X
শনিবার, ২০ এপ্রিল ২০২৪
৭ বৈশাখ ১৪৩১

করোনার করুণ কাহিনি: মৃত্যু চেতনা ও সর্বজনীন বাস্তবতা

মাকসুদুল হক
০৮ আগস্ট ২০২১, ১৪:২৭আপডেট : ০৮ আগস্ট ২০২১, ১৮:১৯

মাকসুদুল হক ‘হায়রে মানুষ, রঙিন ফানুস
দম ফুরাইলে ঠুস!
তবু তো ভাই কারোরই নাই একটুখানি হুঁশ।’

কথা  : সৈয়দ শামসুল হক,
সুর   : আলম খান
শিল্পী: এন্ড্রু কিশোর

১. মহামারির মৃত্যু ও আমরা: আর কত সহ্য করা যায়?

মানুষজন চতুর্দিকে মারা যাচ্ছে। এমন কোনও পরিবার বাংলাদেশে এই মুহূর্তে নেই, যাদের কোনও সদস্য বা নিকটাত্মীয় এই মহামারিতে প্রাণ হারাননি। এ বছর ডেল্টা ভ্যারিয়েন্ট সংক্রমণ কাউকে রেহাই দিচ্ছে না।

মৃত্যুর মিছিল দেখে সবারই মাঝে অব্যক্ত ভয়, আতঙ্ক ও ক্ষোভ প্রকট আকার ধারণ করছে। আগামীকাল কার মৃত্যুর খবর শুনবো– এই চিন্তা নিয়ে সবাই রাতে ঘুমাতে যাই। সকালে উঠেই সেই একই মৃত্যুর ধারাবাহিকতা।

১৬ মাস ইতোমধ্যে পার হয়ে গেলো। আর কত সহ্য করা যায়?

এত কিছু আমাদের আশেপাশে ঘটছে অথচ আমরা বেমালুম ভুলে গিয়েছি জীবন কেবল দুর্ঘটনা তবে মৃত্যু শাশ্বত বাস্তবতা। এ সরল কথাটা আমরা সবাই জানি, বিশ্বাস করি– তথাপি সহজে কেউ মেনে নিতে চাই না।

জীবনের যে বৈচিত্র্যতা, সৃষ্টির ছড়াছড়ি তা দেখেই মানুষ স্রষ্টার ওপরে অগাধ বিশ্বাস স্থাপন করে। সেই বিশ্বাসের ওপরে ভর করে তার জীবনের চালিকাশক্তিকে নির্ণয় করে।

জীবন বিচিত্র হলেও মানব মনের হাজারো প্রশ্নের উত্তর দিলেও– যে প্রশ্নের উত্তর দিতে ব্যর্থ তা হলো– মৃত্যুর পর আমাদের এই ‘আমি’র কী হবে?

কোথায় সে চলে যায় এবং ওই ‘না ফেরার দেশ’টাই বা কেমন? সেখানে এই যে আমাদের চলমান জীবন তার চেয়ে সবকিছুর এমন কিই বা পার্থক্য?

মৃত্যু নিয়ে আমার আজীবন কৌতূহল। বহু লেখা, কবিতা ও গানে মৃত্যু চেতনা বারবার ঘুরেফিরে এসেছে। তবে বিষাদগ্রস্ততা বা মরবিডিটিতে আমি কখনও যে ভুগেছি বা ভুগছি– তেমন কোনও বিষয় না।

জীবনে অনেক মৃত্যু দেখার অভিজ্ঞতাই কেবল হয়নি, মৃত্যুর খুব কাছাকাছি জীবনে বেশ কয়েকবার যাওয়াও হয়েছে। মৃত্যু আমাকে সব সময় ভাবিয়েছে। এই ভাবনার জগতকে কখনই আমি দুঃখে বা আনন্দে গণনা করিনি। মৃত্যুর বাস্তবতা আমাকে সব সময় আকৃষ্ট করেছেও মনে, অন্তরাত্মায় একধরনের অবর্ণনীয় প্রশান্তি দিয়ে ধন্য করেছে।

জীবন-মৃত্যুর সন্ধিক্ষণ সেই ১৯৭১-এর ভয়াল দিনগুলো থেকে শুরু করে এই চলমান মহামারি অবধি প্রত্যক্ষ করেছি ও মাতাপিতাসহ বহু কাছের আত্মীয়স্বজন ও বন্ধুবান্ধবের দেহ কবরে সমাহিত করেছি।

অনেক আত্মীয় ও বন্ধুকুলে শেকায়েত করেন যে আমার এই বাস্তব অভিজ্ঞতার ফলে মৃত্যুর বিষয়ে আমি খুবই ‘ডিসেন্সিটাইজড’- আমার সুবেদিতা হ্রাস পেয়েছে। কিন্তু মৃত্যুকে আমি কখনও অপ্রাকৃতিক কিংবা অতিপ্রাকৃত, অস্বাভাবিক কোনও ‘বিস্ময়কর’ বিষয় মনে করিনি, করি না।

মৃত্যু আমাদের নিজেদের বা অন্যের জীবন যেকোনও মুহূর্তে কেড়ে নিতে পারে ও তার জন্য প্রয়োজন ব্যাপক মানসিক প্রস্তুতি– তা কারও পছন্দ হোক আর নাই হোক।  এই ‘প্রস্তুতির’ বিষয়ে আমি জোর দিয়েছি সবচেয়ে বেশি।

২. মৃত্যুর কার্যকর প্রস্তুতি ও আশার দুরাশা:

বেঁচে থাকার এতটা তীব্র আকাঙ্ক্ষার মাঝে– আমরা ক’জনই বা মৃত্যুর মতো ‘কুৎসিত’ জিনিসের জন্য প্রস্তুতি নেবো? 

কী দরকার যখন কোনও ধরনের রোগে ভুগছি না। যখন জীবনের সব হিসাবই বলছে মৃত্যু থেকে আমরা ‘অনেক অনেক দূরে আছি’?

মৃত্যুর বিপক্ষে যত না যুক্তি আমরা দাঁড় করাই, বাস্তব হলো মৃত্যু নিজে কোনও যুক্তির ধার ধারে না।

সব ধর্মগ্রন্থ বলছে ‘প্রতিটি আত্মাকে মৃত্যুর স্বাদ গ্রহণ করতে হবে’– অথচ জীবনে কেবল বেঁচে থাকার তাগিদে আমরা শত রকম বস্তুর স্বাদ গ্রহণ করলেও মৃত্যুর স্বাদ আদৌ কী? বেঁচে থাকতে তা গ্রহণ করার কৌশল কী– তা কে আমাদের শেখাবে?

জীবন নির্বাপণ হওয়ার মধ্য দিয়েই কি মৃত্যু?

মোটেও না। মৃত্যু কোনও ‘শেষ গন্তব্য’ না বরং এক পরিবৃত্তি —এক রূপান্তর যখন  এই অতি ক্ষুদ্র শুঁয়াপোকা দেহ থেকে প্রজাপতির মতো অনন্তকাল স্থায়ী আত্মাকে প্রকটিত করা হয় - মুক্ত করা হয় সর্বসময় ও সর্বকালের জন্য।

শুনতে ও পড়তে খুব ভালো লাগছে নিশ্চয়ই?

মৃত্যু নিয়ে এসব প্রচণ্ড ‘দার্শনিক’ বক্তব্য কখনই খুব একটা জনপ্রিয়তা না পেলেও এ দর্শনগুলোকে আমরা ফেলেও দিতে পারি না। কিছু হোক আর নাই হোক—এসব চিন্তা আমাদের ‘ফিল গুড আশাবাদী’ করে রাখে– আর পৃথিবীর কোন মানুষটাই বা আশা নিয়ে বেঁচে থাকতে চায় না?

মৃত্যুর ব্যাপারেও মানুষ আশার আলো জ্বালাতে অভ্যস্ত কারণ আশাই তার ভরসা। মৃত্যুর পরেও সে আশা নিয়ে বেঁচে থাকতে চায় এবং মৃত্যু সংক্রান্ত এসব প্রাচীনতম তত্ত্ব চ্যালেঞ্জ করার কোনও পথ কি আমাদের জানা আছে?

মৃত্যু সংক্রান্ত সারাটা জীবন যে কথাগুলো জেনে এসেছি তা কি সত্য নাকি মিথ্যা - সেরকমটা নির্ণয় করার কোনও পথ, বিজ্ঞান বা অন্য কোনও শাস্ত্র আমাদের এ অবধি কি দিতে পেরেছে?

৩. মৃত্যু ধারণা ও সময়ের সময়: ২৪/০৭/৩৬৫ তদতিরিক্ত

আমরা কি মরিয়া প্রমাণ করিবো আমরা বাঁচিয়া ছিলাম? নাকি বাঁচিয়া প্রমাণ করিবো আমরা কোনও দিনও মরিবো না?

‘সত্য’টা কি তাহলে মাঝামাঝি কোথাও অবস্থিত? তা হতেও পারে আবার নাও হতে পারে।

দীর্ঘকাল এই নিয়ে চিন্তা, গবেষণা, বহু পাঠ্যপাঠ, বহু সংস্কৃতির মৃত্যু চেতনার অনুসন্ধান, বহু গুণীজ্ঞানী ব্যক্তিত্ব, বাউল সাধুগুরু, কবর যারা খুঁড়ে, মৃতদেহ যারা গোসল করায়, ডাক্তার বন্ধু যারা হাসপাতাল মর্গে মৃতদেহ ব্যবচ্ছেদ করে, ধর্মীয় ব্যক্তিবর্গ ছাড়া এমন লোক, যারা জীবনে মানুষ হত্যা করেছে বা আত্মহত্যা করার চেষ্টা করে ব্যর্থ হয়েছে তাদের সাথেও আলাপ করে যা বুঝেছি তার সারমর্ম নিচে দিচ্ছি।

কিন্তু আগে একটি বিষয় পরিষ্কার করা জরুরি–

মৃত্যুর মুখ থেকে ফিরে এসেছেন বা ‘ক্লিনিক্যালি ডেড’ ঘোষণার পরেও যেসব মানুষ আবার বেঁচে গেছেন তাদের অভিজ্ঞতা যেসব সাধারণ বিশ্লেষণ প্রচলিত সংস্কৃতিতে পাওয়া যায় তা দু’চারটা ক্ষুদ্র ব্যতিক্রম ছাড়া মূলত এক ও অভিন্ন।

মুখাবয়বগুলো এরকম– মৃত্যুর ঠিক পর মুহূর্তে তাদের মুক্ত আত্মা ভাসমান অবস্থায় এক অন্ধকার সুড়ঙ্গ পাড়ি দিতে থাকে - এবং বহু দূরে একরাশ আলো তাদের পথপ্রদর্শন করে। সেই আলোর কাছাকাছি পৌঁছানো মাত্রই হয় তাদের কেউ হাত ধরে ‘ওপারে’ নিয়ে চলে বা হঠাৎ তাদের ঘুম ভেঙে গিয়ে বাস্তবে ফিরে আসে। 

মূল বিষয়টা হচ্ছে সময়।

আমরা সবাই ২৪/০৭/৩৬৫ - অর্থাৎ ২৪ ঘণ্টা, সাত দিনে এক সপ্তাহ ও ৩৬৫ দিনে এক বছর ছকে আবদ্ধ। জীবন সময়ের এই অতি সাধারণ তবে জটিল অঙ্ক দ্বারা নিয়ন্ত্রিত। তাই মানুষের আবির্ভাব ও তিরোভাবের মাঝামাঝি অতিবাহিত সময়ের নাম আমরা দিয়েছি ‘সময়কাল’।

মানুষ ইহজগতে আসে একা এবং চলে যায় একা। জীবন ‘কালের সময়’ দ্বারা ভাষান্তরিত করা হয় বিধায় আমরা জীবনকে ‘জীবনকাল’ বা জীবনদশা বলে থাকি।

সময় ব্যতীত, জীবনে আমরা মোটামুটি সব কিছুকেই নিয়ন্ত্রণ করতে পারি। অতীত, বর্তমান বা ভবিষ্যৎ নিছক ইতিহাসের পাঠ্য না– প্রতিটা মুহূর্তই আমরা এই তিন নির্দিষ্ট গোলকের মধ্য দিয়ে অনির্দিষ্ট লক্ষ্যে ভ্রমণ করছি।

মানুষ যদিও একা আসে ও যায় তথাপি তার জীবদ্দশায় সে নিরবচ্ছিন্ন কোনও দ্বীপ না। তাকে বেঁচে থাকার জন্য অন্য মানুষের ওপরেই নির্ভর করতে হয়।

মায়ের স্তন্যপান থেকে শুরু করে মৃতদেহ সমাহিত করা অবধি সে অপরের ওপরে সর্বদা নির্ভরশীল ও কেবল মানবপ্রাণী করে, তা কিন্তু নয়। জীবজগতে সব প্রাণীর একইভাবে একে-অপরের ওপরে নির্ভরশীল।

৪. জীবনযুদ্ধ, স্ট্রাগল ও বিবিধ: মৃত্যু কি অনভিজ্ঞ অভিজ্ঞতা?

প্রজনন থেকে প্রজন্ম সৃষ্টি। এত সৃষ্টি দেখে শুরু হয় মানুষের স্রষ্টার আরাধনা এবং সেই আরাধনা থেকে অবিরাম বেঁচে থাকার তাগিদ শুরু হয় সাধনা বা “জীবনযুদ্ধ”।

পৃথিবীর সৃষ্টি থেকে এই জীবনচক্র চলে এসেছে এবং চলতেই থাকবে। ধারণা করা হয়, মানবপ্রাণীর জীবনকাল গড়ে ৬০ থেকে ৮০ বছর, ক্ষেত্রবিশেষে তা ১০০ বছর বা তার বেশিও হতে পারে, তবে সেরকম মানুষের সংখ্যা অতি নগণ্য।

বেঁচে থাকার জন্য মানুষ চালাতে থাকে অপরিসীম স্ট্রাগল, বেঁচে থাকাটা হলো সংগ্রাম, এবং এই ক্রিয়ার ধারাবাহিকতায় রয়েছে সার্বিক অনিশ্চয়তা।

তবে জীবনযুদ্ধে কী পরিমাণ পরিশ্রম করলে ঠিক কতটা সমতুল্য সফলতা আসবে, তা জটিল অঙ্কের নিয়ম কষে নির্ণয় করা অসম্ভব।

মৃত্যু তাহলে কী?

এই প্রশ্নের কোনও সহজ বা সর্বজন গ্রহণযোগ্য উত্তর এ অবধি কেউ দিতে পেরেছে বলে আমার জানা নেই। মৃত্যু নিয়ে সব তর্ক সব জিজ্ঞাসা সবই অনুমান নির্ভর। জ্ঞাতস্বরে আমরা এও জানি “অনুমান কেবলি অনুমান”–  পৃথিবীতে কোনও অনুমান “শক্ত প্রমাণ” বলে গৃহীত হয়নি।

আবার আরেক রূঢ় বাস্তবতা এড়িয়ে চলা অসম্ভব: অনুমাননির্ভর না হলে সবকিছুই অচল, সব কিছুই অদৃষ্টবাদী বা ফেটেলিস্টিক হয়ে পড়তো– জীবন, জীবিকা কোনও কিছুই আগাতো না।

আমার বাউল দীক্ষার প্রারম্ভে মৃত্যু নিয়ে ব্যাপক আলাপচারিতা সাধুগুরুদের সঙ্গে হয়েছিল।

বাউল ‘মৃত্যু’ বলে কোনও কিছুকেই  স্বীকৃতি দেয় না। কেউ মারা গেলে আমরা সবিনয়ে বলি ‘উনি দেহ ত্যাগ করেছেন’, সনাতন বলে ‘দেহ রেখেছেন’, মুসলমান বলে ‘ইন্তেকাল করেছেন’। সুফিগণ বলেন ‘উনি পর্দার আড়ালে চলে গেছেন’ আবার বৌদ্ধরা বলে ‘উনি পাড়ি নির্বানে চলে গেছেন’।

বাউলের মৃত্যু নিয়ে মোদ্দা কথা: ‘আমরা কোথা হতে এসেছি তা কেউ জানি না বা জানার আগ্রহ প্রকাশ করি না। কিন্তু কোথায় যাবো তা নিয়ে কেন এত দুশ্চিন্তা?’

মূলত এটা কোনও ‘দুশ্চিন্তা’ না– এটা  ভয়।

যা নিয়ে মানবকুলের কোনও অভিজ্ঞতা নেই– যা নিয়ে কেউ তাকে প্র্যাকটিক্যাল জ্ঞান দিতে পারবে না— তা নিয়ে ভয় পাওয়াটা কি খুবই অস্বাভাবিক?

যা জীবনদশায় ‘একবারই ঘটবে’- তা নিয়ে কার বা ভয় নেই, বা ভয় হবে না? মৃত্যুর পর এই ‘দুর্লভ অভিজ্ঞতা’ নিয়ে কি কেউ কোনও রচনা, প্রবন্ধ বা উপন্যাস লিখেছেন? ‘ওপারের না ফেরোর দেশের গল্পের’ কোনও বীর মহানায়ক কি আছেন?

যেহেতু আমাদের এই পৃথিবীতে আগমনের আগে আমরা কোথায় ছিলাম, ‘জীবিত নাকি মৃত’ ছিলাম, একি আমাদের পুনর্জন্ম, আগের জন্মে মানুষ ছিলাম নাকি অন্য কোনও প্রাণী ছিলাম– এর যেমন কোনও উত্তর নেই, আমরা যে ‘আছি’ বলে এখন দাবি করছি তার একমাত্র প্রমাণ আমাদের এই অস্তিত্ব।

এই সময়কাল এই মুহূর্ত– এই যে আমি লিখছি ও আপনারা মনোযোগ দিয়ে পড়ছেন– এটাই মানুষ জীবনের সবচাইতে মূল্যবান, অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ মুহূর্ত। এই সময় কি আবার ফিরে আসবে?

তাহলে কি মানুষের মতো সময়েরও মৃত্যু আছে? না, তা নেই।

সূর্যোদয় ও সূর্যাস্ত প্রতিদিনই হচ্ছে কিন্তু তা কি চিরস্থায়ী কোনও ফেনোমেনা? একইভাবে ‘সময়ের মৃত্যু’ বলে কোনও কিছুতে যদি বিশ্বাস করি–  তা কি “সর্বশেষ” কোনও সত্য?

যদি আমরা নিজেদের প্রকৃতির অংশ বলে মনে করি তার অর্থ কি এই নয় যে প্রকৃতি যে নিয়মে চলছে, আমরাও ঠিক একই নিয়মের অন্তর্ভুক্ত? 

এক বীজ থেকে বৃক্ষ, বৃক্ষ থেকে ফুল, ফলাদি, তারপর বৃক্ষের মৃত্যু, আবার সেই বীজ মাটিতে পতিত হয়ে পুনর্জন্ম; আবার ওই একই নিয়মে চলে আসছে মানবজীবন, এর থেকে পৃথক বা “সম্পূর্ণ আলাদা”– আমাদের তা মনে করার কারণ কী? এই সঞ্চরণশীল প্রক্রিয়ার মাঝে মানবজীবন কি অন্তর্ভুক্ত নয়?

যাকে আমরা “মৃত্যু” বলছি তা যে প্রতিদিনই ঘটছে ও আমরা “অভিজ্ঞতা” অর্জন করছি– তা কি বোঝার কোনও উপায় আছে? 

আমরা যখন নিদ্রাজ্ঞাপন করি - বলুন তো আমাদের এই “আমি” তখন কোথায় থাকে? একবারও কি বলতে পারবেন “আমি” সারা রাত কোথায় ছিল - সেকি আমাদের দেহের ভেতরে নাকি বাহিরে অবস্থান করছিল?

ঘুম, নিদ্রা সবই “অবচেতন ধ্যান” ও তাহাকে “ইবাদত” বলা হয় - তার অন্যতম কারণ আমাদের সৃষ্টি হয়েছে “ডাইমেনশন” বা স্রষ্টার আয়তন ও বিস্তার বোঝার জন্য।

সে অর্থে আমাদের এই ২৪/০৭/৩৬৫ ঊর্ধ্বে কি কোনও ডাইমেনশন নেই? অবশ্যই আছে —তবে তার আগে আমাদের আরেকটা বিষয়ে স্পষ্ট থাকা বাঞ্ছনীয়।

নিদ্রার ভেতর স্বপ্ন আমরা যা দেখি তা সবই ওই ২৪/০৭/৩৬৫-এ আবদ্ধ। কারণ- আমাদের দেহ সচল, সজীব ও “জীবিত” থাকে এবং ঘুম ভাঙামাত্রই আমরা সেই অতি পরিচিত ২৪/০৭/৩৬৫-কে ফের আঁকড়ে ধরি।

আমাদের দেহ নিতান্ত তুচ্ছ, পরিত্যাজ্য ও নিষ্পত্তিযোগ্য এক আবরণ । ঠিক যেমন আমরা পোশাক পাল্টাই - এর চেয়ে তা ভিন্ন কিছুই না। মাটি দিয়ে তৈরি দেহ আমরা মাটি থেকে কিছু দিনের জন্য “ধার” নিয়েছি এবং মাটিতে ফেরত দিতে আমরা বাধ্য। অথচ প্রযুক্তির কথা যদি বলেন - মানবদেহের চেয়ে অবিশুদ্ধ কোনও প্রযুক্তি এই পৃথিবীতে কোথাও নেই।

৫. যাহা কিছু বিশ্বব্রহ্মাণ্ড তাহা এই ক্ষুদ্র দেহভাণ্ডে: প্রকৃতির প্রকৃতি

তবে রুহ, আত্মা বা সোল কি জিনিস ভাই?

বাউলদের হিসাবে আত্মার “ওজন” দেড়রতির সমান। এই অতি ক্ষুদ্র এনার্জি বা কর্মশক্তি, জ্বালানি বা “ফিউল” যা আমাদের এই বিশাল দেহ ও মনকে বছরের পর বছর চালিত রাখে তার মানব দেহের অভ্যন্তরে অস্তিত্ব কোথায়? হৃদপিণ্ড, মস্তিষ্ক, ফুসফুসে কোথায়?

এই বিশাল ‘ফিউল ট্যাংক’ দেহের ভেতরে নাকি বাইরে অবস্থিত এ নিয়ে বিতর্কের শেষ নেই। এই প্রশ্নের কেউ কি সদুত্তর দিতে পারবেন যখন এই আত্মাকে আমরা চোখে দেখি না– কেবল অনুভব করি ও এর অনুমানের ভিত্তিতে আমাদের ইহজগতের এই “সময়” নামের ব্যঞ্জনায় পরিভ্রমণ করি?

প্রতিটা গ্রহ, নক্ষত্রের যেমন নিজস্ব আয়তন আছে, প্রতিটি মানুষের “রুহ” বা আত্মারও ওই একই। জাগ্রত জীবন প্রতিনিয়ত এই আশা যাওয়ার নিরিখেই চলছে এবং চলতে থাকবে।

তবে ভুলে গেলে চলবে না, এই ২৪/০৭/৩৬৫ অত্যন্ত সীমিত এক আয়তন। এই ছায়াপথ সংক্রান্ত হিসাব নিরূপণকার্য বা গ্যালাক্টিকেল ক্যালকুলেশন-এ মানব জীবনের ১০০ বছর আমাদের প্রথাগত হিসাবের কয়েক সেকেন্ডেরও কম।

বিশ্বাস হচ্ছে না?

নিজের দম কতক্ষণ ধরে রাখতে পারেন তা কি কখনও হিসাব করেছেন? খুব বেশি হলে এক বা দেড় মিনিট বা তারও কম? ওই অতটুকুই আমাদের জীবনের ‘আয়ু’। গানে আছে ‘এক সেকেন্ডের নাই ভরসা, সাঙ্গ হবে রং তামাশা, চক্ষু মুদিলে হায়রে দম ফুরাইলে’।

তাহলে মানবকুল স্রষ্টার এই অভূতপূর্ব হিসাব নিকাশের সঙ্গে কি সংযুক্ত থাকতে পারে– কীভাবে?

যদি নিদ্রা বা ঘুমকে ‘অবচেতন ধ্যান’ বলি– তাহলে ‘ধ্যান’ কী? ধ্যান একবাক্যে ‘সচেতন নিদ্রা’ – অর্থাৎ মনকে সম্পূর্ণ নীরব রেখে স্রষ্টার সাথে সংযুক্ত করা। আত্মা সজাগ তবে দেহ নিদ্রারত।

পৃথিবীতে প্রীতিটি ধর্মে স্রষ্টার সঙ্গে এই সংযুক্ত থাকার বিধান আছে যা মানবকল্যাণের স্বার্থে যুগ যুগ ধরে পরম্পরার মাধ্যমে চলে এসেছে। তবে সাধকের ধর্মের সঙ্গে সাধারণের ধর্মে ব্যাপক পার্থক্য আছে—এবং এ কারণেই আমাদের সমাজ ও সংস্কৃতিতে সাধকদের উচ্চ মর্যাদায় আসীন।

যারা দয়াল সৃষ্টিকর্তার সাধনাই সম্পূর্ণ নিবিষ্ট থাকেন, যারা তাদের ধ্যানে স্রষ্টার সন্তুষ্টি থেকেও গুরুত্বপূর্ণ- তার সৃষ্টির অংশ হিসেবে সর্বদা নিয়োজিত থাকেন, তাদের ভ্রমরণ্ড বা সুলতানুল ধিকির দ্বারা সৃষ্টার বিবিধ ডাইমেনশনগুলোকে সহজেই উপলব্ধি করতে পারেন। প্রতিটি ধর্মে তাই প্রার্থনা ও ধ্যানকে এতটা গুরুত্ব দেওয়া হয়েছে।

উপসংহার: মৃত্যু যদিও রহস্যে আবৃত, জীবনও কি তাই নয়? আগামীকাল আমরা কোনও রূঢ় বাস্তবতার সম্মুখ হবো তা যেমন কোনোভাবেই ভবিষ্যদ্বাণী বা “প্রিডিক্ট” করা অসম্ভব- একইভাবে মৃত্যু আমাদের ঠিক কোন সময়, কী অবস্থায় অতর্কিতে অভিভূত করবে, তাও কোনও হিসাব কষে বলাটা অসম্ভব।

প্রতিটি ধর্মগ্রন্থ বলছে, “মৃত্যু নিয়ে দিনে যারা অন্তত একবার চিন্তা করে- তাদের দ্বারা পাপ করার সম্ভাবনা খুবই কম”। এই নির্মম মহামারির সময়ে আমরা যেন পাপমুক্ত থাকতে পারি তা হোক আমাদের দয়ালের কাছে একমাত্র চাওয়া, একমাত্র প্রার্থনা।

লেখক: সংগীতশিল্পী

/এসএএস/এমওএফ/

*** প্রকাশিত মতামত লেখকের একান্তই নিজস্ব।

বাংলা ট্রিবিউনের সর্বশেষ
জঙ্গি ও সন্ত্রাসবাদ দমনে পেশাদারত্বের সঙ্গে কাজ করছে পুলিশ: আইজিপি
জঙ্গি ও সন্ত্রাসবাদ দমনে পেশাদারত্বের সঙ্গে কাজ করছে পুলিশ: আইজিপি
তামাকপণ্যের দাম বাড়ানোর দাবি
তামাকপণ্যের দাম বাড়ানোর দাবি
ভারত সফর স্থগিত করলেন ইলন মাস্ক
ভারত সফর স্থগিত করলেন ইলন মাস্ক
বাঘ ছাড়া হবে জঙ্গলে, তাই শেষবার ভোট দিলেন বাসিন্দারা!
বাঘ ছাড়া হবে জঙ্গলে, তাই শেষবার ভোট দিলেন বাসিন্দারা!
সর্বশেষসর্বাধিক

লাইভ