X
শনিবার, ২০ এপ্রিল ২০২৪
৭ বৈশাখ ১৪৩১

বাবা’রা এমন কেন হয়!

উমর ফারুক
২০ জুন ২০২১, ১০:৫৯আপডেট : ২০ জুন ২০২১, ১৭:০৮

উমর ফারুক বাবাদের কিছু থাকে না। গায়ে নতুন জামা থাকে না। পায়ে দামি জুতো থাকে না। পুরনো জামা, ছেঁড়া জুতোয় কেটে যায় তাদের উৎসব। বাবাদের মোটা টাকা থাকে না, মোটা হৃদয় থাকে। বাবাদের গায়ে দামি আতরের ঘ্রাণ থাকে না, ঘামের গন্ধ থাকে। বাবাদের গলায় দামি ফুলের মালা থাকে না, ঘাড়ে পরিশ্রমের চিহ্ন থাকে। বাবাদের চোখে দামি সুরমা থাকে না, ঘুমহীন ক্লান্তির দাগ থাকে। সন্তানের চিন্তায় শ্বাস ঘন হতে থাকে, বুক ধক-ধক করতে থাকে, উচ্চ রক্তচাপ বাড়তে থাকে।

বাবারা এমন কেন? সন্তানের নতুন জামার টাকা থাকে, জুতোর টাকা থাকে, দামি আতরের টাকা থাকে, শুধু নিজের জন্য কিছু থাকে না? বাবারা এমন ‘পচা’ কেন!

পৃথিবীর সব বাবা তাঁর সন্তানের কাছে বিস্ময়। আমাদের বাবারা সব জানে! ঘোড়া হয়ে খেলতে জানে। ঘাড়ে করে ঘুরতে জানে। কোলে করে ঘুম পাড়াতে জানে। সব প্রশ্নের উত্তর জানে। থার্মোমিটার কবে আবিষ্কার হয়েছে সেটা জানে। মহাকাশের কোন তারা কবে জন্মেছে, কবে খসে যাবে সেটাও জানে। কচুর পাতায় পানি কেন টলমল করে সেটা জানে। সন্তানকে পড়াতে জানে। সন্তানকে পড়তে জানে। গল্প করতে জানে। গল্প শুনতে জানে। আদর করতে জানে। শাসনও করতে জানে। আমাদের বাবারা সব জানে, সব। অসুখ হলে রাত জেগে সেবা করতে জানে। বড় বড় স্বপ্ন দেখাতে জানে। বুকে প্রচণ্ড ব্যথা নিয়ে ‘হো হো’ করে হাসতে জানে। একরাশ সংকটে ‘কিচ্ছু হয়নি’ বলে সাহসের আলো জ্বালাতে জানে। ভেজা চোখ লুকিয়ে শক্ত করে বুকে জাপটে ধরতে জানে। বাবারা সব জানে, সব। পড়ে গেলে টেনে তুলতে জানে। আঘাত পেলে মালিশ করতে জানে। ভয় পেলে সাহস দিতে জানে। খারাপ সময়ে বন্ধু হতে জানে। এজন্যই বাবা পৃথিবীর সবচেয়ে বড় বিস্ময়!

বাবারা মিথ্যে বলে। বড্ড বেশি মিথ্যে বলে। ‘আমার খিদে নেই’ কিংবা ‘খেতে ইচ্ছে হচ্ছে না’ বলে -প্রিয় খাবারটা সন্তানের মুখে তুলে দেয়। খুব খারাপ সময়ে মিথ্যে করে বলে, ‘এই তো বাবা সব ঠিক হয়ে যাবে। সূর্য উঠবে আরেকটু পর। কেটে যাবে সব আঁধার।’ একটু সচ্ছলতার জন্য বাড়তি পরিশ্রম করে বলে, ‘কাজটা করতে আমার খুব ভালো লাগে।’ বাবারা এমন কেন? কেন বারবার মিথ্যে বলে?

পৃথিবীর সব বাবার গল্পটা একরকম। আপনার, আমার, সব বাবার গল্প মোটাদাগে একই সুতো, একই ছাঁচে গড়া। আমার বাবা প্রথমবার আমাকে দেখে কেঁদেছিলেন। আমার ভালো খবরে চোখ ভিজে গিয়েছিল। খুব কষ্ট হলে তিনি আমার বুকের ঘ্রাণ নিতেন। তিনি আমাকে উঁচুতে উঠতে শিখিয়েছিলেন। আকাশে উড়তে শিখিয়েছিলেন। সাঁতার কাটতে শিখিয়েছিলেন। সাইকেল চালাতে শিখিয়েছিলেন। হাঁটতে শিখিয়েছিলেন। পোশাক পরতে শিখিয়েছিলেন। মুখে প্রথম ভাত তুলে দিয়েছিলেন। প্রচণ্ড ঝড়ো বাতাসে, প্রবল বর্ষণেও চট করে আমার ইচ্ছে পূরণ করেছিলেন। বর্ণমালা শিখিয়েছিলেন। বাবারা আমাদের সব কৌতূহল ও প্রশ্নের উত্তর দেন। কথাগুলো আনন্দময় ও সাধারণ। আমার জন্য, আপনার জন্য, আমাদের সবার জন্য গল্পগুলো এক ও অনন্য। কোনও ব্যতিক্রম নেই।

আমাদের জন্ম হয় মাতৃগর্ভে। আমাদের জন্ম হয় পিতৃহৃদয়ে। মাতৃগর্ভ ছিঁড়ে, পিতৃহৃদপিণ্ড ছিঁড়ে আমরা বেরিয়ে আসি। আলোর মুখ দেখি, আকাশ দেখি। তবু প্রতিদিন পৃথিবীতে বাড়ছে বৃদ্ধাশ্রম। সেখানে বাবারাই থাকছে। তিনি হয়তো আমার বাবা, নয়তো আপনার। বৃদ্ধাশ্রমের বাবাও তার সন্তানকে হৃদয়ে ধারণ করেছিলেন। কেন একসময় সেই বাবাও নিজের ঘাম বেচে সন্তানের জন্য ঘ্রাণ কিনেছিলেন। সেই বাবাও পকেটের শেষ টাকা দিয়ে সন্তানকে চকোলেট অথবা রুটি কিনে দিয়েছিলেন। সেই বাবাও তার সন্তানকে ঘুড়ি ওড়ানো শিখিয়েছিলেন। পায়ে ভর দিয়ে প্রথমবার চলতে শিখিয়েছিলেন। সেই বাবাও ছিল তার সন্তানের প্রথম বিস্ময়! এখন প্রশ্ন হলো, তাহলে কেন প্রতিদিন বৃদ্ধাশ্রম বাড়ছে? কেন সেখানে কারও না কারও বাবা থাকছেন? কে দায়ী? পরিবার, সমাজ, নাকি রাষ্ট্র? আমাদের মূল্যবোধ, আমাদের নৈতিকতার অবক্ষয়ের কারণ কী? আমাদের কোন শিক্ষা স্বার্থপর-ব্যক্তিচিন্তা নির্ভর পারিবারিক কাঠামো গড়ে তুলতে ভূমিকা রাখছে?

বাবারা একটু বোকা হন। একটু বেশি বোকা হন। নিজের সবটা বিলীন করে সন্তানের জীবন বিনির্মাণ করেন। বুকে আগলে সন্তানকে নিরাপদ রাখেন। বাবা হওয়ার জন্য কোনও প্রশিক্ষণ প্রয়োজন নেই। বাবাকে দেখেই আমরা বাবা হতে শিখি। দায়িত্বশীল হতে শিখি। ভালোবাসতে শিখি। প্রচণ্ড স্রোতে শক্ত করে হাত ধরতে শিখি, হাল ধরতে শিখি। বাবা হওয়া কঠিন। সত্যিকারের বাবা হওয়া কঠিন। হৃদগভীরে কঠিন সাধনা ও ব্রতই পারে আমাদের সত্যিকারের বাবা বানাতে। তিল তিল করে একটি স্বপ্নকে বড় করার নামই পিতৃত্ব। প্রাগৈতিহাসিক সময় থেকে পিতৃত্ব একটি রহস্য, একটি বিস্ময়। আজও যে রহস্যের খোলস উন্মোচিত হয়নি। শত-সহস্র বছর ধরে একটি বিস্ময়কর প্রশ্ন পৃথিবীতে ঘুরে বেড়াচ্ছে, বাবারা এমন কেন?

আমার বাবা আমার এক পৃথিবী বিস্ময়! আমার প্রথম নায়ক, আমার আজীবনের অহংকার। আজ সবচেয়ে কঠিন কাজ বাবার মতো হয়ে ওঠা। বাবা একদিনের নয়, প্রতিদিনের, তাই প্রতিদিন স্বপ্ন দেখি বাবার স্বপ্নে সমান বড় হবো, আর চিৎকার করে বলবো, খুব ভালোবাসি বাবা তোমাকে।

লেখক: শিক্ষক, অ্যাকাউন্টিং অ্যান্ড ইনফরমেশন সিস্টেমস বিভাগ, বেগম রোকেয়া বিশ্ববিদ্যালয়, রংপুর।

[email protected]

 

 

/এসএএস/এমওএফ/

*** প্রকাশিত মতামত লেখকের একান্তই নিজস্ব।

বাংলা ট্রিবিউনের সর্বশেষ
মতিঝিলে ফুটপাত থেকে বৃদ্ধের মরদেহ উদ্ধার
মতিঝিলে ফুটপাত থেকে বৃদ্ধের মরদেহ উদ্ধার
খেলাধুলার মধ্য দিয়ে আমরা দেশকে এগিয়ে নিয়ে যেতে পারি: প্রধানমন্ত্রী
খেলাধুলার মধ্য দিয়ে আমরা দেশকে এগিয়ে নিয়ে যেতে পারি: প্রধানমন্ত্রী
মননের প্রথম আইএম নর্ম, হাতছানি জিএম নর্মের
মননের প্রথম আইএম নর্ম, হাতছানি জিএম নর্মের
যুক্তরাষ্ট্রের সঙ্গে সম্পর্ক পুনর্বিবেচনার হুমকি আব্বাসের
যুক্তরাষ্ট্রের সঙ্গে সম্পর্ক পুনর্বিবেচনার হুমকি আব্বাসের
সর্বশেষসর্বাধিক

লাইভ