X
শুক্রবার, ২৯ মার্চ ২০২৪
১৫ চৈত্র ১৪৩০

‘আমায় ডেকো না’: রাষ্ট্র সার্টিফিকেট বোঝে, মানুষ বোঝে না!

আহসান কবির
২৪ ফেব্রুয়ারি ২০২২, ১৫:০৯আপডেট : ২৪ ফেব্রুয়ারি ২০২২, ১৫:০৯

আহসান কবির ‘ফেরা’ নিয়ে তাঁর ঘোর ছিল। তিনি ফিরতে চাইতেন কাজে, জীবনেও! বহুবার বলেছেন– ফিরে আসাটাই জরুরি। ফিরতে কি পেরেছেন কখনও? নাকি কোনও এক বিষণ্ন বেদনায় স্কুল পালানোর মতো জীবন থেকে পালাতেন নিয়মিত?  লাকী আখান্দের সুর ও কণ্ঠে কাওসার আহমেদ চৌধুরীর একটা গান আছে এমন– ‘পলাতক আমি বহু জনপদ ঘুরে/ আবার এলাম তোমার কাছে ফিরে/ পেরিয়ে এসেছি অজস্র বাধা সময়ের হাত ধরে/ এসেছি আবার ভোরের স্নিগ্ধ আলো ভরা তোমার এই ছোট্ট ঘরে…’

সময়ের হাত ধরে অজস্র বাধা পেরিয়ে তিনি হয়তো চলেই গেলেন। প্রায় একই সময়ে লেখা তাঁর ‘ধুন্দুমার’ জনপ্রিয় আরেকটা গানের কথা এমন-‘বিবাগী এই মন নিয়ে জন্ম আমার/ যায় না বাধা আমাকে কোনও পিছু টানের মায়ায়/ আমায় ডেকো না/ ফেরানো যাবে না...’

ঘোর থাকলেও তিনি কখনও ফিরতে পারেননি। জীবনে চলার পথে ছিলেন প্রায় ‘দলছুট’! প্রায় একা একা একটা মানুষ বিচিত্র রকম জীবন-যাপন করতেন। শেষ করতে না পারা কথাটা আমি বহুবার তাঁর কাছ থেকে শুনেছি। বলতেন–‘ফিরতে যে পারি না তার বড় কারণ আমি কোনও কিছু শেষ করতে পারি না। দিন আসে কিন্তু প্রতিদিন মনে হয় আমি শুধু রাত হয়ে যাই! রাতটা আসলে আঁকতে চাই। ঘুম আসে না বলে রাতের নিস্তব্ধতা আঁকি!’

হয়তো সত্যি সত্যি রাতের নিস্তব্ধতা আঁকতে চাইতেন জীবনে। একটা কবিতার বই বের হয়েছিল তাঁর। নাম ছিল- ‘ঘুম কিনে খাই’। না ঘুমালে মানুষ বাঁচে না। তিনি কি সত্যি ঘুম কিনে খেতেন?

না। তাঁকে আর ঘুম কিনে খেতে হবে না। একারণে বেশিদূরেও তাঁকে যেতে হয়নি। জীবনের বহু বছর তিনি আজিমপুরে থেকেছেন। আজিমপুর কেন? এই প্রশ্নের উত্তরে বলতেন–‘কবরের ঘ্রাণ পাই! কবরের মতো একা মানুষদের কেউ ভালোবাসে নারে!’

শেষ শয্যাটা তাঁর আজিমপুরেই হয়েছে। কবরে থাকলে কি অন্য কবরের ঘ্রাণ পাওয়া যায়? কবর কি সব একা মানুষের বন্ধু? আজিমপুরে থাকার কারণে কি একদা লাকী আখান্দের সাথে তাঁর বন্ধুত্ব হয়েছিল? সঙ্গীতে সৃষ্টিশীল আড্ডা কিংবা বন্ধুত্বটাই আসল। পৃথিবীজুড়ে সুরকার আর গীতিকারদের আড্ডার প্রচুর গল্প আছে। মানুষ চলে গেলেও গল্প হয়ে যায়। লাকী আখান্দ আর কাওসার আহমেদ চৌধুরীর গানের গল্পগুলো দারুন। দিন যাবে কিন্তু গানগুলো থেকে যাবে বহুবছর। কালজয়ী গান নাকি জন্ম নেয় না। কালজয়ী সঙ্গীতের জন্ম হয় স্বর্গে। স্বর্গ থেকে লাকী আখান্দ ও কাওসার আহমেদ চৌধুরীর কাছে কিছু গান এসেছিল। যেমন –‘আমায় ডেকো না/ ফেরানো যাবে না’, ‘পলাতক আমি’, ‘আজ এই বৃষ্টির কান্না দেখে’, যেখানেই সীমান্ত তোমার’। ‘কবিতা পড়ার প্রহর এসেছে রাতের নির্জনে…’ ইত্যাদি।

কবিতা পড়ার প্রহর আসলেও কিংবা জ্যোৎস্নার রাতে ঘুম না আসলেও তিনি সহজে শেষ করতে পারতেন না।

কলেজ পাস করে ভর্তি হয়েছিলেন চারুকলায়। শেষ করতে পারেননি। মুক্তিযুদ্ধে অংশ নিয়েছিলেন। কাব্য করে বলতেন–‘অস্ত্র জমা দিয়েছি, ট্রেনিং না। সার্টিফিকেট নেইনি!’ নিলে হয়তো ওটা শেষ হয়ে যেত। আজিমপুরে শেষ যাত্রার আগে তাই বাজেনি কোনও বিদায়ী বিউগল। দিতে আসেনি কেউ গান স্যালুট। রাষ্ট্র শেষমেষ হয়তো সার্টিফিকেটটাই বোঝে, মানুষ বোঝে না।

হয়তো একারণেই সিনেমায় গান লেখা হতো এভাবে– ‘হয়তো ইতিহাসে তোমাদের নাম লেখা রবে না!’ শ্রদ্ধেয় কাওসার আহমেদ চৌধুরী মানুষের হৃদয় থেকে আপনার নাম কেউ মুছতে পারবে না। দুঃখ শুধু এই বাঙালি নিজেই বাংলা গানের শক্তি জানে না। আপনি পুরোপুরি জেনেও ছিলেন নিভৃতচারি। গানের শুদ্ধতায় আপনি নীরব একটা জীবনই বেছে নিয়েছিলেন। শেষযাত্রায়ও ছিলেন অনেকটা একাকী।

একাকী-ই ছিলেন আপনি। সামিনা চৌধুরী ও তার ভাই পঞ্চম ছাড়া আপনার শেষযাত্রায় আর কোনও গানের মানুষ দেখা যায়নি। দেখা যায়নি গীতিকার বা তার গান গেয়েছেন এমন শিল্পীদের।  চোখের জল মুছতে দেখা গেছে সঙ্গীত পরিচালক ফোয়াদ নাসের বাবুকে। অনেকেই জানে না যে জনপ্রিয় বাংলা ব্যান্ড ‘ফিডব্যাক’ এর শুরুর দিকের অনেক জনপ্রিয় গান কাওসার আহমেদ চৌধুরীর লেখা। যেমন-‘একঝাঁক প্রজাপতি ছিলাম আমরা’, ‘কেন খুলেছ তোমার জানালা’, ‘মৌসুমী বলো কারে খোঁজ তুমি’। বাংলাদেশ টেলিভিশনে প্রচারিত তুমুল জনপ্রিয় ম্যাগাজিন অনুষ্ঠান ‘ইত্যাদি’তে-‘এই দেশে এক শহর ছিল/ শহরে এক রাস্তা ছিল/ রাস্তার ধারে এক বাড়ি ছিল/ বাড়ির নাম এলোমেলো…’ এই গান দিয়ে নাফিস কামাল নামের এক নবীন শিল্পী পরিচিতি পেয়ে গিয়েছিলেন। এই গানটাও লিখেছিলেন কাওসার আহমেদ চৌধুরী!

বাড়ির নাম ‘এলোমেলো’, কারণ সেটা তাঁর ব্যক্তি জীবনেরই প্রতিচ্ছবি! তিনি বলতেন বারবার– ‘আমি কোনও কিছু শেষ করতে পারি না’। যে বাসায় থাকতেন সেখানেও একাই থাকতেন। আপনার একমাত্র পুত্র থাকতো বিদেশে। শেষযাত্রায় ছেলে আর নাতির মুখটা দেখতে চেয়েছিলেন। চেয়েছিলেন আপনার ভাই এসে আপনার হাতটা একটু ধরুক। আমরা জানি আপনার শেষ ইচ্ছে পূরণ হয়েছিল। গায়ক নিলয় দাশ বেঁচে থাকলে হয়তো আপনার লেখা গানটাই শোনাতো আপনার শেষযাত্রায়- ‘সেই যে চলে গেলে/আর হায় এলে না ফিরে/ কত যে খুঁজেছি তোমায় অকারণ অশ্রুজলে..’

জীবনে ফেরার ঘোর থেকে আপনি বের হতে পারেননি। শুধু আপনার ভালোবাসার মানুষের অশ্রুজল আপনি দেখে যেতে পারলেন না। শেষযাত্রায় আপনার লেখা গানের কথাই রেখেছে আপনার স্বজনরা। আপনি লিখেছিলেন– ‘এই রূপালি গিটার ফেলে/একদিন চলে যাবো /দূরে, বহুদূরে/ সেদিন অশ্রু তুমি রেখো গোপন করে...’

সব অশ্রু গোপন থাকে না। মুক্তিযুদ্ধ করার পরও রাষ্ট্র আপনাকে বিদায়ী অভিবাদন জানায়নি। এখানে সার্টিফিকেটই সব, মানুষ না। শেষযাত্রায় অনেকেই আসেনি আপনাকে শেষ দেখাটা দেখতে। আপনি জানতেন এমনই হবে। তাই লিখেছিলেন– ‘আজ আছি কাল নেই/ অভিমান রেখো না/ অধরের এই হাসি মুছে ফেলো না’! লিখে গিয়েছিলেন-‘শেষ হোক এই খেলা এবারের মতোন/ মিনতি করি আমাকে হাসিমুখে বিদায় জানাও…আমায় ডেকো না ফেরানো যাবে না!’

শেষমেষ আপনার আর ফেরা হলো না। ফেরা হলো না জীবনের সর্বস্ব বাজি রেখে যুদ্ধে করে পাওয়া এই বাংলায়। বিদায়ে বাজলো না বেদনার বিউগল। রাশিফল লিখতেন পত্রিকায়। রাশিফলে বিশ্বাস করেন? এমন প্রশ্নের উত্তরে বলতেন– ‘ভাগ্যের শতকরা ৯৬ ভাগ মানুষই গড়ে নিতে পারে। চারভাগ শুধু নিয়তি।’ নিয়তির সংজ্ঞাও দিয়েছিলেন এভাবে– ‘লটারির টিকেট কিনবে এক লাখ লোক, জিতবে একজনই’। লটারির একজন হওয়ার চেয়ে নিজের ভাগ্য নিজে গড়াই উত্তম। তবুও যেভাবে রাশিফল লিখতেন সেসবে সাহিত্যের ছোঁয়া থাকতো। আপনার লেখার কারণেই হয়তো মানুষ রাশিফল বিশ্বাস করার চেষ্টা করতো।

জীবনে শুধু মানুষ থাকারই চেষ্টা করেছেন। এড়িয়ে চলেছেন সংগীত বিষয়ক সব রাজনীতি। বই এর অলংকরণ করতেন। কবি নির্মলেন্দু গুণের প্রথম কাব্যগ্রন্থ ‘প্রেমাংশুর রক্ত চাই’ এর প্রচ্ছদ পরিকল্পনাতেও ছিলেন আপনি। নির্মলেন্দু গুণের ছবি ছাপা হয়েছিল বইতে এবং এরপর থেকে ছবি ছাপানো একটা ট্রেন্ডে পরিণত হয়। নিজের লেখারও অলংকরণ করতেন আপনি। মানুষের সাথে থেকে মানুষ আঁকার চেষ্টা করতেন সবসময়।

শেষযাত্রায় রাষ্ট্রের বিউগল বাজুক কিংবা না-ই বাজুক, আপনাকে আর ডাকবো না। অভিমান থেকে মুক্তিযুদ্ধের যে সার্টিফিকেট আপনি নেননি সেটা নিয়ে আর কথা বলবো না। বলে গিয়েছেন মৃত্যুর পরে আপনাকে যেন কোনও পদক না দেওয়া হয়। হাসপাতালে এবং আগেও অনেকবার বলেছেন মরনোত্তর পুরস্কার তিনি চান না।

শুধু আপনার লেখা গানগুলো শোনার অধিকারটা ফিরিয়ে নিয়েন না। বৃষ্টির কান্না দেখে আপনাকে মনে করবো, রাষ্ট্রকে জানাবো না। এলোমেলো জীবনের বোঝা কাঁধে নিয়ে ঢাকা শহরের সীমান্ত পাড়ি দিয়ে কোনও এক বসন্তে যাবো চট্টগ্রামে। প্রয়াত গায়ক আইয়ুব বাচ্চুর স্মরণে যেখানে স্থাপন করা হয়েছে রূপালি গিটার, সেখানে গিয়ে নীরবে দাঁড়িয়ে মনে করবো রূপালি গিটার গানটা আপনার লেখা।

মনে করবো গিটার যে রূপালি হতে পারে এটা আপনার চেয়ে ভালো কেউ জানে না। মনে করবো কাঁটার আঘাত ভুলে আপনি কাউকে ফিরে আসতে বলেছিলেন।

আপনি জানতেন কেউ আসলে ফেরে না। আপনিও ফিরবেন না। ভালোবাসা হৃদয়ে নিয়ে বার বার ফিরে এসে আপনি আর কখনও ডাকবেন না কাছে।

যতটুকু জল টেনে নেয় ভাটা তার সবটুকু ফেরে না জোয়ারে।

জানি আপনি কিছু দেখবেন না। তবু আমার গান স্যালুটটা নিয়েন। শেষযাত্রার বিউগলে চোখের জলের আল্পনায় এখনও আপনারই গান বাজছে হৃদয়ে-মিনতি করি আমাকে হাসিমুখে বিদায় জানাও...

লেখক: রম্যলেখক

 

/এসএএস/

*** প্রকাশিত মতামত লেখকের একান্তই নিজস্ব।

বাংলা ট্রিবিউনের সর্বশেষ
শনিবার সকালে আবার অবস্থান কর্মসূচির ঘোষণা বুয়েট শিক্ষার্থীদের
শনিবার সকালে আবার অবস্থান কর্মসূচির ঘোষণা বুয়েট শিক্ষার্থীদের
ইসরায়েল যা যা অস্ত্র চেয়েছিল সব পায়নি: মার্কিন সেনাপ্রধান
ইসরায়েল যা যা অস্ত্র চেয়েছিল সব পায়নি: মার্কিন সেনাপ্রধান
ছুটির দিনে নিউ মার্কেটে জনসমুদ্র
ছুটির দিনে নিউ মার্কেটে জনসমুদ্র
ভারতের নিখিলের হ্যাটট্রিকে ঊষার বড় জয়
ভারতের নিখিলের হ্যাটট্রিকে ঊষার বড় জয়
সর্বশেষসর্বাধিক

লাইভ