X
শুক্রবার, ২৯ মার্চ ২০২৪
১৫ চৈত্র ১৪৩০

সর্বজনীন স্বাস্থ্য সুরক্ষা অর্জনে স্বাস্থ্যবিমা কি জরুরি?

স ম মাহবুবুল আলম
২৭ মে ২০২২, ১৬:৫৯আপডেট : ২৭ মে ২০২২, ১৬:৫৯
অধ্যাপক ডা. এবিএম আব্দুল্লাহ কাল্পনিক নাম দিয়ে তুলে এনেছেন কিছু দৃশ্যপট (সংক্ষেপিত), ‘স্বল্প বেতনের চাকরিজীবী রায়হান সাহেবের হঠাৎ বুকের ব্যথা উঠলে মানুষের কাছ থেকে ধার-দেনা করে কয়েক লক্ষ টাকা জোগাড় হলে জরুরি ভিত্তিতে ওপেন হার্ট সার্জারি করে সে যাত্রায় জীবন বাঁচাতে পেরেছেন। কিন্তু ধার কীভাবে শোধ করবেন তা তাকে তাড়িয়ে বেড়াচ্ছে। কৃষক রহিম মিয়ার পায়ের ক্ষতে ক্যানসার ধারা পড়লে তার সম্বল জমিটুকু বন্ধক রেখে পা কেটে ফেলতে হয়েছে। পথে বসেছে পুরো পরিবার। মেধাবী মেডিক্যাল ছাত্রী রেখার লিউকেমিয়া ধরা পড়লে বোন ম্যারো ট্রান্সপ্লান্টেশনের জন্য তার পরিবার ও বন্ধুবান্ধব চারদিকে মানুষের কাছে সাহায্যের জন্য হাত পেতেছে’। এ রকম আরও অসংখ্য মানুষের বুকভাঙা কান্নায় চারদিকের বাতাস ভারী।

বুঝে অথবা না বুঝে বাংলাদেশে কেউ কেউ বলে যাচ্ছেন স্বাস্থ্যবিমা এসব সমস্যার সমাধান দিতে পারে। আবার কেউ কেউ এই আশায়ও বলছেন, অর্থের এই নতুন উৎস চালু হলে তা তাদের পকেটে নিতে পারবেন। প্রয়োজন অনুযায়ী স্বাস্থ্যসেবা পেতে প্রধান অন্তরায় হিসেবে স্বাস্থ্যসেবা গ্রহণের সময়ে ব্যক্তির নিজ পকেট থেকে সরাসরি অর্থ ব্যয় (আউট-অফ-পকেট এক্সপেন্স-নিজস্ব ব্যয়) করতে বাধ্য হওয়াকে চিহ্নিত করা হয়েছে। স্বাস্থ্যসেবা গ্রহণের সময়ে ব্যক্তির নিজের পকেট থেকে আকস্মিক স্বাস্থ্য ব্যয়ের শতাংশকে রোগীর নিজস্ব ব্যয় বলে।

বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থার মতে, একটি নিম্ন-মধ্যম আয়ের দেশে স্বাস্থ্যসেবার জন্য মাথাপিছু প্রয়োজন হবে ১৪৬ ডলার। সেখানে বাংলাদেশে স্বাস্থ্য খাতে মাথাপিছু ব্যয় ৪৬ ডলার, যার ৭৩ শতাংশ ব্যক্তির নিজের ব্যয়। নিজের পকেট থেকে আকস্মিক স্বাস্থ্য ব্যয় মেটাতে গিয়ে বা উপার্জনহীন হয়ে বাংলাদেশে প্রতি বছর ৫২ লাখ মানুষ দরিদ্র হয়ে পড়ছে। সারা পৃথিবীতে স্বাস্থ্যসেবার খরচের ধাক্কায় ১০ কোটিরও বেশি মানুষ দারিদ্র্যসীমার নিচে নেমে যাচ্ছে। এই প্রেক্ষাপটে বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থা তার সব সদস্য রাষ্ট্রকে সর্বজনীন স্বাস্থ্য সুরক্ষা (ইউনিভার্সাল হেলথ কাভারেজ) নিশ্চিত করার জন্য প্রতিশ্রুতিবদ্ধ করেছে। সর্বজনীন স্বাস্থ্য সুরক্ষা মানে- কোনও আর্থিক সংকট ছাড়া প্রত্যেকেই প্রয়োজন অনুযায়ী মানসম্পন্ন স্বাস্থ্যসেবা পাবে।

একটি দেশের সর্বজনীন স্বাস্থ্য সুরক্ষা অর্জনের অগ্রগতিকে তিনটি বিস্তৃত মাত্রায় পরিমাপ করা যায়- স্বাস্থ্যসেবায় অন্তর্ভুক্ত জনসংখ্যার অনুপাত (পপুলেশন কভারেজ), প্রদত্ত স্বাস্থ্য পরিষেবার ব্যাপ্তি (সার্ভিস কভারেজ) এবং স্বাস্থ্যসেবা নিতে ব্যক্তির নিজস্ব ব্যয় (আর্থিক সুরক্ষা)। তবে সর্বজনীন স্বাস্থ্য সুরক্ষার ধারণার ভেতরে প্রোথিত আছে স্বাস্থ্যসেবায় সমতা প্রতিষ্ঠার প্রতিশ্রুতি। জাতিসংঘ ঘোষিত আগামী ২০৩০ সালের মধ্যে টেকসই উন্নয়ন অভীষ্ট লক্ষ্যমাত্রা (এসডিজি) বাস্তবায়নে জনগোষ্ঠীকে সর্বজনীন স্বাস্থ্য সুরক্ষার আওতায় আনতে বাংলাদেশ অঙ্গীকারবদ্ধ। প্রধান বৈশ্বিক প্রতিষ্ঠান বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থা এবং বিশ্বব্যাংক জোরের সঙ্গে বলছে, আগাম-পরিশোধ (প্রিপেইড) ব্যবস্থা প্রবর্তনের মাধ্যমে ব্যাপকভাবে ব্যক্তির নিজস্ব চিকিৎসা ব্যয় কমানো সম্ভব। সর্বজনীন স্বাস্থ্য সুরক্ষা অর্জনে যা সবচেয়ে কার্যকর।

স্বাস্থ্যবিমা: স্বাস্থ্যবিমা হলো অসুস্থতার কারণে উদ্ভূত চিকিৎসা খরচ মেটাতে একটি অগ্রিম স্বাস্থ্য ব্যয় পরিশোধ (প্রিপেইড) ব্যবস্থা। একই সঙ্গে বিমা ব্যবস্থা একে অন্যের ঝুঁকি ভাগাভাগি করে নিয়ে সুস্থ অসুস্থ মানুষের, ধনী গরিবের, যুবক-বৃদ্ধের ঝুঁকি কমাতে (রিস্ক পুলিং) পারে। বিভিন্ন দেশে স্বাস্থ্য খাতে বিভিন্ন ধরনের বিমা প্রচলিত। যেমন- সামাজিক বাধ্যতামূলক স্বাস্থ্যবিমা, কমিউনিটিভিত্তিক স্বাস্থ্যবিমা ও বেসরকারি ঐচ্ছিক স্বাস্থ্যবিমা। সর্বজনীন স্বাস্থ্য সুরক্ষা অর্জনে স্বাস্থ্যবিমাকে অত্যন্ত প্রতিশ্রুতিশীল পদ্ধতি হিসেবে গণ্য করা হয়। সত্যিই কি তাই?

বেসরকারি ঐচ্ছিক স্বাস্থ্যবিমা: প্রধানত, উচ্চ আয়ের দেশে বেসরকারি স্বাস্থ্যবিমার প্রাধান্য দেখা যায়। বেসরকারি (ব্যক্তিগত) ঐচ্ছিক বিমা দেশের ধনী অংশকে অন্তর্ভুক্ত করে। বিমা ব্যবস্থা যখন জনগোষ্ঠীর একটি অংশকে সেবা দেয়, তখন সেখানে ঝুঁকি ভাগাভাগির সুযোগ সীমিত হয়ে যায়। তার নেতিবাচক প্রভাবে স্বাস্থ্যসেবায় বৈষম্য আরও প্রসারিত হয়। একজন ব্যক্তি বিমার কিস্তি (প্রিমিয়াম) ব্যয়বহুল হলে অথবা তার জন্য সুবিধাজনক মনে না করলে স্বেচ্ছায় বিমা নিতে চাইবে না। বেসরকারি কোম্পানি বিমাপত্রকে এমনভাবে সাজায় যাতে বেশি স্বাস্থ্যঝুঁকির মানুষেরা বাদ পড়ে এবং কম ঝুঁকির মানুষেরা আগ্রহী হয়। যুক্তরাষ্ট্রে নিয়োগকারী কর্তৃপক্ষ তার কর্মচারীদের জন্য একাধিক বেসরকারি লাভজনক বিমা কর্তৃপক্ষ থেকে স্বাস্থ্যবিমা ক্রয় করে।

যুক্তরাষ্ট্র স্বাস্থ্য খাতে সর্বোচ্চ ব্যয় করে জিডিপির ১৯.৭ শতাংশ (মাথাপিছু ১১৯৪৫ ডলার)। সে দেশে একাধিক সরকারি অর্থায়নে বিমা প্রকল্প রয়েছে। যুক্তরাষ্ট্রের স্বাস্থ্য ব্যয়ের সরকারি অংশ ৩৬ শতাংশ। তার পরেও প্রায় তিন কোটি মানুষ স্বাস্থ্য বিমার বাইরে। পৃথিবীর কোনও দেশই ঐচ্ছিক বিমা ব্যবস্থার ওপর নির্ভর করে সর্বজনীন স্বাস্থ্য সুরক্ষা অর্জন করতে পারেনি।

কমিউনিটিভিত্তিক স্বাস্থ্যবিমা: কমিউনিটি-ভিত্তিক স্বাস্থ্যবিমা প্রকল্পগুলো খণ্ডিত এবং জনসংখ্যার খুব ছোট অংশকে অন্তর্ভুক্ত করতে সক্ষম। তাই ঝুঁকি ভাগাভাগির সুযোগ কম। এই ঐচ্ছিক বিমা ব্যবস্থা অপ্রতুল অর্থ সংগ্রহ, পরিচালনা ব্যয় অনির্দিষ্ট, সীমাবদ্ধ সেবার আওতা ইত্যাদি নানা দুর্বলতায় পরিব্যাপ্ত। বিমার কিস্তি সাধারণত সবার জন্য একই পরিমাণ বা আনুপাতিক হারে হয়, যা দরিদ্রদের ওপর চাপ তৈরি করে। রুয়ান্ডা, ঘানা, সেনেগাল, ইথিওপিয়াসহ কিছু দেশে শুরু হলেও তারা সরে এসে জাতীয় স্বাস্থ্যবিমার মধ্যে একীভূত হয়ে গেছে। সর্বজনীন স্বাস্থ্য সুরক্ষা অর্জনে কমিউনিটিভিত্তিক স্বাস্থ্যবিমার অবদান রাখার সামর্থ্য খুবই সীমিত।

বাধ্যতামূলক বেতন-কর (পে-রোল ট্যাক্স-শ্রম কর)-ভিত্তিক সামাজিক স্বাস্থ্যবিমা: কর্মজীবীদের সবার বাধ্যতামূলক অংশগ্রহণের মাধ্যমে বেতন উৎস থেকে বিমার কিস্তির অর্থ সংগ্রহের ওপর সামাজিক স্বাস্থ্যবিমা ব্যবস্থা প্রতিষ্ঠিত। প্রত্যেক কর্মজীবী তার স্বাস্থ্য ঝুঁকি নির্বিশেষে বিমায় অন্তর্ভুক্ত হবেন। উচ্চ আয়ের সঙ্গে বর্ধিত হারে তার কিস্তির পরিমাণ নির্ধারিত হয়। বিমার অর্থ একটি তহবিলে সংগৃহীত হয়ে তা একইরকম সুবিধাজনক স্বাস্থ্যসেবা প্যাকেজ হিসেবে সবার মধ্যে পুনর্বণ্টিত হয়। জনগোষ্ঠীর অসুস্থতার জন্য আর্থিক ঝুঁকি সবার ভেতরে ভাগাভাগি হওয়ার সুযোগ তৈরি করে। পৃথিবীর বিভিন্ন দেশে সামাজিক স্বাস্থ্যবিমার বৈশিষ্ট্যের ব্যাপক তারতম্য দেখা যায়- পরিচালনার ধরন-একক বা একাধিক কর্তৃপক্ষ, সরকারি বা বেসরকারি ব্যবস্থা, বিমার কিস্তির অর্থের অংশ ও প্রদানকারী, জনগোষ্ঠীর কারা ও কীভাবে অন্তর্ভুক্ত হবে, স্বাস্থ্য সেবায় কী কী অন্তর্ভুক্ত থাকবে (প্যাকেজ) ইত্যাদি নিয়ে। বিমা ব্যবস্থায় যত খণ্ডিতভাবেই অর্থ আদায় হোক তা সুবিধাজনক প্যাকেজ ক্রয়ে একটি তহবিলে স্থানান্তরিত করা (পুলিং) অধিকতর সাশ্রয়ী ও সমতা প্রতিষ্ঠায় সবচেয়ে কার্যকর। যারা বেসরকারি ঐচ্ছিক ও কমিউনিটি ভিত্তিক স্বাস্থ্যবিমার দুর্বলতা ধরতে পেরেছে তাদের কাছে বাধ্যতামূলক বেতন-কর-ভিত্তিক সামাজিক বিমা আকর্ষণীয় বিকল্প।

সামাজিক স্বাস্থ্যবিমা বাস্তবায়নের শুরুতে বিভিন্ন দেশ প্রথম আনুষ্ঠানিক খাতের কর্মজীবীদের আওতায় আনার সহজ লক্ষ্য নির্ধারণ করে। পরবর্তী সময়ে তাদের জন্য অবশিষ্ট জনগণকে সামাজিক স্বাস্থ্যবিমার আওতায় আনা কঠিন হয়ে পড়ে। জার্মানি ও ফ্রান্স তাদের শতভাগ জনগণকে সামাজিক বিমায় অন্তর্ভুক্ত করতে ১০০ বছরেরও বেশি সময় নিয়েছে। এশিয়া, আফ্রিকা, ল্যাটিন আমেরিকার নিম্ন ও মধ্যম আয়ের বহু দেশ কয়েক যুগ ধরে শ্রম-কর-ভিত্তিক বাধ্যতামূলক সামাজিক স্বাস্থ্যবিমা বাস্তবায়নের প্রচেষ্টা অব্যাহত রেখেছে।

কয়েক যুগ অতিক্রম করার পরেও কেনিয়া, তানজিনিয়াসহ অনেক দেশই তার ২০ শতাংশ জনগণকেও স্বাস্থ্যবিমার আওতায় আনতে সক্ষম হয়নি। যত ভালো উদ্দেশ্য থেকেই নেওয়া হোক- প্রথম আনুষ্ঠানিক খাতের কর্মজীবী অন্তর্ভুক্ত করার সহজ ধারণাটি স্বাস্থ্যসেবায় অসমতা তৈরি করে এবং অসমতা জেঁকে বসে; স্বাস্থ্যসেবা ব্যবস্থা দুই স্তরে বিভক্ত হয়ে যায়।

বাংলাদেশ কি বেতন-কর-ভিত্তিক সামাজিক স্বাস্থ্যবিমা প্রচলন করে স্বাস্থ্যসেবায় মানুষের অন্তর্ভুক্তি ও আর্থিক সুরক্ষা নিশ্চিত করতে পারবে? সরকারের ওপর এক ধরনের দেশি ও বিদেশি চাপ আছে স্বাস্থ্যবিমা প্রচলন করার; তেমনি সরকারও মনে করছে স্বাস্থ্য খাতে অভ্যন্তরীণ উৎস থেকে অতিরিক্ত অর্থের সংযোগ হবে। সর্বজনীন স্বাস্থ্য সুরক্ষা অর্জনের ধারণা অনেকের কাছে পরিষ্কার নয়। স্বাস্থ্যবিমার আগে সর্বজনীন শব্দ জুড়ে দিয়ে অনেকে গুলিয়ে ফেলছে সর্বজনীন স্বাস্থ্য সুরক্ষার সমার্থক হিসেবে। বাংলাদেশে অনেকে সরকারি অর্থায়নে পরিচালিত আয়ুষ্মান ভারত কর্মসূচির দিকে দৃষ্টি আকর্ষণ করে। ভারত সরকার সরকারি স্বাস্থ্য ব্যবস্থাকে দুর্বল করে রেখে অনিয়ন্ত্রিত বেসরকারি খাত থেকে স্বাস্থ্যসেবা ক্রয় করে কী অর্জন করতে চায় তা প্রশ্ন-সাপেক্ষ।

বাংলাদেশে স্বাস্থ্যবিমার ধারণা বা বাস্তবায়নের বিষয়টি প্রায় পুরোপুরি অনুপস্থিত। ২০১৬ সাল থেকে কালিহাতিসহ টাঙ্গাইলের কয়েকটি উপজেলায় সরকারি অর্থায়নে লক্ষ্যবিহীন পরীক্ষামূলক বিমা প্রকল্প চালু আছে। এটা আমলাদের প্রচারে ব্যবহারে চাতুর্যপূর্ণ সময়ক্ষেপণের চেয়ে বেশি কিছু নয়। সম্পদের সীমাবদ্ধতার মধ্যে কোন পথে এগিয়ে গেলে নীতি থেকে বাস্তবায়ন সম্ভব সে সম্পর্কে আমাদের স্বচ্ছ ধারণার ঘাটতি রয়েছে। বিভিন্ন দেশের অভিজ্ঞতাও আমরা নিতে পারছি না। বাংলাদেশের আনুষ্ঠানিক শ্রম খাত খুবই ক্ষুদ্র। তাই ভবিষ্যতে শ্রম-কর-ভিত্তিক বিমা ব্যবস্থা প্রচলন করতে পারলেও খুব সীমিত অর্থ সংগৃহীত হবে।

বাংলাদেশকে প্রায় শূন্য থেকে তৈরি করতে হবে বিমার প্রশাসনিক কাঠামো। বিমা পরিচালনার খরচ  বিমার কিস্তি থেকে সংগৃহীত অর্থের চেয়ে বেশি হওয়ার আশঙ্কা থেকে যায়! যুক্তরাষ্ট্রে বিমা পরিচালনার খরচ ৩০ শতাংশ। মানুষের মাথাপিছু আয় কি স্বাস্থ্যবিমার কিস্তি পরিশোধের উচ্চতায় উঠতে পেরেছে? বাংলাদেশে স্বনিযুক্ত পেশা ও অ-আনুষ্ঠানিক খাত শ্রমবাজারের দুই-তৃতীয়াংশের বেশি। তাদের সামাজিক স্বাস্থ্যবিমায় অন্তর্ভুক্ত করা এক চ্যালেঞ্জ হয়ে থাকবে। দেশের অর্থনীতিতে অগোছালো শ্রম বাজারে অ-আনুষ্ঠানিক খাতের প্রাধান্য আরও বহুদিন থেকে যাবে। অন্যদিকে আনুষ্ঠানিক খাতকে স্বাস্থ্যবিমার বাধ্যবাধকতায় নিতে গিয়ে দেশের দুর্বল আনুষ্ঠানিক শ্রম বাজার নড়বড়ে হয়ে যেতে পারে। মজুরি বৃদ্ধি হয়ে শ্রম বাজারে শ্রম চাহিদা কমিয়ে দিতে পারে। এমনকি নিয়োগকর্তা ও কর্মীরা প্রিমিয়াম ফাঁকি দিতে অবিশ্বাস্য সব নতুন পদ্ধতি আবিষ্কার করতে উৎসাহিত হবে। যা অর্থনীতির সচলতাকে আঘাত করতে পারে। এছাড়া প্রশ্ন তো থেকেই যাচ্ছে– প্রিমিয়ামের বিপরীতে একজন মানুষ কী সেবা পাচ্ছেন! কোনও কাল্পনিক প্রতিশ্রুতির পেছনে নয়, মানুষ উন্নত সেবার বিনিময়ে ব্যয় করতে অনেক বেশি আগ্রহী।

সামাজিক স্বাস্থ্যবিমা প্রগতিশীল কর ব্যবস্থা তুল্য। তথাপি নিম্ন ও নিম্ন-মধ্যম আয়ের দেশে সামাজিক স্বাস্থ্যবিমা বাস্তবায়নের কয়েক যুগের অভিজ্ঞতা বলছে ভিন্ন কথা। সামাজিক স্বাস্থ্যবিমা জনগোষ্ঠীর ব্যাপক অংশে সম্প্রসারিত হতে পারছে না; স্বাস্থ্য খাতে অতিরিক্ত অর্থ সরবরাহ করার ক্ষমতা কম। স্বাস্থ্যসেবা পেতে অসমতা আরও বৃদ্ধি করছে। সর্বজনীন স্বাস্থ্য সুরক্ষা অর্জনকে দূরে ঠেলে দিচ্ছে। বাংলাদেশের আর্থ-সামাজিক বাস্তবতায় তাই সামাজিক স্বাস্থ্যবিমা প্রচলনের কোনও উদ্যোগ স্বাস্থ্য খাতের নাজুক পরিস্থিতির উন্নতি না করে দুর্দশাগ্রস্ত পরিস্থিতি দীর্ঘস্থায়ী করবে।

স্বাস্থ্য ব্যয়ের বিভিন্ন উৎস: সব মানুষকে প্রয়োজন অনুযায়ী স্বাস্থ্যসেবা দিতে বিপুল অংকের অর্থের প্রয়োজন। যেসব উৎস থেকে এই অর্থ আসে সরকারি সাধারণ কর ব্যবস্থা (প্রত্যক্ষ ও অপ্রত্যক্ষ কর), স্বাস্থ্যবিমা, দেশি-বিদেশি অনুদান ও ব্যক্তির নিজ পকেট থেকে স্বাস্থ্যব্যয়। ব্যক্তির পকেট থেকে নিজস্ব ব্যয় কমানোর পদ্ধতি অনুসন্ধান এই নিবন্ধের মূল আলোচ্য। বিদেশি অনুদান অর্থায়নের মোট আয়তনের কাছে অপর্যাপ্ত, অর্থের প্রবাহ অস্থির ও নড়বড়ে। অগ্রাধিকার নির্ণয়, অপর্যাপ্ত সমন্বয় ইত্যাদি কারণে ক্রমশ নগণ্য হয়ে আসা বিদেশি অনুদান গুরুত্বহীন হয়ে পড়ছে।

স্বাস্থ্যসেবা পেতে আর্থিক সুরক্ষার ধারণাটি নতুন নয়। স্বাস্থ্যব্যয়ে আর্থিক ঝুঁকি সুরক্ষায় ঐতিহাসিকভাবে দুটি পদ্ধতি গড়ে উঠেছে- প্রথমটি হলো ১৪০ বছরের পুরনো সামাজিক স্বাস্থ্যবিমা হিসেবে জার্মানিতে বিসমার্ক মডেল আর দ্বিতীয়টি সাধারণ সরকারি রাজস্বভিত্তিক জাতীয় স্বাস্থ্য পরিষেবা হিসেবে দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধ-উত্তর যুক্তরাজ্যে বেভেরিজ মডেল।

শ্রমজীবীদের আর্থিক সুরক্ষা দিতে কর্মক্ষেত্রে নিয়োগ কর্তা ও কর্মীর অংশগ্রহণে স্বাস্থ্যবিমা প্রবর্তন হয়। তা অগ্রগতি অর্জন করে সাধারণ রাজস্ব আয়ভিত্তিক সরকারি ব্যবস্থা থেকে সবার জন্য স্বাস্থ্যসেবার ব্যবস্থার উদ্ভব হয়। সরকারি রাজস্ব আয়ভিত্তিক অর্থায়ন প্রগতিশীল কর ব্যবস্থার ওপর প্রতিষ্ঠিত ও স্বাস্থ্যসেবায় অধিকতর সমতা নিশ্চিত করে। উচ্চ আয়ের দেশ যুক্তরাজ্য, কানাডা, নিউজিল্যান্ড, সুইডেন এই পথ ধরে সর্বজনীন স্বাস্থ্য সুরক্ষা ব্যবস্থা  প্রতিষ্ঠা করতে পেরেছে। পৃথিবীর অনেক উচ্চ আয়ের দেশ- জাপান, জার্মানি, ফ্রান্স, তাইওয়ান, বেলজিয়াম সামাজিক স্বাস্থ্যবিমার পথ ধরে সর্বজনীন স্বাস্থ্য সুরক্ষা অর্জন করেছে। তবে উচ্চ ও উচ্চ-মধ্যম আয়ের কোনও দেশেই শেষ পর্যন্ত শ্রম-কর-নির্ভর সামাজিক স্বাস্থ্যবিমার ওপর দাঁড়িয়ে সর্বজনীন স্বাস্থ্য সুরক্ষা ব্যবস্থা প্রতিষ্ঠা করতে পারেনি। সরকারের প্রত্যক্ষ করের অর্থ তাদের বিপুলভাবে ব্যবহার করতে হয়েছে।

এশিয়ার মধ্যম আয়ের দেশ মালয়েশিয়া, দক্ষিণ কোরিয়া, থাইল্যান্ড, ইন্দোনেশিয়া, ভিয়েতনামসহ অনেক দেশ সর্বজনীন স্বাস্থ্য সুরক্ষা অর্জনে অগ্রগতির বিভিন্ন স্তরে অবস্থান করছে। প্রত্যেকটা দেশকেই নানা বাধা-বিপত্তিতে ভরা অমসৃণ পথে ভিন্ন ভিন্ন অভিজ্ঞতার ভেতর দিয়ে পাড়ি দিতে হচ্ছে। সরকারের সাধারণ রাজস্ব আয়ের ওপর নির্ভর করে অনেক দেশ সর্বজনীন স্বাস্থ্য সুরক্ষার অর্জনের পথ বেছে নিয়েছে। অনেক দেশ শুধু আনুষ্ঠানিক খাতের কর্মজীবীদের কাছ থেকে বিমার কিস্তি সংগ্রহে করে তা সরকারের জাতীয় স্বাস্থ্য সুরক্ষা কর্মসূচির তহবিলে একীভূত করেছে। সামাজিক স্বাস্থ্যবিমা ও সাধারণ রাজস্বভিত্তিক ব্যবস্থার সমন্বয়ে অনেক দেশে প্রচলিত হয়েছে জাতীয় সামাজিক স্বাস্থ্যবিমা। আর যখন সামাজিক স্বাস্থ্যবিমায় সরকারে সহায়তার অংশ বড় হয়ে যায় তা তখন রাজস্বভিত্তিক অর্থায়নের সমার্থক হয়ে দাঁড়ায়। বিশ্বের অনেক দেশ এখন সরকারি সাধারণ রাজস্বের ওপর নির্ভরশীলতা রেখে সামাজিক স্বাস্থ্যবিমাসহ অন্যান্য উৎস থেকে অর্থ সংগ্রহের মিশ্র জাতীয় কাঠামো গড়ে তুলছে।

বাংলাদেশের মতো নিম্ন-মধ্যম আয়ের একটি দেশ কোন পথে দ্রুততার সঙ্গে স্বাস্থ্য খাতে প্রয়োজনীয় অর্থের সংস্থান করতে পারবে? কোন পথে অর্থায়ন ব্যক্তির নিজস্ব পকেট থেকে ব্যয় কমাতে পারবে?

বাংলাদেশের স্বাস্থ্য খাতে সরকারি ব্যয় বৃদ্ধির আর্থিক সক্ষমতা কতটুকু: একটি দেশের আর্থিক সক্ষমতা যত বেশি থাকে স্বাস্থ্য খাতে সরকারি ব্যয় বৃদ্ধির সুযোগও তত বেশি সৃষ্টি হয়। বাংলাদেশ, সরকারের ব্যয় (বাজেট) জিডিপির ১৩-১৪ শতাংশের ওপরে নিতে পারছে না (১৫ শতাংশের নিচে দুর্বল সক্ষমতা নির্দেশক)। কর-জিডিপির অনুপাত ৮ শতাংশে নেমে এসেছে, যা বিশ্বে  সর্বনিম্ন। রাজস্ব আদায় কম হওয়ায় ব্যয়ের আকার বৃদ্ধি কঠিন হয়ে পড়েছে। বাজেটের ঘাটতি জিডিপির ৫ বা সাড়ে ৫ শতাংশের মধ্যেই থাকছে। বাজেট ঘাটতি নিয়ে তাই উৎকণ্ঠা ততটা নেই। গত অর্থবছর শেষে বাংলাদেশ সরকারের ঋণের পরিমাণ ছিল ১৪৭ দশমিক ৮ বিলিয়ন ডলার। ২০২০-২১ অর্থবছর শেষে বিদেশি উৎস থেকে সরকারের ঋণের পরিমাণ দাঁড়িয়েছে ৬২ বিলিয়ন ডলারে। বাংলাদেশের বৈদেশিক ঋণ জিডিপির ১৭ দশমিক ৫ শতাংশ। (এখানে উল্লেখ্য,  শ্রীলঙ্কার যা প্রায় ৪৮ শতাংশ। শ্রীলঙ্কার বিদেশ থেকে নেওয়া ঋণের সুদের হার হলো গড়ে ৬ শতাংশের ওপরে। বাংলাদেশের সুদের হার এখনও ২ শতাংশের নিচে। ঋণ পরিশোধে বৈদেশিক মুদ্রার রিজার্ভের অবস্থাও বিবেচ্য)।

এ মুহূর্তে বাজেটের অন্যতম বড় ব্যয়ের খাত হয়ে উঠেছে ঋণের সুদ পরিশোধ। দেশি-বিদেশি উৎস থেকে সরকারের নেওয়া ঋণের সুদ পরিশোধের অর্থের পরিমাণ বাজেটে স্বাস্থ্য খাতে বরাদ্দের চেয়ে বেশি। সামষ্টিক অর্থনীতির সূচক বলছে অর্থনীতি চাপের মধ্যে দিয়ে চলছে তবে দেনা সংক্রান্ত বিষয়ে উদ্বেগ দেখা দেওয়ার সম্ভাবনা খুবই কম। কোভিড-১৯, ইউক্রেন-রাশিয়া যুদ্ধের মধ্যেও বাংলাদেশের অর্থনীতি টালমাটাল হয়ে পড়েনি। জিডিপির ধারাবাহিক প্রবৃদ্ধির হার বলছে বাংলাদেশের অর্থনীতি ইতিবাচক ধারায় আছে। তবে কর-জিডিপি অনুপাত বৃদ্ধি করতে পারলে ঋণের চক্র থেকে বেরিয়ে আসা সম্ভব হবে। তাই সামষ্টিক অর্থনীতির সূচকে বাংলাদেশ স্বাস্থ্য খাতে এ মুহূর্তেই বাজেট বৃদ্ধি করতে সক্ষম। অর্থনীতির গতিশীলতাকে বিঘ্নিত না করেই। প্রশ্ন সরকারের সদিচ্ছার, প্রতিজ্ঞাবদ্ধতার। আমাদের নীতিনির্ধারকরা কি অবগত নন-স্বাস্থ্য খাতে বিনিয়োগ ছাড়া টেকসই উন্নয়ন সম্ভব নয়। স্বাস্থ্য খাতে বিনিয়োগ শুধু খরচ নয় তা নানাভাবে অর্থনীতি শক্তিশালী করে এবং দারিদ্র্য নিরসনে ও অসমতা দূরীকরণে ভূমিকা রাখে। তাই সামাজিক ন্যায্যতা প্রতিষ্ঠার নীতিগত অবস্থান থেকে স্বাস্থ্যসেবা প্রাপ্তিতে সমতা প্রতিষ্ঠা জরুরি। স্বাস্থ্য খাতে বিনিয়োগ  উন্নত শ্রমশক্তি জোগান, স্কুল শিক্ষায় ভালো অবদান, নারীদের কর্মসংস্থানের সুযোগ ও অর্থনীতিতে উচ্চ উৎপাদনশীলতা তৈরি করবে।

বাংলাদেশে স্বাস্থ্যসেবার অর্থায়ন পুরোপুরি সরকারি সাধারণ কর ব্যবস্থা থেকে আসে। দেশের সাধারণ কর ব্যবস্থায় করভিত্তির আওতা সম্প্রসারিত করে, খণ্ডিত অর্থায়ন ব্যবস্থাকে একত্রিত করে পুনর্বণ্টনের মাধ্যমে, নতুনভাবে অগ্রাধিকার স্থির করে অর্থের সরবরাহ ব্যাপকভাবে বাড়ানোর সুযোগ আছে। কর আদায়ে বিশ্বে দুর্বল অবস্থানে বাংলাদেশ- জিডিপির মাত্র ৮ শতাংশ। রাজস্ব আদায় বৃদ্ধি করতে কর প্রশাসনের আধুনিকায়ন, কর আইনগুলোর সংস্কার ও কর কর্মকর্তাদের দক্ষতা বৃদ্ধি অপরিহার্য হয়ে পড়েছে। কর আদায়ে ফাঁকি, দুর্নীতি ও হয়রানি রোধ করতে হবে। দরিদ্র ও অ-আনুষ্ঠানিক খাতের জনগোষ্ঠীর কাছে স্বাস্থ্যবিমার কিস্তি সংগ্রহের প্রচেষ্টার চেয়ে অনেক বেশি সহজে স্বাস্থ্য খাতে অর্থায়ন সম্ভব হতে পারে সংকীর্ণ কর ব্যবস্থার সম্প্রসারণ ঘটিয়ে।

বিতর্ক অনেক কিছু নিয়েই চলতে পারে। স্বাস্থ্য খাতে সরকারি বাজেট বৃদ্ধির প্রয়োজনীয়তা এখন বিতর্কের ঊর্ধ্বে। আসন্ন বাজেটে স্বাস্থ্য খাতে বরাদ্দ জিডিপির দুই শতাংশে উন্নীত হওয়া দীর্ঘ প্রত্যাশিত। অর্থমন্ত্রী চিন্তা করুন কীভাবে তিনি এই অর্থের সংস্থান করবেন। স্বাস্থ্য খাতে জিডিপির অন্তত ৫ শতাংশ বা বাজেটের ১৫ শতাংশ বরাদ্দ রাখার সুপারিশ বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থার। জিডিপির প্রতি ১ শতাংশ স্বাস্থ্য ব্যয় বৃদ্ধি ০.১৩ শতাংশ মানুষকে বিপর্যয়কর আর্থিক অবস্থায় পতিত হওয়া থেকে রক্ষা করবে। শুধু অনুকরণ করে নয়, সৃজনশীল নিজস্ব কোনও অর্থনৈতিক মডেল তৈরি করে কি আমরা স্বাস্থ্য খাতের অর্থ সংকটের তীব্রতা কমিয়ে আনতে পারি না?

স্বাস্থ্যসেবা প্রদানের চ্যালেঞ্জকে দুটো অংশ বিভক্ত করা যায়- অর্থায়ন (ফাইন্যান্সিং) ও সেবা প্রদান (সার্ভিস ডেলিভারি)। স্বাস্থ্য খাতে দুর্নীতি, চিকিৎসকদের দুর্ব্যবহার, বাজেট বাস্তবায়নে সক্ষমতার অভাবকে বড় করে দেখিয়ে স্বাস্থ্য খাতে ন্যূনতম বরাদ্দ দিতে বাধা দেওয়া হচ্ছে। তাই স্বাস্থ্য খাতে পরিবর্তনের সূচনায় যারা নেতৃত্ব দিতে চায়– তাদের প্রতিটি অর্থের কণাকে মূল্যবান মনে করতে হবে এবং দক্ষতার সঙ্গে তার সদ্ব্যবহার নিশ্চিত করতে হবে।

স্বাস্থ্যসেবায় অর্থ সংকটের বাস্তবতাকে মেনে নিয়েই ব্যয় ব্যবস্থাপনায় অগ্রাধিকার নির্ধারণ করতে হবে। যে সেবা দিতে চাওয়া হচ্ছে তার ব্যয় বের করে বরাদ্দের মধ্যেই সাজাতে হবে প্যাকেজ। দরিদ্র, দুর্বল জনগোষ্ঠীকে সর্বোচ্চ সংখ্যায় অন্তর্ভুক্ত  (পপুলেশন কভারেজ) করাকে অগ্রাধিকারে রেখে কি কি সেবা দেওয়া (সার্ভিস কভারেজ) সম্ভব বিবেচনায় নিতে হবে। দুর্নীতির বিরুদ্ধে শক্ত অবস্থান নিতে হবে। জনগণের সামনে স্বাস্থ্য খাতে ব্যয় ও ফলাফল স্বচ্ছতার সঙ্গে তুলে ধরতে হবে। সরকারের সমীক্ষায় ব্যক্তির নিজস্ব ব্যয়ের মধ্যে ৬৩ শতাংশ খরচ হয় ওষুধে। সর্বজনীন স্বাস্থ্য সুরক্ষা অর্জনে শক্তিশালী প্রাথমিক স্বাস্থ্যসেবা ব্যবস্থা সবচেয়ে সাশ্রয়ী ও কার্যকর ভূমিকা রাখে। প্রাথমিক স্বাস্থ্যসেবা ব্যবস্থাকে প্রকৃত গেটকিপার হিসেবে গড়ে তুলতে হবে।

রোগ প্রতিরোধে সর্বাত্মক উদ্যোগের মাধ্যমে জনস্বাস্থ্য কর্মসূচি বাস্তবায়ন করতে হবে। ওষুধ, চিকিৎসা সামগ্রী ও নতুন প্রযুক্তি ক্রয় ও সরবরাহে ওষুধ ও চিকিৎসা সামগ্রী প্রস্তুতকারক প্রতিষ্ঠানের সঙ্গে ন্যায়সঙ্গত বোঝাপড়া করতে সক্ষম নিশ্ছিদ্র কাঠামো গড়ে তুলতে হবে। অলাভজনক বেসরকারি স্বাস্থ্যসেবা গড়ে তুলতে সহায়তা দিতে হবে। সরকারি ও বেসরকারি স্বাস্থ্য ব্যবস্থার মধ্যে সেবার মান ও ব্যয়ের পার্থক্য কমিয়ে আনতে হবে। সরকারি-বেসরকারি স্বাস্থ্যসেবার পাশাপাশি স্বাস্থ্যসেবায় নিয়োজিত ত্যাগী মনোভাব ও সক্ষমতার অধিকারী এনজিওদের জন্য পরিপূরক হয়ে কাজ করার সুযোগ রাখতে হবে। কর্মক্ষেত্রে সুখী স্বাস্থ্যসেবা কর্মীদের ছাড়া উন্নত সেবা আশা করা যায় না। স্বাস্থ্যসেবা কর্মীদের জীবনমান উন্নয়নে বিনিয়োগ করতে হবে।

সর্বজনীন স্বাস্থ্য সুরক্ষা অর্জনের অভিযাত্রায় সিঁড়ির সর্বশেষ ধাপে বাংলাদেশ। স্বাস্থ্য খাতের প্রতি সরকারের ক্রমাগত অবহেলার সুযোগে রাজনৈতিক-অর্থনীতির নতুন কুশীলবদের আবির্ভাব ঘটছে। ইতোমধ্যে বিভিন্ন প্রভাবশালী গোষ্ঠী সরকারি অর্থে তাদের নিজেদের জন্য হাসপাতাল, বিভিন্ন স্বাস্থ্য সুবিধা আদায় করে নিচ্ছে। এসবের ফলে জনগণের স্বাস্থ্যসেবা প্রাপ্তিতে অসমতা আরও বেড়ে যাবে। ভবিষ্যতে নীতিনির্ধারকদের মত পরিবর্তন করতে গেলে সেই সিদ্ধান্ত থেকে সরে আসা অনেক কঠিন হয়ে পড়বে। গত ২০ বছরের বাজেট পর্যালোচনা করলে দেখা যাবে স্বাস্থ্য খাতে সরকারের অংশ জিডিপি ১ শতাংশের নিচে এবং বাজেটের ৫ শতাংশের নিচে থেকেছে। এ থেকে প্রতীয়মান হয় স্বাস্থ্য খাত সরকারের অগ্রাধিকারে নেই, স্বাস্থ্য খাত নিয়ে সরকারে কোনও সুদূরপ্রসারী পরিকল্পনা নেই।

কলমের এক খোঁচায় রাষ্ট্রীয় আদেশে সর্বজনীন স্বাস্থ্য সুরক্ষা অর্জিত হয়ে যাবে না। গত ৫০ বছরে নিম্ন ও নিম্ন-মধ্যম আয়ের দেশগুলোর অভিজ্ঞতা থেকে শিক্ষা নিয়ে নিজেদের স্বাস্থ্যসেবা ব্যবস্থার ঐতিহাসিক বিবর্তন, সাংস্কৃতিক গ্রহণযোগ্যতা ও রাজনৈতিক-অর্থনীতির বাস্তবতা মাথায় রেখে স্বাস্থ্য ব্যবস্থা গড়ে তুলতে হবে। সর্বজনীন স্বাস্থ্য সুরক্ষা অর্জনের অগ্রগতি পরিমাপে একটি সমন্বিত জাতীয় স্বাস্থ্য ডাটাবেস প্রয়োজন। সেখান থেকে প্রতিনিয়ত প্রাপ্ত তথ্য বিশ্লেষণ করে, পরিকল্পনা তৈরি করে, বাস্তবায়ন ও সাফল্য-ব্যর্থতার শিক্ষা থেকে নতুন সিদ্ধান্ত নিয়ে বিনির্মাণ করতে হবে সর্বজনীন স্বাস্থ্য সুরক্ষা কাঠামো। পৃথিবীর যেসব দেশ সর্বজনীন স্বাস্থ্য সুরক্ষা অর্জন করতে পেরেছে, তাদের রাজনৈতিক এজেন্ডায় ধারাবাহিকভাবে অগ্রাধিকারের সবার উপরে ছিল স্বাস্থ্যখাতে উচ্চ বাজেট বরাদ্দ। দরিদ্র ও দুর্বল জনগোষ্ঠীর জন্য স্বাস্থ্যসেবার আওতা সম্প্রসারিত করতে ও সুবিধাবাদী গোষ্ঠীর ওপরে প্রান্তিক মানুষের স্বরকে প্রতিষ্ঠা করতে প্রয়োজন সুকঠিন রাজনৈতিক প্রতিজ্ঞা।

লাখো মানুষের রক্তে আমরা সংবিধানে লিখেছি সমতাভিত্তিক রাষ্ট্র প্রতিষ্ঠার অঙ্গীকারে। চিকিৎসা নিতে গিয়ে ব্যক্তি বা পরিবার নিঃস্ব হবে না, আরও দারিদ্র্যের দিকে ধাবিত হবে না, তা হোক আমাদের মানবিক আকাঙ্ক্ষার মৌল ভিত্তি।  

লেখক: অবসরপ্রাপ্ত ব্রিগেডিয়ার জেনারেল। সিনিয়র কনসালটেন্ট ও ল্যাব কো-অর্ডিনেটর, প্যাথলজি বিভাগ, এভার কেয়ার হাসপাতাল।
 
 
/এসএএস/এমওএফ/

*** প্রকাশিত মতামত লেখকের একান্তই নিজস্ব।

বাংলা ট্রিবিউনের সর্বশেষ
শিশুশিক্ষার্থীকে বেধড়ক মারপিট, মাদ্রাসাশিক্ষক আটক
শিশুশিক্ষার্থীকে বেধড়ক মারপিট, মাদ্রাসাশিক্ষক আটক
এবার ‘হুব্বা’ নামে হলো গানচিত্র
এবার ‘হুব্বা’ নামে হলো গানচিত্র
আঙুরের গোড়া কালো হয়ে যাচ্ছে? জেনে নিন টিপস
আঙুরের গোড়া কালো হয়ে যাচ্ছে? জেনে নিন টিপস
টেকনাফে ১০ জন কৃষক অপহরণের ঘটনায় ২ জন আটক
টেকনাফে ১০ জন কৃষক অপহরণের ঘটনায় ২ জন আটক
সর্বশেষসর্বাধিক

লাইভ