X
শনিবার, ২০ এপ্রিল ২০২৪
৭ বৈশাখ ১৪৩১

এমনটাই শোনার ছিল প্রত্যাবর্তনে, মাননীয় প্রধানমন্ত্রী?

জহিরুল হক মজুমদার
১৭ জানুয়ারি ২০১৬, ১৩:২০আপডেট : ২৪ জানুয়ারি ২০১৬, ১১:৫৬

জহিরুল হক মজুমদার ১৯৭১ সালের ১৬ ডিসেম্বরের পর বাঙালি জাতির জীবনে উল্লেখযোগ্য ঘটনা বঙ্গবন্ধুর স্বদেশ প্রত্যাবর্তন। বাংলাদেশ স্বাধীন হলেও এর অপূর্ণতার দিকটি ছিল নেতার ফিরে না আসা। তাই জাতি অধীর হয়ে অপেক্ষা করেছিল এক মহান নেতার প্রত্যাবর্তনের। ১০ জানুয়ারি ১৯৭২ সাল ছিল সেই অসাধারণ দিন। সেদিন গোটা শহর ছিল লোকে-লোকারণ্য, নেতাকে এক নজর দেখার জন্য। এক বিশাল গণযুদ্ধের মধ্যেও যে নেতার শূন্যতা মানুষের হৃদয়ে হাহাকার তুলেছে, যার ফিরে আসার জন্য মানুষ রোজা-উপবাস করেছে, সেই নেতা তার নিজের মানুষদের মাঝে ফিরে এসেছিলেন মহাকাব্যের নায়কের মতো। আর মহান নেতার ফিরে আসার দিবসে বাংলাদেশের মাননীয় প্রধানমন্ত্রী জনগণের উদ্দেশে ভাষণ দিয়ে নেতাকে স্মরণ করেছেন, বর্তমান কর্মকাণ্ড এবং উন্নয়ন প্রয়াসকে ব্যাখ্যা করেছেন, যে ভূমিতে দাঁড়িয়ে বঙ্গবন্ধু তার মানুষদের কাছে সংগ্রাম আর ফিরে আসার আবেগকে ব্যাখ্যা করেছিলেন, তার স্বপ্নকে ব্যাখ্যা করেছিলেন, ১৯৭২-এর ১০ জানুয়ারিতে।
যাইহোক, প্রধানমন্ত্রীর ভাষণ সবার জন্য উদ্দীপনামূলক হওয়ার কথা ছিল এবং অনেকটাই ছিল তাই, কিন্তু শেষদিকে এসে সুর কেটে গেছে। সেই সুরকাটা অংশ ছিল শিক্ষকদের প্রতি উষ্মাপূর্ণ এবং আক্রমণাত্মক, যা শিক্ষকদের হৃদয়ে আঘাত করেছে। প্রধানমন্ত্রী তাঁর মেজাজ হারাননি, তিনি তাঁর স্বাভাবিক কণ্ঠস্তরেই ছিলেন, কিন্তু বাক্য ব্যবহারে আক্রমণাত্মক হয়ে উঠেছিলেন কিছু সময়ের জন্য, যে আক্রমণের দাগ সম্ভবত এত সহজে শিক্ষকদের হৃদয় থেকে মুছে যাবে না। ১১ জানুয়ারি বঙ্গবন্ধুর স্বদেশ প্রত্যাবর্তন দিবসের বিলম্বিত উদযাপনে প্রধানমন্ত্রীর ভাষণের উল্লেখযোগ্য অংশ ছিল এই রকম:
১। যদি সচিবের মর্যাদাই লাগে, তাহলে চাকরি ছেড়ে দিয়ে নিজেরা সচিব হয়ে যান বা পিএসসিতে পরীক্ষা দিয়ে চাকরি নেন।
২। তাহলে শিক্ষকদের চাকরির বয়স আবার ৬৫ থেকে ৫৯ করে দেই? যদিও আমি সেদিকে যাচ্ছি না।
৩। শিক্ষকরা সচিবদের সঙ্গে তুলনা করে নিজেদের ছোট করছেন, সম্মান নিজেদের ওপর নির্ভর করে।
৪। ছাত্র-ছাত্রীদের পড়াশোনা নষ্ট করে সম্মান আদায় করা যায় না, ছাত্র-ছাত্রীরা সেটা মেনে নেবে না।
মাননীয় প্রধানমন্ত্রীর এই ধরনের উক্তি কি তাঁর মতো প্রাজ্ঞ রাজনীতিবিদের পক্ষে মানানসই হয়েছে?
বাংলাদেশের বিশ্ববিদ্যালয় শিক্ষকরা যেখানে আন্তর্জাতিক অঙ্গনেও মেধার স্বাক্ষর রেখেছেন এবং ক্রমাগত রাখছেন, গবেষণা ও পঠন পাঠনে এবং পাঠদানে, সেখানে বিসিএস-এর মতো স্থানীয় এবং সাধারণ বিদ্যা নির্ভর পরীক্ষা দেওয়ার আহ্বান কি শিক্ষকদের জন্য সম্মানজনক কোনও আহ্বান? রাজকর্মচারী নিয়োগের পরীক্ষা আর পণ্ডিতের পরীক্ষা এক নয়, মাননীয় প্রধানমন্ত্রী।
শিক্ষকদের চাকরির বয়স কমিয়ে দেওয়ার কথা আরও ভয়ানক মনে হয়েছে। এটি এক ধরনের হুমকির মতো মনে হয়েছে। প্রধানমন্ত্রীর মতো গণতন্ত্রের সংগ্রামী নেত্রী কি মুহূর্তের জন্য স্বৈর মনস্তত্ত্ব দ্বারা তাড়িত হয়েছিলেন? কল্পনা করুনতো শিক্ষকদের চাকরি ৬৫ বছর থেকে হঠাৎ করে ৫৯ হয়ে গেল, সরকারি নির্দেশে, আর ৬০ বা ষাট উত্তর সব বয়োজ্যেষ্ঠ অভিজ্ঞ শিক্ষকরা চাকরি হারালেন মুহূর্তের মধ্যে। 

এর আগেও দলের কার্যনির্বাহী কমিটির মিটিংয়ে মাননীয় প্রধানমন্ত্রী একই প্রসঙ্গে বলেছিলেন:

১। পেটে যখন ক্ষুধা থাকে তখন মানুষ অল্পতেই সন্তুষ্ট হয়। যখন ক্ষুধার জ্বালা দূর হয়ে যায় আর বেশি প্রাচুর্য পেয়ে যায় তখন প্রেস্টিজ, ন্যায়, সম্মান, পদায়ন নানা কথা স্মরণে আসে।

২। মনে হয় একটু বেশি বাড়িয়ে ফেলেছি বেতনটা। সেজন্য এখন প্রেস্টিজ নিয়ে টানাটানি।

এরও আগে অন্য আরেক বক্তব্যে মাননীয় প্রধানমন্ত্রী বলেছিলেন- শিক্ষকদের বেতন মর্যাদা সচিবদের সমান করে দেওয়া হবে, যদি তারা ৯-৫টা অফিস করেন। সেখানেও তিনি শিক্ষকদের চাকরি সমাপ্তির বয়সসীমা বা রিটায়ারমেন্টের বয়স  কমিয়ে দেওয়ার কথা বলেছিলেন।

বিষয়টি এমন দাঁড়িয়েছে যে মাননীয় প্রধানমন্ত্রী ধারাবাহিকভাবেই বিবিধ উপলক্ষে শিক্ষকদের দাবি দাওয়ার বিপরীতে তীর্যক মন্তব্য ছুড়ে দিচ্ছেন।

শুধু ‘চ্যাম্পিয়নস অব দ্য আর্থ’ পুরস্কার প্রাপ্তির পর প্রেস কনফারেন্সে প্রধানমন্ত্রী কিছুটা যুক্তি আশ্রয়ী হয়ে শিক্ষক এবং আমালাদের তুলনামূলক সুবিধাদি সম্পর্কে মতামত দিয়েছিলেন, যদিও সেই যুক্তি ধোপে টেকে না।

প্রাজ্ঞজনেরা, এমনকি সাধারণ নাগরিকরাও হতবাক হয়ে গেছেন প্রধানমন্ত্রীর এই বক্তব্যে। অনেকের মতে এই অঞ্চলের শাসনের ইতিহাসেতো বটেই, বিশ্বের ইতিহাসেও কখনও কোনও রাষ্ট্র বা সরকার প্রধান শিক্ষকদেরকে এই রকম সম্মান হানিকর ভাষায় আক্রমণ করেননি। মাননীয় প্রধানমন্ত্রী কেন এই রকম ধারাবাহিকভাবে শিক্ষকদের আক্রমণ করছেন তার গভীর কারণ এখনও পরিষ্কার নয়। তবে আপাতদৃষ্টিতে মনে হয় ষাটের দশকে বঙ্গবন্ধুর নেতৃত্বে স্বাধীনতা আন্দোলনের প্রস্তুতি পর্ব থেকে শুরু করে ১/১১ এর সাদাপোশাকের বন্দুকওয়ালাদের সরকার তাড়ানোর মাধ্যমে শিক্ষকদের যে গণতান্ত্রিক ভূমিকা সমাজে স্বীকৃত হয়েছে, তার একটি ইতিরেখা টানারই ইঙ্গিত দিচ্ছেন হয়তো প্রধানমন্ত্রী। তার শাসনের সংহতি হয়তো এই পর্যায়ে পৌঁছে গেছে যে উর্দিওয়ালাদের একাংশ হয়তো আর কখনও গণতন্ত্রের ওপর থাবা বসাবে না। এটি গণতন্ত্রের জন্য শুভ সংবাদ বটে, কিন্তু শিক্ষকদের প্রতি অপমানসূচক উক্তি করার কোনও যৌক্তিক সূত্র হতে পারে না।

মাননীয় প্রধানমন্ত্রীর দীর্ঘ গণতান্ত্রিক সংগ্রামের প্রতি শ্রদ্ধা রেখেই একথা বলা আবশ্যক যে কোনও রাজনৈতিক দল বা কর্তৃপক্ষ এর নির্দেশনা কিংবা বাধার ওপর শিক্ষকদের এবং প্রতিষ্ঠান হিসেবে বিশ্ববিদ্যালয়ের গণতান্ত্রিক ভূমিকা নির্ভর করে না। মানুষের অধিকার কোনও সীমিত শব্দমালার অপরিবর্তনীয় বয়ান নয়। অধিকারের চেতনা একটি বিকাশমান প্রক্রিয়া। ব্যক্তির অধিকার এবং রাষ্ট্র ও নাগরিকের সম্পর্ক বিষয়ে নতুন নতুন বয়ান বিশ্ববিদ্যালয়গুলো নির্মাণ করছে এবং করবে। রাজনীতিবিদদেরকে এই নতুন বয়ান শেখার জন্য বারবার বিশ্ববিদ্যালয়ের কাছে আসতে হবে,  কারণ নাগরিকরাও এই বয়ান শিখছে। আর যদি বিশ্ববিদ্যালয়কে পেছনে ফেলে কোনও রাজনীতিবিদ তার চলার পথ রচনা করতে চান তাহলে নিজের লোকই তার কাছে অচেনা হয়ে পড়বে, পেছনের মিছিলটি ক্রমাগত ছোট হতে থাকবে, আর সামনের রাস্তাটি গণতন্ত্রের মহাসড়ক মনে হলেও যাত্রাটি শেষ হতে পারে এক স্বৈরযাত্রায়।

শিক্ষক সমিতি ফেডারেশনের সভাপতি বলছেন, গত আটমাস ধরে যোগাযোগ করেও প্রধানমন্ত্রীর একটি অ্যাপয়েন্টমেন্ট পাননি। সংশয় জাগে, বাংলাদেশ কি একটি রিপাবলিক, নাকি মোনার্কি?

তারপরও শিক্ষক নেতারা আশাবাদী যে মাত্র পাঁচ মিনিটের সাক্ষাৎকারেই না কি মাননীয় প্রধানমন্ত্রী বুঝতে পারবেন শিক্ষকদের সমস্যা। কিন্তু সাধারণ শিক্ষকদের অনেকেই আশাবাদী নন।

বঙ্গবন্ধুর স্বদেশ প্রত্যাবর্তন দিবসে সোহরাওয়ার্দী উদ্যানে প্রধানমন্ত্রীর বক্তব্যের মাধ্যমে এবং শিক্ষকদের আন্দোলন সম্পর্কে বিবিধ সময় মাননীয় প্রধানমন্ত্রীর মন্তব্য থেকে মনে হয় যে, এটি রাষ্ট্রের চরিত্র নির্ধারণী একটি নতুন বাঁক, নেহায়েতই বেতনের বৈষম্যের বিষয় নয়। রাষ্ট্র কি আমলা এবং পুলিশনির্ভর চরিত্র গ্রহণ করবে, নাকি জ্ঞান, উদ্ভাবন এবং নাগরিকদের নতুন নতুন অধিকারের প্রতি সংবেদনশীল রাষ্ট্র হিসেবে গড়ে উঠবে? বেতন স্কেল বৈষম্যের ভেতর দিয়ে এর একটি প্রাথমিক প্রকাশ ঘটল মাত্র।   

আমরা বাংলাদেশকে একটি সঠিক যাত্রায় দেখার জন্য সংগ্রাম অব্যাহত রাখার ব্যাপারে আশাবাদী। এই সংগ্রামে পিছিয়ে থাকার সুযোগ নেই। আমাদের সহকর্মী শিক্ষকরা সেই সংগ্রামের জন্য প্রস্তুত আছেন বলেই মনে হয়। বিশেষ কোনও মতাদর্শের পক্ষে অন্ধ সাফাই কিংবা অন্ধ বিরোধিতার অবস্থান থেকে সরে এসে মানুষের পক্ষে থাকার জন্য দায়বদ্ধ থাকাই যথেষ্ট।

প্রত্যাবর্তন আনন্দের, উপহারের এবং আশার। বঙ্গবন্ধুর স্বদেশ প্রত্যাবর্তন ছিল গোটা জাতির জন্য এক ঐশ্বরিক উপহার। আজ সেই প্রত্যাবর্তন উদযাপনের ৪৪তম বার্ষিকীতে শিক্ষকরা অপমানিত, বিষণ্ণ। কিন্তু আমরা আলো আনবই, আলো নিয়েই আমাদের কাজ।

লেখক: সহযোগী অধ্যাপক, ইলেকট্রিক্যাল ও ইলেক্ট্রনিক ইঞ্জিনিয়ারিং বিভাগ, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়

*** প্রকাশিত মতামত লেখকের একান্তই নিজস্ব।

বাংলা ট্রিবিউনের সর্বশেষ
শিল্পী সমিতির নির্বাচনে মিশা-ডিপজল প্যানেলের বড় চমক
শিল্পী সমিতির নির্বাচনে মিশা-ডিপজল প্যানেলের বড় চমক
ভাগ্নিকে শায়েস্তা করতে নাতিকে হত্যা
ভাগ্নিকে শায়েস্তা করতে নাতিকে হত্যা
৫ বছর বন্ধ সুন্দরবন টেক্সটাইল, সংকটে শ্রমিকরা
৫ বছর বন্ধ সুন্দরবন টেক্সটাইল, সংকটে শ্রমিকরা
বঙ্গবন্ধু ও বঙ্গমাতা গোল্ডকাপের ফাইনাল আজ
বঙ্গবন্ধু ও বঙ্গমাতা গোল্ডকাপের ফাইনাল আজ
সর্বশেষসর্বাধিক

লাইভ