X
সোমবার, ২৩ জুন ২০২৫
৯ আষাঢ় ১৪৩২

‘এ মন হায়, একবার দুইবার নেতা হইবার চায়’

চিররঞ্জন সরকার
২৩ নভেম্বর ২০১৮, ১৭:৪৭আপডেট : ২৩ নভেম্বর ২০১৮, ১৭:৫৯

চিররঞ্জন সরকার এক সময় ডিফারেন্ট টাচ নামে একটি ব্যান্ড দলের গান খুব জনপ্রিয় হয়ে উঠেছিল। গানের কথাগুলো ছিল এ রকম: ‘হাল জামানার রাজনীতি ভাই, করতাছি যে আমরা সবাই/পেছন পকেট সদাই গরম, গলাবাজির আছে যে সায়।/এ মন হায়, একবার দুইবার নেতা হইবার চায়/শুনছি নাকি নেতারা সব এয়ারকন্ডিশন পায়।’

হ্যাঁ, আমাদের দেশে এখন যেভাবে নেতার ‘আধিক্য’ দেখা যাচ্ছে, তাতে করে ওই গানটিই অন্যতম গান হিসেবে পরিগণিত হতে পারে! এখন সবাই যেন নেতা হতে চায়। ঘরে ঘরে নেতা, পাড়ায় পাড়ায় নেতা।  নেতাদের ভিড়ে মঞ্চ ভেঙে পড়তে চায়। দেশ গড়ার, সমাজ বদলের অঙ্গীকার নেই, নিজেদের ভাগ্য বদলের কঠিন শপথ নিয়ে এই নেতারা জেগে উঠেছেন। কিলবিল করছেন। প্রতিটি সংসদীয় আসনে এখন নেতাদের ভিড়ে জনতা ঢাকা পড়েছে। নেতাদের পোস্টার আর বিলবোর্ডে এলাকা ছেয়ে গেছে। সবাই এলাকাবাসীকে ‘সালাম’ জানাচ্ছেন। ‘দোয়া’ চাইছেন। ‘দেশ সেবা’র সুযোগ চাইছেন। এসবের ফাঁকে ফাঁকে অনেকে আবার নিজের যোগ্যতা ও গুণের কথাও ব্যক্ত করছেন। ‘সেবাব্রতী-প্রতিভাধর সৎ-যোগ্য-দেশপ্রেমিক-মহৎ মানুষের’ পদচারণায় এখন বাংলার পথ-ঘাট-প্রান্তর-আকাশ-বাতাস মুখরিত!

সংসদ-নির্বাচন আমাদের দেশের সব নেতাদের একযোগে আত্মপ্রকাশের সুযোগ করে দেয়। যে যেই বিষয়ে পারদর্শী হোন না কেন, সবাই এমপি হতে চান। এমপি পদটি এখন খুবই সাধারণ হয়ে গেছে। ঝাড়ুদার-দোকানদার-আমলা-পকেটমার-যন্ত্রী-মন্ত্রী যারই পকেটের জোর আছে, সে-ই এখন এমপি হতে চান। কোনও একটা পার্টির মনোনয়নপত্র কেনেন। তারপর দাপিয়ে বেড়ান ভোটারের সমর্থন পাওয়ার জন্য। বড় দলগুলোতে এক আসনেই ১০ থেকে ১৫ জন প্রার্থী মনোনয়ন ফরম কিনেছেন। তারা সবাই চান এমপি হতে। এলাকার মানুষের ‘সেবা’ করতে। যেন এমপি না হলে মানুষের ‘সেবা’ করা যায় না!

বিভিন্ন সব গুণের মানুষেরা এখন ‘নির্বাচন-সরোবরে’ অবগাহনের জন্য একাত্ম হয়েছেন। পাপী-তাপী-পুণ্যবান-সবাই যেমন তীর্থে যান, ঠিক তেমনি সবাই নির্বাচন নামক তীর্থ-কেন্দ্রে পৌঁছানোর সাধনায় মশগুল। সবাই নির্বাচন করতে চায়, এমপি হতে চায়, সেবা করার সুযোগ চায়!

এই হাল-জমানার এই নেতাদের কাছে দেশ বড় কথা নয়, আদর্শ বড় কথা নয়, ক্ষমতাই বড় কথা। চেয়ার দখলই বড় কথা। তাই ক্ষমতার লড়াইয়ে তারা পরস্পর অসম প্রতিযোগিতায় মাঠে নেমেছে। এক নেতা আর এক নেতাকে শ্রদ্ধা করে না। জুনিয়র-সিনিয়রকে মানে না। একে অপরকে সহ্য করতে পারে না। আর এসব সুবিধাবাদী, হাইব্রিড রাতারাতি গজিয়ে ওঠা নেতাদের কারণে পোড়খাওয়া সৎ নেতারা রাজনীতি থেকে ছিটকে পড়েছেন। তাদের কোনও ভাত নেই। কালো টাকার খপ্পরে রাজনীতি কলুষিত হয়ে পড়েছে। অথচ ‘নেতৃত্ব’ বলতে আমরা এতদিন যা বুঝে এসেছি, তা হলো ‘পরিবর্তন’ বা ‘পরিবর্তনের অঙ্গীকার’। তিনিই হবেন প্রকৃত নেতা, যিনি সমাজের কোনও না কোনও ক্ষেত্রে সেই ‘কাঙ্ক্ষিত ইতিবাচক পরিবর্তন’ আনতে সক্ষম হবেন। নেতৃত্বের সৃষ্টিশীল প্রক্রিয়াতে ‘পরিবর্তন’ই হবে তার চূড়ান্ত লক্ষ্য, যার মাধ্যমে তিনি একটা সুন্দর সমাজ কিংবা পৃথিবী গড়তে অবদান রাখবেন। তার অন্যতম প্রধান গুণ হলো তাকে দূরদৃষ্টিসম্পন্ন এবং ভিশনারি  হতে হবে। তাকে ‘ভেতর’ দেখার ক্ষমতা থাকতে হবে। কেউ যদি দূরদৃষ্টিসম্পন্ন বা ভিশনারি না হন এবং সমাজে ‘কোনও না কোনোভাবে’ ইতিবাচক পরিবর্তন আনতে না পারেন, তবে তিনি ‘নেতা’ বলে দাবি করতে পারেন না। এখানে মনে রাখা দরকার, ‘ভিশন ইজ দ্য এবিলিটি টু সি সামথিং ইনভিজিবল’ (যা দেখা যায় না, তাকে দেখার ক্ষমতাই দূরদৃষ্টি)। আর হ্যাঁ, নেতাকে অবশ্যই নৈতিকতার সর্বোচ্চ মান (হাইয়েস্ট এথিক্যাল স্ট্যান্ডার্ড) অর্জন করতে হবে। কিন্তু আমাদের দেশে এমন আদর্শিক নেতার আজ  বড়ই অভাব।

বাংলাদেশ এখন যেন নেতা উৎপাদনের কারখানায় পরিণত হয়েছে। এখন দলে কোনও কর্মী নেই, সবাই নেতা। আর নেতা বেশি হওয়ায় দুর্ভোগও বেশি।  নেতা বেশি হওয়ায় বক্তৃতাও বেশি। কিন্তু তাদের সে বক্তৃতা কেউ শুনতে চায় না। পাড়া-মহল্লা-শহর সবখানে নেতার ছড়াছড়ি। রাস্তার ল্যাম্পপোস্ট কিংবা গাছের ডালে ঝুলতে দেখা যায় নেতাদের পোস্টার-ফেস্টুন। আর সেসব পোস্টার-ফেস্টুনে দলের মূল নেতানেত্রীর ছবি ছোট করে থাকলেও স্বঘোষিত ওই নেতার ছবি থাকে বিশাল আকৃতির। এ জন্য অবশ্য এই পোস্টার-ফেস্টুন লাগানো নেতাকে দোষ দেওয়া যায় না। নিজের টাকার ফেস্টুন বানাবেন, নিজের ছবিই তো বড় করে দেবেন!

অথচ একসময় রাজনৈতিক দলগুলোতে নেতার সংখ্যা ছিল নেহায়েতই অল্প। সবাই ছিল কর্মী। এমনকি যারা নেতৃস্থানীয় ছিলেন তাদের মধ্যে অনেকে আবার বিনয়ের সঙ্গে নিজেকে কর্মী হিসেবেই পরিচয় দিতেন। আর এখন কর্মী পরিচয় দেওয়াটা অনেকের কাছেই যেন লজ্জার বিষয়। চলনে-বলনে, আচার-আচরণে, ভাব-ভঙ্গি আর কথাবার্তায় এটা জাহির করতে চান যে, তিনি অমুক দলের একজন নেতা। এরা আবার সংগঠনের পরিচয়সহ ভিজিটিং কার্ডও ছেপে থাকেন। আর তাতে সংযুক্ত থাকে নিজের ছবি। নেতা পরিচয়ে সমাজে পরিচিত হতে কী আগ্রহ।

কিন্তু এর কারণ কী? কেন সবাই নেতা হতে চায়? কেন আর কর্মী থাকতে চায় না কেউ? কারণটা একেবারে সোজা। নেতা পদবিটি এখন খুবই আকর্ষণীয় এবং লাভজনক। নেতা পরিচয়ে পরিচিত হতে পারলে জীবনে উন্নতির সিঁড়ি খুঁজে পেতে তেমন সমস্যা হয় না। অর্থ-বিত্ত-ক্ষমতা-দাপট সবকিছু এসে ধরা দেয়। তাই সবাই এখন নেতা হতে চায়। এ জন্য কে কাকে ল্যাং মেরে ওপরে উঠবেন সে কসরতে লিপ্ত সবাই। আর কার চেয়ে কে বড় নেতা, এটা জাহির করতে এমন কোনও হীন কাজ নেই যা তারা করতে পারেন না।

রাজনীতি ছিল একসময় দেশ ও মানুষের সেবা করার সবচেয়ে উত্তম পন্থা। যারা রাজনীতির খাতায় নাম লেখাতেন তারা আত্মস্বার্থ কখনও বিবেচনায় রাখতেন না। দেশ-জাতি, মানুষের কল্যাণই ছিল তাদের মূল উদ্দেশ্য। তারা জাতির কল্যাণ সাধনায় ব্রতী হয়ে নিজেদের দিকে তাকানোর সময় পেতেন না। জনগণের স্বার্থকে সর্বোচ্চে তুলে ধরে সত্য ও ন্যায়ের পথে থাকতেন সব ধরনের ভয়-ভীতি, লোভ-লালসাকে উপেক্ষা করে। আর এখন? নেতারা পরিণত হয়েছেন সবচেয়ে লোভী মানুষে। তারা মরিয়া চেষ্টা চালান ক্ষমতা দখলে রাখতে, কিংবা দখল করতে। এই ক্ষমতা নামক আলাদীনের চেরাগের জোরে তারা বিশাল কোটিপতিতে পরিণত হোন। নানান সুযোগ-সুবিধা বাগিয়ে নেন। ফুলে-ফলে শোভিত হয় তাদের জীবন।

বর্তমানে দলগুলোও হয়েছে টাকা বানানোর মেশিন। উঠতি ও ভবিষ্যৎ নেতাদের কাছে দলগুলো নানা ফিকিরে টাকা নেয়। ‘মনোনয়ন বাণিজ্য’ কথাটি আমাদের দেশে এখন বহুল প্রচলিত। বড় বড় দলগুলোর কিছু নেতা, যারা মনোনয়ন প্রক্রিয়ায় প্রভাব রাখতে সক্ষম তারা অর্থের বিনিময়ে মনোনয়ন দিয়ে থাকেন। এটা আগে শুধু ছিল জাতীয় সংসদ নির্বাচনের ক্ষেত্রে। বর্তমানে তা সিটি করপোরেশন, পৌরসভা, উপজেলা এবং ইউনিয়ন পর্যায় পর্যন্ত বিস্তার লাভ করেছে।

রাজনৈতিক দলগুলোর মনোনয়ন বাণিজ্য এখন গা-সওয়া হয়ে গেছে। অনেকে এটাকে স্বাভাবিক বলেই এখন মনে করেন। স্বাধীনতা পূর্বকালে এ দেশের বাম ধারার রাজনৈতিক দলগুলোর একটি স্লোগান ছিল- ‘লাঙ্গল যার, জমি তার।’ কোনও কোনও রাজনৈতিক দলে এখন ‘পদ বাণিজ্য’, ‘কমিটি বাণিজ্য’ও ব্যাপকতা লাভ করেছে। কেন্দ্রীয় কমিটি হোক, কিংবা জেলা-উপজেলা কমিটি হোক, যেকোনও কমিটিতে ঠাঁই পাওয়ার একটি সহজ উপায় হলো দায়িত্বপ্রাপ্ত নেতাদের খুশি করা। এর ফলে কোনও ধরনের রাজনৈতিক অভিজ্ঞতা না থাকা সত্ত্বেও অনেকে বিভিন্ন স্তরে গুরুত্বপূর্ণ পদ দখলে সমর্থ হন। পদ কিনে নেতা বনে যাওয়া এসব ব্যক্তি দলের প্রতি কমিটেড হতে পারে না। এদের দলের প্রয়োজনে মাঠে পাওয়া যায় না। এসবই এখন ওপেন সিক্রেট। সবাই জানেন, সবাই বলেন। কিন্তু দলগুলোর কোনও বিকার নেই।

একজন এমপির কাজ কী সেটা না জেনেই আজ  পঙ্গপালের মতো মানুষজন মনোনয়নপত্র কিনছেন। কারণ, তারা জানেন এমপি হওয়া মানেই ক্ষমতা হাতে পাওয়া, টাকা কামানো ও টাকা বানানোর অবাধ সুযোগ, মন্ত্রী হওয়ার সম্ভাবনা তৈরি হওয়া। এই সুযোগ-সুবিধার লোভেই আজ  বাংলাদেশে হঠাৎ গজিয়ে ওঠা কথিত নেতাদের এত ভিড়!

 

 

 

 

ওএমএফ

*** প্রকাশিত মতামত লেখকের একান্তই নিজস্ব।

বাংলা ট্রিবিউনের সর্বশেষ
রাজধানীর বিভিন্ন এলাকায় বৃষ্টি, কমেছে তাপমাত্রা 
রাজধানীর বিভিন্ন এলাকায় বৃষ্টি, কমেছে তাপমাত্রা 
দেশের সম্ভাবনাময় পর্যটন ব্যবসায় অশনিসংকেত
দেশের সম্ভাবনাময় পর্যটন ব্যবসায় অশনিসংকেত
টাঙ্গুয়ার হাওরে পর্যটকবাহী হাউসবোট চলাচল নিষিদ্ধ
টাঙ্গুয়ার হাওরে পর্যটকবাহী হাউসবোট চলাচল নিষিদ্ধ
যশোরে আওয়ামী লীগের দুই নেতা গ্রেফতার
যশোরে আওয়ামী লীগের দুই নেতা গ্রেফতার
সর্বশেষসর্বাধিক