X
মঙ্গলবার, ২৩ এপ্রিল ২০২৪
১০ বৈশাখ ১৪৩১

১৭ মে: ইতিহাস পুনর্নির্মাণের দিন

আবদুল মান্নান
১৭ মে ২০২২, ০০:২১আপডেট : ১৭ মে ২০২২, ০০:২৪

১৯৮১ সালের ১৭ মে ঠিক ৪১ বছর আগে জাতির পিতা বঙ্গবন্ধুর কন্যা শেখ হাসিনা প্রায় ছয় বছর প্রবাসে শরণার্থীর মতো জীবন কাটিয়ে এক ঝড়ো সন্ধ্যায় দিল্লি থেকে ঢাকার বিমানবন্দরে অবতরণ করেছিলেন। তাঁর পিতা শেখ মুজিব নিজের জীবনের বেশিরভাগ সময় পাকিস্তানের কারাগারে কাটিয়েছেন, মৃত্যুর মুখোমুখি হয়েছিলেন দুবার।

বাংলাদেশকে একটি স্বাধীন দেশ হিসেবে জন্ম দিতে সামনে থেকে নেতৃত্ব দিয়েছেন।  আর সেই দেশে ফিরতে তাঁরই কন্যাকে ছয় বছর শরণার্থী জীবন অতিবাহিত করতে হয়েছে। শেখ হাসিনার দেশে প্রত্যাবর্তন ঠেকানোর জন্য জিয়াউর রহমান সরকারের উদ্যোগে ‘শেখ হাসিনা আগমন প্রতিরোধ কমিটি গঠন’ করা হয়েছিল, যার আহ্বায়ক ছিলেন জিয়ার সংসদের স্পিকার মির্জা গোলাম হাফিজ। এর আগে শেখ হাসিনা দেশে ফিরছেন জানতে পেরে জিয়া সাপ্তাহিক ছুটির দিনে (তখন রবিবার) ৩ মে মন্ত্রী পরিষদের বৈঠক ডেকে সিদ্ধান্ত নেন শেখ হাসিনাকে দেশে ফিরতে দেওয়া হবে না । বৈঠক শেষে জিয়ার প্রধানমন্ত্রী রাজাকার শাহ আজিজ সাংবাদিকদের বলেন ‘শেখ হাসিনার দেশে ফেরা নিয়ে আমরা দেশে বিশৃঙ্খলার আশঙ্কা করছি।’ পরদিন ৪ মে স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী এএসএম মোস্তাফিজুর রহমান আনুষ্ঠানিকভাবে ঘোষণা করেন ‘জননিরাপত্তার স্বার্থে শেখ হাসিনাকে দেশে ফিরতে দেওয়া হবে না ।’ এই মোস্তাফিজুর রহমান, যিনি একসময় পাকিস্তান সেনাবাহিনীর সদস্য ছিলেন, তিনি তথাকথিত আগরতলা ষড়যন্ত্র মামলায় পাকিস্তান সেনাবাহিনীর পক্ষে আইও (Interrogation Officer) ছিলেন। তার মূল দায়িত্ব ছিল অভিযুক্তদের কাছ থেকে নির্যাতনের মাধ্যমে জোরপূর্বক নানাভাবে স্বীকারোক্তি আদায় করা। কিন্তু বঙ্গবন্ধুকন্যা জানিয়ে দেন তাঁকে যদি হত্যা করার চেষ্টাও করা হয় তাহলেও তিনি দেশে ফিরবেন এবং তিনি ১৭ মে ১৯৮১ সালে ফিরেছিলেন ।

১৯৭৫ সালের ১৫ আগস্ট যখন বঙ্গবন্ধুকে সপরিবারে হত্যা করা হয় তখন শুধু একজন ব্যক্তি বা তাঁর পরিবারকে হত্যা করা হয়েছিল তা নয়, তাদের উদ্দেশ্য ছিল বাংলা নামের দেশটি যে উদ্দেশ্য নিয়ে ত্রিশ লক্ষ শহীদের রক্তের বিনিময়ে অর্জিত সেই দেশটিকে হত্যা করা আর তাকে আবার একটি মিনি পাকিস্তানে রূপান্তর করা। আর যারা এই হত্যাকাণ্ডের সঙ্গে সরাসরি জড়িত ছিল তারা ১৯৭৫ সাল থেকে ১৯৯০ সাল পর্যন্ত এই কাজটিই করে গেছে অত্যন্ত নিষ্ঠার সঙ্গে। বঙ্গবন্ধুকে হত্যা করার পর খন্দকার মোশতাক, বিচারপতি সায়েমের হাত ঘুরে যখন সরাসরি জিয়া রাষ্ট্রক্ষমতা দখল করলেন তখন বাংলাদেশ এক অন্ধকার যুগে প্রবেশ করেছে। প্রথমে জিয়া যেসব রাজনৈতিক দল ও ব্যক্তি বাংলাদেশের স্বাধীনতার প্রত্যক্ষ বিরোধিতা করেছিল তাদের রাজনৈতিক জীবন শুরু করার অনুমতি দিয়েছিল তাঁর নিজ প্রয়োজনে। ১৯৭২ সালের সংবিধানে বঙ্গবন্ধু এসব ধর্মাশ্রয়ী দলকে নিষিদ্ধ করেছিলেন। জিয়া তাদের রাজনীতিতে ফিরে আসাকে জায়েজ করার জন্য এক সামরিক ফরমান বলে সংবিধানের ওই ধারা বাতিল করেন। জামায়াত, মুসলিম লীগ, নেজামে ইসলামীর আবার পুনর্জন্ম হয়। জামায়াতের আমির একাত্তরের খুনিদের প্রধান গোলাম আযমকে বাংলাদেশে ফিরে আসার অনুমতি দেন জিয়া। পাকিস্তান বিমান বাহিনীর অবসরপ্রাপ্ত কর্মকর্তা এমএজি তোয়াবকে পশ্চিম জার্মানি থেকে ফিরিয়ে এনে বাংলাদেশ বিমান বাহিনীর প্রধান নিযুক্ত করেন। তোয়াবকে বাংলাদেশে ফিরিয়ে আনার পিছনে সবচেয়ে বেশি ভূমিকা ছিল বঙ্গবন্ধুর অন্যতম ঘাতক শরিফুল হক ডালিমের। বাহাত্তরের সংবিধানের মূল শক্তি ছিল রাষ্ট্রের চারটি স্তম্ভ, যার অন্যতম ছিল ‘ধর্মনিরপেক্ষতা’। সংবিধান থেকে সামরিক ফরমান বলে তা তিনি বাতিল করে দেন।

জিয়ার শাসনামল শুরু হয়েছিল রাত্রিকালীন কারফিউ জারির মাধ্যমে দেশ শাসনের বিচিত্র ব্যবস্থার মধ্য দিয়ে। তিনি ছিলেন একজন অত্যন্ত নার্ভাস কিন্তু নিষ্ঠুর রাষ্ট্রপ্রধান। কোনও ব্যক্তিকে তিনি তার শাসনের প্রতি হুমকি মনে করলে তিনি তাঁকে নানা অজুহাতে ফাঁসিতে ঝুলাতেন। তাঁর আমলে উনিশটি অভ্যুত্থানের চেষ্টা করা হয়েছে। সেসব অভ্যুত্থানে যারাই জড়িত ছিলেন বলে তিনি সন্দেহ করেছেন তিনি তাদের বিনা বিচারে নিজ ক্ষমতা বলে মৃত্যুদণ্ড দিয়েছেন। এরা সবাই ছিলেন বাংলাদেশ সেনাবাহিনীর সদস্য। এ ধরনের হত্যাকাণ্ডের সংখ্যা দুই হাজারের ওপর। সামরিক ফরমান বলে নিষেধ করা হয় বঙ্গবন্ধুর নাম নেওয়া (৪ আগস্ট ১৯৭৬- ‘ব্যক্তিপূজা বা ব্যক্তিত্বের মাহাত্মা প্রচার নিষিদ্ধ থাকিবে’)।   ‘জয় বাংলা’ স্লোগান দেওয়া অলিখিতভাবে নিষিদ্ধ হয়ে যায়। জিয়া পাকিস্তান সেনাবাহিনীতে কর্মরত থাকা অবস্থায় বেশিরভাগ সময় কাটিয়েছেন পাকিস্তানের সামরিক গোয়েন্দা সংস্থা আইএসআইতে। তিনি ক্ষমতা দখল করলে বাংলাদেশে এই কুখ্যাত গোয়েন্দা সংস্থা বেশ সক্রিয় হয়ে ওঠে ভারতের পূর্বাঞ্চলীয় রাজ্যগুলোর বিচ্ছিন্নতাবাদী আন্দোলনে মদত দিতে।

জিয়া আওয়ামী লীগের ধর্মনিরপেক্ষতার বিরুদ্ধে ইসলামকে দাঁড় করিয়ে দেন। ঢাকা শহর পবিত্র কোরআনের আয়াত লিখিত বিল বোর্ডে ছেয়ে যায়। ভারতের তৎকালীন প্রধানমন্ত্রী মোরারজি দেশাই বাংলাদেশ সফরে এলে রাতারাতি সেসব বিলবোর্ড গায়েব হয়ে যায়। ১৯৭৬ সালের ৭ মার্চ সরকারি পৃষ্ঠপোষকতায় সোহরাওয়ার্দী উদ্যানে অনুষ্ঠিত হয় সিরাতুন্নবী সম্মেলনের নামে জমায়াত করা হয় স্বাধীনতা বিরোধীদের। সেই সম্মেলনে যুদ্ধাপরাধী দেলাওয়ার হোসেন সাঈদী দাবি করেন বাংলাদেশের নাম যেন ইসলামিক রিপাবলিক করা হয়। মাঠে আওয়াজ উঠে ‘তোয়াব ভাই তোয়াব ভাই চাঁদ তারা মার্কা পতাকা চাই’।  জিয়ার  শাসনামলেই নির্বাচন জিনিসটিকে তিনি এক তামাশায় পরিণত করেছিলেন। নিজে রাষ্ট্রপতি নির্বাচনে একক প্রার্থী হয়ে তাঁর এককালীন বস জেনারেল আইয়ুব খানের পদাঙ্ক অনুসরণ করে ‘হাঁ’ ‘না’ ভোটের আয়োজন করে  নিজের জন্যই শতভাগ ‘হাঁ’ ভোটের ব্যবস্থা করেছিলেন। সেই জিয়ার সাগরেদরাই এখন আবার অবাধ ও সুষ্ঠু নির্বাচনের দাবি তুলে গলা ফাটান। জিয়ার আমলে শুরু হয় রাষ্ট্রায়ত্ত কলকারখানা নিজ দলের প্রতি অনুগত নেতাদের মাঝে পানির দরে বিক্রি করার যাত্রা। বাংলাদেশের অর্থনীতিতে কালো টাকা সাদা করার সংস্কৃতি চালু করেছিলেন জিয়া এই বলে, এই টাকা এসব কলকারখানায় বিনিয়োগ করা হবে। হলো ঠিক উল্টো। সব টাকাই দেশের বাইরে পাচার হয়ে গেলো। যারা পানির দামে এসব কলকারখানা ক্রয় করেছিল তারাও তা অন্যদের কাছে বিক্রি করে দেশ ত্যাগ করলো।

১৯৭৫ সালের ৩ নভেম্বর কারা অভ্যন্তরে জাতীয় চার নেতাকে হত্যা করার পর বঙ্গবন্ধু হত্যা পরবর্তী ক্ষমতা দখলকারী তাঁরই ঘনিষ্ঠ সহকর্মী খোন্দকার মোশতাক ক্ষমতা দখল করেছিলেন । ৩ নভেম্বরের ঘটনার পর জিয়া সরাসরি ক্ষমতায় চলে আসে । মাঝখানে সাক্ষীগোপাল রাষ্ট্রপতি হিসেবে নিযুক্ত করেন বাংলাদেশের প্রথম প্রধান বিচারপতি, যাঁর নিয়োগ বঙ্গবন্ধুর হাত দিয়ে, আবু সাদাত মোহাম্মাদ সায়েমকে। কিছু দিনের মধ্যেই জিয়া তাঁকে অত্যন্ত অপমানজনকভাবে বিদায় করে রাষ্ট্রপতির পদটি নিজে দখল করেছিলেন। 

৩০ মে ১৯৮১ সালে এক সামরিক অভ্যুত্থানে জিয়ার মৃত্যু হলে ক্ষমতা দখল করেন আরেক সেনা শাসক এরশাদ। মাঝখানে কিছু দিন জিয়ার উপ-রাষ্ট্রপতি বিচারপতি সাত্তার দেশের রাষ্ট্রপতির দায়িত্ব পালন করেন। এরশাদ জিয়া থেকে আরেক ধাপ এগিয়ে ইসলামকে রাষ্ট্রধর্ম ঘোষণা করেন। এর ফলে দেশের বাকি সব ধর্মাবলম্বীরা সংখ্যালঘু নাগরিকে পরিণত হয়। এরশাদের আমলে বঙ্গবন্ধুর হত্যাকারীদের অন্যতম নেতা খন্দকার আবদুর রশিদের নেতৃত্বে সব ঘাতক মিলে গঠন করে ‘বাংলাদেশ ফ্রিডম পার্টি’। এই ঘাতকদের অন্যতম ফারুক রহমান (বঙ্গবন্ধু হত্যাকাণ্ডে জড়িত থাকার দায়ে বিচারে ফাঁসির দণ্ডাদেশ কার্যকর করা হয়েছে) ১৯৮৬ সালে এরশাদের বিরুদ্ধে ফ্রিডম পার্টির প্রার্থী হিসেবে রাষ্ট্রপতি নির্বাচনে প্রতিদ্বন্দ্বিতা করেন। এরশাদও জিয়ার পথে হেঁটেছেন। এরশাদের শুধু ক্ষমতা আর অর্থ লোভই ছিল না, তিনি একজন নারীলোভী হিসেবে পরিচিত হয়ে ওঠেন। জিয়ার সঙ্গে যেসব দুর্বৃত্ত যোগ দিয়েছিল তাদের অনেকেই এরশাদের আশ্রয়ে চলে আসেন। এই দুই সামরিক শাসকের আমলে বাংলাদেশে রাজনৈতিক ও অর্থনৈতিক দুর্বৃত্তায়নের নবযাত্রা শুরু হয়। দেশের ভবিষ্যৎ হয়ে ওঠে অন্ধকারাচ্ছন্ন।

জিয়া-এরশাদের আমলে আওয়ামী লীগের রাজনীতি প্রকৃত অর্থেই কোণঠাসা হয়ে উঠলেও দলের নিবেদিতপ্রাণ নেতাকর্মীরা কখনও দলের প্রতি আনুগত্য বিসর্জন দেননি। বঙ্গবন্ধুর আমলে যারা আওয়ামী লীগের রাজনীতির সঙ্গে সম্পৃক্ত হয়েছেন তারা কেউই ব্যক্তিস্বার্থে রাজনীতি করেননি। ১৯৭৫ সালে জেলের ভিতর চার জাতীয় নেতার মৃত্যু তার উৎকৃষ্ট প্রমাণ। তাঁরা যদি ঘাতকদের কাছে আত্মসমর্পণ করতেন তাহলে তাঁদের জীবন বাঁচতো। দল যখন এক ক্রান্তিকাল অতিক্রম করছে তখন জীবনের ঝুঁকি নিয়ে বেগম জোহরা তাজউদ্দীন, আব্দুল মালেক উকিল, জিল্লুর রহমান, সাজেদা চৌধুরী, আবদুর রাজ্জাক, তোফায়েল আহমেদ, দেওয়ান ফরিদ গাজী প্রমুখ দলের হাল ধরে রাখেন। বঙ্গবন্ধু অনেক পণ্ডিতজনকে স্বাধীনতার পর তাঁর সঙ্গে দেশ গড়ার কাজে রেখেছিলেন। তাদের পরামর্শ নিয়েছিলেন। দেখা গেলো তাঁর মৃত্যুর পর তাদের অনেকেই দেশান্তরি হয়েছেন। বঙ্গবন্ধুর ছায়াতলে যে ড. কামাল হোসেন রাজনৈতিক জীবন শুরু (ও শেষ) করেছিলেন সেই ড. কামাল হোসেন তো বঙ্গবন্ধুকে হত্যার পর দীর্ঘদিন প্রবাসে ছিলেন। এই সময় দলের ভিতর এক ধরনের নেতৃত্বের টানাপড়েনও শুরু হয়। বঙ্গবন্ধুকন্যা তখন সপরিবারে দিল্লিতে শরণার্থী জীবনযাপন করছেন।

১৯৮১ সালের ১৩ থেকে ১৫ ফেব্রুয়ারি ঢাকায় অনুষ্ঠিত হয় আওয়ামী লীগের কাউন্সিল অধিবেশন। এরইমধ্যে এটা পরিষ্কার হয়ে যায়, আওয়ামী লীগকে যদি টিকিয়ে রাখতে হয় তাহলে তার হাল ধরতে হবে বঙ্গবন্ধুর একজন উত্তরাধিকারীকে। সবার সামনে দিল্লিতে অবস্থানরত বঙ্গবন্ধুর জ্যেষ্ঠ কন্যা শেখ হাসিনা ছাড়া কোনও বিকল্প ছিল না। তাঁর রাজনৈতিক অভিজ্ঞতা আছে। পিতার রাজনৈতিক জীবন খুব কাছ হতে দেখেছেন। দেখেছেন দেশের মানুষের জন্য তাঁর ত্যাগ আর মমত্ব। হাসিমুখে মৃত্যুর জন্য অপেক্ষা করতেও দেখেছেন। সবার মতৈক্যের ভিত্তিতে বঙ্গবন্ধুকন্যা শেখ হাসিনাকে দলের সভাপতি নির্বাচিত করা হয়।

১৯৮১ সালের ১৭ মে আওয়ামী লীগের কয়েকজন নেতা গিয়ে দিল্লি থেকে বঙ্গবন্ধুকন্যাকে দলের সভাপতি হিসেবে দেশে ফিরিয়ে আনলেন। বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধের চেতনায় যারা বিশ্বাস করেন, আক্ষরিক অর্থে হয়তো তারা এই দিনটির জন্য ছয় বছর অপেক্ষা করেছেন, কিন্তু অনেকের জন্য তা ছিল ষাট বছরের সমান। তারা দেখেছেন কীভাবে ত্রিশ লক্ষ শহীদের রক্তবিধৌত স্বাধীন বাংলাদেশ দুই সেনা শাসকের খপ্পরে পড়ে একটি মিনি পাকিস্তানে রূপান্তরিত হয়েছে। যে মানুষটি আজীবন বাংলা ও বাঙালির জন্য নিজের জীবন উৎসর্গ করেছিলেন সেই বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিব তাঁর সৃষ্ট দেশেই নিষিদ্ধ হয়ে গিয়েছেন। তারা দেখেছেন একাত্তরের পরাজিত শত্রু আর পঁচাত্তরের ঘাতকদের উল্লাস নৃত্য। সেই বিকালে ঢাকা বিমানবন্দর আর সড়কের দুপাশে কত মানুষ সমবেত হয়েছিলেন তার কোনও পরিসংখ্যান কখনও পাওয়া যাবে না। এমন একটি জনসমাগম মানুষ দেখেছে ১৯৭২ সালের ১০ জানুয়ারি যখন পিতা মুজিব পাকিস্তানের কারাগার থেকে মুক্তি পেয়ে দেশে ফিরেছিলেন। শেখ হাসিনার স্বদেশ প্রত্যাবর্তন ঠেকাতে জিয়ার নির্দেশে যে কমিটি করা হয়েছিল সেই কমিটি ভীত হয়ে তাদের কর্মসূচি স্থগিত করেছিল। জিয়ার তাঁর পূর্বের অবস্থান থেকে ফিরে এসেছিলেন। তিনি জনগণের শক্তির কাছে পরাজিত হয়েছিলেন । বুঝেছিলেন আওয়ামী লীগ সব ভেদাভেদ ভুলে এক হতে পারলে দলটি হয়ে উঠতে পারে অদম্য । ১৯৭৫ সালের জুলাই মাসে বিদেশ যাওয়ার সময় যে শেখ হাসিনার সবকিছুই ছিল, তিনি ফিরলেন অনেকটা এক শূন্য ঘরে। কিন্তু বাংলার মানুষ সেদিন তাঁকে ভালোবাসা আর আবেগে সিক্ত করেছিল।

দেশে ফিরেই শেখ হাসিনা ঢুকতে চাইলেন ধানমন্ডির ৩২ নম্বরের বাড়িতে, যে বাড়ি তাঁর স্মৃতিবিজড়িত, যেখানে ঘাতকরা খুন করেছে তাঁর বাবা মা আর পরিবারের স্বজনদের। জিয়া সেই পথ বন্ধ করে দিয়েছেন আগেই। সামনের রাস্তায় বসেই বাবা মা আর পরিবারের অন্যদের জন্য দোয়া আর মিলাদ পড়েছেন শেখ হাসিনা। আশ্রয় পেলেন ফুফুর বাসায়। আওয়ামী লীগের মতো এক বিশাল একটি দলের ক্রান্তিকালে তার নেতৃত্ব গ্রহণ একটি দুঃসাহসী কাজ। তবে হাজার হলেও তো বঙ্গবন্ধুর কন্যা। পিতার কাছ থেকে যে কটি গুণ পেয়েছেন তার মধ্যে একটি সাহস আর অন্যটি দৃঢ়তা । তিনি এও জানতেন, তাঁকে দলের সভাপতি করা হয়েছে ঠিকই কিন্তু কেউ কেউ চিন্তা করেছেন তিনি হবেন একটা সাক্ষীগোপাল সভাপতি আর তার দলের নেতৃত্ব থাকবে তাদের হাতে। তারা শেখ হাসিনাকে চিনতে ভুল করেছিলেন। সেই ভুল এখনও কেউ কেউ করে থাকেন।

যে সর্বহারা শেখ হাসিনা ৪১ বছর আগে এক ঝড়ো আবহাওয়ার মধ্যে দেশে ফিরেছিলেন, তিনি এখন বাংলাদেশের টানা তিনবারের প্রধানমন্ত্রী। সর্বমোট চারবার। একটি অন্ধকারাচ্ছন্ন দেশকে তিনি আলোতে নিয়ে গেছেন। ১৯৯৬ সালে সরকার গঠন করে পঁচাত্তরের ঘাতকদের বিচার করেছেন। ২০০৯-এ এসে ঘাতকদের বিচারের রায় কার্যকর করেছেন। অর্থনৈতিকভাবে দেউলিয়া একটি দেশকে অর্থনৈতিক অগ্রগতির মহাসড়কে তুলেছেন। তাঁর নেতৃত্বে দেশ এখন একটি মধ্যম আয়ের দেশ। সব ঠিক থাকলে ২০৪১ সাল নাগাদ হতে পারে উন্নত অর্থনীতির দেশ। যখন দেশে ফিরেন তখনও বাংলাদেশ একটি রিলিফনির্ভর দেশ। খাদ্য ঘাটতি মানুষকে তাড়া করে বেড়ায়। দেশের ষাটভাগ মানুষ নিরক্ষর। বহির্বিশ্বে বাংলাদেশ একটি দুর্ভিক্ষপীড়িত সমস্যাসংকুল দেশ হিসেবে পরিচিত। এখানে রাষ্ট্রপতিকে খুন করলে খুনিদের বিচার বন্ধ করতে সংবিধান সংশোধন করা হয়। সেই বাংলাদেশ এখন বিশ্বে পাঁচটি দ্রুত উন্নয়নশীল দেশের একটি। দেশের মানুষকে দুবেলা খাওয়াতে পারে। ৭২ শতাংশ এখন অক্ষরজ্ঞানসম্পন্ন। রিলিফ শব্দটি বর্তমান প্রজন্মের কাছে অজানা। কোভিড মহামারি ব্যবস্থাপনায় তিনি বিশ্বে এক অনন্য দৃষ্টান্ত স্থাপন করেছেন। একসময়ের সর্বহারা শেখ হাসিনা বর্তমানে শুধু বাংলাদেশের প্রধানমন্ত্রীই নন, তিনি এখন একজন বিশ্বনন্দিত রাষ্ট্রনায়ক। মাঝে মাঝে তিনি বলেন, বয়স হয়েছে, অবসরে যাবেন। আমি বলি ‘কোথায় যাবেন? আপনার বিকল্প তো দেখা যাচ্ছে না। আপনিই তো বাংলাদেশ। অনেক দূর যেতে হবে সেই আপনার প্রিয় রবার্ট ফ্রস্টের Miles to Go Before I Sleep  কবিতার মতো। নেত্রী আপনি শতায়ু হোন’। কথাশিল্পী শওকত ওসমানের ভাষায় শুধু ‘বাপের বেটা হয় না, বাপের বেটিও হয়।’

লেখক: বিশ্লেষক ও গবেষক

/এসএএস/এমওএফ/

*** প্রকাশিত মতামত লেখকের একান্তই নিজস্ব।

বাংলা ট্রিবিউনের সর্বশেষ
ক্ষতচিহ্নিত হাড়মাংস অথবা নিছকই আত্মজনের কথা
ক্ষতচিহ্নিত হাড়মাংস অথবা নিছকই আত্মজনের কথা
পার্বত্য তিন উপজেলার ভোট স্থগিত
পার্বত্য তিন উপজেলার ভোট স্থগিত
কৃষিজমির উপরিভাগ কাটার ঘটনায় বিচার বিভাগীয় তদন্তের নির্দেশ
কৃষিজমির উপরিভাগ কাটার ঘটনায় বিচার বিভাগীয় তদন্তের নির্দেশ
রাজধানীর শ্যামবাজার ঘাটে লঞ্চে আগুন
রাজধানীর শ্যামবাজার ঘাটে লঞ্চে আগুন
সর্বশেষসর্বাধিক

লাইভ