X
বুধবার, ২৪ এপ্রিল ২০২৪
১১ বৈশাখ ১৪৩১

জনগ, জঙ্গি ও মুক্তিযোদ্ধা

মো. আবুসালেহ সেকেন্দার
২৯ মে ২০২২, ২১:২৯আপডেট : ২৯ মে ২০২২, ২১:৩১

বাংলাদেশের ইসলামি ডায়াসপোরায় ‘জঙ্গি’ শব্দটি নিয়ে এক ধরনের উচ্ছ্বাস আছে। তারা মনে করে, জঙ্গি শব্দটি খুবই ইতিবাচক এবং ইসলামি শব্দ। পশ্চিমা মিডিয়া ও বুদ্ধিজীবীরা ইচ্ছে করেই ইসলাম বিদ্বেষের কারণে এই  শব্দটিকে নেতিবাচকভাবে ব্যবহার করছে। ফলে বাংলাদেশের কিছু উলামারা সুযোগ পেলেই ‘জঙ্গি’ শব্দটি যে ইতিবাচক ও মুসলিমদের জন্য গৌরবজনক তা প্রমাণে তৎপর হন।

এই ধারাবাহিকতায় সম্প্রতি নারায়ণগঞ্জের এক বিতর্কিত ধর্মীয় বক্তা ‘জঙ্গি’ শব্দটির ইতিবাচক দিক তুলে ধরতে গিয়ে বাংলাদেশের মুক্তিযোদ্ধাদের ‘জঙ্গি’ অভিহিত করেছেন। তিনি দাবি করেছেন, ১৯৭১ সালের মহান মুক্তিযুদ্ধের সময়ে দেশমাতৃকার স্বাধীনতা অর্জনে যেসব মুক্তিযোদ্ধা পাকিস্তানি বাহিনীর বিরুদ্ধে যুদ্ধ করেছেন তারাও ‘জঙ্গি’। তার ওই দাবির প্রমাণ হিসেবে তিনি জঙ্গিবিমান শব্দটিকে ঘুঁটি হিসেবে ব্যবহার করেন। তিনি দাবি করেন, জঙ্গি শব্দটি যদি খারাপই হবে তাহলে যুদ্ধবিমানের নাম জঙ্গিবিমান হতো না। তাই জঙ্গি শব্দটি ইতিবাচক।

ওই বক্তার যুক্তিতর্কে জঙ্গিবাদের ‘জঙ্গি’ শব্দটিকে ইতিবাচক হিসেবে প্রতিষ্ঠিত করা এবং মুক্তিযোদ্ধাদেরও ‘জঙ্গি’ বলা সেই প্রয়াসের অংশ। ফারসি ‘জঙ্গ’ শব্দ থেকে ‘জঙ্গি’ শব্দটির উৎপত্তি। ‘জঙ্গ’ অর্থ যুদ্ধ। আর ‘জঙ্গি’ অর্থ ‘যোদ্ধা’। অর্থাৎ যারা যুদ্ধের ময়দানে লড়ে তারাই ‘জঙ্গি’। তাই জঙ্গিবাদের ‘জঙ্গি’রা হচ্ছে ‘যোদ্ধা’। সন্ত্রাসী ও যোদ্ধার মধ্যে যে পার্থক্য রয়েছে এর মাধ্যমে তা নাকচ করার চেষ্টা করা হয়েছে।

অবশ্য তাদের ওই যুক্তির পক্ষে ‘তথ্য-প্রমাণ’ও তাদের হাতে রয়েছে। রাষ্ট্রীয় অর্থে পরিচালিত ও নিজেকে সেক্যুলার প্রতিষ্ঠান দাবিকারী বাংলা একাডেমি প্রকাশিত ‘বাংলা একাডেমি ব্যবহারিক বাংলা অভিধান’ গ্রন্থটিই এক্ষেত্রে তাদের সওয়াল জবাবের জন্য যথেষ্ট। ইসলামি বলয়ের অনেকে মুখে স্বীকার না করলেও তারা যে উক্ত অভিধান দ্বারা বেশ প্রভাবিত তা তাদের কথাবার্তায় বোঝা যায়। উক্ত অভিধান গ্রন্থের ৪৮৮নং পৃষ্ঠায় আলোচিত জঙ্গি শব্দের ভুক্তিতে বলা হয়েছে: ‘জঙ্গ’ শব্দটির অর্থ যুদ্ধ বা লড়াই। ফারসি জঙ্গ (زنگ) শব্দ থেকে বাংলা জঙ্গি শব্দটির উৎপত্তি। বাংলা একাডেমির মতো খ্যাতিমান একটি প্রতিষ্ঠান থেকে প্রকাশিত অভিধান যেখানে এমন দাবি করছে সেখানে ওই বক্তার মতো কিছু ‘কাঠমোল্লা’দের দোষ দিয়ে কী লাভ?

যদিও বাংলা একাডেমি প্রকাশিত উপর্যুক্ত অভিধান ও উক্ত ‘কাঠমোল্লা’ উভয়ের বক্তব্যই ঠিক নয়। কারণ, প্রথমত, ফারসি উপর্যুক্ত زنگ শব্দটির উচ্চারণ জঙ্গ নয়। ঠিক উচ্চারণ হচ্ছে জনগ। দ্বিতীয়ত, জনগ (زنگ) শব্দের অর্থ যুদ্ধ নয়। ফারসি জনগ (زنگ) শব্দের অর্থ বেল বা ঘণ্টা, শিক্ষা প্রতিষ্ঠানের পিরিয়ড বা কাল। অবশ্যই বাংলা যুদ্ধ শব্দের ফারসি প্রতিশব্দও জনগ (جنگ)। তবে ওই জনগ (زنگ) আর এই জনগ (جنگ)-এর মধ্যে বানান, ব্যবহার ও অর্থগত পার্থক্য রয়েছে।

বাংলা জঙ্গ শব্দটি, যার অর্থ যুদ্ধ, এই জনগ (جنگ) শব্দ উদ্ভূত। ওই কারণে বাংলাভাষী কিছু ইসলামিস্টরা মনে করছেন, জনগ বা জঙ্গ, যার অর্থ যুদ্ধ, শব্দ থেকে জঙ্গিবাদের জঙ্গি শব্দটির উৎপত্তি। কিন্তু বাস্তবিক পক্ষে ‘জঙ্গি’ শব্দটি যুদ্ধ অর্থে ব্যবহৃত হওয়া জনগ (جنگ) বা জঙ্গ শব্দ থেকে আসেনি।

জঙ্গিবাদের ‘জঙ্গি’ উৎপত্তি হয়েছে জনগ (زنگ) শব্দ থেকে। এই জনগ (زنگ) শব্দটির অর্থ অবশ্যই যুদ্ধ নয়। জনগ (زنگ) শব্দের আরও কিছু অর্থও রয়েছে। শব্দটি যখন নামবাচক বিশেষ্য বা প্রপার নাউন (Proper Noun) হিসেবে ব্যবহৃত হয় তখন এর অর্থ হয় ভিন্ন; তখন জনগ (زنگ) শব্দের অর্থ হয় কালো, নিগ্রো ও মুর। বিখ্যাত ফারসি অভিধান দেহখোদা’র মতে, জঙ্গি (زنگی) অর্থ নিগ্রো। সমকালীন ইউরোপে কালো, বা আবিসিনিয়ার মানুষদের অসভ্য বা বর্বর বিবেচনা করা হতো। ভারতীয়রাও ইউরোপীয়দের মতো জনগ (زنگ) শব্দটি আবিসিনিয়ান, কালো মানুষ বা মুর (অসভ্য ও বর্বর অর্থে) ব্যবহার করে। হিন্দি ও উর্দু ভাষায় জনগ (زنگ) শব্দটি কালো, আবিসিনিয়া, মুর বোঝাতে আত্তীকরণ হয়েছে। বিখ্যাত উর্দু অভিধান রেকতার মতে, জঙ্গি (زنگی) শব্দের অর্থ নিগ্রো, মুর।

সম্প্রতি ওয়ার অন টেরর-এর যুগেও ‘জঙ্গি’ শব্দটি অসভ্য ও বর্বর মানুষ অর্থে ব্যবহৃত হয়েছে। অসভ্য ও বর্বর মানুষকে জঙ্গি এবং তাদের আদর্শকে জঙ্গিবাদ বলে। জনগ (زنگ) শব্দের উপর্যুক্ত ব্যবহারগত অর্থ থেকেই জঙ্গিবাদের জঙ্গি (زنگی) শব্দটির উৎপত্তি।

বাংলা ভাষায় জঙ্গি শব্দটি দুইভাবে যুক্ত হয়েছে। একটি আধুনিক যুগে, ওয়ার অন টেররের কালে। অন্যটি মধ্যযুগে সরাসরি ফারসি থেকে যুদ্ধ অর্থে। মধ্যযুগের সাহিত্য পড়লে তা বোঝা যাবে। ফকির গরীবুল্লাহ বা দৌলত উজির বহরাম খাঁর লেখা জঙ্গনামা গ্রন্থটি তার উৎকৃষ্ট প্রমাণ। যুদ্ধকাহিনির বিবরণ থাকায় ওই গ্রন্থের নাম জঙ্গনামা হয়েছে। কিন্তু ওয়ার অন টেররের যুগে হিন্দি-উর্দুর (মূলত হিন্দির) প্রভাবে ‘জঙ্গি’ শব্দটি বাংলা ভাষায় আত্তীকরণ করেছে। কিন্তু বাংলা একাডেমির ব্যবহারিক বাংলা অভিধান-এ জঙ্গ শব্দের একটি ভুক্তি থাকায় এই বিভ্রান্তি তৈরি হয়েছে।

অনেকে জঙ্গনামার জঙ্গ, জঙ্গিবিমানের জঙ্গ এবং জঙ্গিবাদের জঙ্গকে এক মনে করছেন। কিন্তু প্রকৃতপক্ষে জঙ্গনামার জঙ্গ, জঙ্গিবিমানের জঙ্গ এক হলেও জঙ্গিবাদের জঙ্গ-এর ভিন্ন অর্থ রয়েছে। একটি যুদ্ধ অর্থে ব্যবহৃত হলেও অন্যটির অর্থ অসভ্য ও বর্বর। তাই মুক্তিযোদ্ধাদের জঙ্গি বলার এবং মুক্তিযোদ্ধাদের জঙ্গি বলে জঙ্গিবাদকে জায়েজ করার আগে জনগ (زنگ) ও জনগ (جنگ) এবং জঙ্গি (زنگی)  ও জঙ্গি (جنگی) শব্দের অর্থ, ব্যবহার ও উৎপত্তিগত পার্থক্য জানা জরুরি। ওয়ার অন টেররের যুগে জঙ্গি ও জঙ্গিবাদ শব্দটি কী অর্থে ব্যবহৃত হয়েছে তা বোঝা দরকার। জঙ্গিবিমানের জঙ্গি আর জঙ্গিবাদের জঙ্গি যে এক নয় সেটা জানা দরকার।

অবশ্য সম্প্রতি নিরপেক্ষ ইতিহাস চর্চার নামে বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধ ও মুক্তিযোদ্ধাদের কলঙ্কিত করার যে চেষ্টা দেশে ও বিদেশে চলছে, যদি তাদের সঙ্গী হয়ে তাদের এজেন্ডা বাস্তবায়নের জন্য এ ধরনের বক্তব্য দিয়ে থাকেন তাহলে সেটি ভিন্ন বিষয়।

দীর্ঘদিন ধরে নীরবে দেশি ও বিদেশি একটি চক্র শর্মিলা বোসের ডেড রেকনিং গ্রন্থের মতো বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধ ও মুক্তিযোদ্ধাবিরোধী শক্তিশালী লিটারেচার তৈরির চেষ্টা করছে। তাই ওই বক্তার মুক্তিযোদ্ধাদের জঙ্গি বলার ঘটনা ‘স্লিপ অব টাং’ বা মুখ ফসকে বলা, না বুঝে বলা মনে করলে প্রকৃত সত্য উপলব্ধি করা যাবে না। বরং বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধ ও মুক্তিযোদ্ধাবিরোধী লিটারেচার তৈরির দেশি-বিদেশি চক্রের তৎপরতার সঙ্গে মেলালে প্রকৃত ঘটনা উপলব্ধি করা যাবে। বোঝা যাবে যে মুক্তিযোদ্ধাদের জঙ্গি বলার ঘটনা সাধারণ কোনও কথা নয়, বরং বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধ ও মুক্তিযোদ্ধাদের কলঙ্কিত করতে দেশি-বিদেশি একটি চক্র দীর্ঘদিন যে লিটারেচার তৈরির চেষ্টা করছে, মুক্তিযোদ্ধাদের জঙ্গি বলার দাবি ওই লিটারেচার কারখানার সুড়ঙ্গের মুখের আলো।

লেখক: সহকারী অধ্যাপক, ইসলামের ইতিহাস ও সংস্কৃতি বিভাগ, জগন্নাথ বিশ্ববিদ্যালয়।

/এসএএস/এফএ/এমওএফ/

*** প্রকাশিত মতামত লেখকের একান্তই নিজস্ব।

বাংলা ট্রিবিউনের সর্বশেষ
চেলসিকে গুঁড়িয়ে দিলো আর্সেনাল
চেলসিকে গুঁড়িয়ে দিলো আর্সেনাল
আদালতে সাক্ষ্য দিতে এসে কাঁদলেন মিতুর মা
আদালতে সাক্ষ্য দিতে এসে কাঁদলেন মিতুর মা
‘ভুঁইফোড় মানবাধিকার প্রতিষ্ঠানগুলো মানবাধিকার লঙ্ঘন করছে’
‘ভুঁইফোড় মানবাধিকার প্রতিষ্ঠানগুলো মানবাধিকার লঙ্ঘন করছে’
গরমে স্বস্তির খোঁজে লোকালয়ে ঢুকছে সাপ, সচেতনতার আহ্বান ডিএমপির
গরমে স্বস্তির খোঁজে লোকালয়ে ঢুকছে সাপ, সচেতনতার আহ্বান ডিএমপির
সর্বশেষসর্বাধিক

লাইভ