X
শনিবার, ২০ এপ্রিল ২০২৪
৭ বৈশাখ ১৪৩১

আগুনই স্বাভাবিক

সৈয়দ ইশতিয়াক রেজা
০৮ জুন ২০২২, ১৭:২৭আপডেট : ০৮ জুন ২০২২, ১৭:২৭
স্বাভাবিক পুনরাবৃত্তির ধর্ম হলো, তা চূড়ান্ত অস্বাভাবিক ঘটনাকেও ক্রমে স্বাভাবিক করে তোলে। বিধ্বংসী আগুনে বাংলাদেশের কোনও না কোনও অঞ্চলের মানুষ সর্বস্ব হারাবেন; নিজের বা প্রিয়জনের জীবন যাবে, আজীবনের স্বপ্ন পুড়ে গিয়ে কোনও নারী, বৃদ্ধ শূন্যদৃষ্টিতে চেয়ে থাকবেন; পুড়ে যাওয়া স্থাপনার অনতিদূরে কোনও শ্রমিকের পুড়ে যাওয়া হাত পড়ে রইবে, সংবাদপত্রে পাতায় তা ভালো ছবি হবে, কোনও শ্রমিকের মা বা স্ত্রী বা সন্তান কারখানার সম্মুখে কান্নায় ভেঙে পড়বেন— এই দৃশ্যগুলো এখন এমনই স্বাভাবিক যে সেগুলো সংবাদমাধ্যমের চিত্রগ্রাহকের ক্ষণিক মনোযোগের চাইতে বেশি কিছু আর দাবি করে না।  

বাংলাদেশে আগুন লাগা এক স্বাভাবিক ঘটনা। তবু কিছু কিছু আগুনের ঘটনা নতুন করে ভাবায় আমাদের। কোনও কোনও ঘটনা আমাদের সামনে বড় বাস্তবতা উপস্থিত করে। চট্টগ্রামের সীতাকুণ্ডের শীতলপুর এখনও শীতল হয়নি। আগুন নিয়ন্ত্রণে, কিন্তু জ্বলছে ঠিকই। সেখানকার বিএম কনটেইনার ডিপোতে অগ্নিকাণ্ড ও ভয়াবহ বিস্ফোরণের ঘটনায় গোটা জাতি আজ স্তব্ধ, শোকার্ত; যদিও কোনও জাতীয় শোকদিবসের ঘোষণা আসেনি। এখন পর্যন্ত ফায়ার সার্ভিসের নয় জন কর্মীসহ চল্লিশের বেশি মানুষ নিহত হয়েছেন। কোনও ঘটনায় এত অগ্নিনির্বাপণ কর্মীর মৃত্যু এটিই প্রথম। আহত দুই শতাধিক, যাদের অনেকে চিরতরে পঙ্গু হয়ে যাবেন বলে আশঙ্কা করা হচ্ছে।

আমাদের দেশে আগে গ্রামাঞ্চলে আগুন লাগতো বেশি। কোনও এলাকায় আগুন লাগলে মহল্লার পর মহল্লা পুড়ে ছারখার হয়ে যেত। মফস্বলের সেই আগুন এখন শহর-বন্দর, শিল্প-বাণিজ্যিক এলাকার ওপর ভর করেছে। সর্বশেষ লাগলো বন্দর সংশ্লিষ্ট এলাকার কনটেইনার ডিপোতে। বিএম কনটেইনারে লাগা আগুন নেভানোর সময় যে বিস্ফোরণ ঘটে, তার প্রথম শিকার হন অগ্নিনির্বাপণ কর্মীরা। অনিয়ম, দায়িত্বহীনতা ও গাফিলতির কারণেই যে অগ্নিকাণ্ড থেকে এত বড় বিস্ফোরণ ও প্রাণহানির ঘটনা ঘটেছে, সেটা প্রাথমিকভাবে স্পষ্ট। কিন্তু পঞ্চম দিন গড়ালেও মামলা হয়নি, ডিপোর মালিক গ্রেফতার হয়নি।

ফায়ার সার্ভিসের কর্মীরা বীরের মতো জীবন দিয়েছেন। কিন্তু তারা জানতেন না যে এখানে এত ভয়ংকর সব রাসায়নিক দ্রব্য আছে। সবচেয়ে দুঃখজনক হলো, কনটেইনার ডিপো কর্তৃপক্ষের তরফেও বিষয়টি তাদের জানানো হয়নি। ডিপোর ভেতরে কনটেইনার রাখার ক্ষেত্রে বড় ধরনের অব্যবস্থাপনা ও দায়িত্বহীনতা যে ছিল সেটা আজ স্পষ্ট। আন্তর্জাতিক গাইডলাইন অনুযায়ী, সাধারণ পণ্যবোঝাই কনটেইনার ও রাসায়নিকের মতো ঝুঁকিপূর্ণ পণ্যবোঝাই কনটেইনার একসঙ্গে থাকার কথা নয়। এখানে সেই নিয়ম কার্যকর ছিল না বলেই অগ্নিকাণ্ডের সূচনার পর বিভ্রান্তি তৈরি হয় এবং তার মর্মান্তিক শিকার হন ফায়ার সার্ভিসের কর্মীরা। এ ছাড়া ডিপোটিতে অগ্নিনিরাপত্তা ব্যবস্থা ও শ্রমিক নিরাপত্তার প্রটোকলের ব্যাপক ঘাটতির বিষয়টিও পরিষ্কার।

দায় নেবে কে? নিশ্চয়ই এই ডিপোর মালিককেই নিতে হবে। কিন্তু আজ পর্যন্ত কোনও ঘটনায় সংশ্লিষ্টদের বড় কোনও শাস্তি হয়নি। গত বছর ৫৪ জন শ্রমিক মারা গিয়েছিল নারায়ণগঞ্জের হাসেম ফুডস কারখানায়। জনাব হাসেমের কিছুই হয়নি। তিনি দিব্যি ব্যবসা করে যাচ্ছেন। তার কারখানায় ১১ বছরের মিশু পর্যন্ত শ্রমিক হিসেবে কর্মরত ছিল। আশুলিয়ায় তাজরীন ফ্যাশনসের ভয়াবহ অগ্নিকাণ্ডের ঘটনায় ২০১২ সালে পুড়ে মারা যান ১১১ জন পোশাকশ্রমিক। সেই ঘটনার মূল আসামি তাজরীনের ব্যবস্থাপনা পরিচালক (এমডি) মোহাম্মদ দেলোয়ার হোসেন। মামলার সুরাহা হয়নি ১০ বছরেও। অথচ এই দেলোয়ার হোসেন এখন ঢাকা মহানগর উত্তর মৎস্যজীবী লীগের সভাপতি। তাই আমরা মনে করি, এই বিএম কনটেইনারের মালিকেরও কিছু হবে না।

এগুলো শুধুই দুর্ঘটনা নয়। রাষ্ট্রীয় অব্যবস্থাপনা, নিয়ম নীতি প্রয়োগের অভাব ও অবহেলাজনিত হত্যাকাণ্ড। যারা মারা যায়, যারা ক্ষতির শিকার হয় তারা প্রায় সবাই অতি দরিদ্র সাধারণ মানুষ বলে রাষ্ট্রও উদ্যোগী হয় না অনাচারের সমাপ্তি টানতে। একটা ঘটনা ঘটে, রাষ্ট্রের কর্তাব্যক্তিরা কিছু কথাবার্তা বলেন, নির্লজ্জের মতো কত কত প্রতিশ্রুতি দেন। বলা হয় এটা করা হবে, ওটা করা হবে। তারপর পরবর্তী বিপর্যয়ের জন্য কর্তাব্যক্তিরা অপেক্ষা করতে থাকেন।

বিএম কনটেইনারের আগুন থামবে, কিন্তু আগুনের এই শিখা নির্বাপিত হলেও দগ্ধাবশেষের পাশেই পড়ে থাকবে একটি সত্য— এই আগুনই শেষ নয়। এ দেশে ভবিষ্যতে আরও অনেক আগুন, আরও অনেক ক্ষয়ক্ষতি লুকিয়ে আছে। এরপর হয়তো পোর্ট নয়, ডিপো নয়, অন্য কোথাও, অন্য কোনোখানে। আমাদের অনেক কিছু মিথ্যা, কিন্তু আগুন সত্য। কেন? সেই কারণ সন্ধান করলে প্রথমেই চোখে পড়বে অগ্নিবিধিকে সম্পূর্ণ অবজ্ঞা করবার প্রবণতাটি। আমাদের উন্নয়ন পরিকল্পনায় সড়ক-মহাসড়ক আছে, বড় স্থাপনা আছে, ব্রিজ আছে, কারখানা আছে, কিন্তু জননিরাপত্তার কোনও ভাবনা নেই, নেই শ্রমিকের কর্মপরিবেশ নিয়ে কোনও চিন্তা। তাই বলতেই হয়, বাংলাদেশ আসলে আক্ষরিক অর্থেই আগুন নিয়ে খেলে।

আগুন আসলে প্রশাসনিক ব্যর্থতা ও রাজনৈতিক গ্রাহক ব্যবসার ভয়াল প্রকাশ। কোনও বাড়িতে বা বাণিজ্যিক কেন্দ্রে অগ্নিবিধি মানা হচ্ছে কিনা, তা দেখা প্রশাসনের দায়িত্ব। প্রশাসন কার্যত চোখ বুজে থাকে। খোঁজ করলে উত্তর মিলবে, কড়া ব্যবস্থা করার কোনও চেষ্টাই কোথাও নেই। আর করতে গেলেও রাজনৈতিক বিবেচনা চলে আসবে, রব উঠবে কে কোন দল করে। অভিযুক্তদের গ্রেফতার করে কঠোর শাস্তির ব্যবস্থা করা বিধেয়। কিন্তু সেটা হতে দেখিনি কোনোদিন। একদিকে সচেতনতা বৃদ্ধি এবং অন্যদিকে শাস্তির ভয়, এই জোড়া অস্ত্র ব্যবহার না করলে চলবে না। অন্যথায়, এই অস্বাভাবিকের স্বাভাবিকতা অব্যাহত থাকবে।

লেখক: সাংবাদিক
/এসএএস/এমওএফ/

*** প্রকাশিত মতামত লেখকের একান্তই নিজস্ব।

বাংলা ট্রিবিউনের সর্বশেষ
হিট অ্যালার্ট উপেক্ষা করে কাজে নামতে হয় যাদের
হিট অ্যালার্ট উপেক্ষা করে কাজে নামতে হয় যাদের
জাতীয় বিশ্ববিদ্যালয়ের অধীন কলেজের পাঠদানও বন্ধ
জাতীয় বিশ্ববিদ্যালয়ের অধীন কলেজের পাঠদানও বন্ধ
রুশ বিদ্যুৎকেন্দ্রে ইউক্রেনের হামলা, ৫০টি ড্রোন ভূপাতিতের দাবি মস্কোর
রুশ বিদ্যুৎকেন্দ্রে ইউক্রেনের হামলা, ৫০টি ড্রোন ভূপাতিতের দাবি মস্কোর
বিয়েবাড়ির খাসির মাংস খেয়ে ১৬ জন হাসপাতালে
বিয়েবাড়ির খাসির মাংস খেয়ে ১৬ জন হাসপাতালে
সর্বশেষসর্বাধিক

লাইভ