X
শনিবার, ২০ এপ্রিল ২০২৪
৭ বৈশাখ ১৪৩১

লাল সবুজের আবেগে সোহরাওয়ার্দী উদ্যান

মোস্তফা হোসেইন
১৬ মে ২০২১, ১৫:৪৩আপডেট : ১৬ মে ২০২১, ১৫:৪৩

মোস্তফা হোসেইন রাজধানীর সবচেয়ে সুন্দর সবুজ চত্বর সোহরাওয়ার্দী উদ্যান। রাজধানীবাসী প্রায় ২ কোটি মানুষের প্রাণভরে নিশ্বাস নেওয়ার জায়গাও এটি। মানুষের স্বাভাবিক একটা আবেগ এর সঙ্গে যুক্ত। সেখানকার সবুজের সামান্যতম আঘাত এলে যেন তাদের অন্তরেই ঘা খায়। প্রকৃতিপ্রেমী মানুষের জন্য এটা অত্যন্ত স্বাভাবিক। সোহরাওয়ার্দী উদ্যানে গাছ কাটার পর সেই স্বাভাবিক আবেগই মানুষকে ক্ষুব্ধ করেছে। বিশেষ করে সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে বিরূপ প্রতিক্রিয়া সৃষ্টি হয় সঙ্গে সঙ্গে। সমালোচনা ও প্রতিবাদে নেমে আসেন অনেকে। কাটা গাছের গোড়ার ছবি নিয়ে ফেসবুকে ব্যাপক আলোড়ন তৈরি হয়েছিল সঙ্গে সঙ্গে। যারা বিরূপ প্রতিক্রিয়া প্রকাশ করেছেন তাদের প্রতিবাদ-প্রতিক্রিয়া যৌক্তিকতা পায় সাধারণ মানুষের কাছে। এমনকি মুক্তিযুদ্ধ মন্ত্রণালয় যখন একটি বিজ্ঞপ্তি প্রকাশ করে তখনও তাদের ক্ষোভ প্রশমিত হয়নি। তারপরও সোহরাওয়ার্দী উদ্যানের ঐতিহাসিক গুরুত্বের চেয়ে বর্তমান প্রাকৃতিক প্রয়োজনটাই বিবেচ্য হয়ে দাঁড়িয়েছিল।

মুক্তিযুদ্ধ মন্ত্রণালয়ের ওই বিজ্ঞপ্তিতে বলা হলো, স্বাধীনতা আন্দোলনের ইতিহাসনির্ভর স্থাপনা ও শিল্পকর্ম স্থাপনের জন্য এই গাছগুলো কাটা হচ্ছে। যতদূর মনে পড়ে, বিজ্ঞপ্তিতে হোটেল-রেস্টুরেন্টের বিষয়টি এড়িয়ে যাওয়া হয়েছে। ফলে মানুষের মধ্যে তখনও স্পষ্টতা আসেনি। কারণ, তারা রেস্টুরেন্ট নিয়ে যে প্রতিবাদী ভূমিকা নিয়েছিল সেই প্রশ্নের জবাবে অস্পষ্টতা থেকে যায় বিজ্ঞপ্তি প্রকাশের পরও।

অথচ পানি ঘোলা হওয়ার পর স্পষ্ট বক্তব্য পাওয়া গেলো সরকারের পক্ষ থেকে। সম্প্রতি গৃহায়ন ও গণপূর্ত মন্ত্রণালয়ের সচিব শহীদুল্লাহ খন্দকার বাংলা ট্রিবিউনকে জানিয়েছেন,‘আমরা ইতিহাস ও প্রকৃতির সমন্বয়ে প্রকল্পের কাজ করছি। সোহরাওয়ার্দী উদ্যানে কোনও হোটেল নির্মাণ হচ্ছে না। এখানে বাঙালি জাতির ইতিহাস সমৃদ্ধ কমপ্লেক্স নির্মিত হচ্ছে। এটি একদিকে পর্যটকদের আকৃষ্ট করবে, অপরদিকে দেশে ও দেশের বাইরের মানুষদের বাংলাদেশের ইতিহাস-ঐতিহ্য সম্পর্কে ধারণা দেবে। এটি হবে বাংলাদেশের স্বাধীনতার জীবন্ত দলিল ও বাঙালির আবেগ। পাশাপাশি শিশু পার্কও থাকছে, যা হবে আপনার এবং আমার অহংকার ও গৌরবের বিষয়।’ একইসঙ্গে জানা গেলো সবুজ চত্বরকে আরও সুন্দর করার পরিকল্পনাও রয়েছে। এই সংবাদ প্রকাশের পর স্পষ্টই মনে হচ্ছে, যথাযথ পদক্ষেপ না নেওয়ার কারণেই বিতর্কিত পরিস্থিতি সৃষ্টি হয়েছে।

এই বিতর্ক তৈরি হওয়ার পর স্বাধীনতার পক্ষের ও প্রকৃতিপ্রেমীদের সুরে সুর মিলিয়ে নেয় মুক্তিযুদ্ধবিরোধী একটি শক্তি। যারা এটাকে আসলে সুযোগ হিসেবেই গ্রহণ করে। প্রকৃতি রক্ষার কথা বলে মুক্তিযুদ্ধবিরোধী কাজটি এগিয়ে নিয়ে যেতে তারা স্বাধীনতার পক্ষের মানুষের মতামতকেই অস্ত্র হিসেবে গ্রহণ করে। মুক্তিযুদ্ধ মন্ত্রণালয় নিশ্চয়ই বিষয়টি উপলব্ধি করেছে। তাহলে প্রশ্ন আসে গাছকাটার বিরোধী প্রকৃতিপ্রেমী মানুষগুলো কি মুক্তিযুদ্ধের স্মৃতিস্থাপনার বিরোধী? এমনটা বিশ্বাস করার কোনও যুক্তি নেই। তাহলে এর পেছনে কী কারণ রয়েছে? তারা কেন এভাবে প্রতিবাদী হয়ে ওঠার সুযোগ পেলো?

গাছ কাটার পর স্বাভাবিক প্রতিক্রিয়া হবে এটা মনে হয় মুক্তিযুদ্ধ মন্ত্রণালয় আমলে আনেনি। কিংবা তারা মনে করেছে মন্ত্রণালয়ের নাম দিয়েই মানুষকে তারা চুপ করিয়ে রাখতে পারবে। এই মন্ত্রণালয়ের অতীত সমালোচনার প্রসঙ্গ না টেনেও বলা যায়, এই কাজটি করার আগে তারা জনসংযোগ করার প্রয়োজনীয়তা মোটেও অনুভব করেনি। যদি গাছ কাটার আগে মুক্তিযুদ্ধের স্মৃতিস্থাপনার প্রসঙ্গ এবং সেই কাজের জন্য কিছু গাছ কাটার প্রয়োজনের কথা মানুষকে জানাতো, বোধ করি আজকের বিরূপ প্রতিক্রিয়ার মুখে পড়তে হতো না তাদের। শুনেছি শিগগিরই বিশিষ্টজনদের নিয়ে সরকারের পক্ষে আলোচনার উদ্যোগ গ্রহণ করা হয়েছে। এই উদ্যোগটি সরকারের আগেই নেওয়া উচিত ছিল। বাংলাদেশে বিশেষ করে ইট-পাথরের ঢাকায় সবুজ গাছ কাটার যে বিরূপ প্রতিক্রিয়া হয় এটা সবাই জানে। সরকার গাছ কাটার আগেই প্রতীকী হলেও বৃক্ষরোপণ কর্মসূচি গ্রহণ করতে পারতো। সেখানেই ঘোষণা হতে পারতো বিশেষ প্রয়োজনে সোহরাওয়ার্দী উদ্যানে কিছু গাছ কাটতে হবে। কিন্তু সবুজ নষ্ট না করার প্রয়োজনে আগেই গাছ লাগানো কর্মসূচি বাস্তবায়ন শুরু হলো। এমনটা হলে আজকে এই অনাকাঙ্ক্ষিত পরিস্থিতি সৃষ্টি হতো না।

সাধারণ মানুষ সতেজ প্রকৃতি যেমন চায় তেমনি মুক্তিযুদ্ধের ইতিহাসকে শৈল্পিকভিত্তিতে আগামী প্রজন্মের সামনে তুলে ধরারও পক্ষে। আর এটা তো স্বীকার করতেই হবে, এই ঘোড়দৌড়ের মাঠটির নামকরণের মধ্য দিয়েই স্বাধীনতা আন্দোলন ও মুক্তিযুদ্ধের সঙ্গে এর সংশ্লিষ্টতা তৈরি হয়েছিল স্বয়ং জাতির জনকের হাত ধরে। ঠিক যেমনি বিশাল ঘাসভূমিতে বৃক্ষরোপণের কাজটিও শুরু করেন বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান নিজ হাত দিয়ে। সুতরাং বলতেই হবে এই জায়গাটি স্বাধীনতা ও প্রকৃতির সম্মিলনস্থলও বটে। সেক্ষেত্রে সবুজকে বাদ দিয়ে যেমন সোহরাওয়ার্দী উদ্যানের কথা ভাবা যায় না, তেমনি মুক্তিযুদ্ধের ইতিহাসের সঙ্গে এর সংশ্লিষ্টতার বিষয়টিও বাদ দেওয়া যায় না। বিশ্বাস করি দুটি দিককে ঠিক রেখে কিছু গাছ কাটা হলে কারও আপত্তি থাকার কথা নয়।

যারা গাছ কাটার বিরোধিতা করেন তাদের প্রত্যেকেই জানেন, বাংলাদেশের স্বাধীনতা আন্দোলনের সূচনা হয়েছিল এই রেসকোর্সে ১৯৪৮ সালের ২১ মার্চ পাকিস্তানের জাতির পিতা মোহাম্মদ আলী জিন্নাহর একমাত্র উর্দুই হবে পাকিস্তানের রাষ্ট্রভাষা দম্ভোক্তির প্রতিবাদের মাধ্যমে। আবার পাকিস্তানিদের বিদায়ঘণ্টাও বেজেছিল ১৯৭১ সালের ১৬ ডিসেম্বর তাদের আত্মসমর্পণের মধ্য দিয়ে। মাঝখানে ৭ মার্চের ঐতিহাসিক ভাষণসহ অসংখ্য ইতিহাসগৃহ এই সোহরাওয়ার্দী উদ্যান। সুতরাং সোহরাওয়ার্দী উদ্যানে স্বাধীনতা স্তম্ভ প্রকল্প বাস্তবায়নে কারও প্রতিবাদ করার কিছু থাকতে পারে, এমনটা মনে করা যায় না।

গাছ কাটার বিরোধীরা বলছেন, গাছগুলো রেখে কি পরিকল্পনা বাস্তবায়ন করা যেতো না? তাদের বক্তব্য থেকে যতটা বুঝি, তারা সবাই মুক্তিযুদ্ধের স্মৃতিস্থাপনাকে অগুরুত্বপূর্ণ ভাবছেন না। অর্থাৎ পুরো বিতর্কিত পরিস্থিতির জন্য সরকারি নির্দিষ্ট প্রতিষ্ঠানের অসতর্কতা ও অসচেতনতাই মূলত দায়ী।

এখন একটি বিরোধী শ্রেণি তৈরি হয়ে গেছে। তাদের অনেকেই ইতিবাচক চিন্তা করবেন। ক্ষুদ্র একটি অংশ কিন্তু এরপরও বিরোধী ভূমিকায় বহাল থাকবে। এই ক্ষুদ্র অংশটি যাতে সৎ উদ্দেশ্য বাস্তবায়নে প্রতিবন্ধক হয়ে না দাঁড়ায় সেদিকটি খেয়াল রাখতে হবে। সবশেষ কথা, আমরা সবুজেই আমাদের ঐতিহ্যকে দেখতে চাই। আমাদের ত্যাগ ও সংগ্রাম তো এই সবুজের জন্যই। আর এই সবুজকে প্রতিষ্ঠার জন্য রক্তলাল একটা মুক্তিযুদ্ধ করতে হয়েছে আমাদের, তাকে কি অবহেলা করার উপায় আছে?

লেখক: সাংবাদিক, শিশুসাহিত্যিক ও মুক্তিযুদ্ধ বিষয়ক গবেষক।

/এসএএস/এমওএফ/

*** প্রকাশিত মতামত লেখকের একান্তই নিজস্ব।

বাংলা ট্রিবিউনের সর্বশেষ
রুশ বিদ্যুৎকেন্দ্রে ইউক্রেনের হামলা, ৫০টি ড্রোন ভূপাতিতের দাবি মস্কোর
রুশ বিদ্যুৎকেন্দ্রে ইউক্রেনের হামলা, ৫০টি ড্রোন ভূপাতিতের দাবি মস্কোর
বিয়েবাড়ির খাসির মাংস খেয়ে ১৬ জন হাসপাতালে
বিয়েবাড়ির খাসির মাংস খেয়ে ১৬ জন হাসপাতালে
সরকারি প্রতিষ্ঠানে একাধিক পদে চাকরি
সরকারি প্রতিষ্ঠানে একাধিক পদে চাকরি
এখনই হচ্ছে না হকির শিরোপা নিষ্পত্তি, তাহলে কবে?
এখনই হচ্ছে না হকির শিরোপা নিষ্পত্তি, তাহলে কবে?
সর্বশেষসর্বাধিক

লাইভ