X
বুধবার, ০৮ মে ২০২৪
২৫ বৈশাখ ১৪৩১

আমলাতন্ত্র নিয়ে সমালোচনার তির কার দিকে যাচ্ছে?

আমীন আল রশীদ
০৩ জুলাই ২০২১, ১৭:৫৪আপডেট : ০৩ জুলাই ২০২১, ১৭:৫৮

আমীন আল রশীদ বাংলাদেশের সংসদীয় রাজনীতির ইতিহাসে গত ২৮ জুন তারিখটি স্মরণীয় হয়ে থাকবে। এদিন সরকারের আমলানির্ভরতার সমালোচনা করে বক্তৃতা দেন ক্ষমতাসীন আওয়ামী লীগেরই সিনিয়র নেতা ও সাবেক মন্ত্রী তোফায়েল আহমেদ। তাঁর সঙ্গে একই সুরে কথা বলেন আরও একাধিক সংসদ সদস্য; যার নেপথ্যে রয়েছে করোনা সংক্রমণ ও ত্রাণ কার্যক্রম সমন্বয়ে ৬৪ জেলায় একজন করে সচিবকে দায়িত্ব দেওয়ার বিষয়টি।

প্রশ্ন হলো, তোফায়েল আহমেদের মতো বর্ষিয়ান রাজনীতিবিদকেও কেন আমলাতন্ত্রের সমালোচনা করতে হচ্ছে? সূতোটা কোথায় আলগা হয়ে গেলো? স্মরণ করা যেতে পারে, ২০১৯ সালের ২৮ সেপ্টেম্বর রাজধানীতে এক শোকসভায় তোফায়েল আহমেদ বলেছিলেন, ‘রাজনীতি এখন আর রাজনীতিবিদদের হাতে নেই।’ একই অনুষ্ঠানে বাংলাদেশের ওয়ার্কার্স পার্টির সভাপতি রাশেদ খান মেনন বলেন, ‘বর্তমান রাজনীতি লুটেরাদের হাতে। আজকের রাজনীতি এমন সব বড়লোকের হাতে যারা এ দেশের মানুষের স্বার্থরক্ষা করে না।’ অনুষ্ঠানে উপস্থিত ছিলেন বাংলাদেশের কমিউনিস্ট পার্টির (সিপিবি) সভাপতি মুজাহিদুল ইসলাম সেলিম। তিনিও বলেন, ‘আগে রাজনীতিবিদেরা রাষ্ট্রযন্ত্রের মাধ্যমে জনগণকে নিয়ন্ত্রণ করতেন। আর এখন রাষ্ট্রযন্ত্র জনগণকে নিয়ন্ত্রণ করছে।’ সুতরাং জাতীয় সংসদে আমলাতন্ত্র নিয়ে তোফায়েল আহমেদসহ অন্য এমপিদের বক্তব্যকে ২০১৯ সালের ২৮ সেপ্টেম্বরের ওই বক্তব্যসমূহের সাথে মিলিয়ে পাঠ করলে পরিস্থিতি বুঝতে সহজ হবে।

২৮ জুন সংসদে তোফায়েল আহমেদ বলেন, ‘আমরা যারা এই জাতীয় সংসদের সদস্য, এমন একজনও নেই যিনি এই করোনাকালে নিজস্ব অর্থায়নে বা যেভাবেই হোক গরিব–দুঃখী মানুষের পাশে দাঁড়াননি। সবাই দাঁড়িয়েছেন। কিন্তু এখন জেলায় জেলায় দেওয়া হয়েছে প্রশাসনিক কর্মকর্তা। মানুষ মনে করে আমরা যা দিই, এটা প্রশাসনিক কর্মকর্তারাই দেন। এতে রাজনৈতিক সরকার এবং রাজনীতিবিদদের যে কর্তৃত্ব কাজ, সেটা কিন্তু ম্লান হয়ে যায়।’ তিনি স্মরণ করিয়ে দেন, ওয়ারেন্ট অব প্রিসিডেন্স অনুযায়ী সংসদ সদ্যরা সচিবদের ওপরে।

ওইদিন এ বিষয়ে সংসদে আরও বক্তব্য দেন জাতীয় পার্টির এমপি কাজী ফিরোজ রশীদ। তিনি বলেন, ‘প্রতিটি জেলার দায়িত্ব দেওয়া হয়েছে সচিবদের। মাননীয় প্রধানমন্ত্রী ডিসিদের সঙ্গে কথা বলেন। আর এমপি সাহেবরা পাশাপাশি বসে থাকেন, দূরে। এরপর বলে ডিসি সাব, আমি একটু কথা বলবো প্রধানমন্ত্রীর সঙ্গে। এই হচ্ছে রাজনীতিবিদদের অবস্থা। মাননীয় প্রধানমন্ত্রী ডিসিদের সঙ্গে যখন কথা বলেন, তখন এমপিদের কোনো দাম থাকে না।’ বগুড়া সদর আসনের এমপি গোলাম মোহাম্মদ সিরাজ বলেন, ‘সরকারি ত্রাণ ও অর্থ বরাদ্দ কার্যক্রমে জনপ্রশাসন কোথায় কী করছে, আমি জানি না। জনগণের ভোটে নির্বাচিত জনপ্রতিনিধি হয়েও সরকারি বরাদ্দ তদারকি করার সুযোগ নেই।’

সিনিয়র রাজনীতিবিদ ও এমপিদের এসব বক্তব্য এবং মানসিক যাতনায় এটি স্পষ্ট যে, তাঁরা রাষ্ট্রপরিচালনায় নিজেদের অবহেলিত বা বঞ্চিত মনে করছেন। কিন্তু এ প্রশ্নও এড়িয়ে যাওয়ার সুযোগ নেই যে, সরকার কেন এভাবে অতিমাত্রায় আমলানির্ভর হয়ে গেলো বা তাঁদের ভাষায় কেন রাজনীতি রাজনীতিবিদদের হাতছাড়া হয়ে গেলো? এখানে তাঁদের নিজেদের কোনও দায় নেই? এর কিছুটা উত্তর দিয়েছেন প্রবীণ সাংবাদিক আবদুল গাফফার চৌধুরী। সম্প্রতি একটি জাতীয় দৈনিকে তিনি লিখেছেন, সংসদ সদস্যদের অদক্ষতার জন্যই আমলারা তাদের ওপর ছড়ি ঘোরানোর সুযোগ পেয়েছেন। তাছাড়া নির্বাচনের বৈতরণী পার হওয়া তথা রাজনৈতিক উদ্দেশ্য হাসিলের জন্য আমলাতন্ত্রের অপব্যবহারকেও অনেকে দায়ী করেন। অর্থাৎ রাজনীতিবিদরা এখন আমলানির্ভরতার যে সমালোচনা করছেন, সেই সমালোচনার তির কি তাঁদের নিজেদেরই বিদ্ধ করছে না?

আপাতদৃষ্টিতে এটিও বিস্ময়কর যে, জাতীয় সংসদে দাঁড়িয়ে তোফায়েল আহমেদের মতো বর্ষিয়ান রাজনীতিবিদ এবং সাবেক মন্ত্রী যেদিন আমলাতন্ত্রের কড়া সমালোচনা করলেন, তার পরদিনই নৌপরিবহন প্রতিমন্ত্রী খালিদ মাহমুদ চৌধুরী করোনাভাইরাস মোকাবিলায় ৬৪ জেলায় ৬৪ জন সচিবকে দায়িত্ব দেওয়ার বিষয়টিকে প্রধানমন্ত্রীর ‘যুগান্তকারী সিদ্ধান্ত’ বলে উল্লেখ করেন। দেখা যাচ্ছে, আমলাতন্ত্র নিয়ে একজন সাবেক মন্ত্রী এবং একজন বর্তমান প্রতিমন্ত্রীর বক্তব্য বা অবস্থান স্পষ্টতই বিপরীতমুখী।

তোফায়েল আহমেদ এখন মন্ত্রী নন। কিন্তু তিনি সংসদের বাণিজ্য মন্ত্রণালয় সম্পর্কিত স্থায়ী স্থায়ী কমিটির সভাপতি। সংসদীয় গণতন্ত্রে সংসদীয় কমিটিগুলোকে সরকারের ‘ওয়াচডগ’ হিসেবে বিবেচনা করা হয়। সুতরাং, যেদিন একজন সংসদীয় কমিটির সভাপতি খোদ জাতীয় সংসদে দাঁড়িয়ে সরকারের অতিমাত্রায় আমলানির্ভরতার সমালোচনা করলেন, তার পরদিনই একজন প্রতিমন্ত্রীকে এর বিপরীত বক্তব্য কেন দিতে হলো, সে প্রশ্নও এড়িয়ে যাওয়ার সুযোগ নেই।

সাংবিধানিকভাবে মন্ত্রিসভা বা সরকার সম্মিলিতভাবে সংসদের কাছে জবাবদিহি করতে বাধ্য। অর্থাৎ সংসদ সদস্যরা প্রশাসন পরিচালনায় নিয়োজিত লোকদের (মন্ত্রী-আমলা নির্বিশেষে) জবাবদিহির আওতায় আনার ক্ষমতা রাখেন। সংসদীয় কমিটিকে সেই ক্ষমতা দেওয়া আছে। কিন্তু আমাদের সংসদীয় কমিটিগুলো আসলেই সরকারকে জবাবদিহিতার মধ্যে রাখতে কতটুকু ভূমিকা রাখতে পেরেছে বা পারছে—সে প্রশ্নও উঠতে পারে। সুতরাং, সংসদীয় কমিটি যদি সরকারকে জবাবদিহির মধ্যে রাখতে ব্যর্থ হয়, তাহলে সেই কমিটির একজন সভাপতি সরকারের আমলানির্ভরতার সমালোচনা করলে সেটিও কতটা যৌক্তিক—ভেবে দেখা যেতে পারে। আবার সংসদীয় কমিটিগুলো যদি সত্যিই ফাংশনাল বা কার্যকর না থাকে, তার নেপথ্যেও কী কী কারণ রয়েছে; কমিটির সাথে যুক্ত ব্যক্তিদের সাথে তাঁদের মন্ত্রণালয়ে কোনও কনফ্লিক্ট অব ইন্টারেস্ট বা স্বার্থের সংঘাত রয়েছে কি না—তাও খতিয়ে দেখা দরকার।

রাষ্ট্রের তিনটি প্রধান অঙ্গের মধ্যে সব সময়ই একটি চেক অ্যান্ড ব্যালান্স বা ভারসাম্য রাখার কথা বলা হয়। যেমন সংসদে প্রণীত আইনের দ্বারা যেমন আদালত পরিচালিত হয়, তেমনি কোনও আইন সংবিধানের সঙ্গে সাংঘর্ষিক হলে সেটি বাতিলের ক্ষমতাও আদালতের রয়েছে। সংবিধানের ব্যাখ্যা করার চূড়ান্ত এখতিয়ারও উচ্চ আদালতের। কিন্তু তারপরও মাঝেমধ্যে রাষ্ট্রের এই তিনটি প্রধান অঙ্গের মধ্যে বৈরিতা ও মুখোমুখি চলে যাওয়ার মতো অবস্থা তৈরি হয়।

পাঠকের স্মরণ থাকতে পারে, ২০১২ সালে সড়ক ভবনকে কেন্দ্র করে উচ্চ আদালত একটি রায় দেন, যা নিয়ে সংসদে আলোচনা হয় এবং এ বিষয়ে তৎকালীন স্পিকার এবং বর্তমান রাষ্ট্রপতি মো. আবদুল হামিদ একটি রুলিং দেন। এর পরিপ্রেক্ষিতে হাইকোর্টের তৎকালীন বিচারপতি এ এইচ এম শামসুদ্দিন চৌধুরী স্পিকারের ওই বক্তব্যকে ‘রাষ্ট্রদ্রোহিতার শামিল’ বলে মন্তব্য করেন। এরপরই ওই বিচারকের অপসারণের দাবি ওঠে সংসদে। এ সময় সংসদ সদস্যরা বিচারকদের অপসারণের ক্ষমতা বাহাত্তরের মূল সংবিধানের আলোকে সংসদের কাছে ফিরিয়ে আনার দাবি জানান। এর দুই বছর পরে পাস হয় সংবিধানের ষোড়শ সংশোধনী যেখানে বিচারকদের অপসারণ-সম্পর্কিত সংবিধানের ৯৬ অনুচ্ছেদ সংশোধন করা হয়।

বাস্তবতা হলো, বাংলাদেশের বিদ্যমান রাজনৈতিক বাস্তবতা ও সংবিধানের আলোকে জাতীয় সংসদ নির্বাচনে কোনও দল দুই তৃতীয়াংশ সংখ্যাগরিষ্ঠতা পেলে তারা এমন ক্ষমতার অধিকারী হয় যা পৃথিবীর অন্য কোনও গণতান্ত্রিক দেশে কল্পনাও করা যায় না। এসব কারণে আইন ও নির্বাহী বিভাগের সঙ্গে বোঝাপড়া করে চলতে হয় বিচার বিভাগকে। সংবিধানের ২২ অনুচ্ছেদে (রাষ্ট্রের নির্বাহী অঙ্গসমূহ হইতে বিচার বিভাগের পৃথকীকরণ রাষ্ট্র নিশ্চিত করিবেন) রাষ্ট্রের নির্বাহী বিভাগ থেকে বিচার বিভাগের আলাদা করার কথা বলা হলেও এখনও বিচার বিভাগের জন্য একটি আলাদা সচিবালয় স্থাপন করা সম্ভব হয়নি। বিচার বিভাগ এখনও কার্যত আইন মন্ত্রণালয়ের অধীন এবং মাজদার হোসেন মামলার রায়ের প্রেক্ষিতে ২০০৭ সালের পয়লা নভেম্বর নির্বাহী বিভাগ থেকে বিচার বিভাগকে আনুষ্ঠানিকভাবে পৃথক করা হলেও বিচার বিভাগ কতটা স্বাধীন (বিশেষ করে যেসব মামলায় সরকারের স্বার্থ রয়েছে), তা নিয়ে প্রশ্ন রয়েছে।

আবার রাষ্ট্রের তিনটি অঙ্গের মধ্যে আইন বিভাগ তথা সংসদের প্রধান (সংসদ নেতা) এবং সরকারের প্রধান নির্বাহী (প্রধানমন্ত্রী) একই ব্যক্তি। আমাদের দেশে এটি এখন অলিখিত নিয়ম। কাগজ কলমে বিচার বিভাগ আলাদা হলেও যেহেতু আদালতের নির্ভরতা আইন মন্ত্রণালয়ের ওপর এবং সরকারপ্রধান হিসেবে সকল মন্ত্রণালয়ের জবাবদিহিতা প্রধানমন্ত্রীর হাতে, সে হিসেবে পরোক্ষভাবে তিনি বিচার বিভাগেরও প্রধান। প্রধান বিচারপতি নিয়োগের এখতিয়ার রাষ্ট্রপতির হলেও এটি যেহেতু বিরাট রাজনৈতিক সিদ্ধান্তের বিষয়, ফলে এই সিদ্ধান্তও কার্যত প্রধানমন্ত্রীকেই নিতে হয়। অর্থাৎ বাংলাদেশের বিদ্যমান রাষ্ট্র ও সরকার ব্যবস্থায় সকল ক্ষমতার একচ্ছত্র অধিপতি মূলত প্রধানমন্ত্রী এবং সংবিধানই তাঁকে এই ক্ষমতা দিয়েছে। সুতরাং আমলাতন্ত্র তথা সরকারের আমলানির্ভর হওয়ার বিষয়ে জনপ্রতিনিধিদের সমালোচনা নিয়ে কথা বলতে গেলে এই বাস্তবতাগুলোও মাথায় রাখা দরকার।

লেখক: সাংবাদিক।

 

/এসএএস/

*** প্রকাশিত মতামত লেখকের একান্তই নিজস্ব।

বাংলা ট্রিবিউনের সর্বশেষ
ইসরায়েলে একাধিক হামলার দাবি হিজবুল্লাহর
ইসরায়েলে একাধিক হামলার দাবি হিজবুল্লাহর
এমপির ছেলের কাছে ৭০৩ ভোটে হারলেন জেলা আ.লীগের সভাপতি
এমপির ছেলের কাছে ৭০৩ ভোটে হারলেন জেলা আ.লীগের সভাপতি
এএফসি নারী চ্যাম্পিয়নস লিগে ভারত আছে, নেই বাংলাদেশ
এএফসি নারী চ্যাম্পিয়নস লিগে ভারত আছে, নেই বাংলাদেশ
‘প্রেমটা থাকুক, বিয়ে কোনও এক সময় হয়ে যাবে’
‘প্রেমটা থাকুক, বিয়ে কোনও এক সময় হয়ে যাবে’
সর্বশেষসর্বাধিক

লাইভ