X
শুক্রবার, ২৬ এপ্রিল ২০২৪
১২ বৈশাখ ১৪৩১

বাংলাদেশের ৫০ বছর: এগিয়েছি যতটা, বাকি পথ ততটাই

ড. এ কে আব্দুল মোমেন
১৩ মে ২০২১, ১২:৪৪আপডেট : ১৩ মে ২০২১, ১২:৪৪

ড. এ কে আব্দুল মোমেন স্বাধীনতার সুবর্ণজয়ন্তী পালন করছে বাংলাদেশ। ১৯৭১ সালের দীর্ঘ ৯ মাসের রক্তক্ষয়ী যুদ্ধের মাধ্যমে অর্জিত এ দেশ স্বাধীনতার ৫০ বছর পূর্ণ করেছে গত ২৬ মার্চ। স্বাধীন হওয়ার পর থেকে বিগত পঞ্চাশ বছরে বিশ্বের বুকে উন্নয়নের বিস্ময় হিসেবে আবির্ভূত হয়েছে বাংলাদেশ। বেড়েছে দেশের জিডিপির (মোট দেশজ উৎপাদন) পরিমাণ, বেড়েছে অর্থনীতির আকার। পাকিস্তানি দুঃশাসনের হাত থেকে স্বাধীনতা লাভ করার পর মাত্র ৫০৭ কোটি টাকার বাজেট নিয়ে যাত্রা শুরু করেছিল যে ছোট অর্থনীতির দেশটি, সেই দেশের বাজেট আজ পাঁচ লক্ষ কোটিকেও ছাড়িয়ে গেছে। ছোট্ট অর্থনীতির দেশটা আজ পরিচিতি পেয়েছে এশিয়ার ‘টাইগার ইকোনমি’ হিসেবে। অর্থনৈতিক প্রবৃদ্ধি ও সামাজিক উন্নয়নের যেকোনও সূচকের বিচারে গত ৫০ বছরে বাংলাদেশের অগ্রগতি হয়েছে অভূতপূর্ব। ১৯৯০-এর পর সার্বিকভাবে প্রবৃদ্ধিতে উন্নয়নশীল দেশের গড় হারের তুলনায় অনেক এগিয়েছে বাংলাদেশ। দারিদ্র্যের হার কমে অর্ধেক হয়ে গেছে। মেয়েদের অর্থনৈতিক কর্মকাণ্ড অবদানের হার দ্রুত বেড়েছে। জনসংখ্যা, গড় আয়ু, শিশুমৃত্যুর হার, মেয়েদের স্কুলে পড়ার হার, সক্ষম দম্পতিদের জন্মনিয়ন্ত্রণ ব্যবস্থা গ্রহণের হার ইত্যাদি সামাজিক সূচকে বাংলাদেশ সমপর্যায়ের উন্নয়নশীল অন্যান্য দেশ, এমনকি প্রতিবেশী ভারতকেও পেছনে ফেলতে সমর্থ হয়েছে। যে পাকিস্তানের হাত থেকে স্বাধীন হয়েছে বাংলাদেশ, সেই পাকিস্তানিরা আজ বিস্মিত নয়নে তাকিয়ে দেখে বাংলাদেশের অগ্রযাত্রা। গত এক দশক ধরে জিডিপিতে চলতি বাজার মূল্যে (কারেন্ট প্রাইস মেথড) বাংলাদেশের প্রবৃদ্ধি সারাবিশ্বে সবার ওপরে!

১৯৭২ সালে বাংলাদেশের মোট জিডিপি বৃদ্ধির হার ছিল মাত্র ২.৫ শতাংশ। ১৯৯৫ সালে তা বেড়ে দাঁড়ায় ৬ দশমিক ৫ শতাংশে। ২০১৯-২০ অর্থবছরে দেশের জিডিপি বৃদ্ধির হার ৮ দশমিক ১৫ শতাংশ। যে কোনও দেশের বিচারেই প্রবৃদ্ধির এ হার অত্যন্ত আশাব্যঞ্জক। পঞ্চাশ বছর একটি দেশের জন্য খুব বেশি দীর্ঘ সময় নয়। পৃথিবীর বহুদেশ, বহু আগে স্বাধীনতা লাভ করেও এখনও উন্নয়নের মূল স্রোতে ভিড়তে পারেনি। বাংলাদেশ সেখানে ধাপে ধাপে কেবল এগিয়েই গেছে। ২ দশমিক ৫ শতাংশ প্রবৃদ্ধি থেকে ৮ বা এর চেয়েও বেশি হচ্ছে বর্তমান প্রবৃদ্ধির হার। ১৯৭২ সালে দেশের মানুষের মাথাপিছু আয় ছিল মাত্র ৭০ ডলার। যা এখন বেড়ে দাঁড়িয়েছে ২০৬৪ ডলার (২০১৯-২০)। মাথাপিছু আয় বৃদ্ধির পাশাপাশি বদলে গেছে মানুষের সামগ্রিক জীবনের চালচিত্র। গরিব দেশের গরিব মানুষ বলে পরিচিতি, এদেশের মানুষ আজ অর্থনৈতিকভাবে সক্ষমতা অর্জন করেছে।

১৯৭২ সালে স্বাধীনতা অর্জনের পরপর বাংলাদেশের মানুষের গড় আয়ু ছিল ৪৬.৫১ বছর। বিগত ৫০ বছরে ধাপে ধাপে মানুষের গড় আয়ু বেড়ে বর্তমানে তা ৭২.৬ বছরে পৌঁছেছে। মানুষের গড় আয়ু বৃদ্ধির ভিত্তিতেও বাংলাদেশের অগ্রগতি ঈর্ষণীয়। কেবল যে গড় আয়ু বেড়েছে, তা নয়। এর পাশাপাশি মৃত্যুহার কমেছে, শিশুমৃত্যু হার কমেছে, জন্মহারও কমেছে। ১৯৭২ সালে প্রতি হাজারে শিশুমৃত্যু হার ছিল ১৪১ জন। ২০২০ সালে এ হার কমে দাঁড়িয়েছে ২১ জনে। প্রতি হাজারে ১৯৭২ সালে জন্মহার ছিল ৫০ জন। ২০২০ সালে প্রতি হাজারে জন্মহার ১৮ দশমিক ১। মৃত্যুহার প্রতি হাজারে ছিল ২০ জন। ২০২০ সালে তা কমে দাঁড়িয়েছে ৪ দশমিক ৯ জনে। ১৯৭২ সালে দেশে মোট জনসংখ্যা ছিল ৭ দশমিক ৫ কোটি। বর্তমানে দেশের মোট জনসংখ্যা ২০২০ সালের হিসেবে ১৬.৬৫ কোটি। মোট জনসংখ্যার আকার বাড়লেও কমেছে জনসংখ্যা বৃদ্ধির হার। ৭২ সালে জনসংখ্যা বৃদ্ধির হার ছিল ২ দশমিক ৭ শতাংশ থেকে ৩ শতাংশ। ২০২০ সালে এ হার কমে দাঁড়িয়েছে ১ দশমিক ৩৭ শতাংশে।

২৯ আগস্ট, ২০১৯ সালে ‘দ্য স্পেক্টেটর ইনডেক্স’ এ প্রকাশিত বিশ্বের ২৬টি শীর্ষ জিডিপি প্রবৃদ্ধি অর্জনকারী দেশের তথ্যের ভিত্তেতে দেখা যায় বাংলাদেশ জিডিপিতে (মোট দেশজ উৎপাদন) অর্জন করেছে বিশ্বের সর্বোচ্চ প্রবৃদ্ধি। ২০০৯ সাল থেকে শুরু করে ২০১৯ পর্যন্ত এদেশের সবচেয়ে সফল প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা সরকারের দশ বছরে বাংলাদেশের প্রবৃদ্ধি সারা বিশ্বে সবার উপরে। এ সময় বাংলাদেশের জিডিপিতে প্রবৃদ্ধি হয়েছে শতকরা ১৮৮ ভাগ। যা বিশ্বের অন্যতম বৃহৎ অর্থনীতির দেশ চীন ও ভারতের চেয়েও বেশি। চীনের প্রবৃদ্ধি হয়েছে চীন ১৭৭ ভাগ ও ভারতের ১১৭ ভাগ। অন্যান্য দেশের মধ্যে ইন্দোনেশিয়া ৯০, মালয়েশিয়া ৭৮, অস্ট্রেলিয়া ৪১, মেক্সিকো ৩৭, ইতালি ৮, জার্মানি ১৫, মিশর ৫১ এবং ব্রাজিল ১৭ ভাগ প্রবৃদ্ধি অর্জন করেছে।

যুক্তরাজ্যভিত্তিক গবেষণা প্রতিষ্ঠান সেন্টার ফর ইকোনমিকস অ্যান্ড বিজনেস রিসার্চ (সিইবিআর) প্রকাশিত এক প্রতিবেদনে বলা হয়েছে ২০৩২ সালের মধ্যে বাংলাদেশ বিশ্বের বড় ২৫টি অর্থনীতির দেশের একটি হবে। তখন বাংলাদেশ হবে ২৪ তম বৃহৎ অর্থনীতির দেশ। বর্তমানে অবস্থান ৪১ তম। ২০৩৩ সালে আমাদের পেছনে থাকবে মালয়েশিয়া, সুইডেন, সুইজারল্যান্ড, সিঙ্গাপুর, ভিয়েতনাম ও দক্ষিণ আফ্রিকার মতো দেশ। আগামী ১৫ বছর দেশের মোট দেশজ উৎপাদন (জিডিপি) প্রবৃদ্ধি গড়ে ৭ শতাংশ থাকবে। ওয়ার্ল্ড ইকোনমিক লিগ টেবিল ২০১৯ শীর্ষক এই প্রতিবেদনে ১৯৩টি দেশের অর্থনৈতিক অবস্থা, চ্যালেঞ্জ ও সম্ভাবনার উল্লেখ আছে।

বাংলাদেশ সম্পর্কে ওই প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, গত ১৫ বছরে বাংলাদেশ ১২টি দেশকে টপকে গেছে। আগামী ১৫ বছরে টপকে যাবে আরও ১৭টি দেশ। এই যাত্রার প্রথম পাঁচ বছরে ৫ টি দেশকে টপকে যাবে। ২০২৩ সালে বাংলাদেশ হবে ৩৬ তম অর্থনীতির দেশ। পরের পাঁচ বছর আরও ৯টি দেশকে পেরিয়ে ২০২৮ সালে হবে ২৭ তম বড় অর্থনীতির দেশ। পরের পাঁচ বছরে টপকাবে আরও ৩টি দেশ। এক দশক ধরে বাংলাদেশ গড়ে ৬ দশমিক ৩ শতাংশ হারে জিডিপি প্রবৃদ্ধি অর্জন করেছে। এখন ক্রয়ক্ষমতার সমতা অনুসারে বা পিপিপি ডলারে মাথাপিছু জিডিপি ৪ হাজার ৬০০ ডলারে উন্নীত হয়েছে, যা দেশটিকে নিম্নমধ্যম আয়ের দেশে উত্তরণে সহায়তা করেছে। সংস্থাটি বলছে, বাংলাদেশের অর্থনীতিতে বড় প্রবৃদ্ধির পেছনে কারণ হলো অভ্যন্তরীণ ভোগ চাহিদা, সরকারি ব্যয়, প্রবাসী আয় ও রফতানি। নানা ধরনের চ্যালেঞ্জ সত্ত্বেও বাংলাদেশ এসব কারণেই সামনের দিকে এগিয়ে যাচ্ছে।

গত ৫০ বছরে বাংলাদেশে বেসরকারি ব্যাংকের সংখ্যা দাঁড়িয়েছে ৪৪ টিতে। যেখানে পাকিস্তানের বেসরকারি ব্যাংক মাত্র ২২টি। দেশে বৈদেশিক মুদ্রার রিজার্ভ ৪২ বিলিয়ন ডলার ছাড়িয়েছে। বর্তমানে পাকিস্তানের বৈদেশিক মুদ্রার রিজার্ভ ২০ দশমিক ৮ বিলিয়ন ডলার। বাংলাদেশের মানুষের মাথাপিছু আয়ের পরিমাণ ২ হাজার ৬৪ ডলার। পাকিস্তানের মানুষের মাথাপিছু আয় ১ হাজার ১৩০ ডলার। বাংলাদেশের মানুষের গড় আয়ু বর্তমানে ৭২ বছর আর পাকিস্তানে ৬৭ বছর। পাঁচ বছরের কম বয়সী শিশু মৃত্যুর হার বাংলাদেশে হাজারে ২৫ জন, পাকিস্তানে প্রতি হাজারে মারা যায় ৫৯ জন। বাংলাদেশে প্রাথমিক শিক্ষাপর্ব শেষ করছে ৯৮ শতাংশ শিশু, পাকিস্তানে ৭২ শতাংশ। যুক্তরাজ্যভিত্তিক অর্থনৈতিক পরামর্শ সংস্থা সেন্টার ফর ইকোনোমিকস অ্যান্ড বিজনেস রিসার্চের (সিইবিআর)  ‘ওয়ার্ল্ড ইকোনমিক লিগ টেবিল (ডব্লিউইএলটি)’ প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, পাকিস্তানকে পেছনে ফেলে জিডিপির আকারের ভিত্তিতে বৃহৎ অর্থনীতির দেশের তালিকায় ৪১তম অবস্থানে উঠে এসেছে বাংলাদেশ। পাকিস্তানের অবস্থান ৪৪তম।

অপ্রতিরোধ্য গতিতে এগিয়ে যাচ্ছে দেশ। যে সোনার বাংলার স্বপ্ন জাতির জনক বঙ্গবন্ধু দেখেছিলেন, যে অর্থনৈতিক মুক্তি চেয়েছিলেন মানুষের, যে ক্ষুধা ও দারিদ্র্যমুক্ত সমাজ গড়তে চেয়েছিলেন সকলের জন্য, তারই সুযোগ্য কন্যা সফল রাষ্ট্রনায়ক শেখ হাসিনার দূরদর্শী নেতৃত্বে সে পথেই তরতর করে এগিয়ে যাচ্ছে বাংলাদেশ। ‘দ্য ওয়ার্ল্ড ইন ২০৩০: আওয়ার লং-টার্ম প্রজেকশনস ফর ৭৫ কান্ট্রিজ’ শিরোনামের এই রিপোর্টে দেখানো হয়েছে, ২০১৮ সাল থেকে ২০৩০ সালের মধ্যে অবস্থানের দিক থেকে বাংলাদেশের অর্থনীতি ১৬ ধাপে উন্নীত হবে। যা অন্য যেকোনও দেশের তুলনায় অধিক। অর্থনৈতিক উন্নয়নের এ তালিকায় বাংলাদেশের পরেই ফিলিপাইন, পাকিস্তান, ভিয়েতনাম ও মালয়েশিয়ার নাম এসেছে। প্রবৃদ্ধি অর্জনের দিক থেকে উন্নত দেশ নরওয়ের চেয়েও বাংলাদেশের অধিক সম্ভাবনা রয়েছে বলে এই প্রতিবেদনে উল্লেখ করা হয়েছে। হংকং সাংহাই ব্যাংকিং করপোরেশন- এইচএসবিসি’র সর্বশেষ গ্লোবাল রিসার্চে বলা হয়েছে, আগামী ২০৩০ সালের মধ্যে মোট দেশজ উৎপাদনের (জিডিপি) নিরিখে বিশ্বের ২৬তম বৃহৎ অর্থনীতির দেশ হতে যাচ্ছে বাংলাদেশ। বর্তমানে বাংলাদেশের অবস্থান যেখানে ৪২তম। যেমন বেড়েছে দেশের অর্থনীতির আকার, তেমনই বিস্তৃত হয়েছে বৈদেশিক বাণিজ্য। বৈদেশিক পণ্য রফতানি আয়ে অর্জিত হয়েছে নতুন মাইল ফলক। এ সরকারের আমলে গত ২০১৮-১৯ অর্থবছরে পণ্য রফতানি হয়েছে ৪০ বিলিয়ন বা ৪ হাজার কোটি মার্কিন ডলার। যা এখন পর্যন্ত দেশের সর্বোচ্চ পণ্য রফতানি আয়। এইচএসবিসি’র দীর্ঘমেয়াদী উন্নয়ন মডেলে দেখানো হয়েছে, ২০৩০ পর্যন্ত প্রতিবছর বাংলাদেশের অর্থনীতিতে গড়ে ৭.১ শতাংশ হারে প্রবৃদ্ধি অর্জিত হবে। যা রিপোর্টে উল্লিখিত ৭৫টি দেশের মধ্যে সর্বোচ্চ। বাংলাদেশে ২০১৮ সাল থেকে ২০২৩ সালের মধ্যে ৭.৩ শতাংশ, ২০২৩ থেকে ২০২৮ সালের মধ্যে ৭.০ শতাংশ এবং ২০২৮ থেকে ২০৩৩ সালের মধ্যে ৭.২ শতাংশ প্রবৃদ্ধি অর্জিত হবে বলেও আশাবাদ ব্যক্ত করা হয়েছে। এ ধারা অব্যাহত থাকলে বর্তমান বাংলাদেশের ৩০০ বিলিয়ন ডলারের অর্থনীতি ২০৩০ সালে পৌঁছে যাবে ৭০০ বিলিয়ন ডলারে। জিডিপির হিসেবে বাংলাদেশ এখন বিশ্বের ৪৪তম বৃহৎ অর্থনীতির দেশ। ক্রয় ক্ষমতার বিবেচনায় ৩৩তম। আর অর্থনৈতিক প্রবৃদ্ধির গতি বিবেচনায় বিশ্বে বাংলাদেশ এখন দ্বিতীয় অবস্থানে।

বিশ্ব অর্থনৈতিক ফোরাম-ডব্লিউইএফের ‘ইনক্লুসিভ ডেভেলপমেন্ট ইনডেস্ক’-আইডিআই ২০১৮ র‌্যাংকিংয়ে দেখা যায়– অন্তর্ভুক্তিমূলক উন্নয়ন সূচকে (আইডিআই) দক্ষিণ এশিয়ার বড় দেশ ভারতের চেয়ে ২৮ ধাপ এবং পাকিস্তানের চেয়ে ১৩ ধাপ এগিয়েছে বাংলাদেশ। বিশ্বের ১০৩ দেশের বার্ষিক অর্থনৈতিক কর্মকাণ্ড বিচার করে সুইজারল্যান্ডের পূর্বাঞ্চলীয় শহর দাভোসে এ সংক্রান্ত প্রতিবেদনটি প্রকাশ করেছে ডব্লিউইএফ। অর্থনীতির তিনটি মানদণ্ড- ‘প্রবৃদ্ধি ও উন্নয়ন’, ‘অন্তর্ভুক্তিকরণ এবং ‘আন্তঃপ্রজন্ম সমতা, প্রাকৃতিক ও আর্থিক সম্পদের টেকসই ব্যবস্থাপনা’র ভিত্তিতে প্রতিবেদনটি তৈরি করে তারা।

বাংলাদেশের অর্থনৈতিক অগ্রগতি এখন বিশ্বের অনেক দেশের জন্যই উদাহরণ। অর্থনীতি ও আর্থসামাজিক বেশিরভাগ সূচকে বাংলাদেশ ছাড়িয়ে গেছে দক্ষিণ এশিয়ার প্রায় সবগুলো দেশকে। নিম্ন আয়ের দেশগুলোকে ছাড়িয়েছে তো অনেক আগেই। সম্প্রতি আন্তর্জাতিক মুদ্রা তহবিল (আইএমএফ) একটি প্রতিবেদন প্রকাশ করে বলেছে, একটি জনবহুল ও নিম্ন আয়ের দেশ হিসেবে বাংলাদেশ যেভাবে প্রবৃদ্ধির সঙ্গে দারিদ্র্য দূরীকরণ এবং বৈষম্য কমানোকে সংযুক্ত করেছে, তা অত্যন্ত উল্লেখযোগ্য। সবাইকে অর্ন্তভুক্ত করে প্রবৃদ্ধি অর্জনের ক্ষেত্রে বাংলাদেশ এখন উদাহরণ দেওয়ার মতো একটি দেশ। বিশ্ব ব্যাংকের হিসেবেও বাংলাদেশের এ অগ্রগতিকে গুরুত্ব দেওয়া হয়েছে বিশেষভাবে। সম্প্রতি তারা একটি টেবিল উপস্থাপন করে দেখিয়েছে উন্নয়নের প্রধান ১২টি সূচকের মধ্যে ১০টিতেই বাংলাদেশ দক্ষিণ এশিয়া এবং অন্যান্য নিম্ন আয়ের দেশের তুলনায় এগিয়ে যাচ্ছে দ্রুত।

উন্নয়নের যে কোনও সূচকের বিচারে বিবেচনা করলেই বিশ্ববাসীর দৃষ্টির কেন্দ্রবিন্দুতে চলে আসছে আজ বাংলাদেশ। কেবল সাধারণ মানুষই নয়, বিশ্বের বিভিন্ন দেশের নাম করা ব্যক্তিবর্গ, অর্থনীতিবিদ, রাজনীতিক সকলেই আজ বাংলাদেশ বিষয়ে সচেতন। নোবেলজয়ী বাঙালি অর্থনীতিবিদ অধ্যাপক অমর্ত্য সেন বাংলাদেশের উন্নয়ন নিয়ে বারবার লিখেছেন। তিনি তাঁর সর্বশেষ প্রকাশিত ‘অ্যান আনসারটেইন গ্লোরি: ইন্ডিয়া অ্যান্ড ইটস কনট্রাডিকশনস’ বইয়ে বাংলাদেশ নিয়ে আলাদা একটি অধ্যায়ও রেখেছেন।

স্বল্পন্নোত দেশের তালিকা থেকে বেরিয়ে বাংলাদেশ এখন নিম্নমধ্য আয়ের দেশ। উন্নয়নশীল দেশ হওয়ার চূড়ান্ত সুপারিশ লাভ করেছে করোনার এ মহামারিরকালেও। বিশ্বের বহু দেশ যখন করোনা মোকাবিলায় হিমশিম খাচ্ছে, বাংলাদেশ সেখানে শেখ হাসিনার নেতৃত্বে অত্যন্ত দক্ষতার সাথে করোনা পরিস্থিতি মোকাবিলা করতে সক্ষম হয়েছে। করোনা ভাইরাস মোকাবিলার সক্ষমতায় বাংলাদেশ দক্ষিণ এশিয়ায় প্রথম এবং বিশ্বে ২০তম। বিশ্বের বহু উন্নত দেশকে পেছনে ফেলে অনেকের আগে করোনা ভ্যাকসিন লাভ করেছে বাংলাদেশের মানুষ। এটাও এদেশের অর্থনীতির সক্ষমতারই পরিচায়ক।

বিগত ৫০ বছরে শুধু যে মানুষের আয় বেড়েছে তা নয়, বেড়েছে মানুষের গড় আয়ু, বেড়েছে জীবনযাত্রার মান। বাড়িঘর, ব্যবহার্য, আসবাবপত্র থেকে শুরু করে সামগ্রিক জীবনে এসেছে উন্নত জীবনের ছোঁয়া। রেকর্ড পরিমাণ বেড়েছে বাজেটের আকার। বাজেট বাস্তবায়নে পরনির্ভরতাও কমছে। অবকাঠামোগত উন্নয়ন হচ্ছে দৃশ্যমান। বড় বড় প্রকল্প বাস্তবায়নে বাংলাদেশের সক্ষমতাও বাড়ছে। পদ্মাসেতুর মতো মেগা প্রজেক্ট নিজেদের টাকায় করার মতো দুঃসাহস এখন বাংলাদেশ দেখাতে পারে। আকাশে উড়িয়েছে নিজস্ব স্যাটেলাইট। নিজস্ব স্যাটেলাইট থেকে প্রাপ্ত ছবি দিয়েই চলছে দেশের সম্প্রচার কার্যক্রম। তথ্য প্রযুক্তিখাতেও বাংলাদেশের অগ্রগতি ঈর্ষণীয়। গত এক দশকে কেবল তথ্য প্রযুক্তিখাতেই কর্মসংস্থান হয়েছে প্রায় ১০ লাখ মানুষের। আগামী পাঁচ বছরের মধ্যে আরো ১০ লাখ লোকের কর্মসংস্থান এ খাতে হবে বলে আশা করা হচ্ছে। কর্মসংস্থান বৃদ্ধি পাওয়ার সঙ্গে সঙ্গে কমে আসছে দারিদ্র্য। বাংলাদেশ পরিসংখ্যান ব্যুরো (বিবিএস)-এর তথ্য বলছে, ২০০৯ সালে বাংলাদেশে প্রায় ৫ কোটি মানুষ চরম দারিদ্র্য সীমার নিচে বসবাস করতে। তাঁদের মধ্যে প্রায় তিন কোটি মানুষ ছিলেন চরম দরিদ্র অবস্থায়। এখন দারিদ্র্য সীমার নিচে বাস করেন পৌনে চার কোটিরও কম মানুষ। আর চরম দারিদ্র্যে আছেন দেড় কোটির কিছু বেশি মানুষ। যে সকল উন্নয়ন প্রকল্প হাতে নিয়েছে সরকার, তা বাস্তবায়ন হলে এই সংখ্যা দ্রুতই কমে আসবে আরো।

১৯৯০ এর দশকেও বাংলাদেশে ৫৭ শতাংশ মানুষ দারিদ্র্যসীমার নিচে বাস করত। এখন করছে মাত্র ২১ দশমিক ৮ শতাংশ। অতি দারিদ্র্যের হাম কমে নেমেছে ১১ দশমিক ৩ শতাংশে। ২০১৭ সালে দেশের সার্বিক দারিদ্র্যের হার ছিল ২৩ দশমিক ১ শতাংশ, আর অতিদারিদ্র্যের হার ছিল ১২ দশমিক ২ শতাংশ।

বাংলাদেশের মোট দেশজ উৎপাদনের (জিডিপি) প্রবৃদ্ধি যে হারে হচ্ছে, তাতে ২০১৩ সালের আগেই দারিদ্র্য হার শূন্যের কোটায় নেমে আসবে। অতি দারিদ্র্যর হার ৩ শতাংশের কম হলেই তা শূন্য দারিদ্র্য হিসেবে ধরা হয়। বাংলাদেশ পরিসংখ্যান ব্যুরোর (বিবিএস) ২০১০ সালের খানা আয় ব্যয় জরিপ অনুযায়ী, তখন দেশের সার্বিক দারিদ্র্যের হার ছিল সাড়ে ৩১ শতাংশ। ২০১৬ সালের জরিপে তা কমে নেমে আসে ২৪ দশমিক ৩ শতাংশে। বিগত এক দশকে দারিদ্র্য হার কমেছে ব্যাপক ভাবে। দেশের অর্থনৈতিক অগ্রগতিই মূলত মূল অনুঘটক হিসেবে কাজ করেছে এর পেছনে।

অথনৈতিক প্রবৃদ্ধিতে ধারাবাহিকতা অর্জন গ্রামীণ অর্থনীতিকে চাঙা করেছে। মূলত বিপুল পরিমাণ প্রবাসীদের পাঠানো আয়, তৈরি পোশাক খাতের প্রায় ৪০ লাখ শ্রমিক এবং কৃষির সবুজ বিপ্লব দারিদ্র্য কমিয়ে গ্রামীণ ও প্রান্তিক মানুষের জীবন যাত্রার উন্নয়নের ক্ষেত্রে বড় ধরনের ভূমিকা রেখেছে। সরকারও পিছিয়ে পড়া ও অতিদরিদ্রদের জন্য সামাজিক কর্মসূচি খাতে অব্যাহতভাবে বাজেট বাড়িয়েছে। দেশের ৪০ শতাংশেরও অধিক অতি দরিদ্র মানুষ এখন এই কর্মসূচির আওতায়। কারণ দরিদ্র জনগোষ্ঠীর যথাযথ কর্মসংস্থান করতে না পারলে উন্নয়নের ফল সুদূর প্রসারী হয় না।

শেখ হাসিনার উন্নয়নবান্ধব সরকার এদিকেও গুরুত্ব দিয়েছে যথার্থ পরিমাণ। বাংলাদেশ এগিয়ে যাচ্ছে, এগিয়ে যাবে। শেখ হাসিনার গতিশীল নেতৃত্বে চলমান অগ্রগতির ধারা অব্যাহত থাকলে খুব সহসাই বাংলাদেশ বিশ্ব অর্থনীতিতে আরো জোরাল দৃষ্টান্ত স্থাপন করবে। স্বাধীনতার ৫০ বছরেই উন্নয়ন ও সমৃদ্ধির যে উচ্চতায় পৌঁছেছে বাংলাদেশ, এর ওপর ভিত্তি করে শতবর্ষ পূর্তিতে এদেশ একটি উন্নত ও আদর্শ দেশে পরিণত হবে সে কথা অনেকটা নিশ্চিতভাবেই বলা যায়।

লেখক: পররাষ্ট্রমন্ত্রী, গণপ্রজাতন্ত্রী বাংলাদেশ সরকার।

 

/এসএএস/

*** প্রকাশিত মতামত লেখকের একান্তই নিজস্ব।

বাংলা ট্রিবিউনের সর্বশেষ
আগুন নেভাতে 'দেরি করে আসায়' ফায়ার সার্ভিসের গাড়িতে হামলা, দুই কর্মী আহত
আগুন নেভাতে 'দেরি করে আসায়' ফায়ার সার্ভিসের গাড়িতে হামলা, দুই কর্মী আহত
কুষ্টিয়ায় ৩ হাজার গাছ কাটার সিদ্ধান্ত স্থগিত
কুষ্টিয়ায় ৩ হাজার গাছ কাটার সিদ্ধান্ত স্থগিত
ট্রাকের চাপায় অটোরিকশার ২ যাত্রী নিহত
ট্রাকের চাপায় অটোরিকশার ২ যাত্রী নিহত
শেষ দিকে বৃথা গেলো চেষ্টা, ৪ রানে হেরেছে পাকিস্তান 
শেষ দিকে বৃথা গেলো চেষ্টা, ৪ রানে হেরেছে পাকিস্তান 
সর্বশেষসর্বাধিক

লাইভ