X
শুক্রবার, ২৯ মার্চ ২০২৪
১৫ চৈত্র ১৪৩০

ধর্ষণবিরোধী সাংস্কৃতিক আন্দোলন দরকার

লীনা পারভীন
০৩ ফেব্রুয়ারি ২০২০, ১৯:৫৩আপডেট : ০৩ ফেব্রুয়ারি ২০২০, ১৯:৫৭

লীনা পারভীন একের পর এক সংবাদ পড়ছি। আজকাল আর হতাশ হই না, রাগও হই না বা ক্ষুব্ধ স্ট্যাটাসও দিতে ইচ্ছে করে না। কেন জানি না মনে হচ্ছে—ধর্ষণের মতো একটি জঘন্য অপরাধ হয়তো আমাদের গা-সওয়া হয়ে যাচ্ছে। নারী সে শিশু বা বয়স্ক যেই হোক না কেন, তাকে ধর্ষণের অধিকার দিয়ে দিয়েছে এই সমাজ। এমনটাই ধারণা প্রতিষ্ঠিত হয়ে যাচ্ছে কিনা, সে বিষয়ে যথেষ্ট শঙ্কায় আছি। একটি সংবাদ পড়ে রীতিমতো গা শিউরে উঠলো। কয়েকজন কিশোর মিলে আরেকজন কিশোরীকে ধর্ষণ করে ফেসবুক লাইভে এসে জয়োল্লাস করেছে। ঘোষণা দিয়েছে, তারা হয়তো জেলেও যেতে পারে।
এটা কি মানুষের সমাজ? এরা কি মানুষের সন্তান? ধর্ষণ করা একটি জঘন্য অপরাধ—বিষয়টি মনে হচ্ছে তাদের অভিধানে নেই বা নারীর প্রতি মর্যাদাপূর্ণ আচরণ কোনটা, সে বিষয়েও এসব কিশোরের চিন্তায়ই আসেনি। অসম্ভব এক দুঃশ্চিন্তা এসে ভর করলো আমার মাথায়। আমিও দুটি কিশোরের মা। আমার সন্তান তাহলে এই সমাজ থেকে কী শিক্ষা নেবে? আমি যতই পরিবার থেকে তাকে জ্ঞান দিয়ে থাকি না কেন, সমাজ যদি সুস্থ না থাকে, তাহলে শেষ রক্ষা হবে?
কিছুদিন আগেই ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের এক শিক্ষার্থীর ধর্ষণের ঘটনা নিয়ে তোলপাড় ছিলাম আমরা। আসামি গ্রেফতার হলো কিন্তু আমাদের একাংশের পছন্দ হলো না। ধর্ষকের চেহারা জীর্ণশীর্ণ আর পেশায় সে সিএনজি অটোরিকশাচালক। মাদকাসক্ত এই সিরিয়াল ধর্ষক নিয়ে চলতে থাকলো সন্দেহের গুঞ্জন। বলা হলো,  প্রকৃত অপরাধীকে আড়াল করতেই নাকি এই নাটক। আবার কেউ একধাপ এগিয়ে গিয়ে বলা শুরু করলো—এটা সরকারের চাল। জনগণের রোষানল থেকে বাঁচতেই তাড়াহুড়া করে এই আসামি ধরার নাটক করা হয়েছে। ভাবনায় পড়ে গেলাম, কেন তবে আমাদের মধ্যে এমন দ্বিধা আর সন্দেহ? একজন ধর্ষক, সে অপরাধী। অপরাধী ধরা পড়েছে, এটাই সবচেয়ে বড় আশার খবর হওয়ার কথা ছিল। ধর্ষকের ডিএনএ মিলেছে এবং প্রমাণিত হয়েছে যে, এই মজনুই আসল  ধর্ষক।  ধর্ষকের ধরা পড়ায় আমাদের বরং আশান্বিত হওয়ার দরকার ছিল। সমাজ থেকে ধর্ষণের বীজ উপড়ে ফেলার শপথ নিয়ে সংশ্লিষ্ট সবাইকে আরও জোরদার ও কার্যকর উদ্যোগের আহ্বান জানানো দরকার ছিল।

সমাজে যে পরিমাণ সাংস্কৃতিক অবক্ষয় চলছে, তার বিরুদ্ধে রুখে দাঁড়ানো এখন আমাদের নাগরিক দায়িত্ব হয়ে দাঁড়িয়েছে। আর এই আন্দোলন শুরু করতে হবে পুরুষদেরই। কারণ ধর্ষক নারী হয় না। পুরুষদের মাঝে পরিবর্তনের ভূমিকায় অগ্রণী থাকতে হবে পুরুষ সমাজকে। অনেকদিন ধরেই বলে আসছিলাম ধর্ষণবিরোধী পুরুষ সমাজের সমাবেশের কথা। অথচ  এই বিষয়ে আজও দেখা যায়নি কোনও উদ্যোগ।

এই যে কিশোরেরা ধর্ষণ করে উল্লাস প্রকাশ করছে, লাইভে এসে জানান দিচ্ছে, এটা কিসের লক্ষণ? কোন সমাজকে চিনাচ্ছে আমাদের? আমাদের সন্তানেরা তাহলে কোন মানসিকতা নিয়ে বেড়ে উঠবে? ধর্ষণ করেও লাইভে আসা যায়? আবার শুনছি তাদের পরিবার পাশে দাঁড়িয়েছে। অবাক হওয়ার আর কিছু বাকি নেই। এই তাচ্ছিল্য করার সাহস তারা পায় কার ছত্রছায়ায়?

উত্তর আসবে বিচারহীনতার সংস্কৃতির ছায়ায় বেড়ে উঠছে এই সাহস। এখানেও সংস্কৃতি আছে। সংস্কৃতি বলতে আসলে কী বুঝি আমরা? একদম সহজ করে বললে, সংস্কৃতি বলতে আমরা সমাজে প্রচলিত আচার আচরণ ও নিয়ম কানুনের সামষ্টিক বহিঃপ্রকাশকেই বুঝি। দীর্ঘদিন ধরে সমাজে যখন কোনও ধারা চলতে থাকে, তখন সেটাই হয়ে যায় সামাজিক সংস্কৃতির অংশ। আমাদের পরিসংখ্যান বলে, ধর্ষণ বা নারী নির্যাতনের কোনও দৃশ্যমান বিচার বা শাস্তির নজির নেই বা থাকলেও হাতেগোনা। সম্প্রতি একমাত্র ফেনীর নুসরাত ধর্ষণ ও হত্যা মামলা ব্যতিত আর কোনও ঘটনারই বিচারের নজির সামনে আসেনি। নুসরাত যদি হত্যাকাণ্ডের শিকার না হতো আর এই নৃশংস হত্যার বিচারে যদি প্রধানমন্ত্রী সোচ্চার ও সজাগ না থাকতেন, তাহলে হয়তো এই মামলাটিও আর দশটার মতোই ফাইলবন্দি হয়ে থাকতো। এভাবেই দিনের পর দিন ধর্ষণকে আমরা সামাজিকভাবে বৈধতা দিয়ে যাচ্ছি। আর এর ফসলই হচ্ছে কিশোরীকে ধর্ষণের পর লাইভে এসে উল্লাস প্রকাশ করা। এই উল্লাসে আমি সমাজ ও রাষ্ট্রের প্রতি খোলা চ্যালেঞ্জের ভাষা খুঁজে পেয়েছি। তারা জানে, জেলে গেলেও বিচার হবে না। কয়দিন জেল খাটার পরই ছাড়া পেয়ে যাবে। এমনটাই তো হয়ে আসছে।

কেবল আইন করে কি এই ধর্ষণের উৎসব থামানো সম্ভব? না সম্ভব নয়। আইন করলেই হবে না, আইনের দ্রুত ও যথাযথ প্রয়োগের নিশ্চয়তা সমাজে আইনের প্রতি দৃষ্টিভঙ্গি পাল্টাতে সাহায্য করবে কিন্তু নারীর প্রতি দৃষ্টিভঙ্গি কি পাল্টাবে? এর জন্য কী দরকার? নাগরিক হিসেবে আমাদের দায়িত্বের জায়গাটি কতটা পালন করছি আমরা? যে পরিবারের সদস্যরা তাদের সন্তানের অপকর্মকে সহায়তা দিচ্ছে তাদের শিক্ষাটাই বা কী? নারীকে তারা কোন দৃষ্টিতে দেখছে? ধর্ষণ তাদের কাছে কোন অপরাধের মধ্যেই পড়ছে না। এটা পরিষ্কার।

আর এই পরিবর্তনের পেছনে একটি সামাজিক আন্দোলনের বড্ড প্রয়োজন। এই সামাজিক আন্দোলনে যুক্ত থাকা লাগবে সাংস্কৃতিক লড়াইও। আমাদের সামাজিক মূল্যবোধ কী, কী আমাদের পারিবারিক মূল্যবোধ আর শিক্ষা এগুলো নিয়ে কাজ করতে হবে গভীরে গিয়ে। আজকাল কি তবে পারিবারিক মূল্যবোধও পরিবর্তন হয়ে যাচ্ছে? পরিবার ছাড়াও বিদ্যালয়, কর্মস্থল, সিনেমা, নাটক, পাঠ্যবই, আড্ডা, সবজায়গা মিলেই আমাদের সমাজ। সময় এসেছে সব জায়গাকে কেন্দ্র করেই নারীর প্রতি দৃষ্টিভঙ্গি পাল্টানোর সাংস্কৃতিক লড়াইটি শুরু করার। নারী কোনও পণ্য নয়, নারী এই সমাজের একটি অংশ যাকে চাইলেই যে কেউ তার সম্পত্তি বানিয়ে ফেলতে পারে না। নারীর আর্থিক নিশ্চয়তার পাশাপাশি তার সামাজিক অবস্থানকে করতে হবে আরও শক্ত। বিচারের পাশাপাশি গড়ে তুলতে হবে এক সামাজিক ও সাংস্কৃতিক আন্দোলন। ধর্ষণকে থামাতে এর কোনও বিকল্প দেখছি না সামনে।

 লেখক: কলামিস্ট

/এসএএস/এমএনএইচ/

*** প্রকাশিত মতামত লেখকের একান্তই নিজস্ব।

বাংলা ট্রিবিউনের সর্বশেষ
চিয়া সিড খাওয়ার ৮ উপকারিতা
চিয়া সিড খাওয়ার ৮ উপকারিতা
ইউক্রেনের শান্তি পরিকল্পনা অর্থহীন: ল্যাভরভ
ইউক্রেনের শান্তি পরিকল্পনা অর্থহীন: ল্যাভরভ
বিএনপির নিগৃহীত নেতাকর্মীদের তালিকা চাইলেন ওবায়দুল কাদের
বিএনপির নিগৃহীত নেতাকর্মীদের তালিকা চাইলেন ওবায়দুল কাদের
৭ বছর পর নজরুল বিশ্ববিদ্যালয়ে ছাত্রলীগের নতুন কমিটি
৭ বছর পর নজরুল বিশ্ববিদ্যালয়ে ছাত্রলীগের নতুন কমিটি
সর্বশেষসর্বাধিক

লাইভ