X
শুক্রবার, ০৪ জুলাই ২০২৫
২০ আষাঢ় ১৪৩২

রোহিঙ্গাদের বাংলাদেশি পাসপোর্টে মিয়ানমারের ‘জয়’

মো. আবুসালেহ সেকেন্দার
১৭ জানুয়ারি ২০২১, ১৬:৩২আপডেট : ১৭ জানুয়ারি ২০২১, ১৬:৩২

মো. আবুসালেহ সেকেন্দার
রোহিঙ্গাদের প্রতি বাংলাদেশিদের দরদের বিষয়টি সারা বিশ্ব জানে। কয়েকশ’ বছর আগের ইতিহাসের দিকে তাকালেও দেখা যাবে যে আজকের মতো বর্মী শাসক কর্তৃক যতবার রোহিঙ্গারা বিতাড়িত হয়েছেন ততবারই অতিথিপরায়ণ বাঙালি তাদের আশ্রয় দিয়েছেন। হারানো রাজ্য পুনরুদ্ধারে সাহায্য করেছেন। এ কথার প্রমাণ, ১৪০৪ খ্রিষ্টাব্দে বর্মী রাজার আক্রমণে পরাজিত আরাকান রাজ মেঙসামোন ওরফে নরমিখলার বাংলার গৌড় সুলতানের কাছে আশ্রয় প্রার্থনা করলে তিনি ওই রাজাকে ফিরিয়ে দেননি। গৌড়ের দরবারে আশ্রয় দেন। আরাকান রাজ ২৪ বছর গৌড়ের রাজকীয় অতিথি ছিলেন। ১৪৩০ খ্রিষ্টাব্দে গৌড়ের সুলতান জালাল-উদ-দীন শাহ সেনাপতি ওয়ালী খানকে প্রেরণ করে আরাকান রাজাকে তার হারানো রাজ্য পুনরুদ্ধারে সহায়তাও করেন।

স্বাধীন বাংলাদেশে ১৯৭৭ সাল থেকেই বাংলাদেশ রোহিঙ্গাদের মানবিক আশ্রয় প্রদান করছে। ওই সময়ে রোহিঙ্গারা সংখ্যালঘু বৌদ্ধদের দ্বারা নির্যাতন-নিপীড়নের শিকার হলে বাংলাদেশ শরণার্থী হিসেবে রোহিঙ্গাদের মানবিক আশ্রয় দেয়। এরপর ১৯৯১-৯২ সালেও নিঃশঙ্কচিত্তে তারা এ দেশে আশ্রয় পেয়েছে। সেবারও তারা মিয়ানমার সরকারের প্রত্যক্ষ উসকানিতে সংখ্যাগুরু বৌদ্ধদের দ্বারা বিতাড়িত হয়। পরবর্তী সময়ে অনেক রোহিঙ্গা মিয়ানমারে ফেরত গেলেও পুনরায় তারা ২০১৭ সালে শরণার্থী হয়ে বাংলাদেশে আশ্রয় প্রার্থী হয়। বাংলাদেশের অভ্যন্তরীণ নানা সংকট থাকলেও মানবিক বাংলাদেশ এবারও রোহিঙ্গাদের আশ্রয় প্রদান করে। মিয়ানমারে গণহত্যার শিকার হওয়া রোহিঙ্গাদের পাশে দাঁড়ায়।

নানা সংকটের সময়ে রোহিঙ্গারা বারবার বাংলা অঞ্চলে আশ্রয় গ্রহণ করলেও ঐতিহাসিক সত্য হচ্ছে, রোহিঙ্গারা আরাকানের স্থায়ী অধিবাসী, বাংলাদেশের নয়। বাংলা অঞ্চলের মানুষ রোহিঙ্গারা তাদের পূর্ব পুরুষ সেই কারণে নয় বরং মানবিক কারণে বারবার নির্যাতিত রোহিঙ্গাদের বাংলাদেশে আশ্রয় দিয়েছেন। তাই বাংলাদেশে নানা সময়ে নানা কারণে বসবাস করায় রোহিঙ্গারা বাঙালি- মিয়ানমারের এমন দাবি সত্য নয়। বরং রোহিঙ্গারা আরাকানি এমন দাবিই ঐতিহাসিক সত্য। তবে বাংলাদেশ ও বাঙালিদের সঙ্গে ঐতিহাসিকভাবে রোহিঙ্গাদের সুসম্পর্ক রয়েছে। রোহিঙ্গাদের নানা সংকটে প্রতিবেশী বাঙালিরা প্রতিবারই মানবিক সহায়তার হাত প্রসারিত করেছেন।

মিয়ানমারের সবার পূর্বপুরুষ যেমন বার্মার মাটি ফুঁড়ে বের হননি, তেমনি রোহিঙ্গারাও আরাকানের মাটিতে আকাশ থেকে পড়েননি। সভ্যতার প্রচলিত নিয়ম অনুযায়ী নানা প্রেক্ষাপটে বর্তমান রোহিঙ্গাদের পূর্বপুরুষেরা নানা জায়গা থেকে এসে আরাকানে বসতি গড়ে তুলেছেন। অতঃপর নানা জাতির মধ্যে মিশ্রণের একপর্যায়ে রোহিঙ্গা নামে একটি জাতিসত্তার উন্মেষ ঘটেছে। তবে আরাকানে বসবাসকারী রোহিঙ্গা জাতিগোষ্ঠীর পূর্বপুরুষেরা কোথা থেকে এসেছেন তা নিয়ে বিতর্ক থাকলেও এই কথা সত্য যে, বর্তমানে আরাকানে জাতিগোষ্ঠীর পরিচয় ছাপিয়ে মানুষ নানা ধর্মীয় সম্প্রদায়ে বিভক্ত হয়ে পড়েছেন। আর বহুধাবিভক্ত ধর্মীয় সম্প্রদায়ের প্রধান দুই পক্ষ হচ্ছে মুসলিম ও বৌদ্ধ। ইতিহাস সাক্ষী, এ উভয় সম্প্রদায়ের পূর্বপুরুষ বহিরাগত।

মগ থেকে বৌদ্ধ ধর্মাবলম্বীরা আরাকানে এসে সর্বপ্রথম বসবাস শুরু করেন এবং বৌদ্ধধর্ম প্রচার করেন। সমুদ্র যোগাযোগের সুবিধার জন্য বৌদ্ধ ধর্মমতের উদ্ভবের প্রথমদিকেই তৎকালীন বার্মা ও আরাকানে বৌদ্ধ ধর্মের প্রবেশ ঘটে। প্রথম খ্রিষ্ট শতকের প্রথম দিকে আরাকানের ম্রোহঙয়ের ২২ মাইল উত্তরে তৎকালীন রাজধানী ধন্যবতীতে মহামুনি মূর্তি এ মতেরই বড় সাক্ষী।

অন্যদিকে মুসলমানরা আরব থেকে এসে অষ্টম শতকে আরাকানে বসবাস শুরু করেন। ইসলামের প্রসারে ভূমিকা রাখেন। ইতিহাসবিদদের বিবরণ থেকে জানা যায়, অষ্টম শতকে আরাকান রাজ মহতৌঙ্গ-সন্দ-অয়য়ের (৭৮৮-৮১০) শাসনামলে আরাকানে মুসলমানদের প্রবেশ ঘটে। বাণিজ্যরত ভাঙা জাহাজের বিপন্ন আরবরা আরাকানের রামনি দ্বীপে আশ্রিত হয়ে রাজার অনুমতি নিয়ে বসতি স্থাপন করেন। ঐতিহাসিকদের ওই দাবি সত্য। কারণ, প্রাচীনকাল থেকেই আরব সাগর ও ভারত মহাসাগরীয় অঞ্চলের মধ্যে নৌ-বাণিজ্য ছিল। ফলে আরব বণিকদের চীন সমুদ্রযাত্রার পথে আরাকানের প্রসিদ্ধ সমুদ্রবন্দর রামরিতে যাত্রাবিরতি ঘটানো অসম্ভব কিছু নয়। তখন রামনিতে মুসলমানদের সংখ্যা কত ছিল, তা জানা না গেলেও তাদের অবস্থান যে সেখানে ছিল তার উৎকৃষ্ট প্রমাণ হলো আকিয়াবে আরব বণিকদের নির্মিত এক গম্বুজবিশিষ্ট ‘বন্দর মোকাম মসজিদ’। দশম শতক নাগাদ আরাকানি নারীদের মধ্যে প্রচলিত পর্দা-প্রথার প্রচলন এ মতের সপক্ষে আরও একটি বড় প্রমাণ।

আরেকটি বিতর্ক বেশ আওয়াজ তুলেছে- রোহিঙ্গাদের পূর্বপুরুষ ‘বাঙালি না আরাকানি’। এক পক্ষ বলছে রোহিঙ্গাদের পূর্বপুরুষ ছিল বাঙালি আর অন্য পক্ষ বলছে, না। প্রকৃতপক্ষে উভয় পক্ষের কথাই ঠিক। আগেই বলা হয়েছে, আরাকানে বিভিন্ন জাতিসত্তার মানুষ বসবাস করেন এবং তাদের পূর্বপুরুষ বিভিন্ন অঞ্চল থেকে এসেছেন। বাংলার সীমান্তবর্তী অঞ্চল হওয়ায় বাংলা থেকে কোনও ব্যক্তি বা গোষ্ঠীর সেখানে গিয়ে বসবাস করার ঘটনাও বিরল নয়। তবে সব রোহিঙ্গার পূর্বপুরুষ বাঙালি, সে দাবি ঠিক নয়। প্রকৃতপক্ষে বাংলা একসময় রোসাঙ্গ রাজ্যের অধীন ছিল। তখন থেকেই সেখানে বাংলার মুসলিম-অমুসলিমদের প্রবেশ ও বসবাস করতে থাকা অসম্ভব নয়। ইতিহাস সূত্রে জানা যায়, ৯৫১ খ্রিষ্টাব্দের দিকে সুল তইঙ্গ সন্দ (উচ্চারণ চিৎ-তৌৎ-গঙ্গ অর্থাৎ যুদ্ধ করা অন্যায়) নামক এক আরাকানি প্রথম চট্টগ্রাম দখল করেন। এভাবে বাংলা ও আরাকান অঞ্চলের রাজনৈতিক সীমানা পরিবর্তিত হওয়ার সুযোগে একই রাজ্যভুক্ত এক অঞ্চলের মানুষ অন্য অঞ্চলে গিয়ে বসবাসের সুযোগ পেয়েছেন। বাঙালি কবি কাজী দৌলত, আলাওল, মাগন ঠাকুরের পক্ষে সপ্তম শতকের মাঝামাঝিতে রোসাঙ্গে বসে বাঙালি সংস্কৃতির ও সাহিত্যের স্বর্ণযুগ সৃষ্টি করা তার বড় প্রমাণ। ব্রিটিশ যুগের ঔপন্যাসিক শরৎচন্দ্র চট্টোপাধ্যায়ের ‘শ্রীকান্ত’ পড়লেই যে কেউ সহজে উপলব্ধি করতে পারবেন সে সময়ে বাংলা-আরাকানের নিবিড় সম্পর্কের নানা দিক। আর অর্থনৈতিক প্রয়োজনে এক অঞ্চলের মানুষের অন্য অঞ্চলে গিয়ে বসবাস করার ঘটনা নতুন নয়। তাই কতিপয় বাঙালির আরাকানে গিয়ে বসবাস করা এবং এই সূত্রে মূল রোহিঙ্গা জনগোষ্ঠীর সঙ্গে মিশে যাওয়ার ঘটনা ঘটেছে তা ঐতিহাসিক সত্য। কিন্তু এর অর্থ এই নয় যে, সব রোহিঙ্গার পূর্বপুরুষ বাঙালি। অথবা রোহিঙ্গারা বাঙালি। বরং রোহিঙ্গা ও বাঙালি দুটি স্বতন্ত্র জাতি গোষ্ঠী, এমনটিই ঐতিহাসিক সত্য।

রোহিঙ্গারা বাঙালি বা বাংলাদেশি নয়, তাদের পরিচয় তারা রোহিঙ্গা আর আরাকানি। আরাকানে রোহিঙ্গা মুসলমানদের হঠাৎ করে উদয় হয়নি। তাদের বিকাশ ধারা একদিনে গড়ে ওঠেনি। আরাকানের অন্যান্য ধর্মাবলম্বীর মতো এরাও সেখানকার স্থায়ী বাসিন্দা। আরাকানি পরিবেশেই প্রতিষ্ঠা পেয়েছে তাদের ধর্মীয়, সামাজিক, রাজনৈতিক, অর্থনৈতিক ও সাংস্কৃতিক অধিকার। আরাকানের ইতিহাস বলে, ১৭৮৫ খ্রিষ্টাব্দ পর্যন্ত সেখানে বৌদ্ধ, মুসলমান, হিন্দু, খ্রিষ্টানসহ সব ধর্মাবলম্বী মানুষ সম্প্রীতির সঙ্গে বসবাস করে এসেছেন। ধর্মীয় বিদ্বেষপ্রসূত কোনও দাঙ্গা আরাকানি ইতিহাসে সংঘটিত হয়নি। আধুনিক যুগে ধর্মের নামে আরাকানে যে দাঙ্গা ঘটছে, তা প্রকৃতপক্ষে মিয়ানমার সরকার-গৃহীত অন্যায় ও ঘৃণ্য রাজনৈতিক নীতির ফল। আর মিয়ানমারের এই রাষ্ট্রীয় নিপীড়নের কারণেই রোহিঙ্গা মুসলিমদের মিয়ানমারের পাসপোর্ট পাওয়ার সুযোগ না থাকায় তারা বাংলাদেশি পাসপোর্ট পাওয়ার চেষ্টা করছেন। বিশ্বের বিভিন্ন দেশে বসবাসের সময় বাংলাদেশি পরিচয় দিচ্ছেন।

রোহিঙ্গাদের বিদেশে নিজেদের বাংলাদেশি পরিচয় দেওয়া এবং বাংলাদেশি পাসপোর্ট ব্যবহার করায় মিয়ানমারের দাবিকে প্রতিষ্ঠিত করছে। মিয়ানমার সরকারের দীর্ঘদিন ধরে রোহিঙ্গাদের বাংলাদেশের নাগরিক হিসেবে দাবি করার দাবিকে জোরালো ভিত্তি দিচ্ছে। ভৌগোলিক অবস্থান এবং ঐতিহাসিকভাবে বাংলা ও আরাকান অঞ্চলের মধ্যে সুসম্পর্কের কারণে মিয়ানমার সরকারকে রোহিঙ্গাদের বাংলাদেশি হিসেবে চিহ্নিত করার ওই অপতৎপরতা চালানোর সুযোগ করে দিয়েছে সত্য। কিন্তু এক্ষেত্রে রোহিঙ্গাদের ভূমিকাও কম নয়। কারণ, অবৈধভাবে বিদেশে পাড়ি জমানো রোহিঙ্গাদের অনেকেই মিয়ানমারে ফেরত না গিয়ে বাংলাদেশে ফেরত আসতে চাওয়ায় এবং নিজেদের বাংলাদেশি পরিচয় দিয়ে বাংলাদেশের পাসপোর্ট দাবি করায় মিয়ানমারের রোহিঙ্গাদের বাঙালি দাবি করার ভিত্তি পাকাপোক্ত করছে। এই মুহূর্তে বাস্তব অবস্থার পরিপ্রেক্ষিতে মিয়ানমার সরকারের দমন-নিপীড়ন থেকে বাঁচার এর চেয়ে ভালো কোনও উপায় অবশ্যই রোহিঙ্গাদের হয়তো জানা নেই। তবে এ বিষয়ে এখনই বাংলাদেশ সরকারের সতর্ক হওয়া দরকার। কারণ, রোহিঙ্গাদের বাংলাদেশি পাসপোর্ট ব্যবহার করে বিদেশযাত্রা ভবিষ্যতে মিয়ানমারের রোহিঙ্গাদের বাংলাদেশি দাবি করার পক্ষে যাবে। আন্তর্জাতিক ফোরামে রোহিঙ্গাদের বাংলাদেশি বা বাঙালি দাবি করার পক্ষে মিয়ানমারকে সুবিধা করে দেবে। কূটনৈতিক কারণে সৌদি আরবের মতো প্রভাবশালী রাষ্ট্রগুলোর সঙ্গে সুসম্পর্ক ধরে রাখতে বাধ্য হয়েই যদি রোহিঙ্গাদের বাংলাদেশি পাসপোর্ট প্রদান করতে হয়। তবে বাংলাদেশ সরকার এক্ষেত্রে যেন বিশেষ পাসপোর্ট প্রদান করেন। ওই পাসপোর্টে অবশ্যই রোহিঙ্গারা রোহিঙ্গা এবং তাদের স্থায়ী ঠিকানা মিয়ানমার অথবা বাংলাদেশের শরণার্থী ক্যাম্প উল্লেখ থাকে সেটা নিশ্চিত করতে হবে। সরকারের দায়িত্বশীলরা এ বিষয়টি গুরুত্ব উপলব্ধি করে প্রয়োজনীয় কার্যকর পদক্ষেপ গ্রহণ করবেন বলে আমরা আশা করি।

লেখক: সহকারী অধ্যাপক, ইসলামের ইতিহাস ও সংস্কৃতি বিভাগ, জগন্নাথ বিশ্ববিদ্যালয়

[email protected]

/এসএএস/এমওএফ/

*** প্রকাশিত মতামত লেখকের একান্তই নিজস্ব।

বাংলা ট্রিবিউনের সর্বশেষ
এশিয়ান কাপে ওঠার অনুভূতি বলে প্রকাশ করতে পারছেন না ঋতুপর্ণা
এশিয়ান কাপে ওঠার অনুভূতি বলে প্রকাশ করতে পারছেন না ঋতুপর্ণা
সরকারের জাতীয় ঐকমত্যের উদ্যোগে বাধা একটি দল: জামায়াত সেক্রেটারি
সরকারের জাতীয় ঐকমত্যের উদ্যোগে বাধা একটি দল: জামায়াত সেক্রেটারি
বিচার, সংস্কার এবং নতুন সনদের বাস্তবায়নে জনগণই আমাদের একমাত্র শক্তি: নাহিদ ইসলাম
বিচার, সংস্কার এবং নতুন সনদের বাস্তবায়নে জনগণই আমাদের একমাত্র শক্তি: নাহিদ ইসলাম
কাবরেরার পদত্যাগ চেয়ে নিজেই অপসারিত শাহীন!
কাবরেরার পদত্যাগ চেয়ে নিজেই অপসারিত শাহীন!
সর্বশেষসর্বাধিক