X
শনিবার, ২০ এপ্রিল ২০২৪
৬ বৈশাখ ১৪৩১

আমার টেলিফোন অডিও প্রকাশ করছেন কোন আইনে?

হারুন উর রশীদ
০৮ ডিসেম্বর ২০১৯, ১২:২০আপডেট : ০৯ ডিসেম্বর ২০১৯, ১৮:৪৯

হারুন উর রশীদ কারও ব্যক্তিগত টেলিফোন অডিও প্রকাশ করা হয় কোন আইনে? সর্বশেষ ডাকসু ভিপি নুরুল হক নুরের টেলিফোন কথোপকথনের অডিও সংবাদমাধ্যমে প্রকাশ হওয়ায় আবারও এই প্রশ্নটি সামনে চলে এসেছে। কারণ, আমরা দেখছি এই ধরনের অডিও প্রকাশ হচ্ছে সংবাদমাধ্যম ও সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে। তারা প্রকাশ করছে, কিন্তু এই রেকর্ড তারা কোথায় পায় তা বলছে না। কারণ, যারা রেকর্ড করছেন, তারা আইন জানেন। আর জানেন বলেই সংবাদমাধ্যমের ঘাড়ে সওয়ার হচ্ছেন। তাদের ব্যবহার করছেন।
বাংলাদেশে একটিই মাত্র আইন আছে, কোনও ব্যক্তির ব্যক্তিগত ফোনকল রেকর্ড করার। আর তা করা যাবে রাষ্ট্রের নিরাপত্তার প্রশ্নে। রেকর্ড করবে সরকারের নির্দিষ্ট কয়েকটি সংস্থা। কিন্তু তা তাদের সাধারণের জন্য প্রকাশের অনুমতি নেই। তারা যদি কোনও অপরাধমূলক কর্মকাণ্ডের প্রমাণ পান টেলিফোন কথোপকথনে, তাহলে আইনগত ব্যবস্থা নেবেন। আদালতে যাবেন। কিন্তু সেটা আমরা দেখি না।
বাংলাদেশে এখন আমরা পর্যন্ত প্রমাণ পাইনি যে, দায়িত্বপ্রাপ্ত কোনও গোয়েন্দা সংস্থা কারও টেলিফোন কল রেকর্ড করে সেখানে ফৌজদারি অপরাধের প্রমাণ পাওয়ার কথা বলেছে। অথবা তাদের করা সেই রেকর্ডের ভিত্তিতে মামলা করে প্রতিকার চেয়েছে। কয়েকটি মামলা হয়েছে (যেমন, মাহমুদুর রহমান মান্না), কিন্তু ওই অডিও রেকর্ড যে সরকারের গোয়েন্দা সংস্থা করেছে, তা কিন্তু কোনও মামলায় বলা হয়নি। তারা সংবাদমাধ্যমে প্রচারিত অডিও’র ভিত্তিতেই মামলা করেছে। তাহলে প্রশ্ন, কারা রেকর্ড করে?
টেলিযোগাযোগ আইন:
বাংলাদেশের ২০০১ সালের টেলিযোগাযোগ আইন, যা ২০১০ সালে সংশোধন করা হয়, তাতে (৯৭-এর ক) রাষ্ট্রের নিরাপত্তা ও শৃঙ্খলার স্বার্থে বিশেষ বিধান সংযোজন করা হয়। তাতে বলা হয়েছে, অন্য আইনে যাই থাকুক না কেন, রাষ্ট্রের নিরাপত্তা ও জনশৃঙ্খলার স্বার্থে সময় সময়, নির্ধারিত সময়ের জন্য টেলিফোন কথোপকথন প্রতিহত ও রেকর্ড করা যাবে। আর এটা করতে পারবে গোয়েন্দা সংস্থা, জাতীয় নিরাপত্তা সংস্থা, তদন্তকারী সংস্থা।
এই আইনের কোথাও তা সাধারণের জন্য প্রকাশের কথা বলা হয়নি।
সংবিধান ব্যক্তিগত যোগাযোগের গোপনীয়তার নিশ্চয়তা দিয়েছে:
তবে এটা স্পষ্ট যে টেলিযোগাযোগ আইনের এই ধারাটি বাংলাদেশের সংবিধানের সঙ্গে সাংঘর্ষিক। কারণ, বাংলাদেশের সংবিধান নাগরিকদের ব্যক্তিগত সব ধরনের যোগাযোগ গোপন রাখার নিশ্চয়তা দিয়েছে। এটা নাগরিকদের মৌলিক অধিকার। সংবিধানের তৃতীয় ভাগে মৌলিক অধিকারের ৪৩ অনুচ্ছেদের শিরোনাম: গৃহ ও যোগাযোগের সংরক্ষণ। এর (খ) উপ-অনুচ্ছেদে বলা হয়েছে,  ‘চিঠিপত্রের ও যোগাযোগের অন্যান্য উপায়ের গোপনীয়তা রক্ষার অধিকার থাকিবে।’
তবে, এটা রাষ্ট্রের নিরাপত্তা, জনশৃঙ্খলা, জনসাধারণের নৈতিকতা বা জনস্বাস্থ্যের স্বার্থে আইনের দ্বারা আরোপিত যুক্তিসঙ্গত বাধানিষেধ-সাপেক্ষে।
সংবিধান হলো মৌলিক আইন। তাই, এর সঙ্গে সাংঘর্ষিক অন্য কোনও আইন কার্যকর থাকতে পারে না। এটি সংবিধানেই বলে দেওয়া আছে।
প্রচলিত আইন কী বলে?

আইনগত কর্তৃপক্ষ ছাড়া বাংলাদেশের প্রচলিত আইনেও কারও অনুমতি না নিয়ে ছবি তোলা বা কোনও ব্যক্তির ব্যাপারে পরিচিতি তথ্য সংগ্রহ করা অপরাধ। ডিজিটাল আইন ২০১৮-এর ২৬ ধারায় এই অপরাধে ৫ বছরের কারাদণ্ড এবং ৫ লাখ টাকা জরিমানার বিধান আছে।


আর ব্যক্তির পরিচিতি তথ্য বলতে বোঝানো হয়েছে, ‘শারীরিক তথ্য বা অন্য কোনও তথ্য, যা এককভাবে বা যৌথভাবে একজন ব্যক্তি বা সিস্টেমকে শনাক্ত করে।’
একইসঙ্গে ২০০৬ সালের আইসিটি আইনের ৬৩ ধারায় ব্যক্তিগত তথ্য সুরক্ষার কথা বলা হয়েছে। তাতে যোগাযোগের তথ্য বা দলিল প্রকাশ শাস্তিযোগ্য অপরাধ।
সুতরাং ব্যক্তিগত টেলিফোন কথোপকথন রেকর্ড এবং তা প্রকাশ করা দেশের প্রচলিত আইনে ব্যক্তিগত গোপনীয়তা লঙ্ঘন ও শাস্তিযোগ্য অপরাধ।
প্রতিকার কোথায়?
তাই যারা টেলিফোন কল রেকর্ড এবং প্রকাশ করছেন তারা দুই ধরনের অপরাধ করছেন-
১. ব্যক্তিগত টেলিফোন কথোপকথন গোপনে রেকর্ড করে ব্যক্তিগত তথ্যের গোপনীয়তা লঙ্ঘনের অপরাধ এবং
২. পরবর্তী ধাপে সংবাদমাধ্যম বা সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে প্রকাশ করে ব্যক্তিগত তথ্যের নিরাপত্তা লঙ্ঘনের অপরাধ।
দায়ী কারা?
এখন প্রশ্ন হলো, এই অপরাধের জন্য দায়ী কারা? বাংলাদেশের কোনও গোয়েন্দা সংস্থা এ পর্যন্ত কারও টেলিফোন কল রেকর্ড করেছে বলে তারা অফিসিয়ালি জানায়নি। এমনকি তাদের করা রেকর্ডের ভিত্তিতে কোনও মামলাও হয়নি।
তাহলে সংবাদমাধ্যম কোথায় পাচ্ছে? তারা কি রেকর্ড করছে? সেটা করছে না বলেই আমার ধারণা। তারা এটা করার জন্য আইনগতভাবে ক্ষমতাপ্রাপ্তও নয়। তাদের সে প্রযুক্তিও আছে বলে আমার মনে হয় না। কিন্তু প্রচার করে ব্যক্তির ব্যক্তিগত তথ্যের গোপনীয়তা ও নিরাপত্তা লঙ্ঘন করছে।
আমার ধারণা, যারা প্রচার করছেন তারা জানেন কারা রেকর্ড করেছে। কোনও সংক্ষুব্ধ ব্যক্তি যদি আদালতে যান, তাহলে হয়তো ওই সংবাদমাধ্যমের কাছ থেকেই জানা যাবে কারা এসব টেলিফোন কল রেকর্ড করে সংবাদমাধ্যমকে দিচ্ছে। আদালতে গিয়ে প্রতিকারও চাইতে পারেন।
যারাই রেকর্ড করুক, তারা জানেন ওইসব ব্যক্তিগত অডিও’র মধ্যে ফৌজদারি অপরাধের মতো কোনও উপাদান নেই। তাই তারা সেটিকে ছড়িয়ে দিয়ে ওই ব্যক্তিকে চাপে ফেলতে চান বা তার মানহানি করতে চান।
আর লক্ষণীয় যে, এ পর্যন্ত যাদের টেলিফোন অডিও রেকর্ড প্রকাশিত হয়েছে, তাদের বড় একটি অংশ সরকারবিরোধী। সরকার সমর্থকদের অডিও তেমন প্রকাশ হতে দেখিনি।
ভারতীয় সুপ্রিম কোর্টের ঐতিহাসিক রায়:
ব্যক্তিগত তথ্যের সুরক্ষা অধিকার নিয়ে ভারতেও কম বিতর্ক হয়নি। কিন্তু ২০১৭ সালের আগস্ট ভারতের সুপ্রিম কোর্ট এক ঐতিহাসিক রায়ে বলেছেন, ব্যক্তিগত গোপনীয়তা ভারতীয় নাগরিকের মৌলিক অধিকার। আদালত রায়ে বলেন, ভারতের সংবিধানের ২১ নম্বর ধারা অনুযায়ী, জীবনের অধিকারের মতোই নিজের ব্যক্তিগত তথ্য গোপন রাখাও একজন নাগরিকের মৌলিক অধিকারের মধ্যেই পড়ে। সেখানে অনেক ধরনের সরকারি ও সেবা নিতে ভারতের জাতীয় পরিচয়পত্র (আধার কার্ড) দেওয়া বাধ্যতামূলক করার বিরুদ্ধে ওই মামলা হয়েছিল। আর ওই কার্ডের মাধ্যমে ব্যক্তিগত তথ্য পাচারের অভিযোগ ওঠে।

লেখক: সাংবাদিক

ইমেইল: [email protected]

/এসএএস/এমএনএইচ/এমওএফ/

*** প্রকাশিত মতামত লেখকের একান্তই নিজস্ব।

বাংলা ট্রিবিউনের সর্বশেষ
রুবেলকে শোকজ দিলো উপজেলা আ’লীগ, প্রার্থিতা প্রত্যাহারের নির্দেশ পলকের
নাটোরে উপজেলা নির্বাচনরুবেলকে শোকজ দিলো উপজেলা আ’লীগ, প্রার্থিতা প্রত্যাহারের নির্দেশ পলকের
এমপি দোলনের গাড়ি লক্ষ্য করে ইট নিক্ষেপ, সাংবাদিক আহত
এমপি দোলনের গাড়ি লক্ষ্য করে ইট নিক্ষেপ, সাংবাদিক আহত
চরের জমি নিয়ে সংঘর্ষে যুবলীগ কর্মী নিহত, একজনের কব্জি বিচ্ছিন্ন
চরের জমি নিয়ে সংঘর্ষে যুবলীগ কর্মী নিহত, একজনের কব্জি বিচ্ছিন্ন
দাবদাহে ট্রাফিক পুলিশ সদস্যদের তরল খাদ্য দিচ্ছে ডিএমপি
দাবদাহে ট্রাফিক পুলিশ সদস্যদের তরল খাদ্য দিচ্ছে ডিএমপি
সর্বশেষসর্বাধিক

লাইভ