X
রবিবার, ০৫ মে ২০২৪
২২ বৈশাখ ১৪৩১

সীতাকুণ্ডের অগ্নিকুণ্ড শেষ অগ্নিকাণ্ড হোক

গওহার নঈম ওয়ারা
০৬ জুন ২০২২, ১৮:১৬আপডেট : ১৮ এপ্রিল ২০২৩, ১৪:২৮

পৌরাণিক আমলে বৃন্দাবনে এক মহা-অগ্নিকাণ্ডের কথা শোনা যায়। সেই অভিজ্ঞতা থেকে তৈরি লোক ছাড়া নির্দিষ্ট করে বলে দিয়েছে কে পারবে সেই আগুন নেভাতে। ‘আমার ভাই বলরাম সে নেভাতে পারে’। আগুন নেভানো যার-তার কাজ নয়, এ কাজ বলরামদের কাজ। এবার আমরা একসাথে অনেক বলরাম হারালাম। হারানোর মিছিল কোথায় গিয়ে থামবে তা এখন হলফ করে বলা যাবে না। কোনোদিনও কি বলা যাবে?

শনিবার (৪ জুন) রাত সাড়ে ৯টার দিকে সীতাকুণ্ডে বিএম কনটেইনার ডিপোতে অগ্নিকাণ্ডের ৩৬ ঘণ্টা পরও আগুন পুরোপুরি নিয়ন্ত্রণে আসেনি। ফায়ার সার্ভিসের ২৫টি ইউনিট ছাড়াও আগুন নিয়ন্ত্রণে ২৫০ জন সেনা সদস্য কাজ করছেন। ঢাকা থেকে পাঠানো হয়েছে ফায়ার সার্ভিসের কেমিক্যাল আগুন নেভানোর বিশেষায়িত দল।

শেষ খবর পাওয়া পর্যন্ত অগ্নিকাণ্ডের ঘটনায় নিহতের সংখ্যা ছিল ৪৯ জন কিন্তু ৬ জুন দুপুরে জানানো হয় সংখ্যাটি হবে ৪১।

তবে এরমধ্যে ফায়ার সার্ভিসের কর্মী ১২ জন। আহত হয়েছেন কমপক্ষে ৪০০ জন। তাদের চট্টগ্রাম মেডিক্যালে কলেজ হাসপাতালসহ চট্টগ্রামের বিভিন্ন হাসপাতালে ভর্তি করা হয়েছে। আহত কয়েকজনকে সেনাবাহিনীর হেলিকপ্টারে করে ঢাকা আনা হয়েছে। আরও আহতদের আনা হবে।

বিএম কনটেইনার ডিপোর অবস্থান চট্টগ্রাম থেকে ২০ কিলোমিটার দূরে সীতাকুণ্ডে ২৪ একর জমির ওপর। সেখানে আগুনের সময় অন্তত ৬০০ জন কর্মী ছিলেন। প্রায় সাড়ে চার হাজার কনটেইনার ছিল। এরমধ্যে ৯০ ভাগই গার্মেন্টস পণ্য।

ফায়ার সার্ভিস সূত্র জানায়, ডিপো কর্তৃপক্ষ তাদের ফোন করেনি। স্থানীয় বাসিন্দাদের কাছ থেকে টেলিফোন পেয়ে ফায়ার সার্ভিসের সদস্যরা আগুন নেভাতে ছুটে যান। ফায়ার সার্ভিসের ১২ জন কর্মী আগুন নেভাতে গিয়ে মারা গেছেন। এরমধ্যে এখন পর্যন্ত ৯ জনের মরদেহ শনাক্ত করা সম্ভব হয়েছে। এছাড়া ১৫ কর্মী সিএমএইচে চিকিৎসা নিচ্ছেন। এছাড়া আগুন নেভাতে যাওয়া ফৌজদারহাট পুলিশ ফাঁড়ির ১০ সদস্য আহত হন। বিস্ফোরণে এক পুলিশ সদস্যের পা বিচ্ছিন্ন হয়ে যায়।

কেন এত মৃত্যু

ফায়ার সার্ভিস কর্মীদের ধারণা ছিল, কনটেইনারের ভেতর পোশাকসহ অন্যান্য মালামাল রয়েছে। আগুন নেভানোর কাজ শুরু করার পরেও ডিপো কর্তৃপক্ষ হাইড্রোজেন পার-অক্সাইডের কথা জানায়নি। ফলে বিস্ফোরণের সময় ডিপোর ভেতরে যারা ছিলেন, তারা আর অক্ষত অবস্থায় ফিরতে পারেননি। শুরুতে কুমিরা ও সীতাকুণ্ড স্টেশনের সদস্যরা ফায়ার স্যুট (অগ্নিনির্বাপণের পোশাক) পরে আগুন নেভাতে বের হন। এজন্যই তারা বেশি ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে বলে বলা হচ্ছে।  রাসায়নিকের আগুন হলে বিশেষায়িত পোশাকে আসার কথা (কেমিক্যাল স্যুট)। এটি পরে ১০ থেকে ১৫ মিনিটে রাসায়নিকের আগুন মোকাবিলা করা যায়। পরবর্তী সময়ে এমন পোশাক পরে ফায়ার সার্ভিস সদস্যদের আগুন নেভানোর কাজে দেখা যায়।

চট্টগ্রামের সীতাকুণ্ডের বিএম কন্টেইনার ডিপোর বিস্ফোরণ এবং আগুন ছড়িয়ে পড়ার কারণ হিসেবে চিহ্নিত করা হচ্ছে হাইড্রোজেন পার-অক্সাইডকে। বিশেষজ্ঞরা বলছেন, হাইড্রোজেন পার-অক্সাইড নিজে দাহ্য নয় কিন্তু এটা উৎকৃষ্ট জারক। এর ধারে-কাছে আগুন জ্বলতে জ্বলতে তাপমাত্রা ১৫০.২ ডিগ্রি সেলসিয়াসে পৌঁছে গেলে হাইড্রোজেন পার-অক্সাইড ভেঙে অক্সিজেন ও পানি তৈরি করে। এই অক্সিজেন সেখানে প্রচণ্ড দহন বিক্রিয়া শুরু করে, যা বিস্ফোরণ ঘটাতে পারে। হাইড্রোজেন পার-অক্সাইড তরল পদার্থ, তাই পানিতে তরল আরও ছড়িয়ে পড়ে আগুন বাড়িয়ে দেয়। এ জাতীয় আগুনে জ্বালানি ও পানি দিয়ে তাপ কমানোর উপায় নেই। উপায় হলো অক্সিজেন সরবরাহ কমানো। এর জন্য CO2, CO, শুকনো গুঁড়ো (বালি, মাটি), ফোম উপযুক্ত। ফায়ার সার্ভিস কর্মীরা শুরুতে ফোম দিলেও পর্যাপ্ত ফোমের অভাবে পরে পানি দেওয়া শুরু করে। তাতেই ঘটে বিপত্তি।

ফায়ার সার্ভিস থেকে একটি কথাই বারবার বলছে যে বিএম কনটেইনার ডিপো কর্তৃপক্ষ সেখানে দাহ্য পদার্থ থাকার তথ্য না দেওয়ায় আগুন ও বিস্ফোরণে এত মানুষের মৃত্যু ঘটেছে। তথ্য জানা না থাকায় আমাদের ফায়ার সার্ভিসের কর্মীরা মারা যান। সাধারণত কনটেইনার ডিপো করতে হলে ফায়ার লাইসেন্স দরকার হয়। আর কোনও দাহ্য পদার্থ বা কেমিক্যাল থাকলেও তা জানিয়ে রাখতে হবে ফায়ার সার্ভিসকে। কিন্তু এই ক্ষেত্রে তা কিছুই করা হয়নি। ফায়ার সার্ভিস বিভিন্ন ধরনের কেমিক্যালের অনেক ড্রামের উপস্থিতি পেয়েছে এবং এগুলোর ফায়ার লাইসেন্স আছে কিনা তা ফায়ার সার্ভিস তদন্ত করে দেখছে। কিন্তু এই তদারকির কাজ আগেই করা দরকার। রাজনৈতিক বিবেচনায় ডিপো করার অনুমতি পেলেও সব কমপ্লায়েন্স মানা হয়েছে কিনা কর্তৃপক্ষের তা নজরে রাখা দরকার ছিল।

তদন্ত কমিটিতেই থেমে যায় সবকিছু

দেশে এক অগ্নিকাণ্ডের ঘটনায় চার থেকে আটটি সরকারি-বেসরকারি তদন্ত কমিটি গঠনের নজির আছে। সীতাকুণ্ডের অগ্নিকাণ্ডের ঘটনায়ও ইতোমধ্যে চার-পাঁচটি তদন্ত কমিটি গঠন করা হয়েছে। পাঠকের মনে আছে, পুরান ঢাকার নিমতলী (জুন, ২০১০) থেকে আগুনের গাড়ি চকবাজার (ফেব্রুয়ারি, ২০১৯) আসতে সময় লেগেছিল প্রায় ৯ বছর। নিমতলীর আগুনের পর গঠিত তদন্ত কমিটির বিশেষজ্ঞরা যে ১৭টি সুপারিশ পেশ করেছিলেন, সেগুলোর প্রথমেই ছিল বিভিন্ন রাসায়নিক পদার্থের গুদাম ও কারখানাগুলো সরিয়ে নেওয়া। বাকি ১৬টি সুপারিশ বাস্তবায়নের দায়িত্ব ছিল শিল্প মন্ত্রণালয়, স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয়, স্থানীয় সরকার মন্ত্রণালয়সহ সরকারের বিভিন্ন মন্ত্রণালয় ও দফতরের ওপর। বলা বাহুল্য, ‘সাত মণ ঘিও জোটেনি, রাধাও নাচেনি’। বাকি আছে সুপারিশ বাস্তবায়নে ব্যর্থতার তদন্ত। সেটাও হয়তো হবে একদিন। কবে হবে, জবাবদিহির কবে সুবাতাস বইবে, তা জানা নেই।

বেসামরিক প্রতিরক্ষাকে শক্তিশালী করতে হবে

আমাদের দমকল বাহিনীর আনুষ্ঠানিক নাম হচ্ছে “বাংলাদেশ ফায়ার সার্ভিস অ্যান্ড সিভিল ডিফেন্স”। এখন শুধু ফায়ার সার্ভিসটাই দেখা যায়, সিভিল ডিফেন্স বা বেসরকারি প্রতিরক্ষা আর নজরে আসে না। জনগণকে সম্পৃক্ত করার প্রক্রিয়া হিসেবে সিভিল ডিফেন্সের উদ্ভাবন, কিন্তু সেটা এখনও অবহেলিত। খাতায় আছে গোয়ালে নেই। সারা দেশে লক্ষ লক্ষ স্বেচ্ছাসেবক তৈরির এক উচ্চাভিলাষী পরিকল্পনা আছে। এই কাজটির দায়িত্ব সিভিল ডিফেন্সের। কিন্তু বাস্তবে সেটা হচ্ছে না।  

মহল্লায় মহল্লায় কলে কারখানায় বেসামরিক প্রতিরক্ষা কমিটি বা ওয়ার্ডেন গড়ে তোলার যে কর্মসূচি ফায়ার ব্রিগেডের ছিল সেটা আবার চালু করা প্রয়োজন। প্রয়োজন স্বেচ্ছাসেবকদের নিয়মিত প্রশিক্ষণ এবং অগ্নিকাণ্ড প্রতিরোধ ও প্রতিকারে তাদের দায়িত্ব সম্পর্কে সচেতন রাখা। ঢাকার মিরপুরে এ ধরনের কাজ করে ফায়ার ব্রিগেড অগ্নি ব্যবস্থাপনায় জনভিত্তি তৈরি করে যথেষ্ট সুফল পেয়েছে।

ফায়ার সার্ভিসের এমন অনেক কর্মী রয়েছেন যারা একই সাথে দক্ষ এবং ঝুঁকি নিতে পিছপা হন না। বনেদি নানা প্রতিষ্ঠানের কর্মী ও কর্মকর্তারা ব্যর্থ হলে ঢাকার অদূরে সালেপুর ব্রিজ থেকে নদীতে পড়ে যাওয়া যাত্রীবাহী বাস খুঁজে বের করেছিলেন ফায়ার ব্রিগেডেরই এক ডুবুরি।

এখন জানা যাচ্ছে, এক্সপ্লোসিভের ধরনের ভিত্তিতে আগুন নিভানোর পর্যাপ্ত ও প্রয়োজনীয় প্রশিক্ষণের ব্যবস্থা ফায়ার সার্ভিস কর্মীদের জন্য নেই। শুধু এই কারণেই শতাধিক মানুষের মৃত্যু ঘটার সাথে সাথে দেশের সম্পদেরও ক্ষতি হচ্ছে–সেটা কি দেশের সর্বোচ্চ মহলের জানা নেই? শুধু তদন্ত কমিটি গঠন ও নামমাত্র ক্ষতিপূরণ প্রদানের মধ্যেই সীমাবদ্ধ থাকবে এবং এরকম দুর্ঘটনার কবলে মানুষ অকাতরে প্রাণ বিসর্জন দেবে।

পরিশেষে বলা জরুরি, এ রকম পরিস্থিতি মোকাবিলা করার যোগ্যতার কোনও বিকল্প নেই। আমরা এখন পারমাণবিক বিদ্যুৎকেন্দ্রের মতো স্পর্শকাতর প্রকল্প বাস্তবায়নে হাত দিয়েছি। তাই অগ্নি নিরাপত্তার ক্ষেত্রে ঢাকাকেন্দ্রিক সনাতন ব্যবস্থায় ইতি টানতে হবে।

আগুন নেভানোর চেয়ে অগ্নিকাণ্ড প্রতিরোধে আমাদের বেশি মনোযোগ দিতে হবে। স্থানীয় সরকারকে নিয়ে বেসামরিক প্রতিরক্ষা ব্যবস্থা গড়ে তুলতে হবে। এ কাজে বড় বড় যন্ত্রপাতি লাগবে না। লাগবে শুধু সদিচ্ছা। প্রয়াত কবি শঙ্খঘোষের ভাষায়, ‘আমাদের চোখ খুলে দেখতে হবে।’

সহ-লেখক: মেহেরুন নেছা

 

লেখক: বাংলাদেশ দুর্যোগ ফোরামের কর্মী

/এসএএস/এমওএফ/

*** প্রকাশিত মতামত লেখকের একান্তই নিজস্ব।

বাংলা ট্রিবিউনের সর্বশেষ
মন্ত্রী-এমপির স্বজনদের বিরত রাখা নীতিগত সিদ্ধান্ত, আইনি নয়: কাদের
মন্ত্রী-এমপির স্বজনদের বিরত রাখা নীতিগত সিদ্ধান্ত, আইনি নয়: কাদের
আইপিএলের সময়ে হবে পিএসএল!
আইপিএলের সময়ে হবে পিএসএল!
বাড়ি ফেরার পথে বজ্রাঘাতে বাবুর্চির মৃত্যু, সারা রাত রাস্তায় পড়ে ছিল লাশ
বাড়ি ফেরার পথে বজ্রাঘাতে বাবুর্চির মৃত্যু, সারা রাত রাস্তায় পড়ে ছিল লাশ
বাড়িতে বিস্ফোরণে আহত স্কুলছাত্রী মারা গেছে
বাড়িতে বিস্ফোরণে আহত স্কুলছাত্রী মারা গেছে
সর্বশেষসর্বাধিক

লাইভ