X
বুধবার, ১৭ এপ্রিল ২০২৪
৩ বৈশাখ ১৪৩১

সাবেক প্রধান বিচারপতির বিচার

মোস্তফা হোসেইন
১৪ নভেম্বর ২০২১, ১৬:২২আপডেট : ১৪ নভেম্বর ২০২১, ১৬:২২

মোস্তফা হোসেইন ‘বিচারপতি তোমার বিচার করবে যারা, আজ জেগেছে সেই জনতা’– স্বাধীন বাংলা বেতারকেন্দ্র থেকে প্রচারিত গানটি যখন কানে আসতো, সত্যিই মনে হতো সব অনাচারের বিরুদ্ধে জেগেছে জনতা। মুক্তির নেশায় উন্মত্ত মানুষের প্রাণে শক্তির জোয়ার নামতো ওই সময়।

আজকে ৫০ বছর সেই গানই যেন বাস্তবায়ন হলো। সত্যি আজ বিচারপতিরও বিচার হয়েছে এই বাংলাদেশে। বলছিলাম সাবেক প্রধান বিচারপতি এস কে সিনহার বিরুদ্ধে দায়ের করা মামলার রায় বিষয়ে। পদত্যাগ করা প্রধান বিচারপতি এস কে সিনহার বিরুদ্ধে রুজুকৃত মামলার রায় দিয়েছেন ঢাকার আদালত। তাকে মোট ১১ বছরের কারাদণ্ড দিয়েছেন আদালত।

সরকারি ভাষ্য, সাবেক প্রধান বিচারপতির বিরুদ্ধে পাওয়া রায় থেকে প্রমাণ হলো আইন কাউকে ছাড় দেয় না। তিনি যত বড় ক্ষমতাসীনই হোন না কেন। এ তো গেলো আইনি কথাবার্তা। আইনমন্ত্রী তার অবস্থান থেকে সেই মতই প্রকাশ করবেন, এটা স্বাভাবিক। আর সাবেক প্রধান বিচারপতির বিরুদ্ধে দুর্নীতির অভিযোগের বিচারে তিনি শাস্তি পেয়েছেন। কিন্তু ত্রিশ লাখ জীবনের বিনিময়ে অর্জিত বাংলাদেশের জন্ম ইতিহাসকে চরম আঘাত করে যে অমার্জনীয় অপরাধ তিনি করেছেন তার কী হবে? তিনি শান্তি কমিটির সদস্য ছিলেন এমন সংবাদ তাঁকে উদ্ধৃত করেই প্রচার হয়েছিল, সেও তো দেশত্যাগ করার আগেই। তিনি জাতির জনক ও মুক্তিযুদ্ধের মহানায়ক সম্পর্কে যে মন্তব্য করেছেন তার কী হবে? প্রশ্ন তো আসতেই পারে, বিচারপতির ক্ষমতা অনেক, তাই তিনি কি রায় দিতে পারেন না? কিন্তু আমাদের জানা আছে, আদালতেরও সীমানা দেওয়াল আছে। সবচেয়ে বড় দেওয়ালটি হচ্ছে জনগণ প্রণীত সংবিধান। বিশাল আদালত ক্ষমতার মালিক হলেও ওই সংবিধানকে ডিঙিয়ে যেতে পারেন না। বলা চলে হাত-পা বাঁধা এখানে।

কিন্তু সংবিধানের চেয়েও বড় একটি দেওয়ালও আছে। সেই দেওয়ালটি সংবিধানকেই ক্ষমতাধর করেছে। আর তা হচ্ছে দেশের জনগণ আর আমাদের দেশের জন্য মুক্তিযুদ্ধও তার অন্তর্ভুক্ত। ত্রিশ লাখ মানুষের রক্ত দিয়ে সেই দেওয়ালটি তৈরি। কেউ ইচ্ছা করলেই সেই দেওয়াল ভাঙতে পারে না। সে হচ্ছে আমাদের মুক্তিযুদ্ধের অর্জন এবং কিছু মৌলিক বিষয়।

তবে আমাদের মুক্তিযুদ্ধের ইতিহাস ও মৌলিক দিকগুলোকে বিভ্রান্ত করার জন্য পাকি আদর্শের মানুষেরা ১৯৭১ সালের পর থেকেই তৎপর। বাংলাদেশের স্বাধীনতায় বিশ্বাসী কোনও মানুষ তাদের সেই ফাঁদে পা দিতে পারে না। সচেতন সাধারণ মানুষ থাক দূরের কথা, দেশের সর্বোচ্চ আদালতের প্রধান যদি সেই ইতিহাসকেই পদদলিত করেন তখন তাকে কীভাবে মূল্যায়ন করা হবে। আমাদের দুর্ভাগ্য আমাদের দেশের সাবেক প্রধান বিচারপতি সেই কাজটিই করেছেন। অত্যন্ত সচেতনভাবে এবং আদালতের পর্যবেক্ষণ আকারে। একটি স্বাধীন দেশের কোনও সাধারণ মানুষও কি সেই দেশের নির্মাতাকে বিতর্কিত করার চেষ্টা করতে পারে? আর তিনি যদি হন কোনও সাংবিধানিক পদের প্রধান, তার পক্ষে তো আরও অসম্ভব। বাস্তবতা হচ্ছে সেই অসম্ভব কাজটিই করেছেন সাবেক এই প্রধান বিচারপতি।

তিনি শান্তি কমিটির সদস্য ছিলেন না, এমন মন্তব্যও কোথাও কোথাও শোনা যায়। ধরা যাক সেটিই সত্যি। কিন্তু তিনি যখন সরাসরি জাতির পিতাকে খাটো করার মতো মন্তব্য করেন, তখন কি এমন মনে করা যায় না যে পাকিস্তানিদের প্রিয়জন যেসব কথা বলে, তিনিও তা-ই বলছেন।

প্রধান বিচারপতি যখন বলেন, ‘কোনও একক ব্যক্তি নিয়ে অথবা তার দ্বারা কোনও জাতি-দেশ গঠিত হয়নি।’ তখন আমরা স্পষ্টতই দেখতে পাই, স্বাধীনতা বিরোধীর মতোই তিনিও মুক্তিযুদ্ধের ইতিহাসকে বিতর্কিত করার চেষ্টা করছেন। আওয়ামী লীগ বিরোধী ও স্বাধীনতা বিরোধী শিবির থেকে এমন মন্তব্য করতে শোনা যায়। তাদের উদ্দেশ্য বঙ্গবন্ধুকে মুক্তিযুদ্ধ থেকে পৃথক করে ফেলা। আর মুক্তিযুদ্ধ নেতৃত্বহীনভাবে সংগঠিত হয়েছিল তা প্রতিষ্ঠিত করা।

সঙ্গত কারণেই আওয়ামী লীগের বিরোধিতার প্রসঙ্গ আসতে পারে। আওয়ামী লীগের বিরোধিতা করার অধিকার রাষ্ট্রের যেকোনও নাগরিকের আছে, যদি আওয়ামী লীগ কোনও ভুল করে থাকে। কিন্তু আদালত কি কোনও রাজনৈতিক আচরণ করতে পারে? তিনি কি এমন কোনও মন্তব্য করতে পারেন, যা একটি রাজনৈতিক দলের বিরুদ্ধে বিদ্বেষ হিসেবে গণ্য হতে পারে। বাস্তবতা হচ্ছে প্রধান বিচারপতির আসনে বসে তিনি সে-ই কাজটিই করেছেন।

ইতিহাস সাক্ষ্য দেয়, বাংলাদেশের স্বাধীনতা আন্দোলন ও তার চূড়ান্ত পর্ব একাত্তরের সশস্ত্র মুক্তিযুদ্ধ হয়েছিল এই অঞ্চলের সাধারণ মানুষের অংশগ্রহণের মাধ্যমে। আর এই পুরো পর্বে দিকনির্দেশক হিসেবে দায়িত্ব পালন করেছেন জাতির জনক শেখ মুজিবুর রহমান। মুজিব আর জনগণ এই দুই থেকে একটিকে বাদ দিয়ে মুক্তিযুদ্ধের ইতিহাস রচিত হতে পারে না। স্বাধীনতা বিরোধীরা দুই সত্তাকে পৃথক করে দিয়ে মূলত মুক্তিযুদ্ধের ইতিহাসকেই বিতর্কিত করার চেষ্টা করে। আর সেই কাজটিই করলেন একাত্তরে শান্তি কমিটির সদস্য হিসেবে আখ্যায়িত ও সাবেক প্রধান বিচারপতি এস কে সিনহা।

তার এই বক্তব্য মূলত স্বাধীনতা বিরোধীদের উসকে দিতে যথেষ্ট। ইতিহাস ও  মুক্তিযুদ্ধের বিরুদ্ধে কোনও মন্তব্য দিয়ে স্বাধীনতা বিরোধীদের উসকে দেওয়ার অধিকার কি আছে তার?

জাতীয় সংসদ সম্পর্কে তার মন্তব্য আইন বিভাগ ও বিচার বিভাগকে মুখোমুখি দাঁড় করিয়ে দিয়েছিল। আমাদের মনে থাকার কথা, জাতীয় সংসদেও তাঁর মন্তব্য নিয়ে ব্যাপক আলোচনা করতে বাধ্য হয়েছে। আইনের দৃষ্টিতে এটা স্বাভাবিক হলেও স্পর্শকাতর বিষয়টি আলোচনায় আসাটা মোটেও কাঙ্ক্ষিত নয়। কিন্তু কোন পর্যায়ে গেলে তা সংসদে আলোচনার বিষয় হয়ে যায় তা সহজেই অনুমান করা যায়।

অনেকেই মন্তব্য করেছেন, আসলে তিনি যদি রাজনৈতিক মঞ্চে দাঁড়িয়ে কোনও রাজনৈতিক দলের নেতা হিসেবে এসব বক্তব্য দিতেন তাহলে এত বিতর্কের সৃষ্টি করতো না। কিন্তু তিনি ছিলেন অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ একটি সাংবিধানিক পদে অধিষ্ঠিত। তার বক্তব্য অবশ্যই রাজনৈতিক মঞ্চের বক্তব্য হবে না, এটা প্রত্যাশিত।

তিনি বিদেশে অবস্থানকালে বাংলাদেশের একটি টেলিভিশন মাধ্যমে সাক্ষাৎকার দেওয়ার সময় যে মনোভাব দেখিয়েছেন, তাও আলোচনার খোরাক জুগিয়েছে। তাঁর মন্তব্য বিবৃতিতে স্ববিরোধিতার বিষয়টিও হালকা করে দেখার সুযোগ নেই।

দুর্নীতির বিরুদ্ধে আনীত মামলার রায় হয়েছে, আমরা আশা করবো বাকি অভিযোগগুলোরও সমাধান হবে। কারণ, বাংলাদেশ আর মুক্তিযুদ্ধ একে অন্যের ছায়া। একটা বাদ দিয়ে অন্যটার চিন্তা করা যায় না।

লেখক: সাংবাদিক, শিশু সাহিত্যিক ও মুক্তিযুদ্ধ গবেষক।

 
 
/এসএএস/এমওএফ/

*** প্রকাশিত মতামত লেখকের একান্তই নিজস্ব।

বাংলা ট্রিবিউনের সর্বশেষ
নারিনকে ছাপিয়ে বাটলার ঝড়ে রাজস্থানের অবিশ্বাস্য জয়
নারিনকে ছাপিয়ে বাটলার ঝড়ে রাজস্থানের অবিশ্বাস্য জয়
সুনামগঞ্জে বজ্রপাতে দুই কৃষকের মৃত্যু
সুনামগঞ্জে বজ্রপাতে দুই কৃষকের মৃত্যু
ঐতিহাসিক মুজিবনগর দিবস আজ
ঐতিহাসিক মুজিবনগর দিবস আজ
অপরাধে জড়িয়ে পড়া শিশু-কিশোরদের সংশোধনের উপায় কী
অপরাধে জড়িয়ে পড়া শিশু-কিশোরদের সংশোধনের উপায় কী
সর্বশেষসর্বাধিক

লাইভ