‘বাংলার মাটি, বাংলার জল, বাংলার বায়ু, বাংলার ফল—
পুণ্য হউক, পুণ্য হউক, পুণ্য হউক হে ভগবান।।’– রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর
১. সংগীতে ভবিষ্যৎ বার্তা, শব্দস্বাক্ষর ও আমাদের সমাজ
আমাদের আবহমান বাংলা সংগীতে যুগ যুগ ধরে লিপিবদ্ধ করা অভাবনীয় সব সাউন্ড সিগনেচার বা অন্তর্নিহিত ‘শব্দস্বাক্ষর’ যেসব ভবিষ্যৎ বার্তা দিয়ে এসেছে ও দিচ্ছে, তা নিয়ে নতুন করে বিশ্লেষণসহ গবেষণা প্রয়োজন।
করোনা পরবর্তী পৃথিবীতে চলমান মনস্তাত্ত্বিক বিশ্বযুদ্ধ, সংঘাত ও মানুষের দৈনন্দিন জীবনে তার সুদূরপ্রসারী প্রভাব কী হতে পারে–তা আকাশের দিকে নয়, মাটির দিকে চোখ নামিয়ে, নমনীয় দৃষ্টি দেওয়ার ও ভাবার এখনই সময়। উঁচু কপালপনা আমাদের দাম্ভিকতাকে প্রশ্রয় দিয়ে ইতোমধ্যে অনেক ক্ষতি করেছে।
আমাদের সমাজ বা রাষ্ট্রচিন্তায় ‘আগামী প্রজন্মের জন্য কিছু রেখে যাবার’ অত্যন্ত জোরদার অঙ্গীকার আমরা সময়-অসময়ে শুনতে পাই।
রাজনৈতিক নেতারা তাদের বক্তৃতায়, কোনও না কোনও সুবিধাজনক সময়ে ‘ভবিষ্যতের সোনার বাংলার স্বপ্ন’, ‘বাংলাদেশের স্বর্ণালি ভবিষ্যৎ’ বা ‘আগামী প্রজন্মের জন্য উপহারস্বরূপ’ অনুগ্রাহক ফুলঝুরির মতো সুন্দরতম অসুন্দর বাক্যগুলো—থাকবেই থাকবে।
কিন্তু এসব স্বপ্নের প্রমিত রূপ আসলে কী?
বড়জোর শুনতে পাবো আনন্দে হৃদপিণ্ডের কাঁপুনি বাড়িয়ে তোলা– ‘নিম্ন আয় থেকে আমরা মধ্যম আয়ের দেশ বনে যাবো’, ব্যস! তাতেই আমরা কী খুশি, তাই না?
আমরা কি এতটাই নিশ্চিত যে ২০৩০-এ ‘বাঙালি একাই’ মধ্যম আয়ের দেশ হবে– আর নিচের সবাই বসে বসে দেখবে?
বাঙালি বরাবরই একটা ‘খতরনাক’ জাতি।
আমাদের ধারণা, ইদানীং ‘খতরনাক’ অলিম্পিকের স্বর্ণ বিজয়ীদের মতো অর্থনৈতিক ‘লম্ফঝম্প’ ও উন্নয়ন দেখে সুউচ্চ আয়ের প্রথম বিশ্বের দেশগুলো ‘বাঙালির দুঃসাহসিক স্টাইলে’– ভীত ও পরাস্ত হয়ে যুদ্ধ না করেই যেন ভেগে যাবে।
এই মধ্যম আয়ের দেশ হওয়ার স্বপ্নে বিভোর হয়ে আমরা মনে করি আমাদের মতো বিশ্বের অন্য সব হতভাগা নিম্ন আয়ের দেশের মানুষের জীবনের কোনোই উন্নতি হবে না। যা হওয়ার তা শুধু আমাদেরই হবে। আমরাই ‘ইমারজিং টাইগার’– বাকি সবাই জড়প্রাণী!
এ কি ক্রিকেটের মতো খেলা? আমরা কার সঙ্গে প্রতিযোগিতায় নেমেছি ভাই? এই মধ্যম আয়ে ওঠার ‘সম্ভাব্য বিজয়’– আমার আরেক দরিদ্র ভাইয়ের গলা চেপে উল্লাস করছি। তা করেই কি আমরা মধ্যম আয়ের দেশ হয়ে উঠবো?
একই ধারাবাহিকতায় উচ্চ থেকে ‘সুউচ্চতর আয়ের’ দেশগুলো কি তাহলে ‘ভ্যানিশ’ হয়ে যাবে, নাকি এতটাই দরিদ্র হবে যে তার জনগণ বাংলাদেশে এসে ভিক্ষা করে বেড়াবে?
কেনই বা এই স্বপ্ন দেখবো না, যখন আমি নিজেই ১৯৬৪ সালে এক আরবকে আমার জন্মস্থান নারায়ণগঞ্জে ৪ আনা ভিক্ষা দিয়েছিলাম? হ্যাঁ, এ দেশে আরবরাও ভিক্ষা করতে আসতো।
সিরিয়াসলি…! আগামীর প্রতিযোগিতায় আমরা টিকতে পারবো তো?
২. প্রকৃতির বার্তা, ভবিষৎবাণী ও বাঙালি জাতি
‘পার হবি চুলের সাঁকো কেমন করে?
একদিন তর পারের ভাবনা ভাবলি না রে’– ফকির লালন শাহ
এসব ‘জটিল’ প্রশ্নের উত্তর দেওয়া সম্ভব না, কারণ সদুত্তর ও সর্বজন গ্রহণযোগ্য ফয়সালার এখানে নেই সুযোগ, নেই কোনও সম্ভাবনা।
তার ওপরে আমাদের এ মুহূর্তের জাতিগত মেধা, মনন, মানসিকতা, রুচি ও ‘অভ্যাসে’র যে ভয়ংকর নমুনা পাচ্ছি– সেই বাঙালি জাতির ‘ভবিষ্যদ্বাণী’ করা ঝুঁকিপূর্ণ কেবল নয়– তা আসলেই হবে মহাপাপ।
তাহলে ‘আগামী ৫০ বছরে বাংলাদেশ বঙ্গোপসাগরের নিচে তলিয়ে যাবে’– এই ভবিষ্যদ্বাণী আমরা কি মেনেই নিলাম? এ নিয়ে দ্বিতীয় পর্বে আলাপ করবো।
৩. কীসের মায়ায়, কীসের টানে, কীসের লোভে, কীসের লাভে?
‘এ দেশের মাটির তরে অনেক জাতির
অনেক দিনের লোভ আছে
সে কথা ইতিহাসে বলে
এ মাটি সোনার মাটি
এই মাটিতে সোনাই শুধু ফলে
সে কথা ইতিহাসে বলে’– অজ্ঞাত পদকর্তা
বহু জাতির সংমিশ্রণের ‘বাঙালি’ জাতির সবচেয়ে শক্তিশালী চারিত্রিক বৈশিষ্ট্য– সে ১০০ ভাগ হালাল ‘আনপ্রেডিক্টেবল’।
সে কোন মুহূর্তে কখন কী করে বসবে, বা করতে পারে– তা তার প্রাকৃতিক আবহাওয়ার পূর্বাভাসের মতো, আজগুবি। বলা হয় এক, হয় আরেক।
বলা হয় সাইক্লোন– আসে সুনামি,
বলা হয় খরা– আসে বন্যা,
বলা হয় শৈত্যপ্রবাহ– আসে ভ্যাপসা গরম,
ক্রিকেট খেলায় ঘাবড়ে গিয়ে দশ দিন হারবে–
চার দিন পর প্রতিপক্ষকে ঘাবড়িয়ে দিয়ে হারাবে,
প্রাক্তন প্রেসিডেন্ট এরশাদ ফতুল্লায় বৃষ্টির জন্য করলেন ‘খাস মোনাজাত’– এসে গেলো পাগলা তুফান, কিন্তু বৃষ্টি আর এলো না!
সত্যি সেলুকাস! কী ‘বৈচিত্র্যতায়’ ভরপুর এই বঙ্গদেশ!
না। আমাদের জাতির বিষয়ে কোনও পূর্বাভাস বা ভবিষ্যদ্বাণী কখনোই করা যায়নি, যাবেও না।
যেমন, একাত্তর সালে পৃথিবীর একটি মানুষও কি পেরেছিল পূর্বাভাস বা ভবিষ্যদ্বাণী করতে যে ঠিক একাত্তরের ১৬ ডিসেম্বর– বাংলাদেশ চূড়ান্ত বিজয় অর্জন করবে?
কোন সময়ে? সেই সময়ে যখন ধ্বংসাত্মক তথাকথিত ‘পাশ্চাত্য সভ্যতা’ তার সম্পূর্ণ শক্তি নিয়োগ করেছিল আমাদের মুক্তির স্বপ্নের বিরুদ্ধাচরণে। কার শক্তি আছে এই বাস্তব ইতিহাস পাল্টে দিতে? না, সেই শক্তি কারোর নেই।
আফ্টারঅল আমরা বাঙালি, আমাদের দ্বারা অনেক অসম্ভবকে সম্ভব করা একেবারেই সম্ভব, তদপুরি আমরা হাডুডু খেলা ‘স্মার্ট’ জাতি।
কী করে কাকে কীভাবে ল্যাং মেরে ফেলে দিতে হয়, কী করে কারও পেছনে লাথি মেরে এগোতে হয়, কী করে স্লিপ কেটে পিছলিয়ে বেরিয়ে পড়তে হয়, কী করে বিজয়ীকে মাথায় তুলে ‘নাচা’র পর হঠাৎ টানাহ্যাঁচড়া করে নামিয়ে ফেলতে হয়– এসব “গুরুতর” বিষয়ে আমরা যথেষ্ট পারদর্শী।
ভুল বলেছি, পারদর্শী কেবল না, এসব অদ্ভুত এবং ক্ষেত্র বিশেষে দারুণ ‘অ্যামেজিং স্কিল’ আজ আমাদের ‘গৌরবময় জাতীয় চরিত্রের অবিচ্ছেদ্য অঙ্গ’।
তথাপি ইলিশ আমাদের জাতীয় মৎস্য হলেও চরিত্রগত দিক দিয়ে আমরা তা না। আমরা ‘বাইল্যা মাছ’। আমরা গায়ে কখনও কাদা মাখি না এবং শুধু তাই নয়, কাউকে সেই সুযোগও দেই না।
আমরা একটা ‘সংস্কৃতিমনা ডিসেন্ট জাতি’– সে যত কালোই আমাদের চেহারা হোক– তাতে কোনও ধরনের ‘কালিমা লেপন’ আমরা বরদাশত করি না।
৪. প্রজন্মগত চিন্তার দ্বন্দ্ব ও আমাদের লাভ ক্ষতি
‘দিলি জিরার দরে হীরা কাঞ্চন
কাঁচের বিনিময় সোনা,
জীবনে কি কত লোকসান
বুঝলি না মনা’– বিজয় সরকার
আমাদের প্রান্তিক জনগোষ্ঠীর গরিমা সংস্কৃতিতে ‘ভিশনারি’ স্বপ্নদর্শী দর্শন বা পরিণামদর্শী চর্চা সব সময় ছিল, আছে ও থাকবে। কিন্তু শহরমুখী বা রাজধানীকেন্দ্রিক রাজনৈতিক সামাজিক সাংস্কৃতিক চর্চায় তা অনুপস্থিত।
এর মূল কারণ হলো আমরা আমাদের বর্তমান নিয়ে এতটাই অতীব আনন্দিত যে ভবিষ্যৎ চিন্তাগুলো ঠিক নাক পর্যন্ত করি– ওই আরকি ‘স্বল্পমেয়াদি ৫ সালা পরিকল্পনা’র মতো- ৪ বা ৫ বছরের বেশি না।
অপরদিকে আজকের দিনের ৮ থেকে ১২ বছরের শিশুদের যদি প্রশ্ন করা হয় ‘বড় হয়ে কী করবে’– নিশ্চিত থাকেন ওদের ভাষ্যে আগামী ২০ বছরের পরবর্তী পৃথিবীর এক প্রচ্ছন্ন চিত্র পাওয়া যাবে।
কিন্তু সেই চিত্র অধিকাংশ আত্মার কৃপণতায় ভরপুর ‘অভিভাবক’ শ্রেণির মানুষজন বাগড়া লাগিয়ে ‘বুঝেও বোঝে না’।
অথচ যাদের বয়স ৫০ থেকে ৭০; ওদের যদি প্রশ্ন করেন ‘আপনার ভবিষ্যৎ পরিকল্পনা কী’– সে যে চিত্র দেবে তাতে মনে হবে তার ‘পরী’ উড়াল দিয়েছে এবং বেচারি ‘কল্পনা’ এই ইডিয়টের দিলে ছ্যাঁকা দিয়ে কেটে পড়েছে!
সে চাকরি বা ব্যবসা থেকে অবসর কখন নেবে ও বাকিটা জীবনের সমস্ত প্ল্যানিংয়ে মোস্ট ইম্পরট্যান্ট ফ্যাক্টর—পূর্বের পাপমোচনের জন্য মসজিদে মসজিদে, আল্লাহ আল্লাহ জপা ও হজ পালন নিয়ে থাকে ব্যস্ত।
৫. ঝটপট রিয়ালিটি চেক– ‘টেহা ফয়সার হিসাপ’
আচ্ছা, আগামী ২০৬১ সালে আমরা অনেকেই যখন আর বেঁচে থাকবো না, সেই পৃথিবীটা, সেই বাংলাদেশটাই বা কেমন হবে দেখতে?
মধ্যম আয়ের দেশে আমরা কোন দেশের মুদ্রায় আয় করবো? টাকা, ডলার, ইউরো, রেনমিনবি, ভারতীয় রুপি নাকি বিটকয়েন? যে মুদ্রায় আয় করবো সে একই মুদ্রায় কি ‘ব্যয়’ করা যাবে?
আজকের এক কোটি টাকার প্রকৃত মূল্য তখন ঠিক কত টাকা হবে– ১০ লাখ নাকি ১০ কোটি? সমগ্র বিশ্ব কি বাংলাদেশ টাকার মূল্যের ওপর তার নিজের মুদ্রা স্থির করবে, নাকি মার্কিনি ডলার মুদ্রা হবে ‘শেষ কথা’?
এসব বাস্তবিকতা খুঁটিয়ে দেখার চিন্তা বা ‘রিয়ালিটি চেক’ করতে গেলে আমাদের মস্তিষ্ক হ্যাং হয়ে যায়– আর কখনোই তা রিবুট করে না।
কারণ, আমাদের অন্তরের সিপিইউ খুবই দুর্বল, তাই ল্যাপটপের মস্তিষ্কে শুধু স্পেস বা জায়গাই বাড়াচ্ছি, কিন্তু নিজের গোঁয়ার্তুমি মস্তিষ্কের জায়গা আর বাড়ছে না। উল্টো ছোট হয়ে অনেক স্লো-ডাউন করছে।
আমাদের মস্তিষ্ক হারিয়েছে তার প্রাকৃতিক স্থিতিস্থাপকতা।
‘মগজ’ বিশেষ শীতের মৃতের মতো শক্ত হয়ে মাদারবোর্ডে নিয়মিত ঝামেলা পাকাচ্ছে।
এসবই করোনার করুণ পরিণাম।
‘অতদিন তো বাঁচবো না– অত চিন্তা করে আমার লাভ কী?’
আমরা এতটাই ‘আমার লাভ’-এ আসক্ত জাতি যে মনে করি– মরে গেলেই বুঝি ‘ভবিষ্যৎ’ বেঁচে থাকবে। কিন্তু আজব বিষয় আমরা মরবোও না, নড়বোও না, সরবোও না, উচ্ছেদও হবো না এবং দয়াময় আমাদের হায়াতও দিয়েছেন মাশাল্লাহ।
‘নুইসেন্স ভ্যালুরও তো একটা ভ্যালু আছে ভাই!’
৬. করোনা-উত্তর বাংলাদেশ: মস্তিষ্ক ধোলাইয়ের ১৭ মাস ও নব্য উপলব্ধি
‘স্বরূপ বলে ওহে ময়না রাম
আগে তর সার মনের বেরাম
যা কিছু সামলাইলে পাবি
অন্তিমের আরাম’– বিজয় সরকার
মস্তিষ্ক সবল, সচল স্বাভাবিক ও ‘পচনমুক্ত’ রাখার সহজ তিনটি ক্রিয়া আছে:
ক) প্রতিদিন একবার হলেও ফুসফুসে বাতাস ভরে সজোরে কয়েক দফা হৃদপিণ্ড বা হার্টকে পাম্প করে শরীর গরম করা।
খ) জ্ঞান অর্জন ও অন্বেষণ যেহেতু মায়ের কোল থেকে কবর পর্যন্ত চলমান প্রসেস, তাই প্রতিদিন নতুন কিছু নিয়ে অধ্যয়ন করা।
ঘ) ‘অসামাজিক সামাজিক যোগাযোগ’ দূরত্ব না, ডিভাইস বা যন্ত্রের কল্যাণে না– মানুষে মানুষে ‘ইন পারসন’ সরাসরি, সামনা-সামনি যোগাযোগ বাড়িয়ে তোলা।
কোভিড-১৯ মস্তিষ্ক ধোলাইয়ের কর্মসূচি এসে এসব মামুলি ও প্রাকৃতিক ক্রিয়া ‘ছেড়াবেড়া’ করে দীর্ঘমেয়াদি জাতিগত মস্তিষ্ক ধ্বংস করেছে।
তার রেশ প্রজন্ম থেকে প্রজন্মের কত বছর বা যুগ ধরে বয়ে নিয়ে চলবে, তা কল্পনাতীত।
অথচ এ নিয়ে রাষ্ট্র, সরকার ও সমাজের কোনও চিন্তাভাবনা নেই। কারণ, এই তিনটি নিষ্ঠুর প্রতিষ্ঠান ঠিক জনগণের মতো ওই একই ব্যামোতে ভুগছে।
আইসোলেশন বা বিচ্ছিন্নতা, ‘বাসায় থাকি নিরাপদে থাকি’র ফতোয়ার কার্যকর ক্ষতি আমরা এখনও বুঝে উঠতে অক্ষম।
আমরা বাসায় বন্দি-দশায় থেকেছি কিন্তু ব্যায়াম করিনি, ঝগড়া করেছি। হাতে প্রচুর সময় থাকা সত্ত্বেও আমরা বই না পড়ে নেটফ্লিক্স ও ইউটিউবে শত শত সিনেমা দেখেছি।
অপ্রয়োজনীয় ইনফরমেশন ওভারলোড করে আমাদের চোখ কানসহ মস্তিষ্কের ১৪টা বাজিয়ে ফেলেছি। অসময়ে প্রচুর ঘুমিয়েছি, কিন্তু মস্তিষ্ক কখনোই রেস্ট পায়নি।
‘অধ্যয়ন’ যে এক ধরনের ‘ধ্যান’ তাও ভুলে গেছি– আর একাকিত্বের জ্বালা যে কত প্রকট, স্বার্থপর, অকৃতজ্ঞ ও সহানুভূতিহীন করে ফেলেছে তা আমাদের বর্তমানের ঝকঝকা হাসিমাখা সেলফিগুলোর অন্তরালে ধরা পড়ছে না।
৭. মানবসম্পদ বনাম আর্টিফিসিয়াল ইন্টেলিজেন্স: রোবটিক দাসত্ব
কোভিড-১৯-এর ছত্রছায়ায় থেকে আমরা ইতোমধ্যে রোবটিক দাসত্বের ট্রেনিং ১৭ মাস ধরেই তো সম্পন্ন করলাম।
আগামীতে ‘মানবসম্পদ’ যা আমাদের ইদানীংকালের গরিব ঠকানোর সেই সম্পদ ২০৬১ সালে ১৬ থেকে ২৬ কোটি যদি হয়ে যায়, এই সম্পদকে খাওয়াবেন কী, পরাবেন কী আর মোস্ট ইম্পরট্যান্ট– রাখবেন কোথায়?
আর্টিফিসিয়াল ইন্টেলিজেন্স বা ‘এআই’, রোবটিকস ইত্যাদি যা মানুষকেই প্রতিস্থাপন করার জন্য সৃষ্টি হচ্ছে। তাতে বিদেশে কর্মস্থানরত লক্ষ লক্ষ পাবলিকগুলোর কী হবে? দেশে ফিরে আসবে? মাটির আয়তন কি খুব একটা বেড়েছে?
৮. কাব্যিকতা বনাম বাস্তবতা- রূপক নাকি স্বরূপ?
তাহলে ইতিহাসে কোন কোন জাতি আমাদের দেশের ‘মাটির তরে’ লোভ ছিল এবং আছে?
কাব্যিক ভাষায় বলা হয়েছে ‘সুজলা, সুফলা, শস্য শ্যামলা আমারি দেশ ভাইরে’– তার অর্থ কি এই যে ‘এমন দেশটি কোথাও খুঁজে পাবে নাকো তুমি– সকল দেশের রানি সে যে আমার জন্মভূমি– আমাদের মতো দেশ পৃথিবীতে দ্বিতীয়টি নেই?
হতদরিদ্র জনগণের দেশে এই ‘রঙিন বর্ণনা’ অতি দেশপ্রেমের সাক্ষ্য দিলেও তা কি আক্ষরিক অর্থে বিশ্বাসযোগ্য?
বাংলাদেশ একদা সমগ্র ভারতবর্ষের শস্যাগার ছিল বটে, কিন্তু আমাদের নিজস্ব খাদ্য স্বয়ংসম্পূর্ণতা এসেছে অতি সম্প্রতি অর্থাৎ প্রাকৃতিক সম্পদ লুণ্ঠন করে, আমাদের দেউলিয়া করে বর্গীরা অনেক আগেই ভেগেছে– তাহলে আর থাকলো কী?
প্রাচীন সময়ের কবি পদকর্তাগণের বিদেশ তেমন দেখার সৌভাগ্য হয়নি। ইউরোপ, আমেরিকার ‘সুজলা সুফলা শস্য শ্যামলা’ প্রাকৃতিক চিত্র দেখা থাকলে– আমাদের দেশটার ‘শ্রেষ্ঠত্ব’ নিয়ে তারা আরও একটু ভাবতেন, এত বড় ভুল করতেন না।
আসলেই কি সবই ‘ভুল’ ছিল?
৯. ‘ভুল যদি হয় মধুর এমন, হোক না ভুল’
‘দে গো তোর পায়ের ধুলা সে যে আমার মাথার মানিক হবে’– রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর।
এই তথাকথিত ‘পরশুরাম-এর দেশ’ খ্যাত বাংলাদেশ কি পুরাকালীন সময়ের কোনও প্রোপাগান্ডা, যা ব্যবহৃত হতো অন্য জাতিকে ভয় দেখিয়ে দূরে সরিয়ে রাখার জন্য?
গরিমার পদকর্তা আব্দুল লতিফ গেয়ে উঠলেন:
‘সোনা সোনা সোনা লোকে বলে সোনা
সোনা নয় তত খাঁটি
বলো যত খাঁটি তার চেয়েও খাঁটি
বাংলাদেশের মাটি
আমার বাংলাদেশের মাটি।’
ঘুরে-ফিরে ইনিয়ে-বিনিয়ে তিনটি শব্দ বারবার আমাদের সাংস্কৃতিক মগজের শব্দচিত্রে সব সময় অকুতোভয়ে স্থান করেছে।
‘মাটি, সোনা’ আর ‘রানি’।
প্রশ্ন হচ্ছে এসব কি শুধুই রূপক সংজ্ঞা নাকি এই মাটির ভেতরে বা নিচে এমন কোনও ‘রহস্যময় সত্য’ লুকিয়ে আছে– যা নিয়ে আমাদের বিন্দুমাত্র ধারণা নেই?
বিষণ্ন ধরিত্রী মা আমাদের কি কানে ফিসফিসিয়ে কিছু বলার চেষ্টা করছেন? উনি কি বলছেন, ‘আমি কান পেতে রই- ও আমার আপন হৃদয়গহন-দ্বারে বারে বারে কান পেতে রই!’
আমরা কি শুনতে পাচ্ছি?
সেই হিমালয় থেকে শুরু করে দেশ দেশান্তরের পলিমাটি, কোটি কোটি ভিনদেশি মানুষের মল, মূত্র, মরদেহ, প্লাস্টিক, কেমিক্যাল ও যতরকম যাবতীয় আবর্জনা বা ‘রাবিশ’ কল্পনা করা যায়, তা সব ভাসিয়ে নিয়ে এসে– বন্যা হয়ে, খরা হয়ে, জলোচ্ছ্বাস হয়ে বাংলাদেশের বিভিন্ন অঞ্চল ঘুরে বেরিয়ে ভিন্ন নদীর সঙ্গে সংমিশ্রিত হয়ে অবশেষে বঙ্গোপসাগরে ধপাস করে সে নিষ্কাশিত হয়।
প্রকৃতির লক্ষ কোটি উপাদান নির্দ্বিধায় বাংলাদেশে ঢুকছে ও বের হচ্ছে কিন্তু মানুষের আনাগোনা বা যাতায়াত হবে না– এ চিন্তা স্রেফ হঠকারিতা কি নয়?
কিন্তু মানুষ বাংলাদেশে আসতোই বা কেন? কীসের মায়ায়, কীসের টানে, কীসের লোভে, কীসের লাভে?
১০. হাদরামৌত হতে শ্রীহট্ট ও হজরত শাহ জালাল (রা.)
‘মাটি পানি দুইটি জিনিস বানাইয়াছে নিরঞ্জন’– অজ্ঞাত
মাটির বিষয়ে যদি আলাপে আসি– কাল্পনিক মনোস্মৃতি নয়, পাঠ্য ইতিহাস বলছে আজ থেকে প্রায় ৭০০ বছর আগে কোরাইশ বংশোদ্ভূত সোহরাওয়ার্দীয়া তরিকত অবলম্বনকারী সুফি সাধক ‘শাইখ আল-মাশায়েখ মাখদুম শাইখ জালাল মুজ্জারদ বিন মুহাম্মদ কুন্যায় (ওরফে) শাহ জালাল’ আমাদের বুজুর্গ হজরত শাহ জালাল (রা.) ইয়েমেনের হাদরামৌত অঞ্চলসমূহ থেকে ৩৬০ জন সাহাবা নিয়ে অনির্দিষ্ট গন্তব্যে ভ্রমণ শুরু করেছিলেন। সাহাবা অর্থাৎ মুরিদ বা সহচর।
ভ্রমণের লক্ষ্য ছিল একটাই– ইসলাম ধর্মের প্রবর্তন। কিন্তু কোথায়, কোন দেশে, কীভাবে তা করতে হবে তার জন্য ছিল তার সাম্যক গুরু ও মামা হজরত সায়েদ আহমেদ কবিরের দেওয়া একটি মাত্র শর্ত। শাহ জালাল সাহেবের হাতে তুলে দিয়েছিলেন কয়েক মুঠো মাটি।
শাহ জালাল সাহেবের সাহাবাদের অনেকেই ছিলেন প্রাচীনতম ভূ-বিজ্ঞানী। তাদের দায়িত্ব ছিল যে দেশেই যাবে সে দেশের মাটির সঙ্গে গুরু প্রদত্ত মাটির মিল আছে কিনা- তা পরীক্ষা করা, সমকক্ষতা নির্ণয় করা এবং সেই কঠিন কর্মটি তারা সম্পাদন করতেন ‘মাটি মুখ দিয়ে চেটে’।
যে দেশে মাটির মিল পাওয়া যাবে, সে দেশেই গোড়াপত্তন করে ইসলাম প্রচার শুরু হবে।
পায়ে হেঁটে অত হাজার মাইল পথ পাড়ি দিয়ে, কত দেশ ভ্রমণ, যুদ্ধ ও অভিজ্ঞতা সঞ্চয় করার পর গুরুর দেওয়ার মাটির সঙ্গে বাংলাদেশের শ্রীহট্টে মাটির ‘পারফেক্ট ম্যাচ’ হয়ে গেলো– বাকিটা ইতিহাস।
‘সিলট পরথম আজান ধ্বনি বাবা-ই দিয়াছে
ওরে সেই ধনীতে পাথর গইল্যা পানি হইয়াছে– হায়রে
সিলট পরথম আজান ধ্বনি বাবা-ই দিয়াছে’– অজ্ঞাত
কী ছিল সেই ইয়েমেনের মাটিতে এবং কেন, কীভাবে তার সঙ্গে শ্রীহট্টের মাটি মিলে গেলো? এ নিয়ে কি কোনও গবেষণা হয়েছে?
যে ধরিত্রী মায়ের গর্ভের মাটির ওপরে আমরা দাঁড়িয়ে আছি তার ‘মূল্য’ আসলেই কত, তা আমাদের কি আদৌ জানা আছে?
‘এই মাটিরই আমরা ফসল
নোংরা শেকড়-বাকড় না
মুখের ওপরে বলতে শিখুন
আমরা কারো চাকর না’– অনিক খান
আমাদের মাটিতে কি আছে তা বিজ্ঞান, প্রযুক্তি, সময়, ‘সুযোগ’ আর স্বকীয়তা দ্বারা কোনও এক উজ্জ্বল আগামীতে আমরা নিঃসন্দেহে উৎপাটন করবো।
শক্ত নিয়ত বেঁধে বুকে একরাশ আশা নিয়ে– আগামী সপ্তাহে ফের কথা হবে।
সে অবধি আল্লাহ আলেক সাঁই।
<চলবে>
লেখক: সংগীতশিল্পী