X
রবিবার, ০৫ মে ২০২৪
২২ বৈশাখ ১৪৩১

‘বানরের তৈলাক্ত বাঁশ’

আমীন আল রশীদ
০২ ফেব্রুয়ারি ২০১৯, ১১:৫৭আপডেট : ০২ ফেব্রুয়ারি ২০১৯, ১১:৫৮

আমীন আল রশীদ তৈলাক্ত বাঁশ বেয়ে বানরের ওপরে ওঠা এবং পরক্ষণেই নিচে নেমে যাওয়ার অদ্ভুত অংকের যৌক্তিকতা নিয়ে প্রশ্ন তুলে ছোটবেলায় শিক্ষকের মার খেয়েছিলাম। এখন বুঝতে পারছি সেই মারটাও যৌক্তিক ছিল। কারণ আমাদের চারিপাশে যা কিছু দেখি, তার সবই এই বানরের তৈলাক্ত বাঁশ বেয়ে ওপরে ওঠা এবং নিচে নেমে যাওয়ারই গল্প।
সম্প্রতি দুটি সংবাদ কাছাকাছি সময়ে গণমাধ্যমের শিরোনাম হয়েছে। ২০ জানুয়ারি বাংলা ট্রিবিউনের শিরোনাম: ‘বিশ্বের শীর্ষ হতদরিদ্রের তালিকায় বাংলাদেশ পঞ্চম, ভারত প্রথম’। বিশ্বব্যাংকের বরাতে ওই সংবাদে বলা হয়েছে, বর্তমানে বাংলাদেশে হতদরিদ্রের (দৈনিক ১ ডলার ৯০ সেন্টের কম আয়) সংখ্যা ২ কোটি ৪১ লাখ।
এর আগে বিবিসির একটি খবর: ‘বিশ্বে অতি ধনী (বাংলাদেশি টাকায় যাদের সম্পদ আড়াইশো কোটি টাকার বেশি) মানুষের সংখ্যা সবচেয়ে দ্রুত হারে বাড়ছে বাংলাদেশে’। একদিকে কিছু লোক ধনী থেকে ধনীতর হচ্ছে, এর বাইরে বিপুল জনগোষ্ঠী দরিদ্র থেকে হতদরিদ্র হচ্ছে। অর্থাৎ বিপুল সংখ্যক দরিদ্র মানুষের সম্পদ চলে যাচ্ছে কিছু ধনী লোকের হাতে। অর্থনীতির ভাষায় যেটিকে বলে বৈষম্য, সেটি ক্রমবর্ধিষ্ণু। সুতরাং ক্রমবর্ধিষ্ণু বৈষম্যের ভেতরে কিছু লোকের ধনী হওয়া এবং দৃশ্যমান অবকাঠামোর পরিমাণগত (গুণগত নয়) সংখ্যা বৃদ্ধিকে উন্নয়নের সূচক বলা যাবে কিনা, তা নিয়েও অর্থনীতিবিদরা বিভিন্ন সময়ে সংশয় প্রকাশ করেছেন।

সবশেষ অক্সফামের প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, বিশ্বে ধনী দরিদ্রের বৈষম্য মাত্রা ছাড়িয়ে গেছে। এতে বলা হয়েছে বিশ্বের শীর্ষ ধনী ২৬ বিলিওনিয়ারের মোট সম্পত্তির পরিমাণ ৩৮০ কোটি মানুষ বা মোট দরিদ্র জনগোষ্ঠীর অর্ধেক লোকের সমান। প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, ধনীদের ওপর ১ শতাংশ হারে কর আরোপ করলে তা দিয়ে সব স্কুলে না যাওয়া শিশুদের শিক্ষা নিশ্চিত করা যাবে।

এ বিষয়ে অক্সফামের প্রচার ও নীতি বিষয়ক পরিচালক ম্যাথিউ স্পেনসার বলেছেন, ‘চরম দারিদ্র্যে বাস করা মানুষের সংখ্যা কমে আসা গত শতকের শেষ অর্ধেকের বড় অর্জন। কিন্তু ক্রমবর্ধমান অসমতা ভবিষ্যতে এ বিষয়ে অগ্রগতিকে জটিল করে তুলছে।

যদিও বাংলাদেশে অতি ধনীর সংখ্যা বৃদ্ধিতে বিশেষজ্ঞরা বিস্মিত নন। কারণ কয়েক বছর ধরেই যে বাংলাদেশে কতিপয় লোকের হাতে অজস্র সম্পদ চলে গেছে এবং যাচ্ছে, সেইসঙ্গে রাষ্ট্রীয় নীতিও যেখানে অবৈধভাবে ধনী বা সম্পদশালী হওয়ার পেছনে ইন্ধন দিচ্ছে, অর্থাৎ সুশাসনের ঘাটতি ও দুর্নীতির অবাধ বিস্তারের ফলে যে যেভাবে পারছে টাকা বানাতে পারছে—সেরকম বাস্তবতায় অতি ধনীর সংখ্যা বাড়বে, সেটিই স্বাভাবিক।

ইতিবাচক দিকও আছে। তৈরি পোশাক, ওষুধ, জাহাজ ভাঙা, চামড়াসহ বিভিন্ন শিল্পের বিকাশ  হচ্ছে এবং এসব খাতে প্রচুর বিনিয়োগ হচ্ছে। ফলে বৈধ পথেও অনেকে অতি ধনী হচ্ছেন। গত দশ বছরে ব্যবসা ও শিল্পখাতে রাষ্ট্রীয় পৃষ্ঠপোষকতা ও প্রণোদনা যথেষ্ট ইতিবাচক এবং তাতে ব্যবসায়ী ও শিল্প উদ্যোক্তারা এতটাই সন্তুষ্ট যে, একাদশ জাতীয় নির্বাচনের মাত্র ১১ দিন আগে ১৯ ডিসেম্বর রাজধানীতে যে ব্যবসায়ী সম্মেলন হয়, সেখানে দলমত নির্বিশেষে দেশের শীর্ষ ব্যবসায়ীরা উপস্থিত ছিলেন এবং সেই সম্মেলনের মধ্যমণি ছিলেন শেখ হাসিনা—যাকে ব্যবসায়ীরা শুধু ‘আশার প্রতীক’ বলেই আখ্যায়িত করেননি, বরং দেশের অর্থনীতির স্বার্থে তাকে আবারও প্রধানমন্ত্রী হিসেবে দেখার আকাঙ্ক্ষা প্রকাশ করেন। জাতীয় নির্বাচনের আগ মুহূর্তে একটি দলের প্রতি দেশের শীর্ষ ব্যবসায়ীদের এভাবে সমর্থন দেওয়ার নজির দেশের ইতিহাসে এই প্রথম এবং এর একটি বিশাল রাজনৈতিক তাৎপর্যও আছে।

ধনী-দরিদ্রের এই বিতর্ক চলাকালীন ঢাকা উত্তর সিটির প্রয়াত মেয়র আনিসুল হকের ছেলে, ব্যবসায়ী নাভিদুল হক ২১ জানুয়ারি ফেসবুকে রাজধানীর বারিধারা এলাকার একটি রাস্তার ছবি দিয়ে লিখেছেন, জে ব্লকে তার বাসার পেছনের রাস্তাটি বছরখানেক আগে নতুন করে তৈরি করে ডিএনসিসি। কিন্তু গত ২০ জানুয়ারি থেকে ডেসকো/ ডিপিডিসি রাস্তা কাটছে। খোঁজ নিয়ে তিনি জানতে পেরেছেন কর্তৃপক্ষ একটি লাইন খুঁজে পাচ্ছে না বলে রাস্তা কেটে লাইন বের করছে। একইভাবে তেজগাঁওয়ে বানানো নতুন রাস্তা, যার বয়স এখনও এক বছরও হয়নি, সেটিও কেটে ফেলা হয়েছে বলে তিনি উল্লেখ করেছেন।  অর্থাৎ একদিকে কোটি কোটি টাকা খরচ করে রাস্তা বানিয়ে উন্নত করা হচ্ছে এবং বছর না ঘুরতেই সেই রাস্তা ভেঙে ফেলা হচ্ছে আরেকটি উন্নয়নের দোহাই দিয়ে। তার মানে বানরটি প্রথম মিনিটে পাঁচ ফুট ওপরে উঠলো এবং পরের মিনিটে চার ফুট নিচে নেমে গেলো। এখন সেই তৈলাক্ত বাঁশের দৈর্ঘ্য যদি হয় দশ মিটার, তাহলে তার বাঁশের চূড়ায় উঠতে কত মিনিট লাগবে?

ঢাকা শহর শুধু নয়, উন্নয়নের নামে এভাবে জনগণের পয়সা অপচয়ের দৃশ্য সারা দেশেই। সরকারের সংশ্লিষ্ট পক্ষগুলোর মধ্যে সমন্বয়হীনতা না থাকাই শুধু নয়, বরং একই জায়গায় বারবার উন্নয়ন প্রকল্প নেওয়ার পেছনে প্রধানত দায়ী ঠিকাদার, সংশ্লিষ্ট কর্তৃপক্ষের অসৎ ও ঘুষখোর কর্মকর্তারা—যাদের কাছে প্রকল্প মানেই কমিশন ও লুটপাট।

একাদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচন সামনে রেখে বর্তমানে ক্ষমতাসীন আওয়ামী লীগ যে ইশতেহার দিয়েছে, সেখানে দুর্নীতির বিরুদ্ধে অবস্থান স্পষ্ট। তবে ইশতেহারের বাইরেও আওয়ামী লীগের নীতিনির্ধারকদের সঙ্গে কথা বলে বিভিন্ন সময়ে আমাদেরও মনে হয়েছে, এই মেয়াদে সরকার দুর্নীতির বিরুদ্ধে একটা বড় ধরনের পদক্ষেপ নেবে। এমনকি সাবেক একাধিক মন্ত্রী-এমপির বিরুদ্ধেও ব্যবস্থা নেওয়া হতে পারে। সরকার গঠনের পরে দুর্নীতির বিরুদ্ধে এই শক্ত অবস্থানের ঘোষণা প্রধানমন্ত্রী তো বটেই, অন্যান্য মন্ত্রীদের মুখেও শোনা গেছে এবং যাচ্ছে। সুতরাং দুর্নীতির বিরুদ্ধে সরকার সত্যিকারের জিরো টলারেন্স দেখাতে পারলে বানরের তৈলাক্ত বাঁশ বেয়ে ওপরে ওঠার অঙ্কটা অনেক সহজ হবে। কারণ বাঁশ তখন যত তৈলাক্তই হোক না কেন, বানর সঠিক সময়ে কাঙ্ক্ষিত চূড়ায় উঠতে পারবে। এক মিনিটে পাঁচ ফুট ওপরে ওঠে পরের মিনিটেই চার ফুট নেমে যেতে হবে না।

নাভিদুল হক তার ফেসবুক স্ট্যাটাসে তার প্রয়াত পিতার উদ্যোগের প্রসঙ্গ টেনে লিখেছেন, তার বাবা মেয়র থাকা অবস্থায় প্রযুক্তি ব্যবহার করে সরকারের উন্নয়ন কর্মকাণ্ডে সমন্বয়হীনতা বন্ধ করতে চেয়েছিলেন। তিনি চেয়েছিলেন “GIS” (জিওগ্রাফিক ইনফরমেশন সিস্টেম) ব্যবহার করে সব সেবা সংস্থা ওয়াসা, ডেসকো, তিতাস, বিটিসিএল মাটির নিচে থাকা তাদের বিবিধ পাইপ, ড্রেইন, তার সবকিছুর তথ্য ডিএনসিসির সেন্ট্রাল GIS-এ জমা করবে (এই সব সংস্থারই কমবেশি “GIS based” প্ল্যান এবং ম্যাপ আছে)। নতুন কাজ করার ছয় মাস আগেই তারা আবার “GIS” আপডেট করে রাস্তা কাটার অনুমতি চাইবে। তখন দেখা যাবে অন্য সেবা সংস্থার কী কী লাইন একই জায়গা দিয়ে গেছে এবং অন্যরাও প্ল্যান করতে পারবে, যেন রাস্তা একবার কাটা হলে সব কাজ একসাথে করা যায়। GIS আপডেট না করলে কোনও রাস্তা কাটার অনুমতিই দেওয়া হবে না। কিন্তু মনে রাখা দরকার, যারা সরকারের বিভিন্ন প্রকল্প বাস্তবায়ন করেন, তাদের একটা বড় অংশই এসব কর্মকাণ্ডকে নিজেদের উন্নয়নের হাতিয়ার হিসেবে ব্যবহার করেন। যে কারণে দেখা যায় জনগণের করের পয়সা নয়ছয় করে একজন তৃতীয় বা চতুর্থ শ্রেণির কর্মচারীও শত কোটি টাকার মালিক হয়ে যাচ্ছেন। বিদেশেও আলিশান বাড়ি তৈরি করছেন। কালেভদ্রে দুয়েকজনের দুই নম্বরি ফাঁস হয়ে গেলেও বা গণমাধ্যমে এলেও আড়ালে থেকে যান বাকিরা। এই সংখ্যা যে অগুনিত, তা দেশে অতি ধনী বৃদ্ধির ঘটনায়ই প্রমাণিত। 

সুতরাং একদিকে কিছু লোক বৈধ-অবৈধ নানা উপায়ে অতি ধনীর ক্লাবে ঢুকে যাবে, পক্ষান্তরে বিপুল জনগোষ্ঠীর মানুষ দরিদ্র থেকে হতদরিদ্র হবে, তাদের জীবন-জীবিকা আরও বেশি অনিশ্চয়তায় পড়তে থাকবে, এভাবে একটি মানবিক ও বৈষম্যমূলক রাষ্ট্র গড়ে তোলা সম্ভব নয়। এই অবস্থা থেকে উত্তরণের প্রধান হাতিয়ার রাজনৈতিক সদিচ্ছা, কেবল সুশাসন। দুর্নীতির বিরুদ্ধে সরকারের যে উচ্চকণ্ঠ, সেটি যদি শুধু কথার কথা বা রাজনৈতিক বুলি না হয়, যদি সরকার সত্যিকারেই অন্তত তার প্রশাসনযন্ত্রকে দুর্নীতিমুক্ত করতে একটা বড় পদক্ষেপ নেয়, তাহলে পাঁচ বছর পরে হলেও এখানে একটি বড় ধরনের পরিবর্তন আসবে। দুর্নীতির বিরুদ্ধে সবচেয়ে বেশি প্রয়োজন আতঙ্ক ছড়ানো। অর্থাৎ দুর্নীতি করলে তাকে প্রকাশ্যে শাস্তি দেওয়া, গণমাধ্যম ও সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে দুর্নীতিবাজদের ভিডিও ও চিত্র প্রকাশ করে দেওয়া, কয়েকজন শীর্ষ দুর্নীতিবাজের কঠোর তথা  দৃষ্টান্তমূলক শাস্তি নিশ্চিত করার মাধ্যমে এই ভয় ছড়িয়ে দেওয়া সম্ভব। তবে অবশ্যই সেটি হতে হবে নিরপেক্ষ এবং দলমত বিবেচনায় না রেখে। কারণ রাষ্ট্রে সুশাসন নিশ্চিতের একটি বড় শর্ত সংবিধানের আলোকে সব নাগরিকের প্রতি  সরকারের  বৈষম্যহীন তথা সমান দৃষ্টি। শুধুমাত্র রাজনৈতিক বিবেচনায় পদক্ষেপ নিলে তৈলাক্ত বাঁশ বেয়ে বানর প্রথম মিনিটে পাঁচ ফুট উঠবে ঠিকই, পরের মিনিটে আবার চার ফুট নেমে যাবে।

লেখক: সাংবাদিক

 

/এসএএস/

*** প্রকাশিত মতামত লেখকের একান্তই নিজস্ব।

বাংলা ট্রিবিউনের সর্বশেষ
দুবাইতে বিশ্বের ২৩ নম্বর চীনের সুপার গ্র্যান্ডমাস্টারের সঙ্গে ড্র করে ফাহাদের চমক
দুবাইতে বিশ্বের ২৩ নম্বর চীনের সুপার গ্র্যান্ডমাস্টারের সঙ্গে ড্র করে ফাহাদের চমক
বরিশালে পরিবহন শ্রমিকদের সংঘর্ষ, অর্ধশতাধিক থ্রি-হুইলার ভাংচুর
বরিশালে পরিবহন শ্রমিকদের সংঘর্ষ, অর্ধশতাধিক থ্রি-হুইলার ভাংচুর
জিরোনার মাঠে বার্সেলোনার নাটকীয় হারে চ্যাম্পিয়ন রিয়াল
জিরোনার মাঠে বার্সেলোনার নাটকীয় হারে চ্যাম্পিয়ন রিয়াল
‘ফাইভ স্টার’ ম্যানসিটি, চার গোল হাল্যান্ডের
‘ফাইভ স্টার’ ম্যানসিটি, চার গোল হাল্যান্ডের
সর্বশেষসর্বাধিক

লাইভ