X
মঙ্গলবার, ১৬ এপ্রিল ২০২৪
৩ বৈশাখ ১৪৩১

‘ফ্যামিলিস নিড ফাদারস’

সাদিয়া নাসরিন
২৩ নভেম্বর ২০১৭, ১৭:০০আপডেট : ২৩ নভেম্বর ২০১৭, ১৭:০৩

সাদিয়া নাসরিন নারীবাদী গবেষক জুলিয়েট মিচেলের একটি বিখ্যাত উক্তি আছে, ‘Maternity Necessitates Withdrawal from Work’। এই দক্ষিণ এশিয়ার, বিশেষ করে বাংলাদেশের ‘মা’ হওয়া প্রতিটি মেয়েই মিচেলের এই মর্মান্তিক সত্যের সঙ্গে একাত্ম হতে পারে। যে কোনও নারীর জন্যই শিশু নিঃসন্দেহে এক মধুর অভিজ্ঞতা, কিন্তু গর্ভধারণ ও সন্তান পালন যখন বাধ্যতামূলক হয়ে ওঠে তখন তা বড়ো মর্মান্তিক হয়ে ওঠে। যখন নারী রোজগার করতে চায়, আঁকতে চায়, লিখতে চায়, গাইতে চায়, নাটক করতে চায়... মাতৃত্বের জন্য তাকে কেবল ছাড়তে হয়, পুরুষকে ছাড়তে হয় না কিছুই পিতৃত্বের জন্য।
যে মেয়েরা সৃজনশীল বা গঠনমূলক কাজ করতে চায়, যাদের মেধা বিকাশের মতো গুণ ও প্রতিভা আছে, তাদের কাছে এখনও সন্তান পালনের বাধ্যবাধকতার চেয়ে বড় প্রতিবন্ধকতা আর কিছু নেই। স্বামী বা পরিবারের বাধা হয়তো মনের জোরে বা অর্থনৈতিক সক্ষমতার জোরে কাটানো যায়, কিন্তু প্রতিটি মেয়ের কাছেই অলঙ্ঘনীয় বাধা সন্তানের প্রতি ভালোবাসা। এই ভালোবাসার কারণেই একটি সন্তানকে অর্জন করতে একজন মাকে অন্তত পাঁচ বছরের ত্যাগের মূল্য দিতে হয়। এই ত্যাগ শারীরিক পরিশ্রম, মানসিক চাপ, কর্মজীবনে ঝরে পড়া আর নিজস্ব বিনোদন বিসর্জনের সমষ্টি।

আমরা যারা বাইরে কাজ করি বা যে কোনও গঠনমূলক কাজের সঙ্গে নিজেকে যুক্ত করতে চাই, তারা সবাই প্রতিদিন নিজের ভেতরে বিভিন্ন রকমের ভূমিকার মধ্যে ‘কনফ্লিক্ট’ এর শিকার হই। যে ভূমিকাটির সঙ্গে আমাদের সবচেয়ে বেশি সংঘর্ষ হয় তা হলো মাতৃত্বের। একদিকে বাচ্চার নিরাপত্তা, অন্যদিকে নিজের অন্যান্য সামাজিক-অর্থনৈতিক ভূমিকা পালন। নারীর বাধ্যতামূলক সন্তান পালনের দায়িত্বের সঙ্গে অন্যান্য দায়িত্বের এই সংঘর্ষ বেদনার, ক্লান্তিকর এবং নিরন্তর বিষন্নতার।

সে বেদনার অভিজ্ঞতা আমরা শুনতে পাই নারীবাদী লেখক, তিন সন্তানের মা এড্রিয়েন রিচ-এর দিনযাপনের বর্ণনায়, ‘বহুদিন পর্যন্ত আমার বাচ্চাদের জীবনের প্রথম দশকের দিকে ফিরে তাকাতেও বিভীষিকা হতো। ওই সময়ের স্ন্যাপশটে আমি দেখি মাতৃত্বের পোষাকে অর্ধনগ্ন শিশুর ওপর ঝুঁকে দাঁড়িয়ে থাকা এক হাস্যোজ্জ্বল তরুণীকে; ক্রমশ সে হাসি থামিয়ে দেয়, বিষণ্ন হয়ে দূরে কোথাও তাকিয়ে থাকে, যেন অন্য কিছু শোনার প্রতীক্ষায়...’ রিচের এই বেদনাকে আমি নিজের মধ্যে ধারণ করতে পারি।

তার মতো আমিও তিন সন্তানের মা। যদিও আমার সন্তানদের বাবা আমার সঙ্গে ভাগ করে নিয়েছে মাতৃত্বের দায়িত্ব, তবুও প্রতিমুহূর্তে আমি বুঝতে পেরেছি এই সমাজ ব্যবস্থা এবং কাঠামো তার জন্য সেটা বাধ্যতামূলক করেনি, আমার জন্য করেছে। ফলে, সে সন্তান পালন করেছে তার স্বাধীন মর্জি মতো, আমাকে করতে হয় আবশ্যিকভাবে। আবার তার এই মর্জির জন্য আমাকে তার কাছে কৃতজ্ঞ থাকতে হয় সব সময়। আর আমার রোজগার করা, অফিস ট্যুর করা, লেখালেখি করা, পড়াশোনা করা, ঘুরতে যাওয়া, আড্ডা দেওয়া সব কিছুর মধ্যেই বাধ্যতামূলক পিছুটান আমাদের তিন সন্তান।

আমাকে সব কিছুর মধ্যেই আগে তাদের কথা ভাবতে হয়, সমন্বয় করতে হয়, সারাক্ষণ দৌড়ের ওপর থাকতে হয়। আমি অনেক সময়ই প্রচণ্ড মানসিক চাপ বোধ করি, কাজের কোয়ালিটি হারাই, দিনের পর দিন লেখার সময় পাই না, তীব্র বিষণ্নতায় আক্রান্ত হই। সারাদিন বাচ্চাদের সামলিয়ে রাতে না ঘুমিয়ে কাজ করতে হয়, ঘুমহীনতার ফলে আমার স্বাস্থ্য নষ্ট হয়। মাতৃত্বের এই কষ্ট সুখের নিশ্চয়ই, কিন্তু সর্বগ্রাসী।  

এই বাস্তবতাকে বুঝতে পেরেই সত্তরের দশকে যুক্তরাজ্যে ‘ফ্যামিলিস নিড ফাদারস’ নামে এই সামাজিক আন্দোলন শুরু হয়, যা নারীর ওপর আরোপিত মাতৃত্বের মিথকে চ্যালেঞ্জ করে সন্তান পালনের বাধ্যবাধকতা থেকে নারীকে মুক্ত করে এবং পুরুষকেও সন্তান পালনের সহযোগী করে তোলার ক্ষেত্রে কার্যকর ভূমিকা রাখে। এই আন্দোলন সম্পর্কে বিস্তারিত আলোচনায় না গিয়েও এর নামের মধ্যে যে মানবিক আর্তি আছে তা-ই বিশ্বব্যাপী মায়েদের ব্যক্তিগত বেদনা ও ত্যাগের অনুভূতিতে একাত্ম করতে পেরেছে এবং ব্যাপক জনপ্রিয়তার কারণে এই আন্দোলন একসময়ে সাংগঠনিক রূপ পেয়েছে।  

পরবর্তীতে এই সংগঠন ইউরোপে মাতৃত্বের অনুকূল এমন একটি সুবিন্যস্ত সমাজ ব্যবস্থা প্রতিষ্ঠিত করতে ভূমিকা রেখেছে যেখানে পুরুষকে পরিবারে এবং সন্তান পালনে সম্পৃক্ত করা হয়। ফলে ইউরোপের নারী-পুরুষ উভয়েই এই সত্য বুঝতে পারে যে সন্তান পালনে পিতার অংশগ্রহণ বাড়লে নারী নিজে সমৃদ্ধ ব্যক্তিগত জীবনযাপন করতে পারে এবং অর্জন করে সত্যিকার মানবিক মূল্যবোধ, ফলে সেই মা সন্তানদের সবচেয়ে ভালোভাবে লালন-পালন করতে সক্ষম।

কিন্তু দক্ষিণ এশিয়ার পুরুষতান্ত্রিক ব্যবস্থা, বিধি-বিধান আজকের দিনেও মাতৃত্ব এবং সন্তান পালন শুধু নারীর জন্য বাধ্যতামূলক করেছে। এখানে নারী পুরুষ বৈবাহিক সম্পর্কে আবদ্ধ হয় শুধুমাত্র সন্তান জন্মদানের জন্য এবং সন্তান পালনের জন্য নারীকে ভোগ করতে হয় আজীবন গৃহদণ্ড, বন্দি হয় পরিবার নামক প্রাইভেট ডোমেইনে। সহজ স্বাভাবিক প্রাকৃতিক মাতৃত্বকে প্রাতিষ্ঠানিক রূপ দিয়ে, ‘নারীরা মায়ের জাত’, ‘মাতৃত্বেই নারীর সার্থকতা’ এই পুরুষের রচিত মিথগুলোকে সুবাসিত করে, গর্ভধারণ ও স্তন্যদানের সঙ্গে শিশুপালনের একচ্ছত্র দায় নারীর কাঁধে চাপিয়ে দিয়ে স্বাধীন, মুক্ত, উপার্জনকারী নারীকে যে কারাগারে বন্দি করেছে তার নাম হেরেম, অন্তঃপুর, প্রাইভেট ডোমেইন। তার প্রাতিষ্ঠানিক নাম পরিবার।

পুরুষতন্ত্র নারীকে অন্তঃপুরে আটকে রাখার জন্য শুধু যে নিয়ম-কানুন বানিয়েই নিশ্চিন্ত হয়েছে তাই নয়, ছলও করেছে। মাতৃত্বের গৌরব তেমনই এক আবেগীয় রাজনীতি―যেখানে নারীর সন্তান জন্মদানের স্বাভাবিক এবং জৈবিক ক্ষমতাকে ঢাল হিসেবে ব্যবহার করে এবং তাতে সম্মান আর মহিমা লাগিয়ে নারীকে প্রসব ও সন্তান পালনে ব্যস্ত রাখে পুরুষ―আর সে সুযোগে উৎপাদন ও অর্থনীতির চাবি করায়ত্ত করে নিয়েছে পুরুষ। যে মাতৃত্ব ছিল নারীর নিজস্ব সম্পদ তাকে দখল করেই পুরুষ নারীর মালিক হয়ে উঠেছে। তার জন্য প্রতিষ্ঠিত করেছে মায়ের সঙ্গে সন্তানের নাড়ির টান বলে এক অসত্য, অযৌক্তিক কিংবদন্তী।

এই নাড়ির টান বলে যে মিথ, তার কিন্তু কোনও জৈবিক ভিত্তি নেই। যা আছে তার পুরোটাই হলো সন্তানের সঙ্গে মায়ের নিরবচ্ছিন্ন শ্রম, যোগাযোগ আর মনোযোগে গড়ে তোলা সম্পর্ক। সন্তানকে শারীরিকভাবে পালন করে, যত্ন দিয়ে, মনোযোগ দিয়ে যোগাযোগ স্থাপন করতে পারলে সন্তানের সঙ্গে নাড়ির টান একজন বাবারও গড়ে উঠতে পারে। এখানে সন্তান জন্মদানের জৈবিক ক্ষমতার সঙ্গে সামাজিকভাবে নির্মিত মাতৃত্বের ভূমিকাকে মিলিয়ে ফেললে চলবে না। সন্তান ধারণ ও জন্মদানের জন্য নারীর জরায়ু আছে, কেবল এটুকুই ‘মা’ হওয়ার জন্য নারীর জৈবিক বাধ্যতা।

এর বাইরে আর যেসব দায়িত্ব পালনের জন্য মাতৃত্বকে মহান করা হয়েছে তার সবটুকুই পুরুষ করতে পারে। কারণ সন্তানের যত্ন নেওয়ার জন্য বা বাচ্চা পালন করার জন্য তো আর জরায়ুর প্রয়োজন নেই। পৃথিবীতে প্রচুর একা বাবা আছেন যারা পূর্ণ মাতৃত্ব দিয়েই সন্তান বড় করছেন। ছোটবেলা থেকে পুতুল পালতে দিয়ে, সেবামূলক কাজ করিয়ে মেয়েশিশুকে যেভাবে মাতৃত্ব শেখানো হয়, সেভাবে কিন্তু একটি ছেলেকেও মাতৃত্বের গুণাবলী শেখানো যায়। আমি নিজের পরিবারে দেখেছি, আমার সন্তানদের বাবা আমার চাইতে অনেক বেশি যত্ন নিয়ে সন্তান পালন করতে পারেন।

পরিবারে বাবারা সন্তান লালন-পালনের কাজে ন্যায্য ভূমিকা নিয়ে এগিয়ে এলে মা-বাবা এবং সন্তানের মধ্যকার সম্পর্কে পরিবর্তন আসে। কারণ, তখন সন্তানের মা ও বাবা উভয়েই সন্তানের জন্য বেশি সময় দেন বলে নারীরা তাদের কাজের ‘দ্বিগুণ বোঝা’ থেকে মুক্তি পান এবং বাবারাও সন্তান বড় করার আনন্দ, সন্তানের সঙ্গে নিবিড় যোগাযোগ স্থাপনের তৃপ্তি এবং চাপ সম্পর্কে অভিজ্ঞতা অর্জন করেন। আরোপিত মাতৃত্বের যে বাধা নারীকে পিছিয়ে রেখেছে তা দূর করার একমাত্র উপায় হলো সন্তানের সঙ্গে মায়ের সঙ্গে বাবারও আত্মিক যোগাযোগ তৈরি করা।

আমাদের মনে রাখতে হবে সন্তানের প্রতি দায়বদ্ধতা পালন করেও যেদিন নারী পুরুষ উভয়ের প্রতিভা ও যোগ্যতা চর্চা করার সমান সুযোগ মিলবে, সেদিনই সমাজে লিঙ্গসাম্য প্রতিষ্ঠিত হয়েছে বলে ধরে নেওয়া হবে। সুতরাং পুরুষের মধ্যে এই বোধ আসা খুব জরুরি যে, সন্তান পালনের দায়িত্ব বাবা ও মা দুজনের। পুরুষদের শিশু যত্নে সম্পৃক্ত করতে হলে, রাষ্ট্রীয় পর্যায়ে উপযুক্ত নীতিমালা ও কর্মসূচি প্রণয়নের প্রয়োজন। রাষ্ট্র শিশুর প্রারম্ভিক বিকাশ, যত্ন ও শিক্ষায় বাবাদের অংশগ্রহণ বাড়াতে উৎসাহিত করবে, যুক্তিসঙ্গত পিতৃত্বকালীন ছুটি সংক্রান্ত নীতিমালা গ্রহণ ও বাস্তবায়ন করবে এবং পিতৃত্বকালীন ছুটি অবশ্যই মাতৃত্বকালীন ছুটির সঙ্গে সঙ্গতিপূর্ণ হবে।

দিন শেষে, আমরা মাতৃত্বের অনুকূল একটি সুবিন্যস্ত সমাজের স্বপ্ন দেখছি যেখানে শিশুদের ভার প্রধানত নেবে পুরো সমাজ বা রাষ্ট্র ব্যবস্থা; যেখানে যত্ন নেওয়া হবে মায়ের এবং তাকে সাহায্য করা হবে, যেন নারীর জন্য মাতৃত্ব ও জীবিকা পরস্পর কঠিন হয়ে দাঁড়ায় না।  মাতৃত্ববোধ হোক নারী পুরুষ উভয়ের জন্য আত্মসমৃদ্ধির, কোনোভাবেই নারীর একা বিপন্নতার নয়।

লেখক: নারীবাদী লেখক ও অ্যাকটিভিস্ট

 

/এসএএস/টিএন/

*** প্রকাশিত মতামত লেখকের একান্তই নিজস্ব।

বাংলা ট্রিবিউনের সর্বশেষ
৫৫০ টাকার ভাড়া ৭০০ নেওয়ায় লাল সবুজ পরিবহনকে ২০ হাজার জরিমানা
৫৫০ টাকার ভাড়া ৭০০ নেওয়ায় লাল সবুজ পরিবহনকে ২০ হাজার জরিমানা
ভারতীয় নিরাপত্তাবাহিনীর সঙ্গে বন্দুকযুদ্ধে ২৯ মাওবাদী নিহত
ভারতীয় নিরাপত্তাবাহিনীর সঙ্গে বন্দুকযুদ্ধে ২৯ মাওবাদী নিহত
কানে আবার আমন্ত্রিত ঢাকার ঋতি
কানে আবার আমন্ত্রিত ঢাকার ঋতি
ডিপ্লোমাধারীদের বিএসসির মর্যাদা দিতে কমিটি
ডিপ্লোমাধারীদের বিএসসির মর্যাদা দিতে কমিটি
সর্বশেষসর্বাধিক

লাইভ