X
শুক্রবার, ২৯ মার্চ ২০২৪
১৫ চৈত্র ১৪৩০

এখনও বুদ্ধিজীবীরা কিছুই বলবেন না?

রুমিন ফারহানা
১১ জানুয়ারি ২০২২, ১৬:২৩আপডেট : ১১ জানুয়ারি ২০২২, ১৬:২৩

রুমিন ফারহানা ‘বিএনপি কি আন্দোলন করতে জানে?’, ‘বিএনপির আন্দোলন লুঙ্গি পরেই সামাল দেওয়া যায়’, ‘বিএনপি আন্দোলন করার মতো সুসংগঠিত নয়’, ‘বিএনপির আন্দোলনের সক্ষমতা নেই’, ‘বিএনপি বিরোধী দলের ভূমিকা যথাযথভাবে পালন করতে পারছে না’, ‘বিএনপির আন্দোলনে জনগণের সাড়া নেই’, ‘বিএনপি কর্মী নির্ভর দল নয়, সমর্থক নির্ভর দল’, ‘ভোট হলে ভোট পাবে কিন্তু ভোট আনার জোর বিএনপির নেই’– গত কয়েক বছরে টকশো টেবিলে, সভা-সমাবেশে আওয়ামী লীগসহ তথাকথিত বুদ্ধিজীবীরা এই কথাগুলোই বলে এসেছেন।

দেশের নির্বাচন সুষ্ঠু হচ্ছে না, দায় বিএনপির। ভোটের আগের রাতে ব্যালট বাক্স পূর্ণ হয়ে যাচ্ছে, দোষ বিএনপির। কারণ, তারা সেটা প্রতিহত করতে পারছে না। স্থানীয় থেকে জাতীয়, সব নির্বাচনেই ‘বিনা প্রতিদ্বন্দ্বিতার’ জয়জয়কার। কারণ, বিএনপি কোথাও প্রার্থী দেয়নি। আওয়ামী লীগ আর বিদ্রোহী প্রার্থীর মধ্যে তীব্র সহিংসতার দায় বিএনপির, কারণ তারা নির্বাচনে অংশ নেয়নি। এই কথাগুলো বিএনপিকে উদ্দেশ করে অহরহ বলা হয়।

দেশের একশ্রেণির বুদ্ধিজীবীর কথা শুনলে মনে হয় সরকার, নির্বাচন কমিশন, ক্ষমতাসীন দল সবার সব ব্যর্থতার দায়ভার একমাত্র বিএনপির। বিষয়টা হলো, বিএনপিকে গালি দিলে, তার ওপর দায় চাপালে পুরস্কার যদি নাও জোটে, অন্তত ডিজিটাল নিরাপত্তা আইনের বেড়াজালে জড়িয়ে পড়ার ভয় থাকে না। তাই নিরাপদে দাঁড়িয়ে বিএনপির সমালোচনাই সই।     

দেশনেত্রী বেগম খালেদা জিয়া প্রায় দুই মাস যাবৎ একটি বেসরকারি হাসপাতালে চিকিৎসাধীন। তার শারীরিক অবস্থার কোনও উন্নতি নেই। চিকিৎসকদের মতে উন্নত চিকিৎসার জন্য তাকে দেশের বাইরে নেওয়া প্রয়োজন। ফৌজদারি কার্যবিধির ৪০১ ধারা অনুযায়ী সরকার চাইলেই দেশের বাইরে তার চিকিৎসা হওয়া সম্ভব। এই বিষয়ে যেকোনও আলোচনায় একটি প্রশ্ন সবসময় করা হয়, আর তা হলো বিএনপি এখন কী করবে?

বাস্তবতা হলো, ৪০১ ধারা বাদ দিলে বিএনপির সামনে পথ থাকে দুটি। এক বিচারিক পথ, দুই আন্দোলন। বিচারিক পথের ক্ষেত্রে কিছু বিষয় পরিষ্কার। দেশে যদি নির্বাহী বিভাগের প্রভাবমুক্ত একটি স্বাধীন বিচার ব্যবস্থা থাকতো তাহলে বহু আগেই দেশনেত্রী বেগম খালেদা জিয়ার জামিনে মুক্ত হওয়ার কথা। জামিনের সব শর্ত পূরণ করা সত্ত্বেও তিনবারের সাবেক এই প্রধানমন্ত্রীর জামিন আবেদন নাকচ হয়েছে বারবার। যে মামলায় তাকে কারাগারে নেওয়া হয়েছে সেই ধরনের মামলায় জামিন হয় অহরহ। সুতরাং আন্দোলন ছাড়া তার ন্যূনতম মানবাধিকার রক্ষার আর কোনও পথ বিএনপির হাতে ছিল না।

এই আন্দোলনের অংশ হিসাবে জেলায় জেলায় সমাবেশের ডাক দিয়েছিল বিএনপি। সেই সমাবেশও পুলিশ, প্রশাসন আর সরকারি দলের পেটোয়া বাহিনীর অত্যাচারে সুষ্ঠুভাবে সম্পন্ন করা সম্ভব হয়নি। তার সঙ্গে যুক্ত হয়েছিল, অনেক জেলায় সরকারি চাপে পরিবহন মালিকরা গণপরিবহন বন্ধ করে দেওয়ার মাধ্যমে বিএনপি নেতাকর্মীদের সমাবেশস্থলে আসার পথে বাধা সৃষ্টি করেছিলেন।

একেক জায়গায় একেক কায়দায় সমাবেশ পণ্ড করে তারা। হবিগঞ্জের সমাবেশে আগত বিএনপি নেতাকর্মীদের ওপরে হামলা চালিয়ে অনেককে আহত করে পুলিশ। সিরাজগঞ্জে সমাবেশে আসার পথে বিএনপি নেতাকর্মীদের ওপরে ঝাঁপিয়ে পড়ে আওয়ামী লীগের ক্যাডার বাহিনী। এরপর সরকার নামে নতুন কৌশলে। কক্সবাজারে বিএনপি যে জায়গায় সমাবেশ ডেকেছিল, সেখানেই যুবলীগকে দিয়ে সমাবেশ ডাকিয়ে ১৪৪ ধারা জারি করে প্রশাসন। এরপর সমাবেশে আসা মানুষ অনেকটা ছত্রভঙ্গ হয়ে যাবার পর ভিন্ন একটি স্থানে সংক্ষিপ্ত সভা করতে দেওয়া হয় বিএনপিকে।

কক্সবাজারের সেই মডেল অনুসরণ করা হয় আমার জেলা ব্রাহ্মণবাড়িয়ায়ও। সেখানেও আমাদের ডাকা সমাবেশস্থলে ছাত্রলীগকে দিয়ে সমাবেশ ডাকিয়ে ১৪৪ ধারা জারি করা হয়। সকাল সাড়ে ৭টায় রওনা হয়ে দুপুর সাড়ে ১১টা নাগাদ ভৈরব পৌঁছলে সেতুর টোল প্লাজার কাছে পুলিশের একটি বিরাট বহর আমার গাড়ির পথরোধ করে। অতিরিক্ত পুলিশ সুপার, ওসি, ইউএনও, ম্যাজিস্ট্রেটসহ প্রায় শ’খানেক পুলিশ ঘিরে ফেলে আমাকে। তাদের একটাই দাবি, আমাকে ঢাকায় ফিরে যেতে হবে। বারবার কারণ জিজ্ঞেস করেও যৌক্তিক কোনও উত্তর পাইনি আমি। আমাকে প্রায় আড়াই ঘণ্টা অবরুদ্ধ করে রাখে তারা। শেষে বহু বাগবিতণ্ডার পর আমাকে ছেড়ে দিলেও পুরোটা সময়ই পুলিশ ঘিরে রাখে আমাদের। সভার স্থান পরিবর্তন করে গ্রামের ভেতর ছোট্ট একটি জায়গা নির্ধারণ করা হয়। আমাদের মাইকও নিয়ে যায় প্রশাসন। আগের রাতেই গ্রেফতার করা হয় আমাদের নেতাকর্মীদের। সার্বিক পরিস্থিতিতে যেমন সমাবেশ হবার প্রস্তুতি ছিল তেমনটি আর করা সম্ভব হয়নি।

এভাবেই পুলিশি বাধার কারণে পন্ড হয় বিএনপির ডাকা সমাবেশগুলো। সভা, সমাবেশ করা সব রাজনৈতিক দলের সাংবিধানিক অধিকার। সংবিধানের ৩৭ অনুচ্ছেদ অনুযায়ী ‘জনশৃঙ্খলা বা জনস্বাস্থ্যের স্বার্থে আইনের দ্বারা আরোপিত যুক্তিসঙ্গত বাধানিষেধ-সাপেক্ষে শান্তিপূর্ণভাবে ও নিরস্ত্র অবস্থায় সমবেত হইবার এবং জনসভা ও শোভাযাত্রায় যোগদান করিবার অধিকার প্রত্যেক নাগরিকের থাকিবে।’ বিএনপির ডাকা এই সমাবেশগুলোর প্রতিটিই ছিল শান্তিপূর্ণ। জনশৃঙ্খলা বা জনস্বাস্থ্যের প্রতি হুমকির কোনও আশঙ্কা কোথাও ছিল না। প্রতিটি সমাবেশের আগে যেভাবে গ্রেফতার, বাড়ি বাড়ি তল্লাশি, নেতাকর্মীদের ভয়ভীতি দেখানো হয়েছে, সেটি তাদের সাংবিধানিক অধিকারকে চরমভাবে ক্ষুণ্ণ করেছে।

ওদিকে আওয়ামী লীগের নিজেদের একটি সংগঠনকে দিয়ে বিএনপির আহ্বান করা স্থানে সমাবেশ ডাকার বিরুদ্ধেই প্রশাসনের অবস্থান নেওয়ার কথা ছিল। দেশে ন্যূনতম আইনের শাসন থাকলে পর্যাপ্ত নিরাপত্তার ব্যবস্থা করে বিএনপিকে জনসভা করতে দেওয়া হতো। এখানে যেভাবে ১৪৪ ধারা জারি করে জনসভা পণ্ড করা হয়েছে সেটাও আইনের চরম অপব্যবহার। বিরোধী দল দমনে আইনকে অস্ত্র হিসেবে ব্যবহারের (ওয়েপনাইজেশন অব ল) এক প্রকৃষ্ট উদাহরণ এটি।

বিএনপির বিরুদ্ধে বহুল ব্যবহৃত প্রপাগান্ডাগুলোর একটি হলো, বিএনপি আন্দোলনের নামে ‘আগুন সন্ত্রাস’ করে। এই কথাটি বিএনপির বিরুদ্ধে তার প্রধান প্রতিপক্ষ আওয়ামী লীগ যেমন ব্যবহার করে, তেমনি দেশের তথাকথিত বুদ্ধিজীবী, সুশীল সমাজের অনেকেই কথাটি বলে এক ধরনের তৃপ্তি পায়। যদিও ২০১৩, ২০১৪, ২০১৫ সালের পত্রিকা ঘাঁটলে যুবলীগ, ছাত্রলীগ, স্বেচ্ছাসেবক লীগ নেতাকর্মীদের নাম পাওয়া যায়। বিভিন্ন সময় আলোচনায় এই প্রসঙ্গে যখন আমি প্রশ্ন তুলেছি, কোনও সদুত্তর পাইনি।

আশ্চর্যের বিষয় হলো, তথাকথিত আগুন সন্ত্রাসের মামলাগুলোর রায় হওয়া দূরেই থাকুক, চার্জশিট পর্যন্ত দেওয়া হয়নি অধিকাংশ ক্ষেত্রে। কেবল রাজনৈতিকভাবে বিএনপিকে প্রশ্নবিদ্ধ করাই ছিল এই মামলাগুলোর উদ্দেশ্য। বিএনপির বিরুদ্ধে এই প্রপাগান্ডা কেবল যে আওয়ামী লীগ ছড়িয়েছে তা নয়; এই প্রপাগান্ডা প্রচারে বুদ্ধিজীবী, সুশীল সমাজও পিছিয়ে ছিল না।

সাংবিধানিক অধিকার থাকলেও আজ বিএনপি কোনও অবরোধ কিংবা হরতালের ডাক দেয়নি। এমনকি রাস্তায় মিছিলও করছে না। কিছু জেলায় কেবল কিছু সমাবেশ করতে চেয়েছে। কয়েকটি জেলায় সমাবেশ হতে পেরেছে এবং সেগুলো জনসমুদ্রে পরিণত হলেও বরাবরের মতোই বিএনপি নেতাকর্মীরা সুশৃঙ্খলভাবে সমাবেশে অংশ নিয়েছে। এরপরও যখন বিএনপির জনসভায় সরকার নানাভাবে বাধা দিয়ে সেগুলো পণ্ড করার চেষ্টা হয়েছে, তখন বিএনপির গণতান্ত্রিক অধিকার হরণের বিরুদ্ধে তথাকথিত বুদ্ধিজীবীদের কাউকে টুঁ-শব্দটি করতে দেখি না। বিএনপিকে সমর্থন করার দরকার নেই, কিন্তু দেশের একটি বৃহৎ রাজনৈতিক দলের সাংবিধানিক এবং আইনি অধিকারের পক্ষে দাঁড়ানো কি তাদের কর্তব্য ছিল না?

বাংলাদেশের দুর্ভাগ্য, আমরা সাদাকে সাদা, কালোকে কালো বলার মতো মানুষ হারিয়ে ফেলছি দ্রুত। ক্ষুদ্র, ক্ষুদ্র স্বার্থ আর তুচ্ছ সুবিধার হিসাব-নিকাশে পালটে গেছে দেশের বুদ্ধিজীবীদের চরিত্র।

তারা যে পরিমাণ সবক বিএনপিকে দেয় তার সিকি পরিমাণ যদি ভোট ডাকাতি, মানবাধিকার লঙ্ঘন, আইনের শাসনের ঘাটতির বিরুদ্ধে তুলতেন, তাহলে দেশ আজকের অবস্থায় এসে দাঁড়ায় না। কিন্তু এখনও তারা কিছুই বলবেন না।

লেখক: আইনজীবী, সুপ্রিম কোর্ট। সংরক্ষিত আসনের সংসদ সদস্য ও বিএনপি দলীয় হুইপ।

/এসএএস/এমওএফ/

*** প্রকাশিত মতামত লেখকের একান্তই নিজস্ব।

বাংলা ট্রিবিউনের সর্বশেষ
ইউক্রেনের শান্তি পরিকল্পনা অর্থহীন: ল্যাভরভ
ইউক্রেনের শান্তি পরিকল্পনা অর্থহীন: ল্যাভরভ
বিএনপির নিগৃহীত নেতাকর্মীদের তালিকা চাইলেন ওবায়দুল কাদের
বিএনপির নিগৃহীত নেতাকর্মীদের তালিকা চাইলেন ওবায়দুল কাদের
৭ বছর পর নজরুল বিশ্ববিদ্যালয়ে ছাত্রলীগের নতুন কমিটি
৭ বছর পর নজরুল বিশ্ববিদ্যালয়ে ছাত্রলীগের নতুন কমিটি
‘ভারতের কঠোর অবস্থানের কারণেই পিটার হাস গা ঢাকা দিয়েছেন’
‘ভারতের কঠোর অবস্থানের কারণেই পিটার হাস গা ঢাকা দিয়েছেন’
সর্বশেষসর্বাধিক

লাইভ