X
মঙ্গলবার, ১৩ মে ২০২৫
৩০ বৈশাখ ১৪৩২

চাঁদের সমস্যা চোখে!

হারুন উর রশীদ
০৬ জুন ২০১৯, ১৩:২৫আপডেট : ০৯ জুন ২০১৯, ১৫:৩৮

হারুন উর রশীদ ঈদের চাঁদ দেখা আর না দেখা নিয়ে এবারই প্রথম বিভ্রান্তি নয়। এর আগেও এই বিভ্রান্তি হয়েছে। কিন্তু বিজ্ঞান বলে দিতে পারে—এখন থেকে ৫০০ বছর বা তারও পরে বাংলাদেশে কখন অমাবস্যা আর কখন পূর্ণিমা হবে, কোন মাসে কখন প্রথম চাঁদ দেখা যাবে, আর কখন ডুবে যাবে। তাহলে চাঁদ দেখা নিয়ে কেন এই বিভ্রান্তি! কেন এই সমালোচনার ঝড়?
এবার ঈদের চাঁদ বাংলাদেশের আকাশে কখন আসবে, তার আকার কী হবে, কতক্ষণ থাকবে, তার সবই কিন্তু জানা ছিল। বাংলাদেশ মহাকাশ গবেষণা ও দূর অনুধাবন প্রতিষ্ঠানের (স্পারসো) কাছে এই তথ্য আগেই ছিল। আর তাদের প্রতিনিধি চাঁদ দেখা কমিটির বৈঠকে উপস্থিত হয়ে তথ্য-উপাত্ত বিশ্লেষণ করে তা জানিয়েও দেন। তাদের বৈজ্ঞানিক তথ্যমতে, মঙ্গলবার (৪ জুন) বিকাল ৫টা ৪০ মিনিটে বাংলাদেশের আকাশে চাঁদ উঠেছে এবং ৭টা ৫১ মিনিটে ডুবেছে। চাঁদের দৃশ্যমান অংশ ছিল মাত্র শতকরা ১ ভাগ। বাংলাদেশ থেকে চাঁদের অবস্থান ছিল ৩৭ হাজার কিলোমিটার দূরে। আকাশে চাঁদের উপস্থিতি ছিল ৪৫ মিনিট।
শুধু তা-ই নয়, তারা স্যাটেলাইট ইমেজ বিশ্লেষণ করে জানিয়ে দেয়—দেশের একমাত্র পঞ্চগড়ের আকাশ একটু পরিষ্কার আছে। আর সবখানেই মেঘাচ্ছন্ন।

আমি জাতীয় চাঁদ দেখা কমিটির সভায় উপস্থিত স্পারসোর প্রধান বৈজ্ঞানিক কর্মকর্তা এস এম মিজানুর রহমানের সঙ্গে এ নিয়ে বিস্তারিত কথা বলেছি। আর সেই কথায় জানা গেলো, দৃশ্যমান চাঁদের যে আকার তার মাত্র শতকরা একভাগ আকাশে দেখা যাওয়ায় তা খালি চোখে দেখা ছিল খুবই কঠিন। এর সঙ্গে মেঘ তো ছিলই।

স্পারসো তাদের বৈজ্ঞানিক তথ্য দেয়। কিন্তু ঈদের চাঁদ দেখা গেছে কিনা, তার সিদ্ধান্ত হয় ধর্মীয় নিয়মের আলোকে। আর সেই নিয়মে চাঁদ দেখা মানে—চোখে চাঁদ দেখা।

এখন প্রশ্ন হলো, যদি জ্যোতির্বিজ্ঞান বলে চাঁদ উঠেছে তাহলে আবহাওয়া, মেঘ বা অন্য কোনও প্রাকৃতিক দুর্যোগের কারণে যদি খালি চোখে চাঁদ না দেখা যায়, তাহলে কি চাঁদ ওঠেনি? যদি এরকম ৭ দিন বা সপ্তাহ ধরে প্রাকৃতিক দুর্যোগ থাকে, চাঁদ চোখে না দেখা যায়, তাহলেও কি চাঁদ উঠবে না?

এই প্রশ্নের জবাব খুঁজতে গিয়ে যা জানলাম এবার তা আপনাদের একটু শোনাই। যারা ইসলামের নিয়ম সম্পর্কে ব্যাখ্যা দেন তাদের কথা হলো—আরবি মাস সর্বোচ্চ ৩০ দিনের হয়। তাই রোজা যদি ৩০টি হয় তার পরের দিন ঈদ হবে। এটা নিয়ে কোনও সন্দেহ বা সমস্যা ইসলামে নেই। খালি চোখে কেউ চাঁদ না দেখলেও হবে। এখানে চাঁদ দেখা আর না দেখা কোনও গুরুত্ব বহন করে না।

কিন্তু রোজা যদি ২৯টি হয় তাহলেই সমস্যা। এক্ষেত্রে চাঁদ যদি চোখে না দেখা যায়—তাহলে রোজা রাখতে হবে, বাদ দেওয়া যাবে না। ৩০ রোজা পূর্ণ করে ঈদ করতে হবে। এই চাঁদ দেখার আবার নিয়ম আছে। আকাশে যদি মেঘ থাকে বা খারাপ আবহাওয়া হয়, তাহলে কমপক্ষে দুইজন নির্ভরযোগ্য মুসলমানের চাঁদ দেখার সাক্ষ্য লাগবে। তাদের এই দেখায় যদি আলেম ওলামারা নিশ্চিত হন, তবেই তা চাঁদ দেখা বলে গণ্য হবে। আকাশ যদি পরিষ্কার হয়, তাহলে খোলা জায়গায় অনেক লোককে একসঙ্গে দেখতে হবে। আমি চাঁদ দেখা কামিটির সদস্য ঢাকার জামিয়া রহমানিয়া আরাবিয়া মাদ্রাসার প্রিন্সিপাল মাওলানা মাহফুজুল হকের সঙ্গে এ নিয়ে কথা বলেছি। তাকে প্রশ্ন করেছিলাম, মঙ্গলবার সন্ধ্যায় আকাশে মেঘ ছিল, যদি অঝোর ধারায় সারাদেশে তখন বৃষ্টি হতো, তাহলে তো কুড়িগ্রাম বা লালমনিরহাটেও কেউ চাঁদ দেখতো না। কেউই শেষ পর্যন্ত চাঁদ না দেখলে কি বুধবার ঈদ হতো না? তার সাফ জবাব, ‘২৯ রোজার ক্ষেত্রে দেশে কেউ যদি নিজ চোখে চাঁদ না দেখেন, তাহলে পরের দিন ঈদ হবে না। পরের দিনও রোজা রাখতে হবে। এটাই ইসলামের বিধান। বৈজ্ঞানিকভাবে চাঁদ আকাশে আসার প্রমাণ থাকলেও হবে না। এক্ষেত্রে বৈজ্ঞানিক তথ্য গ্রহণ করার কোনও সুযোগ নেই।’

আমি আগ্রহ নিয়ে আরও কিছু বিষয় জানার চেষ্টা করেছি। তাতে যা জানা গেলো, মঙ্গলবার রাত পৌনে ৯টা পর্যন্ত দেশের কোথাও চাঁদ দেখা যায়নি বলে ৬৪ জেলার ডিসি নিশ্চিত করেন। আর তার ভিত্তিতে ধর্মপ্রতিমন্ত্রী কমিটির সঙ্গে বৈঠক করা ছাড়াও চরমোনাই এবং হাটহাজারীর আলেমদের সঙ্গে কথা বলেন। তারপর সিদ্ধান্ত জানান—চাঁদ দেখা যায়নি, তাই বৃহস্পতিবার (৬ জুন) ঈদ। এই খবর সংবাদমাধ্যমে প্রচার হওয়ার পর কুড়িগ্রাম, লালমনিরহাট ও নীলফামারী থেকে কিছু লোক দাবি করেন, তারা যথাসময়েই চাঁদ দেখেছেন। তারপর প্রশাসনিকভাবে তাদের দাবির সত্যতা নিশ্চিত হয়ে রাত সাড়ে ১১টায় অবশেষে চাঁদ দেখার ঘোষণা দেওয়া হয়।

আর এতে আমার মনে হয়েছে, জেলা প্রশাসকরা যে প্রক্রিয়ায় চাঁদ দেখার খবর সংগ্রহ করেন, তা সর্বব্যাপ্ত এবং পর্যাপ্ত নয়। সাধারণ মানুষের মধ্যে পর্যাপ্ত প্রচার নেই যে, তারা চাঁদ দেখলে কোথায় তথ্য জানাবেন। হয়তো অনেকেই জানেন না তারা তথ্য জানালে সরকারের সিদ্ধান্ত নিতে সহায়তা হয়। তারা মনে করেন তারা চাঁদ দেখেছেন এবং দেশের আরও অনেকে দেখেছেন।

আবহাওয়া ভালো থাকলে এই সমস্যা হয় না। সমস্যা হয় আবহাওয়া খারাপ থাকলে। রোজা ৩০টি হলে সমস্যা হয় না। সমস্যা হয় ২৯টি হলে। আর আমাদের দেশে একটি প্রচলিত ধারণা আছে—সৌদি আরবের পরের দিন এখানে ঈদ। তাই সব সময়ই প্রশাসন, ইসলামিক ফাউন্ডেশন এবং ধর্ম মন্ত্রণালয়ের দায়িত্বশীল আচরণ করা প্রয়োজন। কারণ, এটা ধর্মীয় অনুভূতির ব্যাপার।

কিন্তু এরচেয়েও একটি বড় বিষয় নিয়ে আমার প্রশ্ন আছে। চাঁদ যদি সত্যিই উঠে থাকে, বিজ্ঞান যদি তা প্রমাণসহ নিশ্চিত করতে পারে, তাহলে চোখে দেখতে হবে কেন? বিজ্ঞান কি এ ব্যাপারে সঠিক তথ্য দিতে কখনও অক্ষম হয়েছে? আমরা কি বিজ্ঞান মানবো না?

আর বাংলাদেশ ঝড়, বৃষ্টি ও প্রাকৃতিক দুর্যোগের দেশ। আরব দেশে কিন্তু তেমন নয়। সেখানে স্বচ্ছ আর ঝকঝকে আকাশ ১৫শ’ বছর আগে ছিল, এখনও আছে। তাদের তো চাঁদ চোখে দেখতে সমস্যা হয় না। যত সমস্যা আমাদের।

স্পারসো এখন নতুন একটি প্রকল্প নিয়ে কাজ করছে চীনের সঙ্গে। তাতে অতি উচ্চ ক্ষমতাসম্পন্ন ১০টি বাইনোকুলার থাকবে। আর সেটা হলে ঝড়-বৃষ্টিতেও ওই পদ্ধতিতে চাঁদ দেখা যাবে। কত খরচ হবে জানতে পারিনি। তবে অনেক খরচের যে ব্যাপার তা আমাকে জানিয়েছেন স্পারসোর এক কর্মকর্তা। যাক, যতই খরচ হোক চোখে চাঁদ না দেখে তো আর বিশ্বাস করা যাবে না! তারপরও যদি এই ঝামেলা মেটে!

লেখক: সাংবাদিক

ইমেইল:[email protected]

 

/এপিএইচ/এমওএফ/

*** প্রকাশিত মতামত লেখকের একান্তই নিজস্ব।

বাংলা ট্রিবিউনের সর্বশেষ
লিবিয়ার ত্রিপোলিতে মিলিশিয়া প্রধান খুন, সংঘর্ষে নিহত ৬
লিবিয়ার ত্রিপোলিতে মিলিশিয়া প্রধান খুন, সংঘর্ষে নিহত ৬
পয়ঃবর্জ্য ব্যবস্থাপনায় সমন্বিত উদ্যোগে কাজ করবে ওয়াসা, রাজউক ও ডিএনসিসি
পয়ঃবর্জ্য ব্যবস্থাপনায় সমন্বিত উদ্যোগে কাজ করবে ওয়াসা, রাজউক ও ডিএনসিসি
এনবিআর কর্মকর্তাদের ৩ দিনের কলম বিরতির ঘোষণা
এনবিআর কর্মকর্তাদের ৩ দিনের কলম বিরতির ঘোষণা
অন্তর্বর্তী সরকার মানেই দুর্বল, এদের পেছনে জনসমর্থন নেই: হাফিজ উদ্দিন আহমেদ
অন্তর্বর্তী সরকার মানেই দুর্বল, এদের পেছনে জনসমর্থন নেই: হাফিজ উদ্দিন আহমেদ
সর্বশেষসর্বাধিক