X
শনিবার, ২০ এপ্রিল ২০২৪
৭ বৈশাখ ১৪৩১

আওয়ামী লীগের ভাদু শেখেরা

স্বদেশ রায়
১০ এপ্রিল ২০২২, ১৫:১৯আপডেট : ১০ এপ্রিল ২০২২, ১৯:২৬

স্বদেশ রায় পশ্চিমবঙ্গে ক্ষমতাসীন দলের ভাদু শেখের মৃত্যু এখন ভারতের ওই রাজ্যের খবরের প্রধান শিরোনাম। খবরের প্রধান শিরোনামের থেকেও বড় হলো, ‘ভাদু শেখের’ এই ‘ভাদু শেখ’ হয়ে ওঠা। এখন পশ্চিমবঙ্গে অনেকখানি কণ্ঠরোধ। তাছাড়া আগের মতো এখন আর সেখানকার বুদ্ধিজীবীরা নিজেদের মতো নিজেদের রাস্তায় হাঁটেন না। এমনকি রাজনীতির বিষয়ে হাঁটতে হলেও রাজনীতিবিদদের আগে হাঁটেন না। পিছে পিছেই হাঁটেন। বেশিরভাগ বুদ্ধিজীবী, কবি, সাহিত্যিক, সাংবাদিক বর্তে যান রাজনীতিবিদের বাহবা পেলে। ইতিহাসের বাস্তবতা হলো, বুদ্ধিজীবী, কবি, সাংবাদিকরা যখন রাজনীতিবিদদের সামনে না হেঁটে পেছনে হাঁটেন তখন ধরেই নিতে হয় সে দেশের আত্মা মারা গেছে।

তারপরও তাদের দেশের পত্রপত্রিকায় এই ভাদু শেখের ভাদু শেখ হয়ে ওঠার কাহিনি বড় করেই আসছে। তা নিয়ে মতামত কলামেও অনেক সত্য কথা বলছেন অনেকে। ভাদু শেখ জীবনের প্রথমে রিকশাভ্যান চালাতেন। তারপরে ট্রাক্টর চালাতেন। সেখান থেকে কীভাবে তিনি পড়ে যান স্থানীয় পুলিশের সুনজরে। পশ্চিমবঙ্গের পুলিশ অন্য অনেক দেশের মতো অনেকখানি ক্ষমতাসীন দলীয় কর্মী। তাই তাদের নজরে পড়ে যাওয়ায় দ্রুত ভাদু শেখের ভাগ্য বদলাতে থাকে। আর এটা আরও দ্রুত বদলানোর জন্যে ভাদু শেখ যোগ দেন রাজ্যের ক্ষমতাসীন রাজনৈতিক দল তৃণমূলে। তারপরে আর ভাদু শেখকে পেছনে ফিরে তাকাতে হয়নি। সাপ্লাইয়ের ব্যবসা, অটোমোবাইলের ব্যবসা থেকে পল্ট্রি সবই চলে এলো তার হাতে। আর ব্যবসার থেকে বড় যে বিষয়টি চলে এলো, সেটা ভাদু শেখের নিজস্ব রাজত্ব। ভাদু শেখ কয়েকটি গ্রামের একজন ভুইয়া হয়ে উঠলেন। তারপরে ক্ষমতার কোন্দল। ভাদু শেখের বাড়িতে বোমা। মৃত্যু। তার বিপরীতে তার প্রতিদ্বন্দ্বীদের বাড়িগুলো ইউক্রেনে রুশ হামলার মতো নারী, শিশু সবই আগুনে দগ্ধ হয়ে ভস্ম হয়ে গেলো।

পশ্চিমবঙ্গ ভারতীয় প্রজাতন্ত্রের একটা রাজ্য। তাই রাজ্যের ওপরও কেন্দ্র আছে। মানুষ বা বিরোধী দল দাবি তুললো কেন্দ্রের তদন্ত। তাদের সেন্ট্রাল গোয়েন্দারা তদন্তে নেমেছেন। আর এ সময়ে মোক্ষম সত্যটি বলেছেন পশ্চিমবঙ্গের মুখ্যমন্ত্রী। যে ভাদু শেখকে নিয়ে কেন্দ্রের এই তদন্ত- মূলত সিস্টেমের গায়ে হাত দেওয়া। তৃতীয় বিশ্বের গণতান্ত্রিক দেশগুলোর জন্যে একেবারে মোক্ষম সত্যটি বলেছেন পশ্চিমবঙ্গের মুখ্যমন্ত্রী। বাস্তবে তৃতীয় বিশ্বের গণতন্ত্রে পার্লামেন্ট, বিচার বিভাগ, নির্বাহী বিভাগ এমনকি মিডিয়াও মূলত গণতন্ত্রের সিস্টেম বা প্রতিষ্ঠান নয়। তৃতীয় বিশ্বের গণতন্ত্রের মূল প্রতিষ্ঠান বা সিস্টেম হলেন ভাদু শেখেরা। কারণ, ভাদু শেখেদের ওপর ভর করেই ভোট সংগ্রহ হয়, কেন্দ্র দখল বা মর্জি মাফিক ভোট হয়, ভাদু শেখরাই সরকারি দলের নামে নানান এলাকা দখল করে রাখে। তাদের কথামতোই এলাকা চলে। এমনিক নির্বাহী বিভাগেরও মূল চালিকা শক্তি এই সব ভাদু শেখরা। আর এই ভাদু শেখরা নানান কাজে, নানান বয়সের, চরিত্রের আছে। যেহেতু তারাই সিস্টেম, তাই তাদের কিছু হয় না। ওই পশ্চিমবঙ্গে আরও দুটো ঘটনা পরিচিত মানুষ নিয়ে ঘটেছিল বলেই এখানে উল্লেখ করছি– যে সিস্টেম নামক এই ভাদু শেখেরা কতটা শক্তিশালী! কয়েক ভাদু শেখের সেখানে একদিন মর্জি হয়েছিল, একজন সম্পাদকের বাড়ির গেটে বসে মদ খাবে। তারা শুরু করে দিলো। সত্তরোর্ধ্ব সম্পাদক নিজে হাতে বাধা দিতে গেলে, তাকে হাসপাতালে যেতে হলো। পুলিশ পরে এসে সিস্টেম অনুযায়ী কাউকে পায়নি। অমনি কলকাতার উপকণ্ঠে আরেক পরিচিতর বাড়িতে গিয়েছি, কোনও একটা ভোটের আগে আগে। দেখা গেলো বারো থেকে পনের বছরের বাচ্চারা সরকারি দলের পোস্টার লাগাচ্ছে। তাদের একজনের হাতের বালতিতে গাম অন্যজনের হাতের বালতিতে বরফের মধ্যে রামের (কম দামি হুইস্কি) বোতল। বয়স্ক লোকেরা পাশ দিয়ে হেঁটে যাচ্ছেন। তাদের কর্মক্লান্ত শরীর। কিন্তু কেউ ওদের ওই বালতির দিকে তাকাচ্ছে না। কিশোর তরুণগুলোকে কিছু বলছে না। বুঝলাম এটা সিস্টেম।

আমাদের দেশে ঢাকার খিলগাঁও, মালিবাগ, গুলবাগে এ ধরনের সিস্টেম ২০০৪, ২০০৫-এর দিকে নিজে চোখে অনেক দেখেছি। সন্ধ্যায় অফিস থেকে ফিরে ছোট বাচ্চাটার হাত ধরে হাঁটতে বেরিয়েছি, গুলবাগের রেললাইনের পাশের গলির মোড়ের মসজিদ থেকে একজন মুরুব্বি নামাজ পড়ে বের হচ্ছিলেন। তিনি আমাকে দেখেই বলেন, আপনি কি পাগল নাকি, বাচ্চা নিয়ে সন্ধ্যার পরে ওই গলিতে যাচ্ছেন। বুঝলাম সন্ধ্যার পরে ওই গলিতে না যাওয়াটা গণতান্ত্রিক সিস্টেম। কিন্তু সিস্টেমটির আদ্যোপান্ত জানতে পারলাম না, সঙ্গে ছোট বাচ্চা থাকায়। পরে খোঁজ নিয়ে জানলাম, সন্ধ্যার পরে গুলবাগ, মালিবাগ, শাহাজাহানপুর, খিলগাঁও এসব এলাকার অনেক রাস্তায় যাওয়া সিস্টেমবিরোধী। কারণ, ওই সময়ে সেখানে ইয়াবা আর ফেনসিডিল বিক্রি হয়। শুধু ক্রেতারা সেখানে যাবে। বিক্রেতাদের এমনকি ক্রেতাদের কাছে বেআইনি অস্ত্রও থাকে। যেকোনও মুহূর্তে তা থেকে তাদের দরকারে বা ফসকে গিয়ে গুলিও বের হয়। পুলিশ সব জানে। কিন্তু এদের গ্রেফতার করার অর্থ সিস্টেমের গায়ে হাত দেওয়া। কারণ, এরা ক্ষমতাসীন গণতান্ত্রিক দলের সিস্টেমের অংশ। তাই রাষ্ট্রের কর্মচারী হয়ে তো আর সরকারি সিস্টেমকে বাধা দিতে পারে না।

সাংবাদিক মন, লিখতে না পারলেও জানতে ইচ্ছে করে। বয়সও কম ছিল। দৌড়ঝাঁপ করার মতো শরীরও ছিল। তাই কয়েক দিনের চেষ্টায় সিস্টেমের ওই সব ভাদু শেখদের চিনতে পারলাম। না, ফেলনা নয় কেউ। সকলেই গাড়ি না চড়লেও বেশ চিকনাই শরীরে চলে। আর বাজার, ফুটপাতের চাঁদা থেকে শুরু করে রাস্তার কন্টাকটারিটাও তাদের হাতে। শুধু এখানেই শেষ নয়, এই সিস্টেমকে বাঁচিয়ে রাখতে গিয়ে কয়েকজন মুদি দোকানির দোকানও উঠে গেছে। কারণ, নিয়মিত সিস্টেমের লোকদের বাকিতে মাল দিতে দিতে এখন আর তাদের প্রাণটুকু ছাড়া হাতে কিছু নেই।

২০০৮-এর নির্বাচনের সময় দেশের অনেক স্থানে ঘুরে নির্বাচনের অবস্থা ও নির্বাচনের দিন নির্বাচনি রিপোর্ট করার কাজ করি। ঢাকায় বসে থাকা অনেক বিশ্লেষক এখনও বলেন, সেদিন মানুষ দ্রব্যমূল্য, আর সরকারি বড় বড় কাজের কমিশনের বিরুদ্ধেই গণরায় দিয়েছিল। একমত হতে পারি না তাদের সঙ্গে এখনও। কারণ, নিজের চোখে যা দেখেছি তা সেদিনও লিখেছি, আজও লিখছি, ভবিষ্যতেও লিখবো। মানুষ মূলত গণরায় দিয়েছিল, ভাদু শেখদের হাত থেকে বাঁচার জন্যে। কারণ, তারা সে সুযোগটি পেয়েছিলো।   

এখন আজ তেরো বছর পরে এসে প্রশ্ন, ভাদু শেখদের কি উচ্ছেদ করা হয়েছে? সিস্টেমের বদলে তারা কি প্রকৃত সিস্টেমে শাস্তির আওতায় গেছে? দু একজন নানান সমীকরণে গেছে ঠিকই। তবে বাস্তবতা হলো, বর্তমানে কী ঢাকা শহরে, কী সারা দেশে সবখানে যা খবর তাতে দেখা যায়, পুরনো সেই সব ভাদু শেখরা আর অনেকে নেই। তাদের বয়স হয়ে গেছে। তবে সেই সব ভাদু শেখদের উত্তরাধিকারী কেউ এখন আর বসে নেই। তারা এখন সবাই সরকারি দলে, সরকারি সিস্টেমের অংশ। তারা বাসস্ট্যান্ড, রিকশাস্ট্যান্ড থেকে শুরু করে এলাকার গরুর বাজার অবধি নিয়ন্ত্রণ করছে। এমনকি কারও বাড়িতে মিলাদ হবে কি হবে না তাও তারা নিয়ন্ত্রণ করছে। সরকারি দলের মাঠ পর্যায়ের অধিকাংশ নেতা ওই ভাদু শেখদের নিয়েই চলছে। কারণ, ভাদু শেখরা তাদের কাছে কাম ধেনু। যখন ইচ্ছে ভাদু শেখরা তাদের দুধ দেয়। এমনকি নিচের দিকের মাঠ পর্যায়ের অনেক নেতাই এখন ওই ভাদু শেখেরা। তারা শুধু ওই এলাকার কামধেনু হয়ে দুধ নিয়ন্ত্রণ করছে না, রাজনীতিও ধীরে ধীরে নিয়ন্ত্রণ করছে। এবার তাদের কথামতোই বা তাদের হাতের কাম ধেনুর দুধ নিয়ে অধিকাংশ জায়গা থেকে স্থানীয় নেতারা কেন্দ্রে ইউনিয়ন পরিষদ নির্বাচনের মনোনয়নের জন্যে নাম পাঠিয়েছিলেন। তাদের ভেতর শুধু ভাদু শেখদের মনোনীত নয়, অনেক ভাদু শেখও ছিল।

তাই মানুষ যেখানে ভোট দেওয়ার সুযোগ পেয়েছে সেখানে তারা ভাদু শেখদের বা তাদের মনোনীতদের ভোট দেয়নি। কারণ, ভাদু শেখরা আর যাই হোক মানুষের কাছে তো সিস্টেম নয়, বরং সিস্টেমের বিপরীতে নররাক্ষস। তারা সবকিছু খায়। তাদের কারণে, সরকারের অনেক সহায়তার কার্ড নিতে গেলেও টাকা দিতে হয়। এমনকি এই যে এক কোটি লোককে টিসিবির কার্ড দেবার ঘোষণা দিতেই সেখানে ভাদু শেখদের উপস্থিতি দেখা গেছে। ইতোমধ্যে পত্রিকায় খবর এসেছে, একশ টাকা করে নেওয়া হয়েছে কার্ডপ্রতি।

তাই এখন দেশের জন্যে বড় থেকে বড় প্রশ্ন, এই মাঠ পর্যায় থেকে ওপর অবধি ভাদু শেখরা কি সত্যিই এভাবে ‘সিস্টেম’-এ থাকবে? আওয়ামী লীগ বলতে ওইভাবে শক্ত কোনও সংগঠন এখন দেশে নেই। এই সিস্টেম ভাঙার মতো শক্তি একমাত্র আছে শেখ হাসিনার। তাই যত দ্রুত তিনি এই ভাদু শেখদের নিশ্চিহ্ন করবেন, ততই মানুষ তাকে আরও বেশি হৃদয়ে স্থান দেবেন।

লেখক: রাষ্ট্রীয় পদকপ্রাপ্ত সাংবাদিক

 

/এসএএস/এমওএফ/

*** প্রকাশিত মতামত লেখকের একান্তই নিজস্ব।

বাংলা ট্রিবিউনের সর্বশেষ
রবিবার গ্যাস থাকবে না যেসব এলাকায়
রবিবার গ্যাস থাকবে না যেসব এলাকায়
চুয়াডাঙ্গায় ৪২ পেরোলো তাপমাত্রা, জনজীবনে হাঁসফাঁস
চুয়াডাঙ্গায় ৪২ পেরোলো তাপমাত্রা, জনজীবনে হাঁসফাঁস
ব্রাদার্সের জালে মোহামেডানের ৮ গোল, দিয়াবাতের ৫
ব্রাদার্সের জালে মোহামেডানের ৮ গোল, দিয়াবাতের ৫
ইউক্রেনের খারকিভে হামলার প্রস্তুতি নিচ্ছে রুশ সেনারা
ইউক্রেনের খারকিভে হামলার প্রস্তুতি নিচ্ছে রুশ সেনারা
সর্বশেষসর্বাধিক

লাইভ