X
সোমবার, ০৭ জুলাই ২০২৫
২৩ আষাঢ় ১৪৩২

মন্ত্রীর ঘড়ি ও কিছু নিরীহ কৌতূহল

মাসুদ কামাল
১৫ জানুয়ারি ২০২০, ১৭:৩৭আপডেট : ১৫ জানুয়ারি ২০২০, ২৩:৩৭

মাসুদ কামাল শুরুতেই বলে নিই—আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক  ও সেতুমন্ত্রী ওবায়দুল কাদেরকে আমি পছন্দ করি। পছন্দ করি তার খোলামেলা কথাবার্তার জন্য, তার আত্মসমালোচনার সৎ সাহসের জন্য। ছোট্ট এই ভূমিকাটুকুর পর এবার মূল প্রসঙ্গে আসি।
সুইডেনভিত্তিক অনলাইন পোর্টাল নেত্র নিউজ ক’দিন আগে ওবায়দুল কাদেরের ঘড়ি নিয়ে একটি প্রতিবেদন প্রকাশ করে। তাতে বিভিন্ন সময়ে ওবায়দুল কাদেরের হাতে থাকা সাতটি ব্র্যান্ডের ঘড়ির ছবিসহ দেখিয়ে কোনটির কত দাম তা উল্লেখ করা হয়েছিল। ব্র্যান্ডের নাম দেখেই বোঝা যাচ্ছিল ঘড়িগুলো বেশ দামি। তারা প্রায় প্রতিটি ঘড়ি আলাদা আলাদা করে দেখিয়ে সেগুলোর দাম পাশে লিখে দিয়েছিলো। বিখ্যাত সব কোম্পানির তৈরি ঘড়িগুলোর বাজার দাম ৯ লাখ থেকে শুরু করে ২৮ লাখ টাকা পর্যন্ত। অর্থাৎ সবচেয়ে দামি যে ঘড়িটি, সেটির দাম মন্ত্রী হিসেবে তিনি এক বছরে যে বেতন পান, তার চেয়েও বেশি!
‘নেত্র নিউজ’-এর নাম আগে আমি কখনো শুনিনি। মন্ত্রীর ঘড়ি সংক্রান্ত এমন একটা রিপোর্ট যখন সোশ্যাল মিডিয়ায় শেয়ার হতে থাকলো, তখনই জানতে পারলাম এই নিউজ পোর্টালটি নাকি সুইডেনভিত্তিক। অর্থাৎ, সুইডেনে বসে কিছু বাঙালি হয়তো এই পোর্টালটি চালায়। অভিজ্ঞতা থেকে একটা বিষয় খেয়াল করেছি, বিদেশে গেলে অনেকে যেন বেশিমাত্রায় দেশপ্রেমিক হয়ে যায়। দেশে থাকতে যারা রাজনীতির ধারে-কাছে ঘেঁষতো না, ইউরোপ আমেরিকায় গিয়ে রাজনীতি করা শুরু করেন। আওয়ামী লীগ-বিএনপির প্রবাসী শাখার নেতা হওয়ার জন্য মারামারি পর্যন্ত করেন অনেকে। নানা উসিলায় ঢাকার ঘটনার প্রতিবাদে লন্ডন নিউইয়র্কে মানববন্ধন করেন। দেশীয় রাজনীতি নিয়ে বিদেশে বসে ফেসবুকে জ্বালাময়ী স্ট্যাটাস দেন। আমরা কেন দিতে পারি না—তা নিয়ে আমাদের লক্ষ্য করে ব্যঙ্গ-বিদ্রূপও করেন অনেকে। আবার তারাই যখন দেশে বেড়াতে আসেন, মহাগুরুত্বপূর্ণ ইস্যুতে রাজপথে তাদের খুঁজেও পাওয়া যায় না।

প্রবাসী ‘দেশপ্রেমিক’দের নিয়ে আমার পর্যবেক্ষণ যা-ই থাকুক না কেন, সে কারণে নেত্র নিউজের আলোচিত এই প্রতিবেদনের গুরুত্বকে অবহেলা করার কোনও সুযোগ নেই। প্রতিবেদন যখন একটি প্রকাশিত হয়েছে, সেখানে আলোচিত ব্যক্তি যখন সরকারের একজন গুরুত্বপূর্ণ মন্ত্রী, তখন বিষয়টি নিয়ে আলোচনা হতেই পারে। সরকারে থাকা গুরুত্বপূর্ণ ব্যক্তিদের নিয়ে আলোচনা নতুন কিছু নয়। এ ধরনের আলোচনা অপ্রয়োজনীয়ও নয়। মন্ত্রীদের কর্মকাণ্ড নিয়ে আলোচনা আগেও বহুবার হয়েছে। তখন অধিকাংশ ক্ষেত্রে দেখা গেছে এরকম পরিস্থিতিতে সংশ্লিষ্ট ব্যক্তিরা চুপ করে থেকেছেন। তাদের এই নীরবতার কারণেই হোক বা অন্য নতুন কোনও প্রসঙ্গ চলে আসার কারণেই হোক, বিষয়টি একসময় ধামাচাপা পড়ে গেছে। কিন্তু এবার সেরকম হয়নি। মন্ত্রী ওবায়দুল কাদের নিজেই প্রসঙ্গটি নিয়ে মন্তব্য করেছেন। তার যে ওই ঘড়িগুলো আছে, তা অস্বীকার করেননি। তবে, সেই সঙ্গে একথাও জানিয়েছেন, ঘড়িগুলো তিনি নিজের টাকায় কেনেননি, উপহার হিসেবে পেয়েছেন। তার দলের কর্মী-সমর্থকদের কেউ কেউ বিদেশ থেকে ফেরার সময় হয়তো এরকম ঘড়ি বা স্যুট বা অন্য কোনও কিছু উপহার হিসেবে তার জন্য এনে দিয়েছেন। সেটা তিনি নিয়ে ব্যবহার করছেন। তার দাবি, ‘আমার যত ঘড়ি আছে, এগুলোর একটিও আমার নিজের পয়সা দিয়ে কেনা নয়। ধরেন আপনি বিদেশে গেলেন, এসে আমাকে একটা ঘড়ি দিলেন, আমি নিলাম।’  

কিছুদিন আগে আওয়ামী লীগের সম্মেলন হয়ে গেলো। সেখানে ওবায়দুল কাদের দ্বিতীয়বারের মতো দেশের বৃহত্তম এই রাজনৈতিক দলের সাধারণ সম্পাদক নির্বাচিত হলেন। এর আগে আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক ছিলেন সৈয়দ আশরাফুল ইসলাম। অসাধারণ সৎ ব্যক্তি হিসেবে সব মহলে তার সুনাম ছিল। পোশাক-আশাকেও তিনি ছিলেন খুব সাদাসিধা। বেশিরভাগ সময়ে পাজামা পাঞ্জাবিই পরতেন। হাতে রোলেক্স বা অন্য কোনও দামি ব্র্যান্ডের ঘড়ি কখনও দেখেছি বলেও মনে পড়ে না। জীবনের একটা বড় সময় তিনি বিদেশে কাটিয়েছেন, তার স্ত্রীও ছিলেন বিদেশি। ফলে পাশ্চাত্যের অত্যাধুনিক বিভিন্ন ব্র্যান্ড সম্পর্কে তিনি ওয়াকিবহাল ছিলেন না—এমনটি মনে করার কোনও সুযোগ নেই। তবে, সেসব জৌলুস তাকে প্রলুব্ধ করতে পারেনি। তার পরেই দলের এই গুরুত্বপূর্ণ পদে এলেন ওবায়দুল কাদের। তিনি অবশ্য স্যুটেড বুটেড থাকতেই বেশি স্বাচ্ছন্দ্যবোধ করেন। পরিপাটি ওবায়দুল কাদেরের  হাতে শোভা পায় দামি ব্র্যান্ডের ঘড়ি। ঘড়িগুলো দামি—সেটা ধারণা করতে পারতাম। কিন্তু কত দামি তা উপলব্ধিতে সমস্যা হতো। নেত্র নিউজ এবার জানিয়ে দিলো—এসব ঘড়ির কোনও একটির দাম নাকি পুরো ২৮ লাখ টাকা! সাত আটটি ঘড়ির মধ্যে কোনোটির দামই নাকি ৯ লাখ টাকার কম নয়!

ওবায়দুল কাদের যখন দ্বিতীয়বার আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক হলেন, একজন সংবাদকর্মী হিসেবে আমি খুশিই হয়েছিলাম। এর কারণ হলো, ইনি কথা বলেন। সৈয়দ আশরাফ কথা কম বলতেন। অথবা কথা বলার জন্য তাকে বেশিরভাগ সময় পাওয়াই যেতো না। দলীয় সাধারণ সম্পাদকের কথা বা মন্তব্য না পাওয়া গেলে নিউজ হবে কী করে? সেই সমস্যাটা মিটে গেলো ওবায়দুল কাদের সাধারণ সম্পাদকের পদে বসার পর থেকে। রাজনৈতিক নেতাদের মধ্যে কথা অনেকেই বলেন কিন্তু তাদের সঙ্গে ওবায়দুল কাদেরের একটা মৌলিক পার্থক্য রয়েছে। সেটি হলো—তিনি অনেক সময় দলের নেতাকর্মীদের নানা কর্মকাণ্ডেরও সমালোচনা করেন। মাঠ পর্যায়ের নেতাকর্মীদের দলীয় শৃঙ্খলা, নিয়মানুবর্তিতা ও সততার বিষয়ে জ্ঞান দেন। সরকারি দলের সাধারণ সম্পাদকের বরাতে সেসব বাণী প্রচারে মিডিয়াগুলোও বেশ আগ্রহ অনুভব করে। তার কথাগুলোর একটা নিউজ ভ্যালু আছে, কথাগুলোই নিউজ অথবা অন্য কোনও নিউজের উৎস।

এবারও তার ব্যতিক্রম হলো না। মন্ত্রণালয়ে সাংবাদিক পরিবেষ্টিত অবস্থায় নিজের ঘড়িগুলো নিয়ে তার বক্তব্য অধিকাংশ মিডিয়ায়ই প্রচারিত হলো। সেগুলো পড়ে আমার মনে বেশ কিছু প্রশ্ন জেগেছে। আচ্ছা, ওবায়দুল কাদের তো অনেকদিন ধরেই বড় নেতা। ৯৬ সালে যখন আওয়ামী লীগ ক্ষমতায় আসে, তখন তিনি সরকারের প্রতিমন্ত্রী হয়েছিলেন। আগেও কি তিনি এমন দামি (২৮ লাখ টাকা দামের ঘড়ি) উপহার হিসেবে পেতেন? কিংবা, তিনি যখন মন্ত্রী থাকবেন না, তখনও কি এরকম দামি উপহার পেতে থাকবেন? অথবা মন্ত্রী বা সরকারের গুরুত্বপূর্ণ পদে থাকা কোনও ব্যক্তিকে কি এভাবে উপহার দেওয়া যায়? অন্য মন্ত্রীরাও কি এভাবে উপহার নেন? নেত্র নিউজে মন্ত্রীর সাত-আটটি ঘড়ির বিবরণ প্রকাশিত হয়েছে। একজন মানুষের এত ঘড়ির প্রয়োজনীয়তা আদৌ রয়েছে? সাধারণ মানুষের প্রত্যাশা থাকে রাজনৈতিক নেতা বা মন্ত্রীরা হবেন অনুকরণযোগ্য। এত এত দামি ঘড়ি এবং যার সবক’টিই উপহারে পাওয়া—এ থেকে আমাদের পরবর্তী প্রজন্ম কী শিক্ষা নিতে পারে? 

এত প্রশ্নের পাশাপাশি আমার ব্যক্তিগত একটা কৌতূহলও রয়েছে। আচ্ছা, ২৮ লাখ টাকা দামের ঘড়িটি উপহার হিসেবে কে দিলেন? ওই ভদ্রলোকের নামটি জানাতে খুবই ইচ্ছা করছে। কেবল ভালোবাসাজনিত কারণে যিনি ২৮ লাখ টাকার উপহার দিতে পারেন, তার হৃদয় না জানি কত বিশাল! তিনি কি কোনও ব্যবসায়ী? ব্যবসায়ীরা কি বিনিময়-প্রত্যাশা ছাড়া এমনি এমনি কাউকে কিছু উপহার দেন?

আগেই বলেছি, ওবায়দুল কাদেরকে আমি পছন্দ করি তার খোলামেলা কথার জন্য। আমার ধারণা, ওইদিন মন্ত্রণালয়ে সাংবাদিকরা যদি তাকে এই প্রশ্নগুলো করতেন, তিনি ঠিকই জবাব দিতেন। কেন প্রশ্নগুলো কেউ করলেন না, বুঝতে পারছি না। তবে সময় ফুরিয়ে যায়নি। তিনি এখনও এসব প্রশ্নের জবাব দিয়ে নিজের ট্রান্সপারেন্ট অবস্থানটা দৃঢ় করতে পারেন।   

লেখক: সাংবাদিক

/এসএএস/এমএনএইচ/এমওএফ/

*** প্রকাশিত মতামত লেখকের একান্তই নিজস্ব।

বাংলা ট্রিবিউনের সর্বশেষ
টিভিতে আজকের খেলা (৭ জুলাই, ২০২৫)
টিভিতে আজকের খেলা (৭ জুলাই, ২০২৫)
মধ্যরাতে সংবর্ধনায় বিশ্বকাপ স্বপ্নের কথা বললেন ঋতুপর্ণা ও আফঈদারা 
মধ্যরাতে সংবর্ধনায় বিশ্বকাপ স্বপ্নের কথা বললেন ঋতুপর্ণা ও আফঈদারা 
গণভবন জয় করেছি, এবার জাতীয় সংসদ জয় করবো: নাহিদ ইসলাম
গণভবন জয় করেছি, এবার জাতীয় সংসদ জয় করবো: নাহিদ ইসলাম
একটি দলের কারণে ঐকমত্য কমিশনে মৌলিক সংস্কারের প্রস্তাবনা আটকে যাচ্ছে: আখতার
একটি দলের কারণে ঐকমত্য কমিশনে মৌলিক সংস্কারের প্রস্তাবনা আটকে যাচ্ছে: আখতার
সর্বশেষসর্বাধিক