X
বুধবার, ২৪ এপ্রিল ২০২৪
১০ বৈশাখ ১৪৩১

ঝরে পড়া শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানগুলোর কী হবে?

উমর ফারুক
২৩ নভেম্বর ২০২০, ১৪:৪২আপডেট : ২৩ নভেম্বর ২০২০, ১৫:০১

উমর ফারুক কোভিড-১৯ মহামারিতে শিক্ষা খাত ইতিহাসের সবচেয়ে বেশি ক্ষতিগ্রস্ত। মুখ থুবড়ে পড়েছে। বিশ্বের ১৬০টিরও বেশি দেশে, প্রায় ১৬০ কোটি শিক্ষার্থী ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে। ব্যাপকভাবে ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে অন্তত ১০০ কোটি শিক্ষার্থী। তাদের শিক্ষা ব্যাহত হয়েছে। মানসিক স্বাস্থ্য ব্যাহত হয়েছে। অন্তত ৪ কোটি শিশু প্রাক-প্রাথমিক শিক্ষা থেকে বঞ্চিত হয়েছে। আড়াই কোটিরও বেশি স্কুল-বয়সী শিশুকে স্কুলে যেতে অপেক্ষা করতে হবে আরও অনির্দিষ্টকাল। জাতিসংঘের এক নথিতে বলা হয়েছে, করোনাকালীন নেতিবাচক অর্থনৈতিক প্রভাবে আগামী বছরে শিক্ষা থেকে ঝরে পড়তে পারে ২ কোটি ৩৮ লাখেরও বেশি শিশু ও তরুণ।
করোনা সংকট বৈশ্বিক। করোনায় শিক্ষাসংকটও বৈশ্বিক। বাংলাদেশ শিক্ষা তথ্য ও পরিসংখ্যান ব্যুরোর তথ্য বলছে, দেশে প্রাথমিক ও মাধ্যমিক পর্যায়ে শিক্ষার্থীর সংখ্যা প্রায় পৌনে ৩ কোটি, এবং দেশে মোট শিক্ষার্থী সংখ্যা প্রায় সাড়ে ৪ কোটি। ইতিমধ্যে এই বিপুলসংখ্যক শিক্ষার্থীর শিক্ষাজীবন ব্যাপকভাবে ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে। একই সঙ্গে ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে বেসরকারি শিক্ষকদের জীবন ও জীবিকা। বেতন না পেয়ে তারা আজ  মানবেতর জীবনযাপন করছে।

বাংলাদেশে মোট প্রাথমিক বিদ্যালয়ের সংখ্যা ১ লাখ ৩৪ হাজার ১৪৭টি। এর মধ্যে সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়ের সংখ্যা মাত্র ৬৫ হাজার ৫৯৩টি। মাধ্যমিক ও উচ্চ শিক্ষা অধিদফতরের তথ্য অনুযায়ী, দেশে বেসরকারি মহাবিদ্যালয়ের সংখ্যা ২ হাজার ৩৬৩টি। বেসরকারি মাধ্যমিক বিদ্যালয়ের সংখ্যা ১৬ হাজার ১০৯টি এবং বেসরকারি মাদ্রাসার সংখ্যা ৭ হাজার ৫৯৮টি। জাতীয় বিশ্ববিদ্যালয়ের পরিসংখ্যান আরও বলছে, দেশে অনার্স ও মাস্টার্স পড়ানো হয় এমন কলেজের সংখ্যা দেড় হাজারের কাছাকাছি। এছাড়া ৫০টি অধিভুক্ত বেসরকারি টিচার্স ট্রেনিং কলেজ রয়েছে। সারাদেশে বেসরকারি স্কুল অ্যান্ড কলেজ রয়েছে প্রায় চার হাজার। বেসরকারি পলিটেকনিক ইনস্টিটিউট রয়েছে ৫৫৩টি। দেশে মোট নন-এমপিওভুক্ত শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানের সংখ্যা প্রায় ৭ হাজার। ইবতেদায়ি মাদ্রাসার সংখ্যা ৯ হাজার। এছাড়া  সারাদেশে ‘ব্যাঙের ছাতা’র মতো, অনুমোদিত অথবা অনুমোদনহীনভাবে গড়ে উঠেছে প্রায় ৪০ হাজার কিন্ডারগার্টেন স্কুল। এসব বেসরকারি প্রতিষ্ঠানের সঙ্গে লাখ লাখ শিক্ষক-কর্মকর্তা-কর্মচারী জড়িত, এবং প্রত্যেকের সঙ্গে জড়িত একটি করে পরিবার। পরিসংখ্যান সারাদেশে শুধু কিন্ডারগার্টেন স্কুলে শিক্ষকতা করেন অন্তত ৫ লাখ শিক্ষক, আর শিক্ষার্থী সংখ্যা প্রায় ১ কোটি।

উপর্যুক্ত প্রতিষ্ঠানগুলো থেকে সরকার দীর্ঘদিন যাবৎ শুধু সেবা গ্রহণ করে। কখনও পাশে দাঁড়িয়েছে বলে মনে পড়ে না। প্রতিষ্ঠানগুলো চলে শিক্ষার্থীদের বেতনের টাকায়। উন্নয়নও হয় সেভাবেই। অথচ, গেলো মার্চ মাস থেকে দেশের শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান বন্ধ থাকায় প্রচণ্ড হুমকির মুখে পড়েছেন শিক্ষকগণ। হুমকির মধ্যে পড়েছে ব্যাপক সংখ্যক বেসরকারি শিক্ষকের জীবন ও জীবিকা। দুঃখের বিষয় হলো, ইতোমধ্যে বন্ধ হয়ে গেছে হাজার হাজার শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান। এখন প্রশ্ন হলো কী হবে এসব শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানের? কী হবে এসব শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানের শিক্ষার্থী ও শিক্ষকদের? আবার সোজা হয়ে দাঁড়াতে পারবে তো প্রতিষ্ঠানগুলো?

লিটল অ্যাঞ্জেল কিন্ডারগার্টেন স্কুল। ২০০৩ সালে প্রতিষ্ঠিত। অবস্থান লালবাগ, রংপুর। শিক্ষার্থী সংখ্যা ১৩৫ জন। শিক্ষক ১৬ জন। বেশ সুনামের সঙ্গেই চলছিল প্রতিষ্ঠানটি। নামডাকও ছড়িয়ে পড়েছিল চারিদিকে। কিন্তু করোনা সংকটে প্রতিষ্ঠানটি এখন দিশেহারা। কথা হচ্ছিল এর প্রশাসনিক প্রধান হারুন-অর-রশিদের সঙ্গে। তিনি বলছিলেন, ‘কয়েক মাস ধরে বেতন দিতে পারছি না শিক্ষকদের। খুব কষ্ট পাচ্ছি। প্রতিষ্ঠান নিয়ে এক চরম অনিশ্চয়তার মধ্যে আছি।’ জানালেন, তার পরিচিত অন্তত দুটো স্কুল বন্ধ হয়ে গেছে বলে তিনি জেনেছেন। বড় আক্ষেপ করে বলছিলেন, জানি না কেমন করে চলছে ষোলটি পরিবার! ক’দিন আগে বাংলাদেশ কিন্ডারগার্টেন স্কুল অ্যান্ড কলেজ ঐক্য পরিষদের চেয়ারম্যান গণমাধ্যমকে বলছিলেন, কিন্ডারগার্টেন স্কুলের শিক্ষকদের কেউ কেউ এখন চা-কফি বিক্রি করছেন, কেউ রাজমিস্ত্রির জোগালি দিচ্ছেন, আবার কেউবা নৌকা চালাচ্ছেন।

আমাদের দেশের বেসরকারি শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানগুলো কেবল নিজেদের প্রয়োজনে প্রতিষ্ঠিত হয়েছে ভাবলে ভুল হবে। দীর্ঘদিন যাবৎ এসব প্রতিষ্ঠান রাষ্ট্রের শিক্ষা পরিচালনা কার্যক্রমে ইতিবাচক অবদান রেখে চলেছে। রাষ্ট্র কখনও তাদের বেতন দেয়নি। অবকাঠামো দেয়নি। খবর নেয়নি। এমনকি তাদের প্রকৃত সংখ্যাটাও হয়তো রাষ্ট্র জানে না! শুধু অনুমোদন দিয়েই দায়িত্ব শেষ করেছে। শিক্ষার্থীদের বেতনই উন্নয়ন ও বেতন দুটোই চালিয়েছে প্রতিষ্ঠানগুলো। সরকারি শিক্ষাবঞ্চিত কোটি কোটি শিক্ষার্থী এসব প্রতিষ্ঠান থেকে শিক্ষার আলো নিয়ে আজ  দেশ বিনির্মাণে নিজেদের সম্পৃক্ত করেছে। এসব বেসরকারি শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে লাখ লাখ মানুষ কর্মসংস্থানের সুযোগ খুঁজে নিয়েছে। আজ  তাদের সংকট। মহাসংকট। ঘরে চাল নেই। চোখে ঘোরতর অন্ধকার। এই সময়ে রাষ্ট্র কি দাঁড়াবে না তাদের পাশে?

লাখ লাখ মানুষ শিক্ষাবঞ্চিত মানুষের পাশে আলোকবর্তিকা হয়ে দাঁড়িয়েছিল। তারা শিক্ষার আলো বিতরণ করে নিজেদের কর্মসংস্থানও খুঁজে নিয়েছিল। ব্যবসায়িক প্রয়োজনে নয়, রাষ্ট্রের প্রয়োজনেই, বিবেকের দায়বদ্ধতা থেকে তারা এসব প্রতিষ্ঠান গড়ে তুলেছিলেন। আজ  সেসব প্রতিষ্ঠান সংকটাপন্ন। আজ সেসব জীবন সংকটাপন্ন। আজ  সেসব জীবিকা সংকটাপন্ন। আমাদের কি কিছুই করার নেই সেসব মানুষের জন্য? কিছুই করার নেই সেসব শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানের জন্য? আমরা কি শুধুই চেয়ে চেয়ে দেখবো?

সরকার ইতোমধ্যে পত্র দিয়ে শিক্ষার্থীদের কাছ থেকে শুধু টিউশন ফি আদায় করতে বলেছে। অন্যদিকে, অভিভাবকবৃন্দ ৫০% বেতন কমানোর দাবি জানিয়েছেন। কোনও কোনও অভিভাবক টিউশন ফি প্রদানে সম্পূর্ণ অনীহা প্রকাশ করছেন। তাহলে কোথা থেকে আসবে শিক্ষকদের বেতনের অর্থ? কে দেবে? এই অসহায়াত্ব আমাদের উন্নয়ন, অর্জন ও অহংকারকে প্রশ্নবিদ্ধ করবে নাতো? আমরা ব্যবসায়ীদের জন্য পৌনে এক লাখ কোটি টাকা প্রণোদনা ঘোষণা করেছি। আমার কৃষি সংকট মোকাবিলায় প্রণোদনা ঘোষণা করেছি। এজন্য নিঃসন্দেহে সরকার প্রশংসার দাবি রাখে। কিন্তু কেন আমরা এখনও বেসরকারি শিক্ষকদের পাশে দাঁড়াতে পারলাম না। তাহলে কি আমাদের আন্তরিকতায় কোনও ঘাটতি আছে? বেসরকারি শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানকে উঠে দাঁড়ানোর জন্য কেন এখনও কোনও প্রণোদনা প্যাকেজ ঘোষণা করতে পারলাম না? মনে রাখতে হবে, বিপুল পরিমাণ শিক্ষার্থী যখন প্রতিষ্ঠানহীন হয়ে পড়বে তখন রাষ্ট্রের শিক্ষাব্যবস্থা ঝুঁকিপূর্ণ হয়ে পড়বে। প্রচুর পরিমাণ মানুষ যখন স্থায়ীভাবে কর্মহীন হয়ে পড়বে তখন রাষ্ট্র দুর্বল হয়ে পড়বে।

বেসরকারি শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান সরকার ও দেশকে সাহায্য করে। ফলে, এই ঘোরতর দুর্দিনে তাদের পাশে দাঁড়ানো আমাদের নৈতিক ও রাষ্ট্রীয় কর্তব্য। এবং আমরা বিশ্বাস করি, তাদের সাহায্য করার মতো, পাশে দাঁড়ানোর মতো যথেষ্ট সামর্থ‌্য আমাদের আছে। আমাদের মনে রাখা দরকার, দেশের মোট শিক্ষাব্যবস্থার প্রায় সিংহভাগই বেসরকারি খাতের মাধ্যমে পরিচালিত। ফলে যদি এই ব্যবস্থার একটি বড় অংশ ঝরে পড়ে, দুর্বল হয়ে পড়ে, সক্ষমতা হারায় তাহলে মোটাদাগে ব্যাপকভাবে ক্ষতিগ্রস্ত হবে আমাদের সামগ্রিক শিক্ষাব্যবস্থা। অতএব, ঝরে পড়া শিক্ষার্থীদের শিক্ষা নিশ্চিতকরণে যেমন আমাদের নানামুখী কর্মসূচি আছে তেমনই ঝরে পড়া শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান দাঁড় করাতেও আমাদের নানামুখী উদ্যোগ থাকা দরকার। সেজন্য কোনও কালক্ষেপণ নয় বরং এখনই বেসরকারি শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানের জন্য মোটা অঙ্কের প্রণোদনা ঘোষণা করা দরকার, নয়তো ব্যাপকভাবে ক্ষতিগ্রস্ত হবে আমাদের শিক্ষা, আমাদের শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান ও আমাদের কর্মসংস্থান; যা কোনও অবস্থাতেই কাম্য নয়। অতএব, যতদিন শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানগুলো পূর্বের ন্যায় টিউশন ফি আদায় করে সচল হয়ে উঠতে পারছে ততদিন তাদের পাশে থাকা রাষ্ট্রের দায়িত্ব।

লেখক: শিক্ষক, অ্যাকাউন্টিং অ্যান্ড ইনফরমেশন সিস্টেমস বিভাগ, বেগম রোকেয়া বিশ্ববিদ্যালয়, রংপুর

[email protected]

 

/এসএএস/এমএমজে/

*** প্রকাশিত মতামত লেখকের একান্তই নিজস্ব।

বাংলা ট্রিবিউনের সর্বশেষ
‘ভুঁইফোড় মানবাধিকার প্রতিষ্ঠানগুলো মানবাধিকার লঙ্ঘন করছে’
‘ভুঁইফোড় মানবাধিকার প্রতিষ্ঠানগুলো মানবাধিকার লঙ্ঘন করছে’
গরমে স্বস্তির খোঁজে লোকালয়ে ঢুকছে সাপ, সচেতনতার আহ্বান ডিএমপির
গরমে স্বস্তির খোঁজে লোকালয়ে ঢুকছে সাপ, সচেতনতার আহ্বান ডিএমপির
৩ ঘণ্টা গ্যাস থাকবে না কয়েকটি এলাকায়
৩ ঘণ্টা গ্যাস থাকবে না কয়েকটি এলাকায়
জাবির সিনেট ও সিন্ডিকেট প্রতিনিধি নির্বাচন: বঙ্গবন্ধু শিক্ষক পরিষদের নিরঙ্কুশ জয়
জাবির সিনেট ও সিন্ডিকেট প্রতিনিধি নির্বাচন: বঙ্গবন্ধু শিক্ষক পরিষদের নিরঙ্কুশ জয়
সর্বশেষসর্বাধিক

লাইভ