X
শুক্রবার, ১৯ এপ্রিল ২০২৪
৬ বৈশাখ ১৪৩১

আওয়ামী ‘দোকান’ 

রুমিন ফারহানা
০৫ জুন ২০২১, ১৬:১৫আপডেট : ০৫ জুন ২০২১, ১৭:১০

রুমিন ফারহানা কথা হচ্ছিল একজন নিয়মিত কলামিস্টের সাথে। আমিও লিখি, উনিও লেখেন, তাই এক ধরনের ভ্রাতৃত্ববোধ তো আছেই। পার্থক্য হলো উনি জান-প্রাণ লড়িয়ে সরকার, সরকারি দল এবং এর নেতা-নেত্রীদের যে কোনও কিছু চোখ বুঁজে সমর্থন করেন, তার পক্ষে কলম ধরেন। একদিন আলাপ চলাকালে বেশ উত্তেজিত হয়ে তাকে প্রশ্ন করলাম, ‘আপনার লজ্জা করে না? কীসের আশায় এত তেল দেন?’ উনি আবার ঠাণ্ডা মানুষ, সহজে উত্তেজিত হন না। হেসে বললেন, ‘আপামনি, দালালির কোটাও পূর্ণ হয়ে গেছে। এত চেষ্টা করেও আমি ওখানে জায়গা পাচ্ছি না। ভীষণ ভিড়।’ এমন মানুষের সাথে রাগ রাখা যায় না, হেসে ফেললাম আমি। উনি যেটা বললেন সেটাই হলো বাস্তবতা।

কিছুদিন আগে আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক ওবায়দুল কাদের বলেছেন, ‘বিদেশের মাটিতে কেউ যেন তাঁতী লীগের দোকান খুলতে না পারে, সেদিকে সতর্ক থাকতে হবে।’ প্রতিটি বড় দলেরই বেশ কিছু সহযোগী ও ভ্রাতৃপ্রতিম সংগঠন থাকে। তারা প্রত্যেকেই যার যার প্ল্যাটফর্ম থেকে মূল দলের আদর্শ ও বিশ্বাস ধারণ করে কাজ করে যায়। একটা দলের জন্মলগ্নের প্রায় কাছাকাছি সময় থেকেই যুবক, ছাত্র, নারী,কৃষক, শ্রমিক ইত্যাদি নামে সহযোগী ও ভ্রাতৃপ্রতিম সংগঠনগুলো তাদের কাজ করে। মূল দলের নীতি-আদর্শের সাথে সঙ্গতি রেখে কেন্দ্র থেকে তৃণমূল পর্যন্ত এই সংগঠনগুলোর শাখা এবং ইউনিট থাকে এবং তারা যার যার মতো সহযোগী সংগঠনের পদ-পদবি নিয়ে কাজ করে যায়। এটাই ছিল দীর্ঘ দিনের সাধারণ চর্চা। 

প্রতিটি সহযোগী সংগঠনেরই নিজের নামের সঙ্গে সঙ্গতি রেখে নীতি-আদর্শ নির্ধারিত হয় এবং কর্মসূচিও সেই আলোকেই প্রণীত হয়। দল ক্ষমতায় গেলে এই সকল সংগঠনের নেতা-কর্মীরা যার যার অঙ্গনে বেশ খানিকটা দাপট নিয়ে চলে। বাংলাদেশের প্রেক্ষাপটে চাকরি, ব্যবসা থেকে শুরু করে নানা ক্ষেত্রে তারা দলীয় পরিচয়ের কারণে একটু বিশেষ সুবিধা পেয়ে থাকে। আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক যখন একটি সহযোগী সংগঠনের সাথে ‘বিদেশ’ এবং বিশেষ করে ‘দোকান’ শব্দটি যোগ করেন তখন তো সে বিষয়ে কিছু প্রশ্ন থেকেই যায়।   

বাংলাদেশের রাজনৈতিক সংস্কৃতি এমন, যেখানে একটি সুষ্ঠু এবং গ্রহণযোগ্য নির্বাচনের মধ্য দিয়ে কোনও দল যদি ৫ বছরের জন্য রাষ্ট্র ক্ষমতায় আসে তারপরও সেই দলের কর্মী-সমর্থকদের মধ্যে ৫ বছর ধরে এক ধরনের ‘উজানি ভাব’ লক্ষ্য করা যায়। নেতা-কর্মীদের ভেতর চাঙ্গা ভাব আসে, ক্ষমতার দাপটে বয়স কমে যায়, চালচলনে জমিদারি ভাব আসে, এমনকি দলের সুনজরে থাকলে বহু মানুষের গায়ের রঙ থেকে শুরু করে চেহারা পর্যন্ত বদলে যায়। কথাগুলো বলছি একটি নির্বাচিত সরকার সম্পর্কে যাদের জবাবদিহিতা নামক ‘বালাই’ আছে। আর সরকারটির সাথে যদি জবাবদিহিতার কোনও সম্পর্ক না থাকে এবং মেয়াদের পর মেয়াদ ক্ষমতায় থাকতে থাকে তখন নেতা-কর্মীদের চেহারা কী দাঁড়ায়, ভাবলে শিউরে উঠতে হয়।  

একটি বড় দলের কর্মী হওয়ার সুবাদে জানি দলগুলোতে স্বীকৃত সহযোগী এবং ভ্রাতৃপ্রতিম সংগঠনের সংখ্যা আট থেকে দশটির বেশি নয়। আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদকের বক্তব্যে দেওয়া ‘দোকান’ প্রসঙ্গে মনে পড়লো সাড়ে পাঁচ বছর আগে ২০১৬ সালের জানুয়ারিতে বাংলা ট্রিবিউনে একটি রিপোর্ট প্রকাশিত হয়েছিল ‘আওয়ামী লীগে ‘লীগের’ ছড়াছড়ি!’ শিরোনামে। রিপোর্টটি বেশ খাটা-খাটনি করে তৈরি করা সন্দেহ নেই। ১০০ টি এ ধরনের ভুঁইফোঁড় আছে দাবি করে রিপোর্টটিতে নির্দিষ্টভাবে ৬১ টি এ রকম সংগঠনের নাম তুলেই দেওয়া হয়। এসব সংগঠনের বেশিরভাগ নামের সাথে আওয়ামী লীগ, বঙ্গবন্ধু, বঙ্গমাতা, শেখ হাসিনা, শেখ রাসেলসহ শেখ পরিবারের নানা সদস্যের নাম যেমন ব্যবহার করা হয়েছে তেমনি মুক্তিযুদ্ধ, স্বাধীনতা, মুক্তিযোদ্ধা, একাত্তর ইত্যাদি শব্দের ব্যবহারও ব্যাপকভাবে লক্ষ্য করা গেছে। এই ৬১ টি নামের মধ্যে কিছু নাম সত্যিই চমকপ্রদ, এখনও মাথায় গেঁথে আছে। যেমন ধরুন - আওয়ামী নৌকার মাঝি শ্রমিক লীগ, আওয়ামী ক্ষুদ্র মৎস্যজীবী লীগ, ছিন্নমূল মৎস্যজীবী লীগ, বঙ্গবন্ধুর আর্দশ ও চেতনা গবেষণা পরিষদ, বঙ্গবন্ধু লেখক লীগ, বঙ্গবন্ধু বাস্তুহারা লীগ, বঙ্গবন্ধুর চিন্তাধারা বাস্তবায়ন পরিষদ, দেশীয় চিকিৎসক লীগ, নৌকার নতুন প্রজন্ম, ডিজিটাল ছাত্রলীগ, ডিজিটাল আওয়ামী প্রজন্ম লীগ, ডিজিটাল আওয়ামী ওলামা লীগ, বাংলাদেশ আওয়ামী পর্যটন লীগ, তৃণমূল লীগ।  

‘দোকান’ খোলা হয়েছে শিশুদের নামেও। এই রিপোর্ট থেকে জেনেছি তাদের লোগো সম্পর্কে - অর্ধসূর্যের আলোর বিকিরণের ওপর একটি ফিডার এবং শিশুদের খেলনা জাতীয় কিছু ছবি। এরপর লেখা ‘বাংলাদেশ শিশু-কিশোর লীগ’। 

আগেই বলেছি রিপোর্টটি প্রকাশিত হয়েছিল ২০১৬ সালে। প্রায় ছয় বছর আগে যদি দোকানের সংখ্যা এবং আকারের এই অবস্থা হয়ে থাকে তা হলে এখন কী হতে পারে বুঝার জন্য সাধারণ কাণ্ডজ্ঞানই যথেষ্ট। এখন প্রশ্ন হলো, মানুষ কেন খোলে এই ‘দোকান’? লোগো বানিয়ে, ব্যানার-ফেস্টুন তৈরি করে, আওয়ামী লীগের নেতা-মন্ত্রীকে অতিথি বানিয়ে বিভিন্ন দিবসভিত্তিক লোক জড়ো করার এই নিরন্তর প্রয়াসের কারণটা কী? 

রিপোর্ট বলছে ২০০৯ সাল থেকে গড়ে ওঠা এসব সংগঠনের কাজই হচ্ছে নানা রকম তদবির। কেউ-কেউ সুবিধা পেলে টেন্ডারবাজি ও চাঁদাবাজিও করছেন সংগঠনের নাম ব্যবহার করে। আওয়ামী লীগও স্বীকার করে এসব নাম সর্বস্ব সংগঠনের জন্ম আওয়ামী লীগ ক্ষমতায় আসার পরেই। আওয়ামী লীগের সর্বোচ্চ পর্যায়ের নেতা-মন্ত্রীরা এসব ‘দোকানে’ যান এবং সেটা করে এদের স্বীকৃতি দেন। 

‘দোকান’গুলোর মধ্যে স্বার্থের সংঘাত এতটাই যে এক ‘দোকান’ অন্য ‘দোকানে’র সাথে সংঘাতে তো জড়ায়ই, একই নামের ‘দোকান’ দেওয়া নিয়ে কাদা ছোঁড়াছুঁড়ি এমনকি মারামারি পর্যন্ত হয়। ওলামা লীগ কার? এই প্রশ্নে দুইটি ওলামা লীগের দুইটি পক্ষের দীর্ঘদিনের বাকযুদ্ধ পরে ‘মল্লযুদ্ধে’ পরিণত হয়েছিল ঢাকার রাস্তায়। সেই ছবি এখনও ঘুরে বেড়ায় অন্তরর্জালে।  

আরেক ‘দোকান’ ‘প্রজন্ম লীগের’ নামেই রয়েছে অন্তত সাতটি সংগঠন। এই সাতটি সংগঠনের চারটি আবার ‘বাংলাদেশ আওয়ামী মুক্তিযোদ্ধা প্রজন্ম লীগ’ নামে বিভিন্ন কর্মসূচি পালন করে। এছাড়াও বাংলাদেশ আওয়ামী প্রজন্ম লীগ, বাংলাদেশ মুক্তিযোদ্ধা প্রজন্ম লীগ ও বাংলাদেশ আওয়ামী মুক্তিযুদ্ধ প্রজন্ম লীগ নামে তিনটি সংগঠন সক্রিয় রাজধানীতে। এদের প্রত্যেকটির নেতারা তাদের নিজেদের ‘সহি’ দাবি করে অন্যদের বিরুদ্ধে নানা অভিযোগ করেন। নিজেরা ছাড়া বাকিদের কেউ নাকি চাঁদাবাজি করে, কেউ টেন্ডারবাজি করে, আবার কেউ নাকি মুফতি হান্নানের খালাতো ভাই।   

ওবায়দুল কাদের খুব সঠিকভাবে ‘দোকান’ শব্দটি ব্যবহার করেছিলেন। প্রতিটি ‘দোকান’ তৈরি, লালন-পালন, শ্রীবৃদ্ধি, এমনকি পারষ্পরিক ‘মল্লযুদ্ধে’র মূল কারণ ছিল ব্যবসা। বিষয়টি এখন আর এত সহজ নেই। বাংলাদেশকে গত এক যুগে এত গভীরভাবে বিভাজিত করা হয়েছে, যে এখন এই দেশে ‘হয় তুমি আমার বন্ধু না হলে আমার শত্রু’ এর মাঝামাঝি আর কিছু নেই। নিজের অস্তিত্ব টিকিয়ে রাখতেই তাই এখন সবাইকে যার যার মাপ মতো কোনও না কোনোভাবে সরকারি দলের সাথে যুক্ত দেখাতে হয়। 

লেখক: আইনজীবী, সুপ্রিম কোর্ট। সংরক্ষিত আসনে সংসদ সদস্য ও বিএনপি দলীয় হুইপ

 

/এসএএস/

*** প্রকাশিত মতামত লেখকের একান্তই নিজস্ব।

বাংলা ট্রিবিউনের সর্বশেষ
শেষ ম্যাচে জিতে সুপার লিগে গাজী গ্রুপ
শেষ ম্যাচে জিতে সুপার লিগে গাজী গ্রুপ
কারাগার এখন বিএনপি নেতাকর্মীদের স্থায়ী ঠিকানা: রিজভী
কারাগার এখন বিএনপি নেতাকর্মীদের স্থায়ী ঠিকানা: রিজভী
তিন নম্বরে থেকে সুপার লিগে মোহামেডান
তিন নম্বরে থেকে সুপার লিগে মোহামেডান
মুখ থুবড়ে পড়েছে ইউক্রেনের অস্ত্র খাত
মুখ থুবড়ে পড়েছে ইউক্রেনের অস্ত্র খাত
সর্বশেষসর্বাধিক

লাইভ