X
বৃহস্পতিবার, ১৮ এপ্রিল ২০২৪
৫ বৈশাখ ১৪৩১

তেল নিয়ে তেলেসমাতি

সৈয়দ ইশতিয়াক রেজা
০৪ মে ২০২২, ১৬:০৬আপডেট : ০৪ মে ২০২২, ১৬:০৬

সৈয়দ ইশতিয়াক রেজা ঈদের আগে হঠাৎ মুদির দোকানে সয়াবিন ও পাম তেল পাওয়া যাচ্ছিল না। তবে ঈদের পরও যে পাওয়া যাবে, সে নিশ্চয়তা নেই। যথারীতি ভোক্তা অধিদফতরের কিছু অভিযান পরিচালিত হলো, কাওরানবাজারসহ বিভিন্ন বাজারে দোকানের ভেতর লুকিয়ে রাখা কয়েক হাজার বোতল উদ্ধার হলো। কিন্তু বড় কোনও উপকার হয়নি। মানুষ ভোজ্যতেল কিনতে গিয়ে হয়রানির মধ্যে পড়েছে। অনেকে পেয়েছে, অনেকে পায়নি। ভোজ্যতেল পরিশোধনকারী কোম্পানিগুলোর কর্মকর্তারা দাবি করছেন, তারা আগের মতোই সরবরাহ করছেন। মাঝপথে কোথাও ‘গরবড়’ হচ্ছে।

এই গরবড়টাই কেউ ধরতে পারছে না বা ধরছে না। বহুদিন ধরেই বাজার সংবাদ শিরোনাম হয়ে আছে। সব জিনিসের দাম বেশি। এমন সব পণ্যের দাম অযৌক্তিকভাবে বেশি যেগুলো দেশেই বিপুল পরিমাণে উৎপাদিত হয় এবং এর সঙ্গে ইউক্রেন যুদ্ধের কোনও সম্পর্ক নেই। চলতি বছরে ইউক্রেন যুদ্ধ শুরুর সময়েও দেশের অনেক এলাকার অনেক দোকানে তেল পাওয়া যায়নি। মার্চের প্রথমে আন্তর্জাতিক বাজারে দাম বাড়ার কথা বলে দেশে ভোজ্যতেলের দাম সরকার নির্ধারিত মূল্যের চেয়ে অন্তত ৪০ টাকা পর্যন্ত বাড়ানো হয়। কোথাও কোথাও খোলা সয়াবিনের দাম ২০০ টাকাও নেওয়া হয়। পরে সরকারের বিভিন্ন পদক্ষেপে সরবরাহ স্বাভাবিক হওয়ার পাশাপাশি দামও কমে আসে। মার্চের ওই সময়ে সরকার ভোজ্যতেলের ওপর থেকে ভ্যাট ও শুল্ক প্রত্যাহারের পর দামেও সমন্বয় করে। নতুন দরে লিটারপ্রতি বোতলজাত সয়াবিন তেল ১৬০ টাকা, খোলা সয়াবিন তেল ১৪০ টাকা এবং পাম তেল ১৩০ টাকা নির্ধারণ করা হয়।

নিত্যপণ্যের দাম অতীতের প্রায় সব রেকর্ড ভেঙে দিয়েছে। ঈদের আগে সংকট সৃষ্টি করা হলো আর এখন পূর্বাভাস দেওয়া হচ্ছে যে ঈদের পর ভোজ্যতেলের দাম আরেক দফা বাড়বে। করোনার সময়কালে তো বটেই, ইউক্রেন যুদ্ধের উছিলাতেও গত কয়েক মাসে প্রতিটি ভোজ্যতেলের দাম যে হারে বেড়েছে তাতে প্রমাদ গুনছেন সাধারণ মানুষ। পরিস্থিতি যা, তাতে আগামী দু’মাসে দাম সম্পূর্ণ হাতের বাইরে চলে গেলে অবাক হওয়ার নয়। কারণ, ইতোমধ্যে ইন্দোনেশিয়া পাম ওয়েল রফতানি বন্ধ ঘোষণা করেছে, যার প্রভাব পড়বে সয়াবিনের বাজারে। বাংলাদেশে সয়াবিন ও  পাম — মূলত এই দুই ধরনের তেল খাওয়া হয়। সর্ষের তেলের দামও অনেকাংশে নির্ভর করে এই দুটি তেলের দামের ওপর। দেশে ভোজ্যতেলের চাহিদার ৮০ শতাংশের বেশি আমদানি করে পূরণ করা হয়। সাত থেকে আটটি প্রতিষ্ঠান অপরিশোধিত তেল আমদানি করে পরিশোধন করে বাজারে ছাড়ে।

উদ্ভূত পরিস্থিতিতে ভোজ্যতেলের লাগামহীন দামে গৃহস্থের রান্নাঘরে আগুন লাগাতে চলেছে। তাই এই গভীর সমস্যার সমাধান কীভাবে হবে তা নিয়ে দ্রুত ভাবনা প্রয়োজন। সমস্যাটিকে আড়ালে রাখার কোনও সুযোগ নেই। জ্বালানি তেলের দাম বাড়লে জিনিসপত্র অগ্নিমূল্য হয়। এর বাইরে সংসারের অন্যতম দুটি গুরুত্বপূর্ণ জিনিস হলো গ্যাস, বিদ্যুৎ ও রান্নার তেল। এই তিনটির দাম সব অঙ্ককে হার মানাচ্ছে। এই অবস্থায় গরিব মধ্যবিত্ত বাঁচবে কীভাবে প্রশ্ন সেখানে। জ্বালানি তেল, ভোজ্যতেল, রান্নার গ্যাস, বিদ্যুৎ—প্রতিটি ক্ষেত্রে সদিচ্ছা থাকলে দাম নিয়ন্ত্রণে রেখে জনগণকে সুরাহা দেওয়া যায় বলেই মনে করছেন বাজার বিশ্লেষকরা।

তাই কীভাবে দ্রব্যমূল্য নিয়ন্ত্রণ করা যায় সেটি এখন অর্থনীতির এজেন্ডা। নীতি নির্ধারকদের কেউ কেউ মনে করেন, আন্তর্জাতিক বাজারে ক্রমবর্ধমান দামের মধ্যে সরকারের ভর্তুকির বোঝা ‘সহনীয় মাত্রায়’ নামিয়ে আনতে জরুরি সেবাসমূহ, যেমন- গ্যাস ও বিদ্যুতের ‘মূল্য সমন্বয়’ প্রয়োজন। তারা মনে করছেন, করোনার টিকা, বুস্টার ডোজের মতো জরুরি স্বাস্থ্যসেবা উপকরণ সংগ্রহ, কৃষকদের ক্ষতির হাত থেকে বাঁচাতে চাল ক্রয় বৃদ্ধি, উন্নয়ন কার্যক্রম অব্যাহত রাখা ইত্যাদি কাজের জন্য তহবিল নিশ্চিত করতে এই ‘মূল্য সমন্বয়’ সাহায্য করবে। কথায় যুক্তি আছে। কিন্তু প্রশ্ন হলো, জনগণের পকেট থেকে অতিরিক্ত টাকা নিয়ে কেন এগুলো করতে হবে? সেই সিরিয়া যুদ্ধের সময়ে জ্বালানি তেলের দাম তলানিতে গিয়ে ঠেকলেও জনগণের পকেট থেকে বেশি দাম নেওয়া হয়েছে।

আমরা জানি আন্তর্জাতিক পরিস্থিতির প্রভাব পড়ছে বাংলাদেশের বাজারে। মূল্যস্ফীতির ধাক্কায় চাপে পড়েছে গরিব মানুষ আর এ অবস্থায় তাই নিত্যপ্রয়োজনীয় পণ্যের উচ্চমূল্য নিয়ন্ত্রণ করাই বাংলাদেশের সামনে বড় চ্যালেঞ্জ। ২০২১-২২ অর্থবছরের বাজেটে মূল্যস্ফীতির হার ৫ দশমিক ৩ শতাংশের মধ্যে রাখার ঘোষণা দিয়েছিল সরকার। অথচ ফেব্রুয়ারিতেই মূল্যস্ফীতি ছিল ৬ দশমিক ১৭ শতাংশ, যা গত প্রায় দেড় বছরের মধ্যে সর্বোচ্চ।

ইউক্রেন যুদ্ধের প্রভাব আছে। কিন্তু আমাদের কিছুটা ভেবে দেখা দরকার বৈশ্বিক বাজারের চেয়ে বাংলাদেশের অভ্যন্তরীণ বাজারে দাম বাড়ার প্রবণতা বেশি কিনা। এখানে মজুত করে, সরবরাহে বিঘ্ন ঘটিয়ে এবং আরও নানা কায়দায় পণ্যের দাম বাড়ানো হয়। সেটা বন্ধ করা হবে সরকারের জন্য বড় চ্যালেঞ্জ। ঈদের আগে সয়াবিন তেলের উধাও হয়ে যাওয়াটা সে ধরনের কারসাজি বলেই মনে হচ্ছে।

রোজা গেছে। কিন্তু মানুষের স্বল্প মূল্যে পণ্যের চাহিদা কমে যাবে না। তাই সরকারকে এটা চালিয়ে যেতে হবে ও প্রয়োজনে পণ্যের সংখ্যা আরও বাড়াতে হবে। এছাড়া সামনে বাজেট আসবে, যেখানে মানুষ এসব বিষয়ে অনেক কিছু প্রত্যাশা করছে। তেল নিয়ে যে তেলেসমাতি হয়েছে, সেই অভিজ্ঞতা থেকে বলা যায়, বাজার ব্যবস্থায় মনিটরিং আরও জোরদার করা দরকার, যাতে মানুষ বাজারে যে দামে আসে সেই দামের চেয়ে বহুগুণ বেশি টাকা দিতে না হয় এবং বাজারে যেন ইচ্ছাকৃত কোনও সংকট সৃষ্টি করা না হয়। মজুতদারি, পণ্য বন্দরে রেখে দেওয়া, স্থানীয় বাজারে ও সড়কে চাঁদাবাজি, পুলিশি হস্তক্ষেপ এবং দুর্নীতির মাধ্যমে দাম বেড়ে যাওয়া ঠেকাতে পারলে কিছুটা হলেও কাজ হবে।

লেখক: সাংবাদিক

/এসএএস/এমওএফ/

*** প্রকাশিত মতামত লেখকের একান্তই নিজস্ব।

বাংলা ট্রিবিউনের সর্বশেষ
রাশিয়া জিতে গেলে তৃতীয় বিশ্বযুদ্ধ শুরু হবে: ইউক্রেন
রাশিয়া জিতে গেলে তৃতীয় বিশ্বযুদ্ধ শুরু হবে: ইউক্রেন
কামরাঙ্গীরচর নাগরিক পরিষদের সঙ্গে মেয়র তাপসের মতবিনিময়
কামরাঙ্গীরচর নাগরিক পরিষদের সঙ্গে মেয়র তাপসের মতবিনিময়
সাউথইস্ট ইউনিভার্সিটির নতুন প্রো ভিসি এম মোফাজ্জল হোসেন
সাউথইস্ট ইউনিভার্সিটির নতুন প্রো ভিসি এম মোফাজ্জল হোসেন
কাপ্তাই হ্রদে তিন মাস মাছ শিকার বন্ধ
কাপ্তাই হ্রদে তিন মাস মাছ শিকার বন্ধ
সর্বশেষসর্বাধিক

লাইভ