X
বুধবার, ০১ মে ২০২৪
১৮ বৈশাখ ১৪৩১

জামায়াত রক্ষা প্রকল্প নাকি জোটের কফিনে পেরেক?

মোস্তফা হোসেইন
০৫ জুলাই ২০১৯, ১৩:৪৪আপডেট : ০৫ জুলাই ২০১৯, ১৩:৪৬

মোস্তফা হোসেইন এলডিপির চেয়ারম্যান অলি আহমদের জাতীয় মুক্তি মঞ্চ কি মুক্তির লক্ষ্যে সৃষ্টি? নাকি ২০ দলীয় জোটের সমন্বয়ক হিসেবে জোটের কফিনে পেরেকটি মারলেন তিনি? একাত্তরে ৩০ লাখ মানুষের রক্তে যে জামায়াতিদের বিভাজনরেখা তৈরি হয়েছে, সেই জামায়াতের কাঁধে সওয়ার হয়ে তিনি কোনও ঐক্য তৈরি করবেন? তিনি যখন জামায়াতকে নিয়ে জোট বা ঐক্যবদ্ধ হওয়ার চেষ্টা করছেন তখনও তো তিনি ২০ দলীয় জোটের সমন্বয়কের দায়িত্ব পালন করছেন। ২০ দলীয় জোটে ঐক্য সৃষ্টি না করে তিনি আলাদা জোট গঠন করে সেখানেও কি বিভাজন তৈরি করেননি?
একইসঙ্গে ২০ দলীয় জোটের প্রধান দল বিএনপি যখন ড. কামাল হোসেনের নেতৃত্বে ঐক্যফ্রন্টে যোগ দিয়েছিল, তখনও তো তিনি ২০ দলীয় জোটের অন্যতম নেতা হিসেবে নিজেকে ঐক্যফ্রন্টের সঙ্গে যুক্ত করতে পারেননি। সেও জামায়াতের ক্ষত বয়ে বেড়ানোর কারণেই। আজকে সেই জামায়াতের শক্তিতে বলিয়ান হয়ে তিনি যখন মুক্তিম  করেন তখন সঙ্গত কারণেই বলা যায়, বিএনপির নেতৃত্বাধীন ২০ দলীয় জোটের বাইরে আলাদা শক্তি হিসেবে তিনি নিজের দলকে প্রতিষ্ঠা করতে চাইছেন। অবশ্যই বলতে হবে ২০ দলীয় জোটে বিভাজন তৈরিই হয়ে যাচ্ছে।

সূত্র হিসেবে খালেদা জিয়ার মুক্তির দাবিকে তিনি ব্যবহার করেছেন। হয়তো তিনি ভেবেছেন, এতে করে বিএনপির মাঠপর্যায়ের কর্মীদের সমর্থন পাবেন। আর আন্দোলনের প্রয়োজনে জামায়াতের কর্মীবাহিনীও প্রাণ ফিরে পাবে। যাদের সক্রিয় হওয়ার মাধ্যমে সরকারবিরোধী আন্দোলনে গতি ফিরিয়ে আনা সম্ভব।

কতটা পারবেন সফল হতে? বিএনপির মতো শক্তিশালী সংগঠনও সঠিক নেতৃত্বের অভাবে ক্ষয়িষ্ণু দল হিসেবে পরিচিতি পেতে শুরু করেছে। আর ক্ষয়ের ধারায় অন্যতম ব্যক্তি হিসেবে কর্নেল অলি আহমদ নিজের নামটিওতো আগেই লেখা হয়ে আছে। তিনি যেভাবে নীতিগত কারণে বিএনপি ত্যাগ করেছেন তেমনি তার পদাঙ্ক অনুসরণ তো অনেকেই করেছেন। সেই ক্ষোভই কি মেটানোর জন্য তিনি জামায়াতকে বিএনপি থেকে খসিয়ে এনে আরেক দফা ক্ষয় ঘটাতে চাইছেন?

তার মনে কী আছে বলা মুশকিল। তবে মুক্তিমঞ্চ  যে ২০ দলীয় জোটকে আঘাত করার একটা রাজনৈতিক কৌশল, বলার অপেক্ষা রাখে না। আর এই প্রক্রিয়ায় জামায়াতও কিছুটা নিঃশ্বাস ফেলার সুযোগ পাবে। জামায়াত ২০ দলীয় জোট থেকে দূরে সরে যাওয়ার কথা ভেবে বিএনপি মুক্তিমঞ্চকে স্বাগত জানালেও জামায়াতে ইসলামী কিন্তু ২০ দলীয় জোট ত্যাগ করেনি। সুতরাং জামায়াতমুক্ত জোট গঠনের তৃপ্তি বোধ করতে পারছে না বিএনপি। তাহলে এই মুক্তিমঞ্চ  কি ২০ দলীয় জোটের ভিতরে থেকে আরেকটি জোটের জন্ম দিচ্ছে?

বিশ্লেষকরা অন্যভাবেও দেখছেন বিষয়টিকে। নির্বাচনকালে মনোনয়ন নিয়ে বিএনপির সঙ্গে শরিক দলগুলোর যে দূরত্ব তৈরি হয়েছে, পরবর্তীকালে বিএনপি সরকারবিরোধী আন্দোলন করতে যে ব্যর্থতার পরিচয় দিয়েছে, সেই ক্ষোভেরই বহিঃপ্রকাশ হচ্ছে মুক্তিমঞ্চ । মুক্তিমঞ্চ  তাই যতটা সরকারবিরোধী ভাবনাকে লালন করে, ততটাই বিএনপিকে এক হাত দেখানোর কথাও ভাবে।

শুধু তাই নয়, ২০ দলীয় জোটকে পাশ কাটিয়ে বিএনপি ড. কামাল হোসেনের নেতৃত্বে জাতীয় ঐক্যফ্রন্ট গঠন করার কারণে জোটভুক্ত দলগুলো যে হোঁচট খেয়েছিল, তার পাল্টা নিতেই মুক্তিমঞ্চ গঠন হয়েছে এমনটাও ভাবছেন অনেকে। নতুন এই উদ্যোগ রাজনীতিতে কী পরিবর্তন আনতে পারবে, সেই প্রশ্ন না করেই বলা যায়–এতে করে ২০ দলীয় জোটের ভাঙনটাই নিশ্চিত হওয়ার দিকে এগিয়ে যাচ্ছে। কল্যাণ পার্টির নেতা মেজর জেনারেল সৈয়দ মুহাম্মদ ইবরাহিম বীরবিক্রম (অব.) নিজেকে কতটা মিলিয়ে চলতে পারবেন সেরকম সন্দেহ কিন্তু একটা থেকেই যাচ্ছে। আন্দালিব পার্থ  ২০ দলীয় জোট ত্যাগ করায় মনে করা হয়েছিল তিনি হয়তো মুক্তিমঞ্চে  থাকছেন। যতটা জানা যায়, তিনি দূরত্ব বজায় রেখে চলেছেন। আওয়ামী লীগ থেকে বহিষ্কৃত এবং বিএনপি থেকে গত নির্বাচনে অংশ নেওয়া গোলাম মাওলা রনিকে দেখা গেছে কর্নেল অলি আহমদের সাংবাদিক সম্মেলনে। যদিও বিএনপি থেকে এ বিষয়ে কিছু বলা হয়নি। গোলাম মাওলা রনির মতো আরও কিছু বিএনপি নেতা পা বাড়িয়ে আছেন নতুন প্ল্যাটফরমে যোগ দেওয়ার জন্য। মনে করা হচ্ছে, বিএনপির ভেতরে জামায়াতপন্থী হিসেবে পরিচিত কিছু ব্যক্তিকে কর্নেল (অব.) অলি কাছে টানার চেষ্টা করতে পারেন। কারণ মুক্তিযুদ্ধের পক্ষের শক্তি ড. কামাল হোসেনের গণফোরামসহ কিছু দল ও ব্যক্তি যখন বিএনপিকে লড়াইয়ে যুক্ত করেছে, তখন জামায়াতকে তারা বোঝা হিসেবেই মনে করছে। একইসঙ্গে জামায়াত বিষয়ে দেশের ভেতরে-বাইরে যে নেতিবাচক চিন্তা আছে, সেই থেকে মুক্তির পথ পাচ্ছিল না বিএনপি। আবার জামায়াতের মতো শক্তিকে কাজে লাগানোর কৌশলকেও তারা বাদ দিতে পারছিল না। এখন জামায়াতের যে মরণদশা এই মুহূর্তে তারা মানে মানে বিদায় হলে বিএনপি কম মাত্রার কষ্টই পাবে। সেইদিক বিবেচনা করলে কর্নেল অলির ঘাড়ে জামায়াতের বোঝাটা চাপিয়ে দিয়ে নিজেরা সফেদ হওয়ার কথাও ভাবনায় থাকতে পারে।

এবার ভাবতে হবে মুক্তি মঞ্চ প্রতিষ্ঠার আরেকটা কারণ কী থাকতে পারে? যদি মুক্তি মঞ্চ কার্যকর হয় তাহলে আসলে খালেদা জিয়ার মুক্তির চেয়ে জামায়াত প্রতিষ্ঠাই নিশ্চিত হবে। আর সেই লক্ষ্য নিয়েই সর্বোতভাবে সহযোগিতার হাত বাড়িয়েছে জামায়াত। ২০ দলীয় জোটে জামায়াতকে ‘প্রজাসম’ গুরুত্ব দেওয়া হয়েছে। এমনটা অনেকবারই উচ্চারিত হয়েছে। বাইরেও তাদের গ্রহণযোগ্যতা প্রায় শূন্যের কোঠায়। এমন পরিস্থিতিতে জামায়াতের একটা মঞ্চ  পেলে মন্দ কী?

জামায়াতের নেতা ডা. শফিকুর রহমান দীর্ঘদিন বিদেশ সফর শেষ করে মুক্তিমঞ্চে  বসেছেন। বহির্বিশ্বে তাদের মন্ত্রণাদাতাদের পরামর্শেই কি তিনি এই উদ্যোগ নিয়েছেন? জামায়াতের সিনিয়র নেতা মজিবুর রহমান মঞ্জু ইতোপূর্বে জন আকাঙ্ক্ষার বাংলাদেশ নামে নতুন রূপে আত্মপ্রকাশের চেষ্টা করেছেন। পত্রপত্রিকায় এ নিয়ে বিস্তর লেখালেখি শুরু হওয়ার পর আকাঙ্ক্ষা পূরণের আগেই সংগঠনটির নিশানা নেই আর। জন আকাঙ্ক্ষা আর মুক্তির কাছাকাছি অর্থবহন করে। মজিবুর রহমানের ব্যর্থ প্রচেষ্টার মতোই আরেকটি কি এই মুক্তি মঞ্চ। ইতোমধ্যে অনেকেই বলতে শুরু করেছেন, মজিবুর রহমানের ব্যর্থ চেষ্টার পর অলি আহমদকে দিয়ে জামায়াত মুক্তি মঞ্চ  প্রতিষ্ঠা করছে।

জন আকাঙ্ক্ষার বাংলাদেশ সাংবাদিক সম্মেলন করেছে ৭১ হোটেলে। কাকতালীয় মনে হলেও এর পেছনে ৭১’কে সঙ্গে নেওয়ার কৌশল বলে তখনো কেউ কেউ মন্তব্য করেছেন। এবার জামায়াত আর প্রতীকী নয়, মুক্তিযুদ্ধের মহান সৈনিক সৈয়দ মুহাম্মদ ইবরাহিম বীরপ্রতীক ও অলি আহমদ বীরবিক্রমকেই তাদের সামনে রেখে এগিয়ে এসেছে।

বিভিন্ন দিক বিবেচনা করে মনে হতে পারে জামায়াতকে প্রতিষ্ঠার জন্যই অলি আহমদ এই পদক্ষেপ নিয়েছেন। যে কারণে তিনি বলতে পেরেছেন একাত্তরের জামায়াত আর ২০১৯-এর জামায়াত এক নয়। প্রশ্ন হচ্ছে—জামায়াত রক্ষার এই চেষ্টা কি বিএনপিকে আঘাত করার জন্য নাকি বিএনপিত্যাগী অলির রাজনৈতিক হতাশার ফল, তাই দেখার বিষয়। 

 লেখক: সাংবাদিক, শিশুসাহিত্যিক ও মুক্তিযুদ্ধ বিষয়ক গবেষক

 

/এসএএস/এমএনএইচ/

*** প্রকাশিত মতামত লেখকের একান্তই নিজস্ব।

বাংলা ট্রিবিউনের সর্বশেষ
ঢেউয়ের আঘাতে ছিটকে পড়ে সাগরে নিখোঁজ জেলে
ঢেউয়ের আঘাতে ছিটকে পড়ে সাগরে নিখোঁজ জেলে
মোসাদ্দেকের মতে চ্যাম্পিয়নশিপের দাবিদার আবাহনী
মোসাদ্দেকের মতে চ্যাম্পিয়নশিপের দাবিদার আবাহনী
মিরপুরে সড়ক দুর্ঘটনায় শিশুসহ নারী নিহত
মিরপুরে সড়ক দুর্ঘটনায় শিশুসহ নারী নিহত
লাইয়ের অভিষেক পরবর্তী চীনা সামরিক মহড়া নিয়ে সতর্ক অবস্থানে তাইওয়ান
লাইয়ের অভিষেক পরবর্তী চীনা সামরিক মহড়া নিয়ে সতর্ক অবস্থানে তাইওয়ান
সর্বশেষসর্বাধিক

লাইভ