X
শুক্রবার, ২৯ মার্চ ২০২৪
১৪ চৈত্র ১৪৩০

গণমামলা নয়, প্রয়োজন শক্তিশালী প্রেস কাউন্সিল

তানভীর আহমেদ
২৫ ফেব্রুয়ারি ২০১৬, ১৫:৫৩আপডেট : ২৫ ফেব্রুয়ারি ২০১৬, ১৭:০৪

তানভীর আহমেদ ব্রিটেনে কোনও সংবাদপত্র যদি ভুল সংবাদ প্রকাশ করে আর সেই ভুলের কারণে যদি কোনও ব্যক্তি বা প্রতিষ্ঠান ক্ষতিগ্রস্ত হয়, তাহলে তারা ইনডিপেন্ডেন্ট প্রেস স্ট্যান্ডার্ড অর্গানাইজেশন বা আইপিএসও নামে যে প্রতিষ্ঠান আছে, সেখানে প্রতিবাদ পাঠান। আইপিএসও অভিযোগ মূল্যায়ন করে সংশ্লিষ্ট পত্রিকাকে তাদের মতামত জানায়। ভিকটিম আবার ব্যক্তিগতভাবে সংশ্লিষ্ট পত্রিকার সম্পাদকের কাছে তার প্রতিবাদ পাঠাতে পারেন অথবা ক্ষতিপূরণ চেয়ে আদালতে যেতে পারেন।
টেলিভিশন ও রেডিওর ক্ষেত্রে মিডিয়া তদারকি করে থাকে অফিস অব কমিউনিকেশন্স বা অফকম। টেলিভিশনের কোনও সংবাদ বা অনুষ্ঠানমালা যদি পক্ষপাতদুষ্ট হয় অথবা কোনও ব্যক্তি বা প্রতিষ্ঠানের সুনাম ক্ষুণ্ন করে তবে ক্ষতিগ্রস্ত ব্যক্তি বা সাধারণ দর্শক অফকমের কাছে অভিযোগ করতে পারেন।
শুধু বিবিসি টেলিভিশন তার ট্রাস্টিদের দ্বারা গঠিত প্যানেলের মাধ্যমে অভিযোগের নিষ্পত্তি করে। অন্যদিকে অফকম প্রতি মাসে তার প্রকাশিত বুলেটিনে ব্রিটেনের সকল গণমাধ্যমের অভিযোগের সিদ্ধান্ত ও সংশ্লিষ্ট গণমাধ্যমের বিরুদ্ধে নেওয়া পদক্ষেপের বিস্তারিত প্রকাশ করে। সিদ্ধান্ত দেওয়ার ক্ষেত্রে ‘অফকম’ তার একটি নীতিমালা অনুসরণ করে। ইংল্যান্ডের প্রত্যেকটি টেলিভিশন ও রেডিওকে অফকমের নীতিমালা অনুসরণ করে চলতে হয়। প্রত্যেকটি টেলিভিশন চ্যানেল আবার অফকমের মাধ্যমে লাইসেন্স গ্রহণ করে এবং অফকমকে লাইসেন্স ফি বাবদ প্রতিমাসে নির্দিষ্ট অংকের অর্থ পরিশোধ করে। তাই সকল কর্মকাণ্ডে তারা অফকমের কাছে দায়বদ্ধ।
একইভাবে সংবাদপত্রগুলোকে আইপিএসও কোড মেনে চলতে হয়। ‘আইপিএসও’ বা ‘অফকম’ ভিকটিম বা ক্ষতিগ্রস্তদের অভিযোগের ভিত্তিতে সংশ্লিষ্ট গণমাধ্যম কোনও নীতিমালা ভঙ্গ করেছে কিনা সেটি বিবেচনায় নিয়ে ব্রিজ, নট ব্রিজ অথবা রিজলভ এই তিনটি সিদ্ধান্ত দিয়ে সংশ্লিষ্ট গণমাধ্যমের বিরুদ্ধে নেওয়া শাস্তি সম্পর্কেও বিস্তারিত বিবরণ প্রকাশ ও জরিমানা করে। আমার পূর্বের লেখায় আমি ব্রিটেনের গণমাধ্যমের কিছু জরিমানা ও শাস্তির দৃষ্টান্ত তুলে ধরেছিলাম। আজও নতুন কয়েকটি দৃষ্টান্ত দিচ্ছি।
প্রিমিয়াম রেইটের ফোন কলের অপব্যবহারের জন্য ২০০৮ সালে লন্ডনের আইটিভিকে ৫.৭ মিলিয়ন পাউন্ড জরিমানা করা হয়েছিলো, এটিই এখনও ব্রিটেনের গণমাধ্যমের ইতিহাসে সর্বোচ্চ জরিমানার দৃষ্টান্ত।
২০১১ সালে ব্রিটিশ রাজ পরিবারের বিরুদ্ধে টেলিফোন হ্যাকিং কেলেঙ্কারির কারণে ব্রিটেনের ‘নিউজ অব দ্য ওয়ার্ল্ড’ পত্রিকার সম্পাদক পদ থেকে সরে গিয়ে এন্ডি কুলসনকে ১৮ মাসের জেল খাটতে হয়েছিলো। মিডিয়া মুঘল বলে খ্যাত রুপার্ট মারডককে প্রকাশ্যে হাত জোর করে ক্ষমা চেয়ে নিউজ অব দ্য ওয়ার্ল্ড বন্ধ করে দিতে হয়েছিলো। যদিও রুপার্ট মারডকের একটা ইচ্ছে ছিলো তার নতুন পত্রিকা ‘মেইল অন সানডে’র সম্পাদক হিসেবে এন্ডি কুলসনকে ফেরাবেন, কিন্তু ব্রিটিশ জনগণের প্রচণ্ড চাপে সেটি সম্ভব হয়নি।
এখানে সবকিছুরই কিন্তু সমাধান হয়েছিলো একটি নিয়মতান্ত্রিক পদ্ধতির মাধ্যমে। বাংলাদেশের সাংবাদিক বা গণমাধ্যমও ভুলের উর্ধ্বে নয়, বাংলাদেশের গণমাধ্যমের অপরাধ ও ভুলের ন্যায়-অন্যায় বিবেচনার অফিসিয়াল কাঠামোটি যদি প্রেস কাউন্সিল হয়ে থাকে, তাহলে দ্য ডেইলি স্টার সম্পাদক মাহফুজ আনামের বিরুদ্ধে যত অভিযোগ আসছে বা ভবিষ্যতে গণমাধ্যমের বিরুদ্ধে যত অভিযোগ আসবে, তার সমাধান হওয়া উচিৎ প্রেস কাউন্সিলের মাধ্যমে, সারাদেশে গণমামলা দিয়ে নয়! আমার প্রথম লেখায় আমি একাধিক আইনজীবীর রেফারেন্স দিয়ে বলেছিলাম, সম্পাদক হিসেবে মাহফুজ আনাম কোন পয়েন্টে ভুল করেছেন। এখন তার বিরুদ্ধে মানহানি মামলা হবে, ক্ষতিপূরণ মামলা হবে নাকি রাষ্ট্রদ্রোহ মামলা হবে সেটি অবশ্যই বিস্তারিত আলোচনা ও বিতর্কের দাবি রাখে।

কিন্তু মাহফুজ আনাম সম্পাদক হিসেবে যে ভুল করেছেন এবং সেই ভুলের একটি আইনি পরিসমাপ্তি প্রয়োজন, সেটির ব্যাপারে কারও দ্বিমত রয়েছে বলে মনে হয় না। প্রধানমন্ত্রী তার বক্তৃতায় ডিজিএফআইয়ের দু’জন কর্মকতার নাম বলেছেন, যারা মূলত গণমাধ্যমে ভুল তথ্য সরবরাহ করেছেন। তাদের আইনের আওতায় আনার ব্যাপারেও আলোচনা হওয়া উচিৎ। আইন সবার জন্যই সমান।

কিন্তু যে প্রক্রিয়ায় ডেইলি স্টার সম্পাদকের বিরুদ্ধে মামলা হচ্ছে, সেই প্রক্রিয়াটি কোনও সুস্থধারার গণমাধ্যমের ভুল সংশধোনের পদ্ধতি হতে পারে না। পৃথিবীর কোনও দেশেই এমন নজির নেই। দেশজুড়ে আওয়ামী লীগের দলীয় নেতাকর্মীদের দায়ের করা গণমামলাগুলো দলীয় প্রধানকে খুশি করতে আবেগতাড়িত হয়ে দেওয়া হচ্ছে সেটা বোঝার জন্য কোনও প্রকার অনুসন্ধানের প্রয়োজন নেই।

এই ইস্যুতে প্রধানমন্ত্রী কিংবা সজীব ওয়াজেদ জয় অথবা তাদের মনোনীত ব্যক্তিরাই বিষয়টি নিয়ে আইনি পদক্ষেপ নিলে আওয়ামী লীগ ও ক্ষমতাসীনদের ভাবমূর্তি নষ্ট হওয়ার সুযোগ কম হতো। তবে প্রধানমন্ত্রীর ছেলে ও তথ্য প্রযুক্তি বিষয়ক উপদেষ্টা সজীব ওয়াজেদ জয়ের ফেসবুক স্ট্যাটাসটি অত্যন্ত স্পর্শকাতর। তিনি তার মায়ের বিনা অপরাধে ১১ মাস কারাদণ্ড ভোগের কষ্ট, সংশ্লিষ্ট সম্পাদককে অনুভব করার কথা বলেছেন। একটি দেশের প্রধানমন্ত্রী হয়েও যদি তার ওপর নির্যাতন কিংবা মিথ্যে সংবাদ প্রকাশের জন্য তার ছেলেকে ন্যায় বিচার পাওয়ার জন্য স্ট্যাটাস দিতে হয়, তাহলে রাষ্ট্রের একজন সাধারণ নাগরিককে কী অবস্থার মধ্য দিয়ে যেতে হয়, সেটি অনুমান করা খুব কঠিন নয়। তাই গণমাধ্যমের জবাবদিহিতার জন্য একটি শক্তিশালী প্রেস কাউন্সিল প্রতিষ্ঠার ব্যাপারে নজর দেওয়ার এখনই প্রকৃত সময়।

এবার প্রেস কাউন্সিল সম্পর্কে একটু বিশদ বলি। প্রেস কাউন্সিলের ওয়েবসাইটে গেলে দেখা যাবে, সেখানে লেখা আছে ‘বাংলাদেশ প্রেস কাউন্সিলে প্রাথমিক অভিযোগ এখানে দায়ের করুন’। (প্রাথমিক অভিযোগ দায়ের করা হলেও নিয়মমাফিক পদ্ধতি অনুসরণ করে প্রয়োজনীয় কাগজপত্রসহ সশরীরে উপস্থিত থেকে মামলা দায়ের করতে হবে)। আরেকটি কলামে লেখা আছে- ‘অভিযোগকারী যে কারণে সংক্ষুব্ধ হয়েছেন তার সংক্ষিপ্ত বিবরণ লিখতে হবে ১শত শব্দের মধ্যে।’  ডেইলি স্টার সম্পাদকের বিরুদ্ধে সারা দেশে ৭৯টি মামলা হলেও ধারণা করি মাহফুজ আনামের বিরুদ্ধে প্রেস কাউন্সিলে একটি অভিযোগও জমা পড়েনি বা মামলাও হয়নি! এই সমস্যাটির সমাধানে সবচেয়ে বেশি প্রয়োজন প্রেস কাউন্সিলকে শক্তিশালী করা, সাধারণ মানুষকে সচেতন করানো কীভাবে একটি প্রকাশিত সংবাদের প্রতিবাদ করতে হয়। সংবাদের প্রতিবাদের ক্ষেত্রে প্রথম প্রতিবাদলিপিটি যাওয়ার কথা সংশ্লিষ্ট পত্রিকার সম্পাদকের কাছে, সম্পাদক যদি প্রতিবাদটি ছেপে সংশোধনী না দেন তাহলেই কেবল তিনি প্রেস কাউন্সিলে যাবেন। মাহফুজ আনামের বিরুদ্ধে মামলা তুলে নেওয়ার দাবি জানিয়েছে বাংলাদেশের সম্পাদক কাউন্সিল। অন্যদিকে এশিয়ার ১৯টি দেশের ২২টি মিডিয়ার সমন্বয়ে গঠিত ‘দি এশিয়ান নিউজ নেটওয়ার্ক‘ এর সদস্যরা প্রকাশক ও সম্পাদক মাহফুজ আনামের বিরুদ্ধে মামলা তুলে নেওয়ার জন্য প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার কাছে চিঠি লিখেছেন। এ ধরণের গণমামলা যত বেশি হবে আন্তজার্তিক অঙ্গনে বাংলাদেশ সম্পর্কে তত বেশি নেতিবাচক ধারণা তৈরি হবে। অথচ গণমাধ্যমের ভুল স্বীকার, শাস্তি বিশ্বব্যপী একটি স্বীকৃত প্রক্রিয়া। এ ধরণের গণমামলা সরকারের ভাবমূর্তি নষ্ট করতে পারে।

বাংলাদেশের গণমাধ্যমের মালিক, প্রকাশক ও সম্পাদকরা উদ্যোগী হয়ে যদি প্রেস কাউন্সিলকে গতিশীল করতে আরেকটা উদ্যোগ নেন, তাহলে ভবিষ্যতে এ ধরণের জটিল সমস্যার সমাধান সঠিক মানদণ্ড দ্বারা করানো সম্ভব। এক্ষেত্রে ব্রিটেনের অফকম ও আইপিএসও প্রতিষ্ঠান দু‘টি হতে পারে বাংলাদেশের জন্য অনন্য উদাহরণ।

একটি দৃষ্টান্ত দিয়ে লেখাটির ইতি টানবো। বাংলাদেশের বেশ কয়েকটি টেলিভিশন চ্যানেল ব্রিটেনে প্রচারিত হয়, বাংলাদেশের অধিকাংশ টেলিভিশন চ্যানেলের প্রচারিত সংবাদই ব্রিটেনের অফকমের নীতিমালা ভঙ্গ করে, তাই বাংলাদেশের টেলিভিশন চ্যানেলের সংশ্লিষ্ট কর্তৃপক্ষ বাংলাদেশের সংবাদ ও অনুষ্ঠানমালায় ব্যবহৃত বিজ্ঞাপনগুলো ইউকেতে সম্পাদনা করে প্রচার করে থাকে।

২০১৫ সালের নভেম্বরে অফকম বুলেটিন সূত্রমতে, এনটিভি ইউরোপকে ২০ হাজার পাউন্ড জরিমানা করা হয়েছে। অফকমের বুলেটিনে প্রকাশিত হয়েছে, গত এপ্রিল ২০১৩ সাল থেকে সেপ্টেম্বর ২০১৪ সাল পর্যন্ত এনটিভি ইউরোপে যত অভিযোগ জমা পড়েছে তারমধ্যে ২০টি অভিযোগে অফকমের নিয়ম ভঙ্গ করেছে। এর মধ্যে ১৬টি অভিযোগ ছিলো সংবাদ সংক্রান্ত। অফকম বলছে, এনটিভিতে তাদের ‘অফকম‘ কোড মনিটরিংয়ের জন্য কোনও কমপ্লায়েন্স অফিসার নেই, যার কারণে এ ধরনের ভুল হচ্ছিল। এনটিভি ইউরোপ যদি ধারাবাহিকভাবে এমন ভুল করতেই থাকে তাহলে তারা তাদের লাইসেন্স হারাবে। অফকমের এমন জরিমানার পর এনটিভি ইউরোপ তাদের ভুল সংশোধনে কার্যকরী উদ্যোগ নেয় এবং ডিসেম্বর ২০১৪ সালের পর থেকে তাদের আর এমন ভুল পাওয়া যায়নি। এখন কথা হচ্ছে, একটি মিডিয়া ওয়াচডগ প্রতিষ্ঠান প্রেস কাউন্সিলকে আধুনিকায়ন করা। সংবাদপত্র, টেলিভিশন, বেতার ও অনলাইন মিডিয়ার জন্য আলাদা ‘প্রেসকোড’ তৈরি ও সেগুলো অনুসরণের আইনি বাধ্যবাধকতা আরোপ করা প্রয়োজন। প্রযুক্তিনির্ভর বিশ্বমিডিয়া এগিয়ে গেছে অনেক দূর। সেই অর্থে আমাদের প্রেস কাউন্সিল এখনও কার্যকর নয়। সেই সঙ্গে সংশ্লিষ্ট সংবাদপত্র, টেলিভিশন, রেডিও কিংবা অনলাইন প্রেসকোড ভঙ্গ করলে তাদের ভুলের জন্য আর্থিক জরিমানা, জেল দণ্ডের বিধান, ক্ষেত্র বিশেষে লাইসেন্স বাতিলের মতো কঠিন নীতিমালা আরোপ করলে প্রেস কাউন্সিল যেমন কার্যকর ও শক্তিশালী হবে তেমনি গণমাধ্যমকর্মীরাও আরও বেশি দায়িত্বশীল থাকবেন।

লেখক: সাংবাদিক ও গবেষক। একাত্তর টেলিভিশন ও বাংলা ট্রিবিউনের লন্ডন প্রতিনিধি

*** প্রকাশিত মতামত লেখকের একান্তই নিজস্ব।

বাংলা ট্রিবিউনের সর্বশেষ
এক সপ্তাহের মাথায় ছিনতাইকারীর ছুরিকাঘাতে আরেকজন নিহত
এক সপ্তাহের মাথায় ছিনতাইকারীর ছুরিকাঘাতে আরেকজন নিহত
‘উচিত শিক্ষা’ দিতে পঙ্গু বানাতে গিয়ে ভাইকে হত্যা
‘উচিত শিক্ষা’ দিতে পঙ্গু বানাতে গিয়ে ভাইকে হত্যা
পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ে মানবাধিকার উইং চালুর পরামর্শ সংসদীয় কমিটির
পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ে মানবাধিকার উইং চালুর পরামর্শ সংসদীয় কমিটির
পণ্ড হলো না পরাগের শ্রম, দিল্লিকে হারালো রাজস্থান
পণ্ড হলো না পরাগের শ্রম, দিল্লিকে হারালো রাজস্থান
সর্বশেষসর্বাধিক

লাইভ