর্ণজয়ন্তী পালন করতে থাকা রাষ্ট্রটির নাগরিকরা দেখছেন, সাম্য, মানবিক মর্যাদা আর সামাজিক ন্যায়বিচারের স্বপ্ন দেখিয়ে তৈরি করা রাষ্ট্রটি আজ কতটা উল্টো পথে চলে গেছে।
 
লেখক: শিক্ষক ও অ্যাকটিভিস্ট
 
/এসএএস/এমওএফ/

*** প্রকাশিত মতামত লেখকের একান্তই নিজস্ব।

বাংলা ট্রিবিউনের সর্বশেষ
টিভিতে আজকের খেলা (৭ জুলাই, ২০২৫)
টিভিতে আজকের খেলা (৭ জুলাই, ২০২৫)
মধ্যরাতে সংবর্ধনায় বিশ্বকাপ স্বপ্নের কথা বললেন ঋতুপর্ণা ও আফঈদারা 
মধ্যরাতে সংবর্ধনায় বিশ্বকাপ স্বপ্নের কথা বললেন ঋতুপর্ণা ও আফঈদারা 
গণভবন জয় করেছি, এবার জাতীয় সংসদ জয় করবো: নাহিদ ইসলাম
গণভবন জয় করেছি, এবার জাতীয় সংসদ জয় করবো: নাহিদ ইসলাম
একটি দলের কারণে ঐকমত্য কমিশনে মৌলিক সংস্কারের প্রস্তাবনা আটকে যাচ্ছে: আখতার
একটি দলের কারণে ঐকমত্য কমিশনে মৌলিক সংস্কারের প্রস্তাবনা আটকে যাচ্ছে: আখতার
সর্বশেষসর্বাধিক