X
বৃহস্পতিবার, ২৫ এপ্রিল ২০২৪
১১ বৈশাখ ১৪৩১

সার্চ কমিটি ও আগামী নির্বাচন

স্বদেশ রায়
১৫ ফেব্রুয়ারি ২০২২, ১৮:৩০আপডেট : ১৫ ফেব্রুয়ারি ২০২২, ১৯:২৩

স্বদেশ রায়

নির্বাচন কমিশন গঠনে সার্চ কমিটির ক্ষমতা নিয়ে নতুন আইনে যা বলা হয়েছে, তাতে তাদের কাজ শেষ হয়ে যাবে- দশটি নাম নির্দিষ্টকরণ করে রাষ্ট্রপতির কাছে দেওয়ার পরে। রাষ্ট্রপতি তারপরে সংবিধান অনুযায়ী নির্বাচন কমিশন গঠন করবেন। কিন্তু আইন পালনের সব থেকে বড় বিষয় হলো বাস্তবতার দিকে চোখ রেখে আইনকে ব্যবহার করা। এবং যতদূর সম্ভব বাস্তবতাকে মোকাবিলা করতে পারবে বা সমস্যা সমাধান করতে পারবে, এমনভাবেই আইন পালন করা।

এবারের সার্চ কমিটি নির্বাচন কমিশন গঠনের জন্যে তৈরি আইন অনুযায়ী হলেও, এর আগে দুটো সার্চ কমিটি কাজ করেছে। এবার সার্চ কমিটি অনেক বেশি সংখ্যক বিভিন্ন পেশাজীবীর সঙ্গে মতবিনিময় করলেও মতবিনিময় করতে পারেনি দেশের অন্যতম বৃহৎ রাজনৈতিক দল বিএনপি, দেশের অনেক পুরানো দল সিপিবিসহ বেশ কয়েকটি রাজনৈতিক দলের সঙ্গে। তারা সার্চ কমিটিকে নির্বাচন কমিশন গঠন করার জন্যে কোন নামও দেননি।

খুব সহজে একটা কথা বলা যায়, সময় বসে থাকে না। সময় তার নির্দিষ্ট গতিতে এগিয়ে চলে। তাই বিএনপি বা সিপিবির মতো রাজনৈতিক দল এই নির্বাচন কমিশন গঠনের প্রক্রিয়ায় না এলেও নির্বাচন কমিশন গঠন হবে। কিন্তু যে বিষয়টি এখানে সামনে আসে তা হলো, এই নির্বাচন কমিশন গঠনের কাজটি রাজনৈতিক। যদিও সুশীল সমাজের অনেকে রাজনৈতিক দলের দেওয়া নামকে বাদ দিতে বলেছেন। তাঁদের হয়তো কোনও হিসাব-নিকাশ আছে। তাঁরা হয়তো রাজনৈতিক প্রতিষ্ঠানগুলোর বিরাজনীতিকরণের ভয়াবহতা নিয়ে অন্যভাবে ভাবছেন। তবে ভারতের বহুল আলোচিত ও পরবর্তী সময়ে বিজেপির রাষ্ট্রপতি মনোনয়ন প্রার্থী সাবেক প্রধান নির্বাচন কমিশনার টি এন সেশন যখন রাজনীতিবিদদের বেশ কিছুটা তুচ্ছ-তাচ্ছিল্য করে কথা বলছিলেন, তখন তারই নির্বাচন কমিশনের সদস্য, পরবর্তী সময়ে প্রধান নির্বাচন কমিশনার মি. গিল এক মন্তব্যে বলেছিলেন, তিনি বলেছিলেন, ‘আমাদের রাজনীতিবিদদের প্রতি শ্রদ্ধা রাখতে হবে। শেষ বিচারে তারাই দেশ পরিচালনা করবেন।’ মি. গিল যখন এই মন্তব্য করেছিলেন তখন যে ভারতের রাজনীতিবিদরা খুব শ্রদ্ধার আসনে ছিলেন তা নয়। প্রায় বর্তমানেরই মতো। তখনও খুনের আসামিরা পার্লামেন্ট সদস্য হতো। এবং জাত, পাত ধর্মে মানুষকে বিভক্ত করে কৌশলে রাজনীতিকরা নির্বাচনি বৈতরণী পার হতেন। আর দুর্নীতি তো ছিলই।

বাংলাদেশেও রাজনীতিবিদরা সেই সত্তর দশকের শ্রদ্ধার আসনে নেই। এখন সকলে ধর্ম ব্যবসাকে রাজনীতির ভোটে ও ক্ষমতা জোটে কাজে লাগান। আর পার্লামেন্টের সদস্যদের চরিত্র ভারতীয় বা পাকিস্তানের পার্লামেন্টের সদস্যদের থেকে খুব ভালো কিছু নয়। তাছাড়া দুর্নীতি ও রাজনীতিক শব্দটি প্রায় একসঙ্গে উচ্চারিত হয়। কিন্তু প্রশ্ন হলো, সমাজের অন্য জায়গাগুলো দিয়ে কি পবিত্র ঝরনার জল প্রবাহিত হচ্ছে। যারা মতামত দিচ্ছেন, তাদের ক’জনের শরীর দুধ দিয়ে ধোয়া? তাই গোটা সমাজ যেভাবে প্রবাহিত হচ্ছে রাজনীতি ও রাজনীতিবিদরাও সেভাবে প্রবাহিত হচ্ছেন। কেউ হয়তো বলতে পারেন, রাজনীতিবিদদের তো দায়িত্ব ছিল সমাজের এই ধারা বন্ধ করা। যেখানে বিশ্ববিদ্যালয়ের ভিসি, সম্পাদকীয় টেবিলের সম্পাদক থেকে শুরু করে মিটার রিডার অবধি একই ধারায় প্রবাহিত হয়, সেখানে একটি শ্রেণির বা একটি পেশার ওপর বেশি আশা করা ঠিক নয়। তাছাড়া সামরিক শাসনের আঘাতে, লোভের আঘাতে আর অদক্ষতার কারণে প্রতিটি প্রতিষ্ঠানের ইটগুলো যখন একটু একটু করে আলগা হয়ে যায়, তখন সমাজ ও রাষ্ট্রকে সংশোধন করতে সময়ের প্রয়োজন পড়ে। আর সেই প্রয়োজনীয় সময় শেষে যে প্রজন্মই হোক না কেন, সেই প্রজন্মের রাজনীতিবিদদেরই এ কাজ করতে হবে। তাই রাজনীতিবিদদের, রাজনৈতিক দলকে বাইরে রেখে সময়কে চালিত হতে দেওয়া ঠিক নয়।

এই যে ঠিক নয়, তা গত নির্বাচনের আগে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা দেখিয়েছিলেন। নির্বাচনের জন্যে তৈরি হওয়া বিরোধী জোটের নেতা ড. কামাল হোসেন তাঁর সঙ্গে সংলাপে বসার জন্যে চিঠি দিতেই তিনি সেই সংলাপে রাজি হন এবং সংলাপে বসেন। সংলাপ শেষে ড. কামাল হোসেন কিন্তু বলতে পারেননি যে সংলাপ ব্যর্থ হয়েছে বা তিনি অসন্তুষ্ট হয়েছেন। বরং সন্তুষ্ট চিত্তে তিনি নির্বাচনে গিয়েছিলেন। তারপরে যে নির্বাচন হয় ওই নির্বাচনকে কামাল হোসেন প্রশ্নবিদ্ধ নির্বাচন বলেছিলেন। বলেছিল পশ্চিমা গণতান্ত্রিক অনেক রাষ্ট্রও। ভবিষ্যতের ইতিহাস যারা লিখবেন, তারা ঠিকই খুঁজে বের করবেন, ওই নির্বাচন যে শতভাগ নির্বাচন হতে পারেনি, তার জন্যে শুধু রাজনীতিবিদরা, শুধু সরকার প্রধান শেখ হাসিনা দায়ী ছিলেন না। অনেক কিছু ছিল এর সঙ্গে, হয়তো ভবিষ্যতে খুঁজে পাওয়া যাবে। কার ভুল তাও সেদিন বেরিয়ে আসবে। আর সে ভুলের মাশুল কাকে কতটা দিতে হবে তাও ভবিষ্যৎ বলবে।

যাহোক, অতীতের থেকে এখন গুরুত্বপূর্ণ হচ্ছে দুই বছরের কম সময়ের মধ্যে যে নির্বাচন অনুষ্ঠান হবে সেই নির্বাচন। আর সেই নির্বাচনের জন্যে গঠিত নির্বাচন কমিশন। নির্বাচন কমিশন গঠনের বলটি সার্চ কমিটি এখনও রাষ্ট্রপতির কোর্টে দিয়ে দেননি। তাই ধরে নেওয়া যায়, যেসব নাম প্রকাশ হয়েছে এর বাইরে সার্চ কমিটি হয়তো আরও নতুন নাম যোগ করতে পারেন। কারণ, তারা মোটেই বাধ্য নন এই নামগুলোর ভেতর দিয়ে নাম দেওয়া। তারা হয়তো আরও নতুন নাম যোগ করে সেখান থেকে দশ জনকে বেছে নেবেন। তাই তাদের কাছে বল থাকার এই অবস্থায় বলা যায়, বলটি তিনটি কোর্টে এখনও গড়াবে, সার্চ কমিটি, রাষ্ট্রপতি ও তাকে পরামর্শদাতা প্রধানমন্ত্রী। সার্চ কমিটির রাজনৈতিক উদ্যোগ নেওয়ার খুব বেশি সুযোগ নেই। তবে রাষ্ট্রপতি ও প্রধানমন্ত্রীর রাজনৈতিক উদ্যোগ নেওয়ার সময় আছে বা তারা সৃষ্টি করে নিতেও পারেন। বা এই তিনটি কোর্ট মিলে এখনও একটি রাজনৈতিক সমাধানের উদ্যোগ নিতে পারেন।

অনেকে বলছেন, কোনও দল যদি এ প্রক্রিয়ায় না আসে, কোনও দল যদি এ নির্বাচনে অংশ না নেয়, তারপরেও নির্বাচন বসে থাকবে না। নির্বাচন ঠিকই হয়ে যাবে। এবং তারাই শুধু  মূল স্রোত থেকে ছিটকে পড়বে, যারা নির্বাচন থেকে দূরে থাকবেন। বাস্তবে বাংলাদেশের অর্থনীতির গুরুত্ব এবং অর্থনীতির সঙ্গে সংশ্লিষ্টদের ভূমিকা রাজনীতিতে এখন অনেক বড়। তারপরে রয়েছে আন্তর্জাতিক রাজনীতির এই নতুন মেরুকরণের সময় বাংলাদেশের ভূ-রাজনৈতিক গুরুত্ব। এই দুই মিলে সত্যি অর্থে আগামী নির্বাচনের রথের চাকা থামিয়ে দেওয়ার শক্তি কারও নেই। তবে এ সত্য মানতে হবে, নির্বাচনের রথের চাকা থামাতে না পারলেও দুটো ঘটনা ঘটে। এক, নির্বাচন থেকে অনেক মানুষ দূরে চলে যায়। নির্বাচনের মানুষের অংশগ্রহণ কমে যায়। দুই, যখনই গণতান্ত্রিক দেশে নির্বাচনি প্রক্রিয়া থেকে মানুষ দূরে চলে যায় তখনই অরাজনৈতিক আচরণ বড় হয়ে ওঠে রাষ্ট্রে। আর বাংলাদেশে সেই অরাজনৈতিক আচরণ খুব বড় আকারে আছে। এখানে ধর্মীয় মৌলবাদ দিন দিন পুষ্ট হচ্ছে। নির্বাচনের সঙ্গে বা রাজনীতির সঙ্গে ধর্মীয় মৌলবাদ যোগ করলে কী ভয়াবহ অবস্থা হয় তা আমরা ভারতে দেখছি প্রতি মুহূর্তে। আবার নির্বাচন প্রক্রিয়ায় মানুষকে না এনে তাদের অনেক বেশি অগণতান্ত্রিক বিষয়ের দিকে ঠেলে দিলে তারাও কী ভয়াবহ হয় তা আমরা দেখতে পাচ্ছি। যদিও এ মুহূর্তে বাংলাদেশে জঙ্গিবাদ কম, কিন্তু মানুষের মনোজগৎ প্রতি মুহূর্তে দখল করছে ধর্মীয় মৌলবাদ। এর অন্যতম বড় কারণ হলো, দেশের সব মানুষকে গণতান্ত্রিক রাজনীতির সঙ্গে শুদ্ধভাবে যোগ করা সম্ভব হচ্ছে না।

তাই নির্বাচন কমিশন গঠনের আগে ভাবতে পারলে সব থেকে ভালো হয়, কীভাবে দেশের সব মানুষ ও রাজনৈতিক শক্তিকে নির্বাচনি গণতন্ত্রে আনা যায়। এবং প্রভাবমুক্ত স্বাধীন নির্বাচনি প্রক্রিয়া কীভাবে আবার ফিরিয়ে আনা যায়। যারা বলেন, দলীয় সরকারের অধীনে নির্বাচনে এটা ফিরবে না, তারা পুরোপুরি ভুল বলেন। কারণ, নির্বাচনকে সব প্রভাবমুক্ত করতে পারে রাজনৈতিক দল ও তাদের সংগঠনের সঙ্গে সংযুক্ত জনগণ। তত্ত্বাবধায়ক সরকার কখনোই সুষ্ঠু নির্বাচনের কোনও উপায় নয়। তত্ত্বাবধায়ক সরকারের ইতিহাস বলে, যে দল আন্দোলন করে বিজয়ী হয়ে তত্ত্বাবধায়ক সরকার প্রতিষ্ঠা করতে পারে, তারাই নির্বাচনে জেতে। অর্থাৎ নির্বাচনে যাবার আগে যারা বিজয় অর্জন করে তারাই বিজয়ী হয়।

বাংলাদেশকে এই আন্দোলনের মাধ্যমে আগে বিজয়ী হয়ে বিজয়ীর প্রতীক নিয়ে নির্বাচনে গিয়ে নির্বাচনে জয়লাভ করার ধারা থেকে বের হয়ে আসতে হবে। উন্নয়নমূলক কাজ, অধিকতর আধুনিক উন্নয়নের প্রতিশ্রুতি ও সর্বোপরি সঠিক রাজনৈতিক সংস্কৃতি গড়ে তোলার প্রতিশ্রুতি ও আচরণের মাধ্যমে নির্বাচনে জয়লাভ করার কালচার এখনই গড়ার সময়। পাশাপাশি সে কালচারও গড়তে হবে অন্যান্য গণতান্ত্রিক দেশের মতো, যাতে প্রশাসনসহ যারাই নির্বাচনের সঙ্গে জড়িত থাকে, তাদের কাছে রাষ্ট্র ও জনগণ বড় থাকবে।

সার্চ কমিটির হাতে যে সময় আছে তাতে তারা সব দলের দেওয়া নাম নিয়ে তাদের দশ জনের লিস্ট সরকারের কাছে পাঠাতে পারবে কিনা তা বলা যাচ্ছে না। তবে রাষ্ট্রপতিও প্রধানমন্ত্রী দুজনেই রাজনীতিবিদ। রাজনীতির হাত অনেক লম্বা, অনেক নমনীয়, অনেক শোভনীয় আপসের টেবিলে। তাই সে টেবিলের দুই পাশের চেয়ার এখনই উঠে যাচ্ছে না। বরং তারা সেখানে সবাইকে বসিয়ে, সবাইকে নিয়ে আগামী নির্বাচন করবেন- সেটাই দেশের প্রতিটি সুস্থ নাগরিকের কাম্য। আর সেই কাজটির কোনও বাধা যেন না হয় এমন নির্বাচন কমিশন গঠিত হোক, এটাই এ মুহূর্তের সব থেকে বড় বিষয়।    

লেখক: রাষ্ট্রীয় পদকপ্রাপ্ত সাংবাদিক

/এসএএস/এমওএফ/

*** প্রকাশিত মতামত লেখকের একান্তই নিজস্ব।

বাংলা ট্রিবিউনের সর্বশেষ
চার বছরেও পাল্টায়নি ম্যালেরিয়া পরিস্থিতি, প্রশ্ন নিয়ন্ত্রণ পদ্ধতি নিয়ে
চার বছরেও পাল্টায়নি ম্যালেরিয়া পরিস্থিতি, প্রশ্ন নিয়ন্ত্রণ পদ্ধতি নিয়ে
দিল্লিকে ভয় ধরিয়ে হারলো গুজরাট
দিল্লিকে ভয় ধরিয়ে হারলো গুজরাট
ডিইউজে নির্বাচনে সভাপতি পদের মীমাংসা মামলার শুনানি ২৫ এপ্রিল
ডিইউজে নির্বাচনে সভাপতি পদের মীমাংসা মামলার শুনানি ২৫ এপ্রিল
জুড়ী উপজেলা চেয়ারম্যান প্রার্থীকে মারধরের অভিযোগ
জুড়ী উপজেলা চেয়ারম্যান প্রার্থীকে মারধরের অভিযোগ
সর্বশেষসর্বাধিক

লাইভ