X
শুক্রবার, ২৯ মার্চ ২০২৪
১৪ চৈত্র ১৪৩০

‘জাতীয় সরকার’ গঠনের বাস্তবতা কতটুকু?

আমীন আল রশীদ
০১ নভেম্বর ২০২১, ১৬:৫৯আপডেট : ০১ নভেম্বর ২০২১, ১৬:৫৯

আমীন আল রশীদ ২০১৮ সালের ৩০ ডিসেম্বর অনুষ্ঠিত একাদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচনের আগে রাজনীতির মাঠে ‘অন্তর্বর্তী সরকার’ শব্দটি আলোচনায় আসে। কারণ, এর আগে ২০১৪ সালের ৫ জানুয়ারি অনুষ্ঠিত দশম জাতীয় সংসদ নির্বাচন হয়েছিল দলীয় সরকারের অধীনে এবং দেশের দ্বিতীয় বৃহত্তম দল বিএনপি ওই নির্বাচন বয়কট করে।

২০০৮ সালের ২৯ ডিসেম্বর নির্দলীয় তত্ত্বাবধায়ক সরকারের অধীনে নবম সংসদ নির্বাচন হলেও ২০১১ সালে সংবিধানের পঞ্চদশ সংশোধনীর মাধ্যমে তত্ত্বাবধায়ক সরকার ব্যবস্থা বাতিল করে দেওয়া হয়। ফলে দলীয় সরকারের অধীনে নির্বাচন করা ছাড়া আর কোনও উপায় থাকে না। যে কারণে সামনে আসে নির্বাচনকালীন অন্তর্বর্তী সরকারের ধারণা। কিন্তু কোনও একটি দল ক্ষমতায় থাকাকালীন, তাদের অধীনে কিংবা নির্বাচনকালীন ছোট মন্ত্রিসভার অধীনেও মাঠ প্রশাসন কতটা নিরপেক্ষভাবে নির্বাচনি দায়িত্ব পালন করতে পারবে— তা নিয়ে সংশয় তৈরি হয়।

কিন্তু বিদ্যমান সংবিধানের আলোকে ক্ষমতাসীন দল সরকারে থাকা অবস্থায় ২০১৪ ও ২০১৮ সালে যে দুটি জাতীয় সংসদ নির্বাচন হয়েছে, তা নিয়ে সমালোচনাও আছে। সম্ভবত সে কারণেই এবার দ্বাদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচনের তিন বছর আগে থেকেই ভোট নিয়ে রাজনীতির মাঠে আলাপ-আলোচনা শুরু হয়েছে। যে আলোচনায় সম্প্রতি সরকারবিরোধী ফোরাম থেকে দুটি বিষয় উত্থাপন করা হয়েছে; ১. ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় ছাত্র সংসদের সাবেক ভিপি নুরুল হক নুরের সঙ্গে যুক্ত হয়ে গণঅধিকার পরিষদ নামে একটি নতুন রাজনৈতিক দলের আত্মপ্রকাশ অনুষ্ঠানে দলের আহ্বায়ক রেজা কিবরিয়া জাতিসংঘের অধীনে আগামী জাতীয় সংসদ নির্বাচনের দাবি জানিয়েছেন এবং ২. জাতীয় সরকার গঠনের দাবি জানিয়েছেন গণস্বাস্থ্য কেন্দ্রের ট্রাস্টি ডা. জাফরুল্লাহ।

গত সেপ্টেম্বর মাসেও জাতীয় সরকার গঠনের দাবি জানিয়ে ডা. জাফরুল্লাহ কয়েকজনের নামও প্রস্তাব করেছিলেন। তিনি বলেন, ‘আওয়ামী লীগকে বাদ দিয়ে জাতীয় সরকার নয়। আওয়ামী লীগের পক্ষ থেকে শেখ রেহেনা, তার ছেলে (রেদওয়ান মুজিব সিদ্দিক ববি), তোফায়েল আহমেদ, মতিয়া চৌধুরী, বিএনপির যারা আছে তাদের নিয়ে আর আমরা সাধারণ মানুষ যারা আছি তাদের নিয়ে জাতীয় সরকার করুন।’ প্রশ্ন হলো, ডা. জাফরুল্লাহর ভাষায় ‘সাধারণ মানুষ’কে নিয়ে জাতীয় সরকার গঠনের প্রস্তাব কতখানি যৌক্তিক ও বাস্তবসম্মত? তিনি সাধারণ মানুষ বলতে কি সুশীল সমাজকে বুঝিয়েছেন, যাদের নিয়ে অতীতে তত্ত্বাবধায়ক সরকার গঠন করা হয়েছিল?

স্মরণ করা যেতে পারে, একাদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচন অনুষ্ঠানের নয় মাসের মাথায় ২০১৯ সালের ২৮ সেপ্টেম্বর গণফোরামের সাবেক সাধারণ সম্পাদক ড. রেজা কিবরিয়া স্বাক্ষরিত বিবৃতিতে জাতীয় ঐক্যফ্রন্টের পক্ষ থেকে যে তিনটি দাবি তুলে ধরা হয়, তার অন্যতম ছিল বর্তমান সরকারের পদত্যাগ করে জাতীয় সরকার ঘোষণা করা। এর কয়েক দিন পরে জাতীয় সমাজতান্ত্রিক দল (জেএসডি) সভাপতি আ স ম আবদুর রবও ‘জাতীয় সরকার’ গঠনের দাবি জানান। তার ভাষায় বিদ্যমান ‘অবৈধ’ সরকারের পদত্যাগের পর সাংবিধানিক শূন্যতা ও সংকট পূরণ করবে ‘জাতীয় সরকার’—যা গঠন করা হবে রাজনৈতিক দল, পেশাজীবী সমাজ ও বুদ্ধিজীবী শক্তিগুলোর সংলাপের মাধ্যমে।

প্রশ্ন হলো, একটি স্বাধীন সার্বভৌম দেশে জাতিসংঘের অধীনে নির্বাচন কতটা সম্মানজনক এবং বিদ্যমান সংবিধানের আলোকে ‘জাতীয় সরকার’ গঠন আদৌ সম্ভব কিনা? সেই সঙ্গে আরও যেসব প্রশ্ন সামনে আনা দরকার তা হলো, জাতীয় সরকার বলতে কী বোঝায়; এই সরকারে কারা যুক্ত থাকবেন; তাদের যোগ্যতা কী; কীভাবে তাদের নির্বাচন করা হবে; এর সঙ্গে তত্ত্বাবধায়ক সরকারের কোনও পার্থক্য আছে কিনা ইত্যাদি।

সবচেয়ে বড় প্রশ্ন, ক্ষমতাসীন আওয়ামী লীগ কেন এমন একটি সরকার গঠন করবে? এ রকম একটি সরকার গঠন করে তাদের অধীনে যদি একটি অবাধ, সুষ্ঠু, অংশগ্রহণমূলক ও গ্রহণযোগ্য নির্বাচন করা সম্ভব হয় এবং সেই নির্বাচনে যদি আওয়ামী লীগের পরাজয়ের শঙ্কা থাকে, তাহলে সে রকম একটি ব্যবস্থায় বর্তমান সরকার বা তার দল কেন যাবে? আওয়ামী লীগের মতো একটি দলকে এ রকম একটি সিদ্ধান্ত নিতে বাধ্য করার মতো রাজনৈতিক শক্তি কি এখন দেশে বিদ্যমান আছে?

বলা হয়, আন্দোলনের মাঠ যার দখলে থাকে, ভোটের মাঠও তার দখলে। গত প্রায় এক যুগ ধরে ক্ষমতাসীন আওয়ামী লীগের বিরুদ্ধে বিএনপি ও তার শরিক দলগুলো কোনও ইস্যুতে কি খুব জোরালো কোনও আন্দোলন গড়ে তুলতে সক্ষম হয়েছে? বিএনপির মাঠ পর্যায়ে সাংগঠনিক অবস্থা যে রকম দুর্বল হয়েছে, সেটি তারা কতটুকু কাটিয়ে উঠতে পারবে? নেতৃত্বের প্রশ্নে তাদের দলের ভেতরে যে বিশৃঙ্খলা ও অনৈক্য—সেটি এখন আর গোপন কোনও বিষয় নয়। সুতরাং আওয়ামী লীগের মতো একটি দলকে নির্বাচনকালীন অন্তর্বর্তী বা এমন একটি জাতীয় সরকার গঠনে বিএনপি বাধ্য করতে কতটা সক্ষম হবে, যা বিএনপি ও তার জোটকে ক্ষমতায় নিয়ে আসতে সহায়তা করবে—তা নিয়ে সংশয়ের যথেষ্ট কারণ আছে।

সংবিধানে অন্তর্বর্তী বা নির্বাচনকালীন সরকারের সুস্পষ্ট রূপরেখা না থাকলেও এ বিষয়ে কিছু ইঙ্গিত রয়েছে। ৫৬(৪) অনুচ্ছেদে বলা আছে: সংসদ ভেঙে যাওয়া এবং সংসদ-সদস্যদের অব্যবহিত পরবর্তী সাধারণ নির্বাচন অনুষ্ঠানের মধ্যবর্তীকালে কাউকে মন্ত্রী নিয়োগ করার প্রয়োজন দেখা দিলে সংসদ ভেঙে যাওয়ার অব্যবহিত আগে যারা সংসদ-সদস্য ছিলেন, তারা বহাল থাকবেন। তার মানে নির্বাচন সামনে রেখে যদি সংসদ ভেঙে দেওয়া হয় অথবা সংসদ বহাল রেখেই একটি নির্বাচনকালীন সরকার গঠন করা হয়, তারপরও সংসদ সদস্যরা তাদের পদে বহাল থাকবেন। আর ওই অন্তর্বর্তী মন্ত্রিসভার সদস্য নিতে হবে সংসদ সদস্যদের মধ্য থেকেই। ২০১৪ সালের ৫ জানুয়ারির নির্বাচনের আগে এ রকম একটি নির্বাচনকালীন মন্ত্রিসভা গঠিত হয়েছিল। তখন বিএনপি সংসদে থাকলেও তারা এই সরকারে তাদের কোনও প্রতিনিধি দেয়নি। এমনকি তারা ওই নির্বাচন বয়কট করে।

সংবিধানে সরাসরি নির্বাচনকালীন সরকারের কথা বলা না থাকলেও রাষ্ট্রপতি চাইলে একটি ছোট মন্ত্রিসভা গঠন করতে পারেন। আবার সংসদ বহাল থাকা অবস্থায় নির্বাচন নিয়ে যাতে জটিলতার সৃষ্টি না হয় সে বিধানও রয়েছে ৭২ অনুচ্ছেদে। অর্থাৎ একটি অধিবেশন শেষ হওয়ার ৬০ দিনের মধ্যে পরবর্তী অধিবেশন শুরুর বাধ্যবাধকতা থাকলেও ৭২ অনুচ্ছেদ অনুযায়ী নির্বাচনকালীন বা অন্তর্বর্তী সরকারের ওই ৯০ দিনের মধ্যে সংসদের অধিবেশন বসবে না।

কিন্তু মূল প্রশ্ন হলো, নির্বাচনের আগে সংসদ ভেঙে দিয়ে যদি ছোট আকারে নতুন মন্ত্রিসভা গঠন করা হয়, যেটির নাম অন্তর্বর্তী কিংবা জাতীয় সরকার, যাই হোক না কেন, তার প্রধান হিসেবে বর্তমান প্রধানমন্ত্রীর বাইরে অন্য কাউকে নিয়োগ দেওয়ার সুযোগ নেই। যদি করতে হয় তাহলে সংবিধান সংশোধন করতে হবে। বর্তমান ক্ষমতাসীন দল কেন সংবিধান সংশোধন করে এই ব্যবস্থা চালু করবে? তাছাড়া দেশ কি এমন কোনও ভয়াবহ অবস্থার মধ্যে আছে যে সংবিধান সংশোধন করে তত্ত্বাবধায়ক বা জাতীয় সরকার জাতীয় কিছু একটা গঠন করতে হবে? নাকি সে রকম একটা পরিস্থিতি তৈরির জন্যই সাম্প্রতিক দুর্গাপূজার সময়ে পূজামণ্ডপে সাম্প্রদায়িক সহিংসতার জন্ম দেওয়া হলো?

যে রাজনৈতিক পরিস্থিতিতে ১৯৯৬ সালে সংবিধান সংশোধন করে নির্দলীয় তত্ত্বাবধায়ক সরকারের বিধান যুক্ত করা হয়েছিল, সেই পরিস্থিতি কি এখন বিদ্যমান আছে বা সে রকম পরিস্থিতি কি আদৌ তৈরি করা সম্ভব?

জাতীয় সরকারের সুনির্দিষ্ট সংজ্ঞা ও রূপরেখা না থাকলেও বৃহত্তর রাজনৈতিক আন্দোলন ও জনদাবির মুখে, দেশে শান্তি ও স্থিতিশীলতা বহাল রাখার স্বার্থে এরকম একটি সরকার গঠন করা যেতে পারে। অনেক সময় মহামান্য রাষ্ট্রপতিও জরুরি অবস্থা জারির মধ্য দিয়ে অন্তর্বর্তী সরকার গঠন করতে পারেন যদি, দেশ কোনও ক্রান্তিকাল বা সংকটময় মুহূর্ত অতিবাহিত করে। কিন্তু দেশে এখন কি সেরকম কোনও ক্রান্তিকাল, ভয়াবহ সংকট বা সাংবিধানিক শূন্যতা বিরাজ করছে যে কারণে জাতীয় সরকার গঠন করতে হবে?

লেখক: কারেন্ট অ্যাফেয়ার্স এডিটর, নেক্সাস টেলিভিশন।

 

 

/এসএএস/এমওএফ/

*** প্রকাশিত মতামত লেখকের একান্তই নিজস্ব।

বাংলা ট্রিবিউনের সর্বশেষ
পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ে মানবাধিকার উইং চালুর পরামর্শ সংসদীয় কমিটির
পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ে মানবাধিকার উইং চালুর পরামর্শ সংসদীয় কমিটির
পণ্ড হলো না পরাগের শ্রম, দিল্লিকে হারালো রাজস্থান
পণ্ড হলো না পরাগের শ্রম, দিল্লিকে হারালো রাজস্থান
বাসের পেছনের অংশ খোয়া যাচ্ছে কেন?
বাসের পেছনের অংশ খোয়া যাচ্ছে কেন?
বিরল সূর্যগ্রহণ দেখতে নায়াগ্রা জলপ্রপাতে জড়ো হবেন ১০ লাখ দর্শনার্থী
বিরল সূর্যগ্রহণ দেখতে নায়াগ্রা জলপ্রপাতে জড়ো হবেন ১০ লাখ দর্শনার্থী
সর্বশেষসর্বাধিক

লাইভ