X
শনিবার, ২০ এপ্রিল ২০২৪
৭ বৈশাখ ১৪৩১

অবৈধ অভিবাসন: কুড়ালের ঘা নিজের পায়ে

এরশাদুল আলম প্রিন্স
২৭ নভেম্বর ২০২১, ১৭:১৬আপডেট : ২৮ নভেম্বর ২০২১, ১৬:৩৫

এরশাদুল আলম প্রিন্স

বাংলা ট্রিবিউনে ২১ নভেম্বর ‘মেক্সিকোয় ৩৭ বাংলাদেশিসহ ৬০০ অভিবাসনপ্রত্যাশী উদ্ধার’ শিরোনামে একটি সংবাদ প্রকাশিত হয়েছে। অভিবাসনপ্রত্যাশীদের নিয়ে ক’দিন পরপরই এ ধরনের সংবাদ গণমাধ্যমে আসে। উন্নত জীবন, জীবিকার আশায় মানুষ নিজ দেশ থেকে আরেক দেশে বৈধ-অবৈধ উপায়ে পাড়ি জমায়। যারা বৈধ উপায়ে যায় তাদের জীবন সংগ্রামের গল্প এক রকম। কিন্তু যারা অবৈধ উপায়ে এভাবে বিদেশে পাড়ি জমায় তাদের সংগ্রামের গল্প একেবারেই ভিন্ন।

অবৈধভাবে অন্য দেশে পাড়ি জমানোর নামই মানবপাচার। এর পেছনে একটি দেশের আর্থ-সামাজিক অবস্থাই মূলত দায়ী। বেঁচে থাকার তাগিদে, উন্নত জীবনের আশায় মানুষ বিদেশে পাড়ি জমায়। তবে বর্তমানে দেশের রাজনৈতিক প্রেক্ষাপটও অনেকটা দায়ী। শরণার্থী সমস্যা, রাজনৈতিক প্রতিহিংসা ও সংঘাত, যুদ্ধ–এসব কারণে মানুষ নিজ দেশ থেকে পালিয়ে বাঁচতে অন্য দেশে যাওয়ার চেষ্টা করে।

জীবিকার সন্ধানে বাংলাদেশ থেকে প্রতিবছর লাখ লাখ তরুণ বিদেশে যায়। অনেক কষ্ট করে অর্থকড়ি জোগাড় করে বিদেশে গিয়ে অনেকে স্বাবলম্বী হয়েছেন, দারিদ্র্য দূর করেছেন, সামাজিকভাবে প্রতিষ্ঠিত হয়েছেন।

একসময় শুধু মধ্যপ্রাচ্যই ছিল শ্রমিকদের গন্তব্য। এরপর মালয়েশিয়া, সিঙ্গাপুরসহ ইউরোপ-আমেরিকাও বাংলাদেশি অভিবাসীদের অন্যতম গন্তব্য হয়ে ওঠে। নারী ও পুরুষ শ্রমিক এবং অভিবাসী হিসেবে সবাই এখন এসব দেশে যায়। শ্রমিকরা সেখানে গিয়ে বিভিন্ন পেশায় আত্মনিয়োগ করেন। আশির দশক থেকে মালয়েশিয়ায় ব্যাপকভাবে বাংলাদেশি শ্রমিকরা যাওয়া শুরু করেন। সেখানকার নির্মাণ শিল্পে বিপুলসংখ্যক বাংলাদেশি এখনও কাজ করেন। এছাড়া বিভিন্ন বাণিজ্যিক ভবনের শ্রমিক ও গাড়িচালক হিসেবেও কাজ করেন বাংলাদেশিরা। কিন্তু প্রায় একদশক ধরেই মালয়েশিয়া আমাদের শ্রমিকদের জন্য কঠিন হয়ে পড়েছে।

গত কয়েক বছরে বহু শ্রমিক দেশে ফিরে আসতে বাধ্য হয়েছেন, যাদের অনেকেই অন্তত ২০-৩০ বছর ধরে মালয়েশিয়ায় থাকেন। এত বছর থাকার পরে এসব শ্রমিক দেশে ফিরে আসতে বাধ্য হয়েছেন। এখনও সেখানে ধরপাকড় চলছেই।

আজকের মালয়েশিয়া, সৌদি আরব, কুয়েত, কাতার, সিঙ্গাপুর বিনির্মাণে বাংলাদেশি শ্রমিকদের অবদান অস্বীকার করার উপায় নেই। একইসঙ্গে আজকের বাংলাদেশের অর্থনীতি যেখানে দাঁড়িয়েছে সেখানেও রয়েছে এসব প্রবাসী শ্রমিকের অবদান। জনশক্তি রফতানি খাতের জন্যই আমাদের অর্থনীতি শক্ত পায়ে দাঁড়িয়ে আছে। ২০০৭-০৮ সালের বৈশ্বিক মন্দার মধ্যেও আমাদের অর্থনীতির ওপর তেমন কোনও নেতিবাচক প্রভাব পড়েনি। রেমিট্যান্সের গতিপ্রবাহ ঠিক তো অর্থনীতি ঠিক। রেমিট্যান্সের জন্যই এই কঠিন করোনা পরিস্থিতির মধ্যেও আমাদের অর্থনীতিতে বড় কোনও আঘাত লাগেনি।

তবে করোনার কারণে বৈশ্বিক শ্রমবাজারে যে ধ্স নেমেছে তাতে কোনও সন্দেহ নেই। প্রায় সব দেশই ছোট-বড় ব্যবসা প্রতিষ্ঠান বন্ধ করে দিতে বাধ্য হয়েছে বা সীমিত করেছে। এর প্রথম আঘাতই এসেছে প্রবাসী শ্রমিকদের ওপর। ক্ষতিগ্রস্ত দেশগুলো প্রবাসী শ্রমিকদের নিজ দেশে পাঠিয়ে দিয়েছে। মধ্যপ্রাচ্য বা অন্যান্য দেশে থেকে করোনাকালে অনেক শ্রমিক বাংলাদেশে ফিরে আসতে বাধ্য হয়েছেন। আবার যারা করোনার আগে দেশে এসেছিলেন তাদেরও অনেকে এখনও ফিরে যেতে পারেননি। গণমাধ্যমের খবর অনুযায়ী, করোনার কারণে বিভিন্ন দেশ থেকে যারা দেশে ফিরে এসেছিল তাদের মধ্যে প্রায় ৪০ হাজার শ্রমিক এখনও কর্মস্থলে ফিরে যেতে পারেননি। আদৌ পারবেন কিনা তাও অনিশ্চিত।

তবে করোনা শুরুর আগে থেকেই বৈশ্বিক শ্রমবাজারে ধ্স নেমেছে। করোনা এই ঘটনাকে আরও ত্বরান্বিত করেছে মাত্র। আমাদের শ্রমিকদের অন্যতম প্রধান গন্তব্য ছিল সৌদি আরব। কিন্তু কয়েক বছর ধরেই মালয়েশিয়ার মতো সৌদি আরব থেকেও অনেক শ্রমিক দেশে ফিরে এসেছেন। সেখানকার আকামার খরচ মিটিয়ে, নিজের থাকা-খাওয়ার খরচ মিটিয়ে হাতে আর তেমন কিছু থাকে না। ফলে যারা পারছেন, তারা থাকছেন। আর যারা পারছেন না তারা বাধ্য হয়ে দেশে ফিরে আসছেন। সেখানে নতুনভাবে শ্রমিক নিয়োগের সম্ভাবনাও দেখা যাচ্ছে না। উপরন্তু এ বছর সৌদি আরব ১২ শতাংশ কম আকামা ইস্যু করেছে। ওমানও বাংলাদেশি শ্রমিকদের আগের চেয়ে ১৫ শতাংশ কম ভিসা দিয়েছে।

বর্তমান আন্তর্জাতিক শ্রমবাজারের বিরাজমান অবস্থার জন্য শ্রম আমদানিকারক দেশগুলোকে দায়ী করা যায় না। কারণ, করোনার ঢেউ সব দেশের অর্থনীতিকেই আঘাত করেছে। ফলে দেশগুলো তাদের শ্রমবাজার সংকুচিত করতে বাধ্য হয়েছে। আগে নিজ দেশের শ্রমিকদের কর্মসংস্থান, তারপর তো বিদেশি শ্রমিকদের নিয়ে ভাবনা।

আমাদের অন্যতম শ্রমবাজার ছিল ইউরোপ। করোনার আঘাতে সেই ইউরোপও নাস্তানাবুদ। ফলে, ইউরোপ থেকে অনেক শ্রমিক দেশে ফিরে আসতে বাধ্য হয়েছেন। দেশে এসে অনেকে এখনও ফিরে যেতে পারেননি। শোনা যাচ্ছে, ইউরোপ করোনার চতুর্থ ঢেউয়ের আশঙ্কা করছে। যদি তাই হয়, তবে ইউরোপে আমাদের বাজার আরও সংকুচিত হবে বলেই মনে হয়। এভাবে একে একে আমাদের প্রবাসী আয়ের পথ রুদ্ধ হয়ে যাচ্ছে। এটাই আজকের বৈশ্বিক বাস্তবতা।

একদিকে দেশের অর্থনীতি বড় হচ্ছে, অন্যদিকে দেশের জনসংখ্যাও বাড়ছে। ফলে, দেশের বিদ্যমান শ্রমবাজারের ওপর চাপ বাড়ছে। দেশে পোশাক শিল্প ছাড়া তেমন কোনও ভারী শিল্পের বিকাশ হয়নি। বিপুলসংখ্যক জনসংখ্যার চাপ সামলানোর মতো শ্রমসংস্থান আমাদের নেই। ফলে, আমাদের জন্য আন্তর্জাতিক শ্রমবাজার প্রসারের বিকল্প নেই। দেশীয় কর্মসংস্থান সৃষ্টি করতে হলে শিল্পায়ন জরুরি। পাশাপাশি নজর রাখতে হবে সম্ভাবনাময় আন্তর্জাতিক শ্রমবাজারের দিকেও। একইসঙ্গে বিদ্যমান শ্রমবাজারেও আমাদের টিকে থাকতে হবে। বিদ্যমান শ্রমবাজারকে হারানো যাবে না। সেজন্য দক্ষ শ্রমশক্তি নিয়োগ, নিয়োজিত শ্রমিকদের প্রশিক্ষণ ও টেকসই কূটনৈতিক সম্পর্কের ওপর জোর দিতে হবে।

আমাদের বৈদেশিক মুদ্রা আয়ের বড় খাত হচ্ছে রফতানি ও রেমিট্যান্স। কাজেই শ্রমবাজার সংকুচিত হয়ে যাওয়া মানে রেমিট্যান্সের ঘাটতি। এদিকে আন্তর্জাতিক বাজারে পণ্যের মূল্যবৃদ্ধির ফলে আমদানি ব্যয়ও বেড়ে যাচ্ছে। প্রাপ্ত তথ্যমতে, চলতি অর্থবছরের জুলাই-সেপ্টেম্বরে আমদানি ব্যয় বেড়েছে ৪৮ শতাংশ। এটি অর্থনীতির ওপর দ্বিমুখী চাপ সৃষ্টি করছে।

করোনায় আন্তর্জাতিক শ্রমবাজারের পাশাপাশি আমাদের আরেকটি বড় কর্মসংস্থান ও বৈদেশিক আয়ের খাত তৈরি পোশাক শিল্পও চ্যালেঞ্জের মুখে পড়েছে। করোনার দেড় বছরে তৈরি পোশাক শিল্পের অবস্থা খুবই নাজুক হয়ে পড়েছিল। যদিও এখন একটু একটু করে আবারও মাথা তুলে দাঁড়াচ্ছে এটি। এই খাত শুধু রফতানি আয়ের বড় খাতই নয়, অভ্যন্তরীণ শ্রমবাজারেরও একটি বড় আনুষ্ঠানিক খাত।

স্বাধীনতার পর বৈধ শ্রমিকদের ঘামে সিক্ত হয়ে ধীরে ধীরে গড়ে উঠেছে আমাদের আন্তর্জাতিক শ্রমবাজার। এই বাজারে ফটকাবাজ ও মানবপাচারকারীরা ঢুকে ধীরে ধীরে আমাদের বাজার নষ্ট করে দিচ্ছে। দিনের পর দিন অবৈধপথে বিদেশে পাড়ি জমানোর কারণে আন্তর্জাতিক শ্রমবাজারে আমাদের অবস্থান প্রশ্নবিদ্ধ হচ্ছে। দরিদ্র মানুষের প্রয়োজন ও দুর্বলতাকে কাজে লাগিয়ে অবৈধভাবে বিদেশে নেওয়ার নামে মানবপাচার বেড়ে গেছে। একে তো স্বাভাবিক প্রক্রিয়াতেই আন্তর্জাতিক শ্রমবাজার সংকুচিত হচ্ছে, সেই সঙ্গে আমাদের বিতর্কিত ও প্রশ্নবিদ্ধ ভূমিকার জন্য সেখানে অন্যরা ঢুকে পড়ছে।

কাজেই আন্তর্জাতিক শ্রমবাজারে আমাদের সুনাম পুনরুদ্ধারে অবৈধ পথে মানবপাচারকারী চক্রকে আইনের আওতায় আনতে হবে। আমাদের দেশে মানবপাচার একটি ভয়াবহ আর্থ-সামাজিক ব্যাধিতে পরিণত হয়েছে। বিশেষ করে নারী পাচার অনেক বেড়ে গেছে। এর সঙ্গে দেশ-বিদেশের অনেক চক্র জড়িত। এ ব্যাপারে আইনশৃঙ্খলা বাহিনী, সীমান্ত রক্ষাকারী বাহিনী, ইমিগ্রেশন কর্তৃপক্ষ, প্রবাসীকল্যাণ ও বৈদেশিক কর্মসংস্থান মন্ত্রণালয়সহ সবাইকে এগিয়ে আসতে হবে। সাধারণ মানুষকেও সচেতন হতে হবে। কোনও কিছু না জেনে-বুঝে মানবপাচারকারীদের হাতের পুতুল হওয়া যাবে না। সরকারকে এ বিষয়ে সচেতনতামূলক কার্যক্রম পরিচালনা করতে হবে।

অভিবাসী, শ্রমিক ও দেশের স্বার্থে আমাদের আন্তর্জাতিক শ্রমবাজার ধরে রাখতে হবে। অবৈধ অভিবাসী তথা শ্রমিকদের গতিরোধ ও বৈধ উপায়ে তাদের যাতায়াতের পথ সুগম করতে হবে। অবৈধ অভিবাসন বাণিজ্য ও মানবপাচারের সঙ্গে যারা জড়িত তাদের আইনের আওতায় এনে বিচার করতে হবে। এদের জন্য আমাদের শ্রমবাজার ক্ষতিগ্রস্ত হচ্ছে, বৈধ অভিবাসী ও অভিবাসনপ্রত্যাশীরাও ক্ষতিগ্রস্ত হচ্ছে। এটা আত্মঘাতী– নিজের পায়ে নিজে কুড়াল মারার মতো।

পাশাপাশি মানবপাচার সংশ্লিষ্ট কোনও অভিযোগ এলে সেগুলো যথাযথভাবে তদন্ত করে জড়িতদের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নিতে হবে। এ বিষয়ে দেশে একাধিক আইন আছে। বৈদেশিক কর্মসংস্থান ও অভিবাসী আইন-২০১৩’র মাধ্যমে এসব সমস্যা সমাধানের চেষ্টা করতে হবে। ভুক্তভোগীদের জন্য আইনি সহায়তা ও পুনর্বাসনের ব্যবস্থা থাকা চাই। এছাড়া প্রকৃতই মানবপাচার হয়ে থাকলে মানবপাচার প্রতিরোধ আইন-২০১২’র অধীনে মামলা করা যেতে পারে। অভিযুক্ত এজেন্সি হলে সেই রিক্রুটিং এজেন্সির লাইসেন্স বাতিল ও স্থগিত করাসহ বিভিন্ন আইনি ব্যবস্থা নেওয়ারও সুযোগ আছে। জনগণের সচেতনতা, সংশ্লিষ্টদের দায়িত্বশীলতা ও আইনের প্রয়োগ হলে এই খাতে শৃঙ্খলা ফিরিয়ে আনা যাবে।

লেখক: আইনজীবী

/এসএএস/জেএইচ/এমওএফ/

*** প্রকাশিত মতামত লেখকের একান্তই নিজস্ব।

বাংলা ট্রিবিউনের সর্বশেষ
চাটমোহরে ঐতিহ্যবাহী ঘোড় দৌড় প্রতিযোগিতা শুরু
চাটমোহরে ঐতিহ্যবাহী ঘোড় দৌড় প্রতিযোগিতা শুরু
রাজশাহীতে দিনব্যাপী অনুষ্ঠিত হলো বিভাগীয় সর্বজনীন পেনশন মেলা
রাজশাহীতে দিনব্যাপী অনুষ্ঠিত হলো বিভাগীয় সর্বজনীন পেনশন মেলা
রুবেলকে শোকজ দিলো উপজেলা আ’লীগ, প্রার্থিতা প্রত্যাহারের নির্দেশ পলকের
নাটোরে উপজেলা নির্বাচনরুবেলকে শোকজ দিলো উপজেলা আ’লীগ, প্রার্থিতা প্রত্যাহারের নির্দেশ পলকের
এমপি দোলনের গাড়ি লক্ষ্য করে ইট নিক্ষেপ, সাংবাদিক আহত
এমপি দোলনের গাড়ি লক্ষ্য করে ইট নিক্ষেপ, সাংবাদিক আহত
সর্বশেষসর্বাধিক

লাইভ