X
বৃহস্পতিবার, ২৮ মার্চ ২০২৪
১৪ চৈত্র ১৪৩০

মুনীরুজ্জামান: কমরেড, বিদায়

দাউদ হায়দার
২৬ নভেম্বর ২০২০, ১৫:৪৮আপডেট : ২৬ নভেম্বর ২০২০, ১৬:৪৭

দাউদ হায়দার সুইডেনের গোথেবুর্গ থেকে মুস্তফা জামিল ফোনে জানালেন, ‘দৈনিক সংবাদ-এর ভারপ্রাপ্ত সম্পাদক খন্দকার মুনীরুজ্জামান মারা গেছেন। হাসপাতালে। করোনাভাইরাসে কুপোকাৎ হয়ে তিন সপ্তাহের বেশি চিকিৎসাধীন, চিকিৎসকরা শত চেষ্টাতে ব্যর্থ।’
বয়স কত হয়েছিল জানতে চাইলুম। সঠিক বলতে পারেননি, ’৭২ বা ৭৩  হয়তো। আপনার চেয়ে বছর তিন চারেকের বড়।’
খন্দকার মুনীরুজ্জামানের সঙ্গে বার্লিনে ঘনিষ্ঠতা। আগে কখনও দেখিনি। লেখা পড়েছি পত্রপত্রিকায়। কলাম পড়েছি ‘যায়যায়দিন’-এ। নির্মেদ গদ্য। ঝরঝরে বাংলা। গাঁথুনি পোক্ত। বক্তব্য সরাসরি। বিচার-বিশ্লেষণের নির্মোহ। সমাজ রাজনৈতিক লেখার মুন্সিয়ানা ষোলআনা। প্রখর বুদ্ধিদীপ্ত মন্তব্যে চাঁছাছোলা। আপসহীন। মনমননে বামপন্থী। চিন্তাবোধে সমাজবাদী তথা সমাজতান্ত্রিক।
জানতুম না গল্প-কবিতাও লেখেন। পরে অবশ্যই পড়েছি। নিজেই পাঠিয়েছিলেন, সংবাদ-এর সম্পাদকীয়তে যোগ দিয়েছেন তখন। পড়েছি কিনা, কিংবা পড়ে মতামত কী, জানতে চান নি কখনও। সৌজন্যবশতও লেখা হয়নি, মর্মযাতনা এখন। তবে ফোনে বলেছিলুম একবার। খুশি হন।
গত শতকের উপান্তে, এক সন্ধ্যায় ফোন। ফোনের স্ক্রিনে দেখলুম অচেনা ফোন নাম্বার। যেহেতু অচেনা, ধরি না। না-ধরার অপবাদ বহুবিধ। খেসারতও দিতে হয়েছে।
বারবার ফোন, লক্ষ করি (স্ক্রিনে) ডেনমার্কের কোড। ধরলুম। বললেন, ‘আমি খন্দকার মুনীরুজ্জামান কথা বলছি। সংবাদ-এর মুনীরুজ্জামান।’
বিস্ময় মানি। জিজ্ঞেস করি, ‘কোত্থেকে?’
উত্তর: ডেনমার্কের কোপেনহেগেন থেকে। কাল বিকেলে বার্লিনে আসছি, সঙ্গে স্ত্রী। আপনার ওখানে থাকবো। দু-তিনদিন।’
জানি, বিদেশে ঠাঁই বা আস্তানা পাওয়া সহজ নয়, চটজলদি। পরিচিত হলে সমস্যার সুরাহা। ইতস্তত করছি। বুঝতে পারেন। জানতে চান, ‘সমস্যা হবে?’ ক্ষণকাল ভেবে দেখলুম, আসছেন বার্লিনে, কোথায় থাকবেন তাহলে? বললুম। ‘চলে আসুন।’
ইতস্তত কারণ ছিল। দুই কামরার ফ্ল্যাটে থাকি। দিন চারেক আগেই গোথেবুর্গ থেকে জামিল, ওঁর স্ত্রী দিলরুবা জামিল ওরফে ডেইজি এবং পুত্র অয়ন এসেছেন, আছেন এক ঘরে। কী আর করণীয়।
বাংলায় প্রবাদ, যদি হয় সুজন তেঁতুল পাতায় ন’জন।
মুনীরুজ্জামান এলেন, সঙ্গে স্ত্রী। সুশ্রী। বচনে নাম। পরিচয় করিয়ে দিলেন, ‘ওর নাম রেখা।’ ভালো নাম বলেননি। একদিন পরে পুরো নাম জানান, রোকেয়া খাতুন। পেশায় ডাক্তার। মুনীরুজ্জামানের রসিকতা, ‘রোগবালাই থাকলে বলুন, ওষুধ লিখে দেবে।’
কথায়-কথায় জানলুম, ওদের একমাত্র সন্তান, পুত্র। ডাক্তারি পড়ে বা পড়বে এইরকম কিছু।
একঘর ছেড়ে দিয়েছি মুনীরুজ্জামান-রেখার জন্যে। অন্য ঘরে জামিল, ডেইজি, অয়ন। ওঁদের এবং নিজের বিছানাও মেঝেয়, ম্যাট্রেসে।
ভাবছিলুম জামিলরা কি ভাবছেন? রেখারা কি ভাবছেন। ভাবনা অমূলক। জামিলের বড় ভাই গালিব, তাঁর কাছে মুনীরুজ্জামানের নাম শোনা, এবং গালিব ও মুনীরুজ্জামান বন্ধু, কিশোর বয়স থেকেই, একই স্কুলের সহপাঠী। এই সম্পর্কে জামিল-মুনীরুজ্জামানের হৃদ্যতা অচিরেই। হাঁফ ছাড়লুম।

জানতুম মুনীরুজ্জামানএকদা ছাত্র ইউনিয়নে (স্কুল-কলেজ-বিশ্ববিদ্যালয়ে পড়াকালীন ছাত্র ইউনিয়নে নিবিড় যুক্ত ছিলুম), পরে পার্টির (কমিউনিস্ট) সঙ্গে ওতপ্রোত, শ্রমিক সংগঠনেও। সার্বক্ষণিক কর্মী। মুক্তিযুদ্ধে প্রত্যক্ষ যোদ্ধা। ট্রেনিংপ্রাপ্ত। নানা সংগ্রামে, স্বৈরাচারবিরোধী আন্দোলনে নওজোয়ান। শ্রদ্ধায় অবনত হই।
বার্লিন থাকাকালীন, মুনীরুজ্জামান নানা ঐতিহাসিক দ্রষ্টব্যস্থান দেখতে উৎসাহী। নিয়ে যাই। খুঁটিয়ে-খুঁটিয়ে প্রশ্ন। জানার অদম্য বাসনা। অবশ্য অনেক কিছু জানেন, পূর্ব পশ্চিম জার্মানির রাজনীতি, পূর্ব পশ্চিম ইউরোপের এবং মার্কিন সাম্রাজ্যবাদের রাজনীতি। স্বচক্ষে দেখার অভিজ্ঞতা নিশ্চয় বই পড়ে জানার চেয়ে বেশি।
ছাত্র ইউনিয়ন করতুম, কমিউনিজমে ঘোরতর আস্থা এবং সংবাদ-এর সাহিত্য সম্পাদক ছিলুম, মুনীরুজ্জামান সম্বোধন করলেন, ‘কমরেড।’ বললুম, ‘আপনিও।’ অতঃপর কেউ আর নামে ডাকি না, ‘কমরেড’ সম্বোধন।
সংবাদ-এর ভারপ্রাপ্ত সম্পাদকীয়তার দায়িত্ব নিয়ে, মাসখানেক পরে মুনীরুজ্জামানের টেলিফোন, ‘কমরেড, আপনার সংবাদ-এ লিখতে হবে।’ বলি, ‘টাকা দিতে হবে। টাকা ছাড়া লিখি না।’ শুনে, ‘কবে থেকে পুঁজিবাদী? কমিউনিস্ট নন আর?’
-পুঁজিবাদী নই। অর্থের টানাটানি। কমিউনিস্টরাও আজকাল টাকার কাঙাল।’
বছর চারেক আগে (দিন, মাস মনে নেই) আবার টেলিফোন, ‘কমরেড, আজকাল লিখছেন না কোথাও, আপনার অভিমান বুঝি, মনোকষ্টে আছেন, আপনাকে প্রকৃত সম্মান দিচ্ছি না। অপরাধ আমাদের। সবই রাজনৈতিক কারণ। নিমিত্ত আমরা। আবার কবে দেখা হবে?’
জামিল মুস্তফার টেলিফোনে খন্দকার মুনীরুজ্জামানের মৃত্যু সংবাদ জেনে বিমর্ষ, আত্মিক বেদনা, স্বগত উচ্চারণ, কমরেড বিদায়।

লেখক: কবি ও সাংবাদিক

/এসএএস/এমওএফ/

*** প্রকাশিত মতামত লেখকের একান্তই নিজস্ব।

বাংলা ট্রিবিউনের সর্বশেষ
ঢাকা-ময়মনসিংহ মহাসড়ক অবরোধ করে শ্রমিকদের বিক্ষোভ
ঢাকা-ময়মনসিংহ মহাসড়ক অবরোধ করে শ্রমিকদের বিক্ষোভ
কুমিল্লা মেডিক্যাল সেন্টার হাসপাতালকে ২ লাখ টাকা জরিমানা
কুমিল্লা মেডিক্যাল সেন্টার হাসপাতালকে ২ লাখ টাকা জরিমানা
ফটোকপি দোকানের কর্মচারী, জেলে, রাজমিস্ত্রি তৈরি করতো জাল টাকা
ফটোকপি দোকানের কর্মচারী, জেলে, রাজমিস্ত্রি তৈরি করতো জাল টাকা
রুশ ক্ষেপণাস্ত্র হামলার পর নিরাপত্তা জোরদার করছে কিয়েভ
রুশ ক্ষেপণাস্ত্র হামলার পর নিরাপত্তা জোরদার করছে কিয়েভ
সর্বশেষসর্বাধিক

লাইভ